মিজানুর রহমান রানা
বাউল সাধক লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০) ছিলেন ভাবজগতের গানের রাজা, বাউলের শিরোমণি। বাউল সাধক ও বাউল সঙ্গীত রচয়িতাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে বলা যায় তার স্থান সবার শীর্ষে। তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে সমানভাবে আদৃত।
গবেষকদের ধারণা, লালন ফকির জন্মসূত্রে হিন্দু কায়স্থ পরিবারের সন্তান এবং তাঁর জন্ম ১৭৭৪ সালে বর্তমান কুষ্টিয়া (তৎকালীন নদীয়া) জেলার অধীন কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের ভাঁড়ারা গ্রামে। লালন ছিলেন একাধারে ভাববাদী, যুক্তিবাদী ও স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যমনা একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তিনি ছিলেন ফকিরি মতবাদে বিশ্বাসী। তার পদাবলির ভণিতায় এ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তাঁর গানে দেহবিচার, মিথুনাত্মক যোগসাধনা, গুরুবাদ, মানুষতত্ত্ব- বাউলসাধনার প্রসঙ্গ চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা তাঁর গানগুলো শুনলেই বুঝতে পারি তা’ অনায়াসে।
লালনের উচ্চকণ্ঠে সর্বদা উচ্চারিত হতো একটি পঙক্তি: ‘জাত হাতে পেলে পোড়াতাম আগুন দিয়ে।’ এ সম্পর্কে যা অনুমিত হয়, লালন একবার তীর্থযাত্রা থেকে বাড়ি ফেরার পথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে নদীর তীরে মৃতবৎ অবস্থায় পড়েছিলেন। তাকে তুলে নিয়ে এক মুসলমান রমণী নিজ গৃহে রেখে সেবা শুশ্রƒষা দিয়ে রোগমুক্ত করেন। সেখান হতে রোগমুক্ত হয়ে লালন তার বাড়ি ফিরলে প্রকাশিত হয়, তিনি মুসলমানের ঘরে অন্ন্গ্রহণ করেছেন। ফলে অন্যজাতের মানুষের হাতে অন্নগ্রহণের অপরাধ চিহ্নিত করে গোঁড়া, ধর্মান্ধরা তাকে এ অপরাধে সামাজিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। বরং সে প্রায়ান্ধ, অজ্ঞ সমাজ সে সময়ে লালনকে সমাজচ্যুত করে। মানুষ হয়েও মানুষের প্রতি এ ধরনের অমানবিক আচরণ লালন ফকির মেনে নিতে পারেননি। ফলে লালন বৃদ্ধা মা আর স্ত্রীকে চিরকালের জন্যে পরিত্যাগ করে মনের মাঝে এক প্রকার অভিমান নিয়ে গৃহত্যাগ করেন। তিনি মায়ের স্নেহ এবং স্ত্রী থেকে বঞ্চিত হন। মনের মাঝে অপ্রকাশিত এ যন্ত্রণা লালন ফকিরকে দগ্ধ করেছিলো সারাজীবনভর। তাঁর জন্যে যদি স্বাভাবিক জীবন বয়ে যেত তাহলে তিনি হয়তো আর লালন ফকির হতে পারতেন না। অপ্রত্যাশিত এ মর্মান্তিক ঘটনাটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় বাউলসাধনার দিকে। লালন ফকির পরবর্তীতে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় এসে বসবাস করেন। ফকিরি মতে তিনি সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীা নিয়েছিলেন। কারণ, তার পদাবলির ভণিতায় গুরু সিরাজ সাঁইয়ের নাম তিনি স্মরণ করেছেন বার বার।
আমরা দেখতে পাই যে, দেহ জরিপ ও গুরুবন্দনাই বাউল সাধনার মূলকেন্দ্র। বাউলের সাধনা হচ্ছে দেহকেন্দ্রিক। কারণ দেহের মধ্য লুকিয়ে আছে মানুষের পরমাত্মার এক গুপ্ত অবস্থান। দেহ ছাড়া আত্মা অচল। আত্মাকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট দেহ কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করতে হয়। তাই দেখা যায়, কোনো মানুষের দেহ কলুষিত হলে আত্মাও কলুষিত হতে থাকে। দেহ বিচারের মাধ্যমে আত্মস্বরূপ নির্ণয় করতে পারলেই সেই পরম আরাধ্য মানুষের প্রত্যাশিত মনের সন্ধান লাভ সম্ভব। দেখা যায়, লালন ফকির তার গানে মানবদেহকে কখনো ‘খাঁচা’, কখনো ‘ঘর’, ‘আরশিনগর’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন। যেমন: ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়?’। এখানে ‘খাঁচা’ হচ্ছে দেহ, আর ‘অচিন পাখি’ হচ্ছে মানুষের আত্মা। আবার তিনি যখন বলেন, ‘আমার ঘরের চাবি পরের হাতে/কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেব চেেত?’ এখানেও ‘ঘর’ বলতে তিনি ‘দেহকেই বুঝিয়েছেন।
লালন সাঁই মনে এক ধরনের গুরুবাদ পোষণ করতেন। বাউল সাধনা গুরুবাদী লৌকিক ধর্ম। কারণ গুরু বিনা সর্বপ্রকার সাধন-ভজন বৃথা। তাই আমরা দেখতে পাই যে, সর্বদা লালন ফকিরের গানে বাউল সাধনার এই অনুসঙ্গটি অত্যন্ত প্রকট হয়েছে। লালন বলেন, ‘ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার/সর্ব-সাধন সিদ্ধ হয় তার।’
লালন ফকিরি মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এর প্রমাণ তার পদাবলির ভণিতায় তা’ স্পষ্টভাবেই উচ্চারিত হয়েছে। তিনি তার আত্মপরিচয়ের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন ফকির এবং দরবেশ এ দু’টি শব্দ দ্বারা। তাই তার মানস-ভুবনকে বুঝার জন্যে তার সমসাময়িক কালের একজন মানবতাবাদী মনীষীর সঙ্গে তার অবস্থানগত দিক সম্পর্কে তুলনা করা যায়। তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায়। লালন তার গানে, ধ্যানে যেমন সমাজ সংস্কার, মানুষের মনের কুটিলতা, রূঢ়তা ইত্যাদি সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন ঠিক তেমনি রাজা রামমোহন রায়ও ছিলেন একজন মানবতাবাদী সমাজ সংস্কারক। রাজা রামমোহন রায় হিন্দু সমাজে তৎকালীন সময়ে প্রচলিত নানা কুসংস্কার, অমানবিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন হয়ে এর বিরুদ্ধে নানা পদপে গ্রহণ করেছিলেন। সতীদাহ প্রথা এর মধ্যে অন্যতম। একে তিনি আন্দোলনের দ্বারা পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারকে দিয়ে তা আইনে পরিণত করিয়ে এই অমানবিক প্রথা রোধ করেছিলেন।
লালন ফকিরের আলোচনা প্রসঙ্গে কেন রাজা রামমোহন রায় প্রসঙ্গের অবতারণা? এ প্রসঙ্গে বলা যায়, উভয়ের অবস্থান আলাদা হলেও তাঁরা উভয়েই ছিলেন একাধারে ভাববাদী, যুক্তিবাদী এবং উভয়ের জন্মও বেশ কাছাকাছি। তবে উভয়ের ভাববাদ ও যুক্তিবাদ একই উৎস থেকে আসেনি। রামমোহন রায় ছিলেন তৎকালীন আধুনিক শিায় শিতি মানুষ। পান্তরে লালন ফকিরের জ্ঞান আহরণের উৎস ছিলো লোকায়তিকদের থেকে প্রাপ্ত, নিজস্ব মেধা-মনন ও সর্বোপরি নিরবচ্ছিন্ন ভাববাদের অভীষ্ট ল্য থেকে।
লালনের বাউল সাধনার মূল বিষয় বা অনুসঙ্গ ছিলো মানুষ। মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তার সাধনা। কারণ, মানুষের ভেতরই বসবাস করে অন্য এক অদৃশ্য ‘আরশি নগরের পরশী’ যা কি-না লালনের ‘মনের মানুষ’ এবং লালন তাকেই বলেছেন ‘অলখ সাঁই’ এবং লালন এই সাঁইকেই বলেছেন ‘সাঁই নিরঞ্জন।’ মানুষকে এবং মানুষের মধ্যে সুপ্ত মনুষ্যত্বকে কেন্দ্র করে লালন পেতে চেয়েছেন সৃষ্টিকর্তাকে এবং সেই অদৃশ্য স্রষ্টাকে মানুষের মাঝে চিনিয়ে দিতে চেয়েছেন। সেই সত্যকে অন্তরে ধারণ করেই তিনি বলেন:
“মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে
সে কি অন্য তত্ত্ব মানে ॥”
লালনের গান যেহেতু আধ্যাত্মবাদের ওপর ভিত্তি করে রচিত এবং মানুষের পরম আপনজনকে পাওয়ার ল্েয উদ্ভাসিত সে জন্যে লালনের গান একাধারে সাধনাসঙ্গীত, শিল্পশোভিত কাব্যবাণী ও দর্শনকথা। লালনের গানগুলোতে আকর্ষণীয় ও শ্রীমণ্ডিত যে শব্দের সংমিশ্রণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, প্রায় নিরর লালনের শব্দ-চেতনা, শব্দ ভাণ্ডার ও ভাষাশৈলী অনেক পরিশীলিত ও সমৃদ্ধ ছিলো। লালনের গানের এই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য, উচ্চাঙ্গের দর্শন এবং মানুষের জন্যে মানবিকতাবোধের জন্যে এদেশে রবীন্দ্রনাথ, অন্নদাশঙ্কর রায় ও বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত অনেক সমালোচক লালনের এই ভাববাদী গানের প্রশংসা করেছেন।
লালনের গানে হিন্দু-মুসলিম বা কোনো জাতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়নি। লালন সংসারে কী জাত ছিলেন বা লালন কোন্ সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করতেন সেটাও বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে লালন নিরাকার এক ‘অচিন পাখি’র সন্ধান করতেন। সেই অচিন পাখি কোন্ দেশের, কোন্ জাতের সেটার কোনো ইঙ্গিত তিনি দেননি। অপরদিকে লালনের গান কোনোপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার দোষেও দুষ্ট নয়। বরং তাই এ প্রসঙ্গে কবি জসীমউদ্দীনের একট কথা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘লালনের খৎনা হয়েছে কি-না তাতে কী এসে যায়? বাংলাদেশে কয়েক কোটি মানুষেরই তো খৎনা হয়েছে, কই, আরেকটি লালন কি আর পয়দা হয়েছে?’
লালনের গান আজ আমাদের দেশের পরম সম্পদ। কারণ তাঁর গান দেশের গণ্ডি ছড়িয়ে বিদেশের মানুষের মনেও করেছে গভীর রেখাপাত। লালনকে তাই আমাদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে হৃদয়ে লালন করতে হবে। তাঁর গানগুলোকে চর্চা করে কিংবদন্তীতুল্য লালনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে চিরকাল। তাতে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভাণ্ডার হবে পরিপূর্ণ। আমরাও হবো গৌরবদীপ্ত, পরিপূর্ণ হবে আমাদের জাতীয় সম্পদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন