বাইসাইকেল থিফ

মাসকাওয়াথ আহসান

বাইসাইকেল থিফ, "Ladri di biciclette" ইতালির কথাসাহিত্যিক লুইগি বার্তোলিনির উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রকার ভিত্তোরিও ডি সিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালিতে মুসোলিনির রেখে যাওয়া সমাজে বাস করে; রিচ্চি নামের এক নীল কলারওয়ালা যুবক ; যে তার স্ত্রী মারিয়া; ছেলে কিশোর ব্রুনো আর একটি নবজাত সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে একটি বাই সাইকেল বন্ধক রেখেছিলো।
প্রতিদিন সে গিয়ে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের সামনে চাকরির খোঁজে বসে থাকতো যদি তার ডাক পড়ে। একদিন ডাক পড়ে ঠিকই; চাকরির পূর্বশর্ত একটি সাইকেল থাকতে হবে; কারণ সে পেয়েছে বিজ্ঞাপনী পোস্টার লাগানোর কাজ।

মারিয়া বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দিশেহারা। তাই সে এক আধ্যাত্মিক নারীর ওপর নির্ভর করতে শুরু করে। সে মানত করেছিলো স্বামীর চাকরির জন্য।

রিচ্চি এসে নতুন চাকরির খবর দিলে মারিয়া খুব খুশি হয়; কিন্তু এই চাকরিতে সাইকেল লাগবে শুনে বিক্ষুব্ধ হয়, কেন সাইকেল বন্ধক রেখেছিলে! এরপর বিয়ের সময় মায়ের বাড়ি থেকে আনা বেডশিটগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে যায় বন্ধক দিতে। বন্ধকী কারবারি চাদরের বিনিময়ে যে লিরা(ইতালীয় মুদ্রা) দেয়; তা সুদসহ দিয়ে সেখান থেকে সাইকেল ছাড়িয়ে নেয়। দেখতে পায় তাদের বন্ধক রাখা চাদরগুলো রোমের ভাগ্যহত মানুষের জমা রাখা সারি সারি চাদর রাখার শেলফের সব উঁচুতে ঠাঁই পেলো। বন্ধকী কারবারির আড়তে অসংখ্য মানুষ তার পছন্দের জিনিস বন্ধক রাখতে এসেছে।
ফেরার পথে মারিয়া সেই আধ্যাত্মিক নারীর আস্তানায় যায়। রিচ্চি তাকে জোর করে ফিরিয়ে আনে; সে এসব তুকতাক-কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না । তুকতাকের আসরে অসংখ্য নিয়তিবাদী অসহায় মানুষের ভিড়। আধ্যাত্মিক নারী হাত তুলে শুধু বলে, গড আমাকে আলো দাও যেন দেখতে পাই।

পরদিন খুব ভোরবেলা ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়ে রিচ্চি। মাসে মাসে বাঁধা বেতনের নিশ্চয়তা; ওভারটাইমের বাড়তি উপার্জনের হাতছানি; রিচ্চি আর মারিয়ার অনেক দিনের হারিয়ে ফেলা স্বপ্ন আর রোমান্টিসিজম যেন ফিরিয়ে দেয়। পাখি ডাকা ভোরে উঠে, স্বামী আর ছেলের জন্য ডিমের স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেয়।
ছেলে ব্রুনো একটি পেট্রোলপাম্পে কাজ করে। তাকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে অফিস থেকে মই সংগ্রহ করে সিনেমার পোস্টার লাগাতে যায়। সে যখন পোস্টার লাগাতে উঁচু মইয়ে ওঠে; তখন এক বাইসাইকেল চোর এসে সাইকেল চালিয়ে চলে যায়; চোরে সহযোগী রিচ্চিকে ঐদিকে গেছে বলে ভুল দিকে নিয়ে যায়। মুসোলিনির রাজ্যে চোরের সংঘবদ্ধ চক্র বেশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে চুরি করে।
পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ রিচ্চিকে পাত্তা দেয়না; একটা সাইকেল খুঁজতে পুরো টিম লাগানো কী সম্ভব বলে ধমক দিয়ে ফেরত পাঠায় রিচ্চিকে। মুসোলিনির রেখে যাওয়া রাজকীয় পুলিশ এসব নীল কলারের আর্তনাদ শুনবে কেন!

শ্রমিকদের পার্টি অফিসে রিচ্চি যায় এক বন্ধুর খোঁজে। মারিয়াও সেখানে আসে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে। বন্ধু একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। তাকে সাইকেল চুরির কথা জানালে সে পরদিন লোকজন নিয়ে চোরাই সাইকেল বিক্রির বাজারে যাবার আশ্বাস দেয়।

অসহায় রিচ্চি সেই আধ্যাত্মিক বৃদ্ধার আস্তানায় যায়; অসহায়ত্ব মানুষকে কুসংস্কারের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে দেয় বলেই হয়তো। জানতে চায়, তিনি কী বলতে পারবেন; বাইসাইকেল চোরটি কোথায়? বৃদ্ধা বলে, খোঁজো, পেতেও পারো; আবার নাও পেতে পারো। নজরানার কিছু লিরা দিয়ে রিচ্চি বেরিয়ে পড়ে।

বন্ধু আর তার লোকজন নিয়ে চোরাই বাজারে অনেক খোঁজাখুঁজি করে সাইকেল না পেয়ে; বন্ধুকে সেখানে রেখে রিচ্চি আরেক চোরাই বাজারে সাইকেল খুঁজতে যায়। সঙ্গে ব্রুনো ছায়ার মতো। সেখানেই দূর থেকে দেখে তার সাইকেল নিয়ে সেই চোর এক অশীতিপর বুড়োর সঙ্গে কথা বলছে। রিচ্চি চোর চোর বলে তেড়ে গেলে; চোরটি আবার সাইকেল চালিয়ে হাওয়া হয়ে যায়।

পরে ঐ বুড়োকে অনুসরণ করে একটি চার্চে পৌঁছে যায় রিচ্চি। সাইকেল উদ্ধার অভিযানে ব্রুনো তার বাবার সঙ্গে প্রাণপণ চেষ্টায় অক্লান্ত। চার্চে তিল ধারণের জায়গা নেই। সেখানে হৃদয় শুদ্ধ করে তবে পৃথিবী ছাড়ার আদর্শের বয়ান করছে। চোরের সহযোগী বুড়োটির পাশে বসে রিচ্চি তাকে চেপে ধরে। বুড়োটি অগত্যা সাইকেল চোরের বাড়ির ঠিকানা দেয়। সঙ্গে যেতে বললে বুড়োটি চোখে ধূলো দিয়ে সটকে পড়ে।

বাপ-ছেলে চার্চ থেকে বেরিয়ে বুড়োটিকে আর খুঁজে পায়না। হতাশ রিচ্চি ব্রুনোকে চড় বসিয়ে দেয়। ব্রুনো প্রতিবাদ করে। ভয় দেখায়, মাকে বলে দেবে যে বাবা তার গায়ে হাত তুলেছে। রিচ্চি জিজ্ঞেস করে ক্ষিদে পেয়েছে; পিটযা খাবে! ব্রুনো হ্যা বলে মাথা নাড়ায়। রিচি দেখে নেয় পকেটে কয়টাকা আছে। তারপর বলে, মরতে যখন হবেই একসময়; চলো আজ একটু আনন্দে বাঁচি।

রেষ্টুরেন্টে কাতর চেহারার চোখ জুলজুলে একটা লোক গান গেয়ে সবাইকে বিনোদন দিচ্ছে। বাজনা বাজাচ্ছে শীর্ণ শরীরের বাজিয়েরা। খাবার টেবিলে ব্রুনো বসে দেখে দূরের টেবিলে একটা ধনী পরিবারের বাচ্চা খাচ্ছে। সেই টেবিলে রাশি রাশি খাবার। মুসোলিনির ব্যাপ্টিজমে সাদাকলার পরিবারটির নিটশের শিশুর সঙ্গে বারবার চোখাচোখি হয় ব্রুনোর। পাশাপাশি দুটি টেবিলে দুই ইতালি যেন।

রিচ্চি ওয়াইন আর খাবার অর্ডার দেয়। খাবার এলে বাপ বেটা খায়। ব্রুনোকে ওয়াইন খেতে দিয়ে রিচ্চি হেসে বলে, তোমার মা যদি এই দৃশ্য দেখতো! তারপর আকন্ঠ ওয়াইন পান করে রিচ্চি বলে, পৃথিবীতে সব সমস্যাকে জয় করা যায়; শুধু মৃত্যু ছাড়া। যদি চাকরিটা করতে পারতাম তাহলে বেতন ওভার টাইম মিলিয়ে কতো উপার্জন হতো জানো! ব্রুনোকে পেন্সিল এগিয়ে দেয়, টিস্যু পেপারের ওপর তার "মানি ইন হোপে"র হিসাব করার জন্য। ব্রুনোকে বারবার সেই উতসবমুখর দূরের টেবিলের দিকে তাকাতে দেখে রিচ্চি বলে, ওরকম খাবার খেতে গেলে মাসে এক লাখ লিরা কামাতে হয়।

পরদিন চোরের ঠিকানায় তাকে খুঁজতে যাবার পথে বাইসাইকেল চোরকে হঠাত দেখে তেড়ে যায় রিচ্চি। চোর দৌড়ে গিয়ে ঢোকে আনন্দপসারিনীদের লালবাতি গৃহে। রিচ্চি সেখানে গিয়ে দেখে সেখানে সখি পরিবেষ্টিত হয়ে আছে চোর। সখিরা বাধা দিলেও রিচ্চি তাকে বাইরে নিয়ে আসে। সাইকেল চোরের মহল্লার লোকেরা এগিয়ে আসে; ঘন হয়ে আসে চোরের সমর্থনে; বাড়ির জানালা খুলে চোরের মা চেঁচায়, আমার ছেলের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। মহল্লার সানগ্লাস পরা বড় ভাই; তাদের সহমত ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে দেখে বাইসাইকেল চোর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়ে কাতরানোর অভিনয় করতে থাকে। সানগ্লাস পরা বড় ভাই ও সহমত ভাইয়েরা রিচ্চিকে চ্যালেঞ্জ করে, আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে; অযথা ভালো ছেলেটাকে চোর বলে মানহানি করছেন। ভয় দেখায়, আপনি মানহানি মামলায় পড়ে যাবেন তো!

ব্রুনো দৌড়ে গিয়ে এক পুলিশকে ডেকে নিয়ে আসে, পুলিশ জিজ্ঞেস করে একই কথা; আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে যে সে চোর!
পুলিশ আইনের শাসন উপহার দিতে রিচ্চিকে চোরের বাড়িতে যায় তল্লাশী করতে। চোরের মা বলে, তার ছেলে নিষ্পাপ-নিষ্কলুষ। ঘরে চোরাই টায়ারের দিকে রিচ্চি তাকালে; চোরের মা বড় গলা করে বলে, ছেলেটার গাড়ী ছিলো আগে। পারলে তাকে চাকরি দিয়ে সহযোগিতা করুন। চোরের মাকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে পুলিশ শুরু করে তার ছক, চোরকে কী পেছন থেকে ঠিক দেখতে পেয়েছিলেন; কী করে বুঝলেন যে এই চোরই সেই চোর; প্রমাণ ছাড়া কথা বললে কী হবে বোঝেন তো! নীচে মহল্লার লোকের ভীড় দেখেছেন; আপনি তো উলটো কেসে পড়ে যাবেন মিথ্যা অপবাদ দেবার অভিযোগে।
চোরের বাড়ি থেকে বের হবার মুহূর্তে রিচ্চি লক্ষ্য করে; চোরের বোন কোনো দোকান থেকে বেশ কিছু সৌখিন সামগ্রী চুরি করে এনে; আগে চুরি করা ছোট্ট পাহাড়ের ওপর ঢেলে দিলো। বাইরে অপেক্ষমান চোরের খনি বিজয়ের উল্লাসে রিচ্চিকে খাট্টাতামাশা করতে শুরু করে। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা পুলিশ রিচ্চিকে চলে যাবার পরামর্শ রাখে। ব্রুনোকে ডেকে নিয়ে রিচ্চি চোরের মহল্লা থেকে বের হবার সময় চোরেরা শিয়াল পালের মতো হুক্কা হুয়া করতে থাকে, আর জানি তরে এই মহল্লায় না দেখি।

একটু এগিয়ে এসে বিশাল স্টেডিয়ামের সামনে ক্লান্ত হয়ে ব্রুনো রাস্তার ফুটপাথে বসে পড়ে। স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা হচ্ছে। দর্শকের গগণ বিদারী উল্লাস। স্টেডিয়ামের সামনে সারি সারি সাইকেল। রিচ্চির সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত; একটি সাইকেলহীন জীবন মানেই বেকারত্বের আঁধার-সমুদ্রে পুরো সংসার নিয়ে ডুবে মরা। পাশের নির্জন গলিতে একটি নিঃসঙ্গ সাইকেলের দিকে বার বার তাকায় দ্বিধান্বিত রিচ্চি; যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। কয়েকবার পায়চারী করে চকিতে কী যেন ভেবে ব্রুনোকে টাকা দিয়ে বলে, তুমি বাসে চড়ে গিয়ে একটু দূরে নেমে আমার জন্য অপেক্ষা করো! ব্রুনো বিস্ফারিত চোখে তাকায়; বাবার ধমক শুনে বাসে উঠতে গিয়েও ভীড়ের কারণে উঠতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে।

সে চেয়ে চেয়ে দেখে বাবা একটা সাইকেলে চড়ে দ্রুত চলে যাবার চেষ্টা করছে! ; আর লোকজন চোর চোর বলে তাকে ধাওয়া করছে। একসময় সাইকেল থেকে পড়ে যায় বাবা। গণপিটুনী চলতে থাকে। ব্রুনো গিয়ে বাবার কোটের একপাশে ধরে বাবা বাবা আর্তনাদে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। সে অশ্রুধারা যেন রুমাল দিয়ে মুছেও শেষ করতে পারে না ব্রুনো; কী হচ্ছে কী হবে অজানা আশংকায় ছোট্ট বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে। তার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে যায় হাতে নাতে চোর ধরার উল্লাসে।

উপস্থিত জনতা বাইসাইকেল থিফ বাবাকে পুলিশে দেবার পরামর্শ দেয়। সাইকেলের হৃদয়বান মালিক মালিক "এক দেবশিশু আর তার উপায়হীন বাবা"র অসহায়ত্ব যেন খানিকটা আঁচ করতে পারে। সে বলে, আমি ঝামেলা বাড়াতে চাইনা; সাইকেল ফেরত পেয়েছি এই বেশ।

গ্লানির আলো আঁধারীতে বাবার সংগে অনিশ্চয়তার পথে হাঁটতে থাকে ব্রুনো। এই জন-অরণ্যে ভাগ্য তাদের কোথায় নিয়ে যাবে কেউ জানেনা!

(বাইসাইকেল থিভস, "Ladri di biciclette" ইতালির কথাসাহিত্যিক লুইগি বার্তোলিনির উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রকার ভিত্তোরিও ডি সিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন