টি এম আহমেদ কায়সার


ইয়োসার (Llosa) পাঠকেরা দীর্ঘদিন ধরেই বোধ করি এই শুভ-ক্ষণের অপেক্ষায় ছিলেন। কেউ কেউ নোবেল কমিটির অনীহা ও উপেক্ষায় বেজায় বিরক্তও ছিলেন, বিশেষত যখন গত ছয় বছর ধরে নোবেল পুরষ্কার ইউরোপীয় দেশগুলোর ভেতরই ঘুরপাক খেতে দেখা যাচ্ছিল। গত বছর জার্মানীর হার্টা ম্যুলারের নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির ঘটনায় বিশ্বের তাবৎ সাহিত্য- তাত্ত্বিকেরা আবারো নোবেল কর্তৃপক্ষের মানদণ্ড, স্বচ্ছতা ও বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ফলে মিলান কুণ্ডেরার মতো লেখক দীর্ঘদিন থেকেই কেবল জল্পনা-কল্পনায় সীমিত থাকার পর প্রথমত তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের লেখক এবং অন্যবিধ রাজনৈতিক অনুষঙ্গ বিবেচনায় এবারো যে তিনি বঞ্চিত হবেন তা মোটামোটি ধারণার বাইরে ছিল না।
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শোষণমুখি পররাষ্ট্রনীতির কট্টর সমালোচক, লাতিন আমেরিকান ‘বুম’ (Boom) আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কার্লোস ফুয়েন্তসকে যে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হবে না, এই উন্মুক্ত-গুপ্ত তথ্য আমরা ইতিপূর্বেই আন্দাজ করতে পেরেছি। নানাবিধ অদৃশ্য বিবেচনার প্রভাবে আমরা দেখেছি, বিংশ শতকের দুই অপ্রতিদ্বন্দ্বি গদ্যকার, লাতিন আমেরিকান ‘বুম’ আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তিকার হুলিও কোর্তাসার ও হোর্হে লুইস বোর্হেস নোবেল পুরষ্কার ছাড়াই মুত্যুবরণ করেছেন। এমন এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ইয়োসার নোবেল প্রাপ্তি প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠেছিলো, বিশেষত এই বিবেচনায়ও যে লাতিন আমেরিকা ছাড়াও ইয়োসা ইংরেজী ভাষার পাঠকের কাছেও দীর্ঘদিন ধরে বিপুলভাবে সমাদৃত। বাংলা ভাষায় ইয়োসা কম হলেও আশির দশক থেকে (অন্তত মার্কেজের নোবেল প্রাপ্তির বছর থেকে) বহুলভাবে উদ্ধৃত, আলোচিত এবং সমাজতন্ত্রী শিবিরে ব্যাপকভাবে সমালোচিতও।
ইয়োসার উপন্যাসের চেয়েও তাঁর সমকালীন রাজনীতি ও সাহিত্যভাবনা, ক্রমাগত রূপান্তর এবং আত্মজৈবনিক অনুষঙ্গাদি বিশদভাবে পঠিত বা প্রচারিত, এমনকি কোথাও কোথাও মুখরোচক গল্পের উপাদানে পরিণত হয়েছে। তাঁর কোনো লেখা পাঠের অভিজ্ঞতা হবার পূর্বেও আমরা জানতাম, ইয়োসা হলেন সেই লেখক যিনি মার্কেজের নোবেল প্রাপ্তিরও অনেক পূর্বে, ১৯৭১ সালে লিখে ফেলেছিলেন 'Garcia Marquez: story of a decide’ আবার এই ইয়োসাই ১৯৭৬ সালে মেক্সিকো সিটির এক থিয়েটারে প্রকাশ্যে ঘুষি মেরে মার্কেজের মুখমণ্ডল জখম করে দিয়েছিলেন।(পশ্চিমা সংবাদপত্রে আমরা মার্কেজের সেই কালশিঁটে পড়া মুখের ছবি দেখেছি) ইয়োসা হলেন সেই লেখক যিনি একদা ক্যাস্ট্রো ও কিউবান বিপ্লবের কট্টর সমর্থক ছিলেন এবং পরবর্তীতে ইয়োসা-ই আবার তাঁর ঘোর সমালোচকে পরিণত হন, বিশেষত ক্যাস্ট্রো যখন বিখ্যাত কিউবান কবি হারবার্তো পাদিল্লাকে (Herberto padilla ) কারারুদ্ধ করে রাখেন। মেক্সিকো সম্পর্কে রাজনৈতিক কৌতুক করতে গিয়ে তিনি আরেক মহান লাতিন আমেরিকান লেখক অক্তোভিও পাজকে খেপিয়ে তোলেন। তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা প্রবাহে আমরা এক অনিশ্চয়তার পথে অবিরাম রূপান্তর লক্ষ করেছি। ফলে সমাজবাদী দর্শন ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়ে তাকে হঠাৎ নিও-লিবারেল মুক্তবাজারের সমর্থক, অথবা ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাবেজের তীব্র সমালোচক হিসাবে এবং পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে এসে ডানপন্থী কোয়ালিশনের (FREDEMO) হয়ে পেরুর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ায় একটুও অবাক হইনি। তাঁর গল্প উপন্যাসে এই ট্রানজিশন ও ট্রান্সফরমেশন মোটেও দুর্লক্ষ্য নয়। লাতিন আমেরিকার আরেক বিখ্যাত উত্তর-বুম (Post –boom) লেখক ও দার্শনিক ওস্কার গুয়ার্দিলো বিভেরা (Oscar Guardiola- Rivera) ইয়োসার এই রূপান্তরকে ‘রূঢ় আধুনিকবাদ থেকে আত্মশ্লেষপূর্ণ উত্তআধুনিকবাদের দিকে যাত্রা’(Moved from strict modernism to playful self parodic style of turn- of- the cencury most-modernism) হিসাবে দেখতে অভিনিবিষ্ট হয়েছেন। আমরা দেখেছি তার টেক্সট অপেক্ষাকৃত সরল বুননশৈলী থেকে ধীরে ধীরে জটিল সব ধারাপাতের অনুগামী হয়ে উঠেছে। Time of Hero'র অপেক্ষাকৃত সরল আখ্যান থেকে The feast of the Goat এর বহুধাব্যাপ্ত সংগঠন প্রণালীর ভেতর তিনি ক্রমশ ঢুকে পড়েছেন। লিমা’র লিওনসিও প্রাদো মিলিটারি একাডেমী-তে (Leoneio Prado Military Academy) তার নিজের অভিজ্ঞতাকে ঘিরেই Time of Hero উপন্যাসের ভিত্তি ও বিস্তার। এই উপন্যাসে আনুপঙ্খ বর্ণনা-শৈলীর জন্য অচিরেই Premio de la critica Espanola পুরষ্কারে ভূষিত হন যদিও পেরুর মিলিটারি শিবিরে এটি তুমুল বিতর্কের সূচনা করে, পরিণতিতে উপন্যাসের হাজার খানেক কপি পুড়ানোও হয় এবং পেরুর কতিপয় সামরিক প্রধানরা ইয়োসাকে ‘ইকুয়েডরের ভাড়াটে’ বলেও আক্রমণ করতে ছাড়েননি। লক্ষনীয়ভাবে আমরা Time of Hero’র ইয়োসাকেই The feast of the Goat এ গিয়ে আবিষ্কার করি এক পোস্ট-মডার্ন গদ্যকার হিসাবে, যিনি মিলিটারি একাডেমির অভিজ্ঞতার সূক্ষ ডিটেলস ও ইহ- বাস্তবতাবাদ থেকে মোড় নিতে শুরু করেন এক কৌশলী, কুহুক বাস্তবতাবাদী লেখকে। যিনি ইতিহাসকে বর্তমানের ছকে ফেলে এর বিশদ ব্যাখা ও বিভিন্নমুখী প্রতিবেদন রচনায় ব্যাপৃত হতে চান। ইতিহাস ও বর্তমান যেন এক সমান্তরাল ডায়লগে জড়িয়ে পড়ে। The feast of the Goat এ অন্যান্য বুম লেখকদের মতোই এক উত্তাল লাতিন আমেরিকান রাজনৈতিক পটকে উপজীব্য করেন, যেখানে একনায়কতন্ত্র, রক্তপাত, ষড়যন্ত্র, ক্যু, ক্ষমতা ও নৃশংসতা, পিশাচ-যৌনতা ইত্যাকার পরিচিত অনুষঙ্গগুলোই পুনরাবৃত্ত হতে দেখি। কিন্তু ইয়োসা লক্ষ্যনীয়ভাবে যা করেন, উপন্যাসের বয়নে তিনি উত্তরাধুনিক নির্মাণ প্রণালীর অনুগামী হয়ে ওঠেন। যেখানে একই ঐতিহাসিক ফ্যাক্ট বিবৃত হয় তিনটি ভিন্নমুখী চরিত্রের অভিজ্ঞতায়; কাহিনী বিস্তৃত হয় আইজেনস্টনীয় মন্তাজ রীতিতে। কুরাশাওয়ার ‘রশোমন’ অথবা হালের গনৎজালেজ পরিচালিত ‘Amores pores’ ছবিতে একই শৈলীর প্রয়োগ আমরা লক্ষ করেছি। এমনকি ইয়োসার ভ্রাতা (Cousin) লুইস ইয়োসা পরিচালিত The feast of the Goat এর সিনেমা এডাপটেশনেও এই দুর্দান্ত মন্তাজ কৌশলের স্বাদ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ডোমনিকান একনায়কতন্ত্রী রাফায়েল লিওনিডাস ট্যুজিলোকে হত্যা এবং এর পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ নিয়েই উপন্যাসটি আবর্তিত। তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই হত্যা এবং হত্যা পরবর্তী আখ্যানগুলো বিবৃত হতে দেখি। প্রথমে হলেন ইউরোনিয়া শ্যাব্রল নামের এক মহিলা যিনি অনেকদিন পর ডোমনিকান রিপাবলিকে ফিরে আসেন তার অসুস্থ পিতাকে দেখার জন্য। দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ হলো, রাফায়েল নিজেই, যে তার জীবনের শেষ দিনটির নির্মোহ বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখানে জানতে পারি একনায়কতন্ত্রী জান্তার অর্ন্তবৃত্ত, যে চক্রের সাথে একদা জড়িত ছিলেন ইউরোনিয়ার পিতা নিজেও। তৃতীয় বিন্দুটি হলো রাফায়েলের হত্যাকারীরা যারা বিভিন্নভাবে তাঁর নৃশংসতার শিকার হয়েছেন। তিনটি ভিন্নমুখী দৃষ্টিবিন্দু দিয়ে ইয়োসা ফলতঃ ইতিহাস ও বর্তমানের এক অভিনব মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়েছেন ফিকশনের অনেকার্থময় রূপকল্পে। কাহিনীর নেপথ্যে ইয়োসা যুক্ত করেছেন ক্ষমতা ও যৌনতার পারষ্পরিক সম্পর্ক, বিকৃতি ও মাকিজমো (Machismo) এবং ব্যর্থ যৌনতার গূঢ় মনস্তাত্বিক প্রতিবেদন, যা বোধ করি ইয়োসা ছাড়া তাঁর সমকালীন আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আমাদের মনে আছে ফ্লবেয়ার (Flaubert) সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ইয়াসো তাঁর The Perpetual orgyতে বলেছিলেন ‘সাহিত্য হলো বিদ্রোহের স্বাক্ষর’ (Literature is the act of Rebellion) ইয়োসা নিজেও সম্ভবত একরৈখিক ঘটনা বর্ণনার ক্লান্তি থেকে বেরিয়ে এসে The feast of the Goat এ এক জটিল, বিদ্রোহী বহুরৈখিক বুনন শৈলীর পত্তন করেন। ফলে আমরা ইতিহাসকে আর ফ্যাক্ট নয়, বরং ভিন্নমুখী মানব মনস্তত্ত্বের আলোকে ব্যাখার পরিসর পেয়ে যাই।


মারিও ভার্গাস ইয়োসার জন্ম পেরুতে, ১৯৩৬ সালের ২মার্চে। Time of Hero এবং The feast of the Goat ছাড়াও তিনি The Green House, Conversation in Cathedral, Captain Pantoza, Aunt Julia and the scriptwriter, The War of end of the world, The real life of Alejan dre Mayta, Special service, Bad girl প্রভৃতি অসামান্য গ্রন্থের রচয়িতা। উপন্যাস ছাড়াও তিনি সিনেমার script, সাহিত্যে আলোচনা, রাজনৈতিক ভাষ্য ও সাংবাদিক প্রতিবেদন রচনায় ব্যাপৃত আছেন। নোবেল পুরষ্কার পাবার আগে Green House উপন্যাসের জন্য তিনি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ও জুয়ান কার্লোস ওনেত্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৯৬৭ সালে Romulo Gallegos International Novel পুরষ্কার জয় করেন। স্পেনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি কার্ভেন্তেস পুরষ্কারেও তিনি ভূষিত হন ১৯৯৪ সালে। মহান উপন্যাসিক ফকনারের দ্বারা প্রভাবিত ইয়োসা ফলত লাতিন আমেরিকার ‘বুম-উত্তর’ লেখকদের কাছে বিপুলভাবে প্রেরণার উৎস। হালের প্রখ্যাত গদ্যকার জুনত ডিয়াজ, জোয়ান গাব্রিয়াল ভাস্কেজ, সান্তিয়াগু রংকাগিলিও-র রচনায় ইয়োসার মহান ঐতিহ্যে ও বুনন-শৈলী সগৌরবে প্রবাহিত হতে দেখি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতারত এই পোস্ট-মডার্ন ‘বুম’ লেখকের নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির পর মার্কেজ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন : ‘Now we’re even...’ আর ইয়োসা নিজে বলেছেন 'This Novel goes to Latin America. It’s a recognaition that sorrounds me' অন্যদিকে নোবেল কর্তৃপক্ষ তাঁর লেখাকে অভিহিত করেছে Cartography of structures of power (ক্ষমতা কাঠামোর আনুপঙ্খ মানচিত্র) বলে। তাদের ভাষায় ইয়োসার রচনা হলো ‘ব্যক্তির প্রতিরোধ, বিদ্রোহ এবং পরাজয়ের মর্মভেদী রূপকল্প (Trenchant image of individual’s resistance, revolt and defeat)।