অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল ‘অকুলার’-এর সম্মেলক প্রদর্শনী।মৃণাল ঘোষ
দলটির নাম ‘অকুলার’। বাংলায় যার অর্থ দৃশ্য, চাক্ষুষ বা প্রত্যক্ষ। দৃশ্যকলার মূলগত প্রত্যয়টি ধরা আছে এই নামের মধ্যে। পাঁচ জন তরুণ শিল্পী একত্রিত হয়ে গড়ে তুলেছেন এই ‘দল’। ২০০৯ সাল থেকে সম্মিলিত ভাবে তাঁরা প্রদর্শনী করে আসছেন। তাঁদের প্রকাশের দর্শনগত ভিত্তি তাঁরা অধিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন পোস্ট-মডার্ন বা উত্তর-আধুনিক ‘কনসেপ্ট’ বা ভাবনার উপর।
উত্তর-আধুনিক দর্শন ভিত্তিক ‘কনসেপচুয়াল আর্ট’-এর অভিযাত্রা পাশ্চাত্যে শুরু হয়েছিল ১৯৬০-এর দশক থেকে। আমাদের দেশে এই ভাবনার ও শিল্প-প্রক্রিয়ার বিস্তারের সূচনা হয়েছে ১৯৯০-এর দশক থেকে উত্তর আধুনিকতা ও বিশ্বায়নের দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অভিঘাতে। এই পাঁচ জন শিল্পী তাঁদের কাজে এই প্রত্যয়বাদী ধারাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। রূপনির্মাণের এক বিকল্প-পদ্ধতি অনুধাবনের প্রয়াসী হয়েছেন, যাতে প্রচলিত শিল্পরূপের যে ‘aura’ বা মহনীয়তা, তাকে ভেঙে ফেলে শিল্পকে জীবনের সঙ্গে আরও বেশি করে অন্বিত করা যায়।
এটা করতে গিয়ে তাঁদের কেউ কেউ অতিরিক্ত নৈর্বক্তিকতার দিকে চলে গেছেন, যে নৈর্ব্যক্তিকতা রূপকে এমন নৈরাজ্যময় রূপহীনতার দিকে নিয়ে যায় যে, তা সাধারণ দর্শকের অনুধাবনের সীমাকে বিপর্যস্ত করে। এটা তথাকথিত উত্তর-আধুনিকতারই একটা সমস্যা। এই সমস্যার মধ্য থেকেই তাঁরা তাঁদের প্রকাশের এক নতুন দিগ্দর্শন তৈরির চেষ্টা করেছেন। এই দলের পাঁচ জন শিল্পীর চার জনেরই সে রকম কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, বিজ্ঞান, সাহিত্য বা সমাজতত্ত্ব চর্চার অভিজ্ঞতাকে তাঁরা শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন।
শিল্পী: সাধনা নস্করঅ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল এই দলের একটি সম্মেলক প্রদর্শনী, যার শিরোনাম ‘বেরিয়াল অব দ্য সান’ বা ‘সূর্যের সমাধি’। নানা অর্থেই এই শিরোনামকে অনুধাবনের চেষ্টা করা যেয়। এর একটা সমাজবাস্তবতামূলক দিক যেমন আছে, তেমনই আছে ‘সত্য’ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধও।
সাধনা নস্কর একমাত্র শিল্পী এই দলে, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রশিক্ষিত। রবীন্দ্রভারতী থেকে ২০০৯-এ তিনি চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর করেছেন। বিশ্বাস, সংস্কৃতি, প্রগতির যে ধোঁয়াশায় আধুনিকতার বিশ্ব সমাকীর্ণ, তাকেই তিনি প্রশ্ন করতে চেয়েছেন আগুন ও ধোঁয়ার সক্রিয়তায় এক দগ্ধতার শিল্পরূপ তৈরি করে। ‘দ্য আর্থস স্কিন’ শীর্ষক রচনায় তিনি ক্যানভাসের উপর সিগারেটের পাত, প্যারাফিন, আঠা, কালি ও রং দিয়ে যে বিমূর্ত শিল্পরূপ গড়েছেন, তাতে তাঁর এই ভাবনাই প্রতিফলিত হয়েছে।সায়ক মিত্র শিক্ষাগত দিক থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ডিজিটাল প্রিন্টের বড় মাপের একটাই ছবি ছিল তাঁর। বিভিন্ন বর্ণের নাটকীয় সংঘাতে গড়ে ওঠা সেই সুবিপুল প্রতিমাকল্পে শিল্পীর আত্মচেতনা-নিরপেক্ষ ভাবে ‘রূপ’ তার অশান্ত, আলোড়িত অস্তিত্বকে প্রসারিত করেছে।
পৃথ্বীশ সেন ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শিক্ষার পর চলচ্চিত্র নির্দেশনায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি ভাবতে চেয়েছেন কেমন করে শিল্প প্রাতিষ্ঠানিকতার ক্ষমতায়নকে প্রতিহত করে নিজের অস্তিত্বকে প্রসারিত করতে চায়। তিনি চান শিল্প যাতে প্রকাশের জটিলতায় প্রহেলিকাময় না হয়ে ওঠে। যাতে তা মানবিক সহজতায় স্থিত থাকতে পারে। কিন্তু অতি-বিমূর্ত যে রচনারাজি তিনি উপহার দিয়েছেন, তাতে প্রকাশের বিভিন্ন ধাপ তিনি এতটাই অনুচ্চারিত রেখেছেন যে, তা এক দিকে যেমন প্রচলিত বা পরিচিত কোনও দৃশ্যনন্দনকে প্রতিভাত করে না, অন্য দিকে সেই প্রহেলিকাতেই আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এটা তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যা যেমন, তেমনই উত্তর-আধুনিকতারও অন্যতম একটি সমস্যা।
সব্যসাচী মল্লিক শিক্ষাগত দিক থেকে মলিকিউলার বায়োলজির এম এসসি। তাঁর শিল্পপ্রকল্পে তিনি ভাবতে চেয়েছেন পদার্থবিদ্যার ‘এনট্রপি’ বা সামগ্রিক বিশ্বপ্রবাহের ক্ষয় নিয়ে। রূপ-নির্মাণের যে প্রচলিত ভাষা তার আধিপত্যের বাইরে গিয়ে তিনি চেষ্টা করেছেন বস্তুর ক্ষয়ের প্রক্রিয়া থেকে শিল্প-প্রকাশের স্বতন্ত্র ভাষা নিষ্কাশিত করতে। কয়লা ও রেজিন দিয়ে তৈরি ‘ব্লাইন্ডনেস আনআর্থড’ শীর্ষক ভাস্কর্যধর্মী ইনস্টলেশনটিতে এই বৈশিষ্ট্যেরই প্রকাশ প্রতিভাত হয়।
সৌভিক ঘোষ মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন সম্পর্কে আকর্ষণ বোধ করেন। তিনি সেই গাঠনিকতাকে ভেঙে রূপের সারল্যে পৌঁছতে চান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন