১৯২৮ সালে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে, ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় জমিতে লাঙল টানার সময় একজন কৃষক অদ্ভুত এক আবিষ্কার করে বসেন। তিনি খুঁজে পান অতি প্রাচীন এক কবর। চাঞ্চল্যকর এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারটি পরবর্তীতে দরজা খুলে দেয় ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রাচীন নগরী ‘উগারিত’-এর। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫০ থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত এই নগরের সভ্যতা তার উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছিলো। নগরের ধ্বংসাবশেষ খননের পর সেখান থেকে প্রচুর কাদামাটির ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ধর্মীয় বর্ণনা সম্বলিত ট্যাবলেটে ‘বা’ল-হাদাদ’ নামক দেবতার সাথে দেবতা ‘ইয়াম’ এবং ‘মট’-এর যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া গেছে।
সেমেটিক মিথোলোজির একজন বিখ্যাত দেবতার নাম ছিল ‘হাদাদ’ (Hebrew: בעלהדד)। তিনি ‘হাদ’, ‘হাদ্দু’ বা ‘হাদ্দা’ নামেও পরিচিত। হাদাদ ছিলেন বজ্র এবং উর্বরতার দেবতা। তিনি ছিলেন দেবতাদের রাজা, যাকে সেমেটিক বা আক্কাদিয়ান ভাষায় বলা হত বা’ল (Ba’al, অর্থাৎ রাজা)। তাঁকে আক্কাদিয়ান আবহাওয়ার দেবতা ‘আদাদ’ এর সমতুল্য ধরা হয়। তবে বা’ল শব্দটি দ্বারা আরও অনেক অঞ্চলের প্রধান দেবতাকেও বুঝানো হতো।
উত্তর সিরিয়া, ফিনিশীয় উপকূল এবং ইউফ্রেটিস নদীর দীর্ঘ তীরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হাদাদের উপাসনা করা হত। বিভিন্ন বর্ণনায় জানা যায়, বা’ল হাদাদ ছিলেন দাড়িমোছযুক্ত, তাঁর এক হাতে ছিল শক্তিশালী মুগুর এবং অন্য হাতে বজ্র উদ্গিরণকারী অস্ত্র। তাঁর প্রতীক ছিল ষাঁড়। বজ্র, বৃষ্টি এবং উর্বরতার দেবতা হিসেবে তাঁকে গ্রিক দেবতা জিউস, রোমান দেবতা জুপিটার, ঋগ্বেদ দেবতা ইন্দ্র, ব্যাবিলনের মারদুক, এবং আনাতোলীয় দেবতা ‘তেশুব’-এর সমমানের বলে মনে করা হয়।
দেবতা ‘দাগন’ (Dagon) অথবা ‘এল’ (El)-কে হাদাদের পিতা বলে ধারণা করা হয়। তবে যেহেতু সর্বোচ্চ কেনানাইট দেবতা ছিলেন এল, সেহেতু তাঁকে হাদাদের পিতামহ বলে ধরে নেওয়াই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত।
হাদাদের তিনজন কন্যার পরিচয় জানা যায়, যাদের নাম‘পিদরে’ (‘Pidray’ অর্থ উজ্জ্বল), ‘তালে’(Tallay, অর্থ বর্ষণমুখর) এবং ‘আশরে’ (Asreyঅর্থ কর্দম)। তাদের মায়ের নামের কোন উল্লেখ না পাওয়া গেলেও বহুল প্রচলিত বর্ণনা এই যে, হাদাদের স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা ছিলেন তাঁর নিজেরই বোন ‘আনাত’।
হাদ ও ইয়ামের যুদ্ধ
কেনানের সর্বোচ্চ দেবতা ‘এল’, দেবতা ‘ইয়াম’কে অন্য দেবতাদের উপর কর্তৃত্ব দান করেছিলেন। ইয়াম ছিলেন নদী ও সাগরের দেবতা। তাঁকে গ্রিক মিথের পসেইডনের সমতুল্য বলা যায়।
কর্তৃত্ব লাভ করে ইয়াম আরও লোভী এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠলেন। তিনি একাই সকল দেবতার শাসনভার পেতে চাইলেন। এলের স্ত্রী এবং সকল দেবতার মা দেবী ‘আশেরাহ’ ইয়ামকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলেন। অহংকারী ইয়াম তাঁকে মানলেন না। ইয়াম নিজের দাবী দেবতাদের সভায় উত্থাপন করলেন। এতে হাদাদ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং ইয়ামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। বিদ্রোহের কথা শুনে ইয়াম হাদাদকে গ্রেফতার করার আদেশ দেন। হাদাদকে ইয়ামের সামনে আনা হয়। দুজনে পরস্পর লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন।
ইয়ামের তুলনায় হাদাদ ছিলেন কিছুটা দুর্বল। তাঁকে দুটি অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেন স্বর্গীয় অস্ত্র নির্মাতা ‘কোথার-ওয়া-খাসিস’ (kothar-wa-khasis)। ইয়াম যুদ্ধে পরাস্ত হন। জয়লাভ করে হাদাদ ইয়ামকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দেবী আশেরাহ বলেন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা কাপুরুষোচিত কাজ। লজ্জিত হাদাদ ইয়ামকে ছেড়ে দেন।
এই মিথের আরও এক বর্ণনায় আছে, হাদাদের হাতে সাত মাথা বিশিষ্ট ড্রাগন লোটানের মৃত্যুর কথা, যাকে হিব্রু ভাষায় লেভিয়াথান বলা হয়। কিন্তু উগারিতে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য না পাওয়ায় এটা বলা যায় না যে, এই লোটান কি ইয়ামেরই অপর নাম, নাকি সে স্রেফ ইয়ামের সঙ্গী! তবে মিথ বিশেষজ্ঞরা লোটান এবং ব্যাবিলনীয় দেবী তিয়ামাতকে একই সত্ত্বা বলে মনে করেন। কর্তৃত্ব লাভ করে ইয়াম আরও লোভী এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠলেন। তিনি একাই সকল দেবতার শাসনভার পেতে চাইলেন। এলের স্ত্রী এবং সকল দেবতার মা দেবী ‘আশেরাহ’ ইয়ামকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলেন। অহংকারী ইয়াম তাঁকে মানলেন না। ইয়াম নিজের দাবী দেবতাদের সভায় উত্থাপন করলেন। এতে হাদাদ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং ইয়ামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। বিদ্রোহের কথা শুনে ইয়াম হাদাদকে গ্রেফতার করার আদেশ দেন। হাদাদকে ইয়ামের সামনে আনা হয়। দুজনে পরস্পর লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। ইয়ামের তুলনায় হাদাদ ছিলেন কিছুটা দুর্বল। তাঁকে দুটি অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেন স্বর্গীয় অস্ত্র নির্মাতা ‘কোথার-ওয়া-খাসিস’ (kothar-wa-khasis)। ইয়াম যুদ্ধে পরাস্ত হন। জয়লাভ করে হাদাদ ইয়ামকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দেবী আশেরাহ বলেন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা কাপুরুষোচিত কাজ। লজ্জিত হাদাদ ইয়ামকে ছেড়ে দেন।
এই মিথের আরও এক বর্ণনায় আছে, হাদাদের হাতে সাত মাথা বিশিষ্ট ড্রাগন লোটানের মৃত্যুর কথা, যাকে হিব্রু ভাষায় লেভিয়াথান বলা হয়। কিন্তু উগারিতে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য না পাওয়ায় এটা বলা যায় না যে, এই লোটান কি ইয়ামেরই অপর নাম, নাকি সে স্রেফ ইয়ামের সঙ্গী! তবে মিথ বিশেষজ্ঞরা লোটান এবং ব্যাবিলনীয় দেবী তিয়ামাতকে একই সত্ত্বা বলে মনে করেন।
মট এর কাহিনি
ইয়ামের বিরুদ্ধে হাদাদের বিজয় উপলক্ষে দেবতারা লেবানন ও সিরিওনের সিডার, রুপা এবং স্বর্ণ দ্বারা একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন। দেবতাদের তুষ্ট করতে হাদাদ একটি বিশাল ভোজসভার আয়োজন করেন। এই ভোজে হাদাদ নিমন্ত্রন জানান দেবতা ‘মট’কে। মট হলেন খরা, দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর দেবতা। তিনি এই মিথের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র। প্রধান দেবতা এলের খুব প্রিয়পাত্রও তিনি।
মট এই আমন্ত্রণে অপমানিত বোধ করেন। কারণ তাঁর খাদ্য হল মানুষের প্রাণ। অন্যদের মত সামান্য রুটি ও মদ তিনি গ্রহণ করেন না। মট ইয়ামকে হত্যার হুমকি দিলেন। মটকে শান্ত করতে হাদাদ মটের জন্য ভেট হিসেবে একটি বাছুর নিয়ে নিজেই পাতালে গমন করেন। মিথে উল্লেখ করা হয় যে, মট বাছুরটিকে হত্যা করেন। কিন্তু কিছু বর্ণনায় দাবী করা হয় মট হাদাদকে হত্যা করেন।
আনাত এবং সূর্য দেবী শাপাশ হাদাদের লাশ খুঁজে বের করেন। আনাত হাদাদের মৃত্যু সম্পর্কে দেবরাজ এল এবং দেবরাণী আশেরাহকে অবহিত করেন। তাঁরা উভয়ে অত্যন্ত ব্যথিত হন। সম্মানের সাথে হাদাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। তাঁর স্মৃতির উদ্যেশ্যে ৭০টি করে মহিষ, গাভী, গাধা, হরিণ, বন্য ছাগল এবং মেষশাবক উৎসর্গ করা হয়। হাদাদের স্থলে ‘আশতার দ্য টেরিবল’কে প্রাসাদের সিংহাসনে বসানো হয়।
এদিকে হাদাদ যেহেতু ছিলেন উর্বরতার দেবতা, তাই তার মৃত্যুর পর শক্তিশালী মট ব্যাপক খরা এবং অনাবৃষ্টির সূচনা করেন। ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এল স্বপ্নে দেখেন যে, হাদাদকে আবার জীবিত করা সম্ভব এবং তাহলেই এই খরা আর দুর্ভিক্ষ বন্ধ হবে। তার ইচ্ছা অনুযায়ী হাদাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে দেবী আনাত পাতালে গমন করেন আর মটের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তলোয়ার দিয়ে তিনি মটের দেহকে খণ্ড খণ্ড করেন, আগুনে মটকে দাহ করেন এবং মটের দেহাবশেষ পাখির খাদ্য হিসেবে ছড়িয়ে দেন।
অবশেষে আবার হাদাদ জীবিত হন, তাঁকে আবার স্যাফন পর্বতে তার প্রাসাদে পূর্বের আসনে আসীন করা হয়। আবার বৃষ্টিপাত হয়, জমি উর্বর হয় এবং খরার অবসান ঘটে।
সাত বছর পর আবার আকস্মিকভাবে মটের পুনরাবির্ভাব ঘটে এবং তিনি আবারও হাদাদকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। রক্তক্ষয়ী সে যুদ্ধে কেউই জয়ী বা পরাস্ত হন না। এসময় দেবরাজ এল, শাপাশ, আনাত সকলে হাদাদের পক্ষ নেন। মট আত্মসমর্পণ করেন এবং হাদাদের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেন।
এভাবেই শেষ হয় এক মহাকাব্যিক লড়াইয়ের।
[উল্লেখ্য, সেমিটিক ও আফ্রো-এশিয়ান ভাষাসমূহে দেবতা মটের বিভিন্ন নাম জানা যায়। যেমন আরবি ‘মাওত’ (موت), হিব্রু ‘মাভেত’( מות) এবং সিরিয় mautā। ফিনিশীয় লেখক সানচুনিয়াথন-এর বর্ণনায় মট হলেন আদি দেবতা এল-এর পুত্র। এল’কে আবার গ্রিক মিথের ক্রোনাস-এর সাথে আইডেন্টিকাল বলে মনে করেন অনেকে। পবিত্র কোরআন এবং বাইবেলের কয়েক স্থানে মট এবং বা’ল এর প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন