শুনেছি কিন্নরকণ্ঠ দেবদারু গাছে

মাসুদুজ্জামান   

'শুনেছি কিন্নরকণ্ঠ দেবদারু গাছে'

স্কেচ : মানব

শেষ থেকেই শুরু হোক। বলতে বাধা নেই, উৎপলকুমার বসু আমাদেরই লোক। বাংলা কবিতার একজন অবিস্মরণীয় কৃতী লেখক। কোনো অহং নেই, আত্মম্ভরিতা নেই। নিজের জীবন আর কবিতায় ভ্রমণের পথটাকে তিনি কোনো রকম জাঁক না করেই বলেছেন-'হাঁস চলার পথ'। এই নামেই এ বছর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ। এ বইয়ের প্রথম কবিতায়ই তো বলে দিয়েছেন কিভাবে শুরু হয়েছিল জীবন, কিভাবে কবিতাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁস চলার পথ ধরে তাঁর পরিভ্রমণ : 'ভুলে যাই নিজের ঠিকানা/ছোট একটা বাড়ি ছিল। কিছু দূরে নীলকুঠি। /গুটিকয় তালগাছ আর কিছু লতাপাতা/জড়িয়ে আমার স্থাপত্যের সামান্য ঘোষণা।/ছিল হাঁস। বাল্যের পাঠ্য বই থেকে/নেমে আসা উট ও বিদেশি গাধার দলে/আমি একা ক্রীতদাস-/আপাতত স্থলপদ্মের বনে নিদ্রাহীন জেগে আছি।' শ্যামল নিবিড় সহজ একটা ছবির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন তাঁর ঠিকানা। ওই যে বাড়ি, নীলকুঠি, তালগাছ, লতাপাতা, হাঁস-এসব নিয়েই উৎপলকুমার বসুর কবিতা-স্থাপত্যের নির্মিতি। পাঠ্য বইও তাঁকে প্রাণিত করেছিল, বিদেশেও কাটিয়েছেন কয়েক বছর। কিন্তু পরে থিতু হয়েছেন স্থলপদ্মের বনে, এই বাংলাদেশে। ভুলে যাওয়া যাচ্ছে না যে উৎপলেরই আরেকটা অর্থ হচ্ছে পদ্ম। সবই তো এই একটি কবিতায় বলে ফেলেছেন উৎপলকুমার, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত স্বদেশে নিদ্রাহীন ছিলেন তিনি। নিরন্তর লিখে গেছেন কবিতা, মাঝেমধ্যে গদ্যও। বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ গতিপথটা তাঁর দ্বারা অনেকটাই উজ্জ্বলতা পেয়েছে।

বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে অনেক আগে আমি তুলনামূলক গবেষণা করেছিলাম। তখনই বলেছিলাম, তিরিশের কবিতার পরে পশ্চিম বাংলার পঞ্চাশের দশকের কবিদের হাতে বাংলা কবিতা নতুন বাঁক নেয়। 'কৃত্তিবাস' পত্রিকা প্রকাশের সূত্রেই সেই বাঁকটা তখন লক্ষগোচর হয়ে ওঠে। কিন্তু কেমন ছিল সেই কবিতার ধরনটা? আমি উল্লেখ করেছিলাম, 'স্বীকারোক্তিমূলক আত্মজৈবনিক' কবিতার সূচনা ঘটে সেই সময়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সেই আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার প্রধান প্রবক্তা। তিনি নিজেই লিখেছেন, 'সাহিত্যের আড়ালে নিজেকে লুকোতে চাইনি, নিজেকেই প্রকাশ করতে চেয়েছি। আমার প্রতিটি কবিতাই আমার জীবনযাত্রার প্রতিফলন, সে জন্যই আমি একাধিক জায়গায় বলেছি, আমার কবিতাগুলো স্বীকারোক্তিমূলক।' এর পর থেকে আজ পর্যন্ত যে কবিতা লেখা হচ্ছে, যাকে বলা হয় আধুনিক কবিতা, তা মূলত এই আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তিমূলক কবিতাই। পঞ্চাশের আরেক কবি শঙ্খ ঘোষও এই একই কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর আমিত্ব ও কবিত্ব সমর্পিত হয়েছে ঐতিহাসিকতায়, দেশকালের সমকালীন ঘটনায়। সুনীল চেয়েছেন বাইরের পৃথিবী আর আত্মগত পৃথিবীর সমন্বয় বা সিনথেসিস। উৎপলকুমার বসুও বলেছেন কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সবার কবিতাই ছিল এ রকমই, আত্মপ্রকাশময়, 'কৃত্তিবাস' নামের একটি অনিয়মিত কবিতা পত্রিকার মাধ্যমে ওই দশকের তরুণ কিছু কবি আত্ম-উন্মোচনের বা ইংরেজিতে যাকে বলে 'সেলফ-এক্সপ্রেশন'-এর ভাষা তৈরি করলেন। কোন প্রেক্ষাপটে এটা ঘটেছিল, কিভাবে, কৃত্তিবাস কবিগোষ্ঠীর কবি হিসেবে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন উৎপলকুমার বসু। খণ্ডিত দেশ, উদ্বাস্তু আগমন, মধ্যবিত্তের জীবনযুদ্ধ, গ্রাম ও শহরের সংঘাত, অসাম্য, স্বাধীনতা নিয়ে দ্বিধা-সংশয়-দুঃস্বপ্ন-এ রকম 'এক রক্তাক্ত রণক্ষেত্রেই পাঁচের দশকের কবিদের উত্থান' ঘটে। উৎপলকুমারও ছিলেন সেই নতুন কবিদেরই একজন। কিন্তু অনেকটা পার্থক্য আছে-শঙ্খের সঙ্গে সুনীলের, শঙ্খ ও সুনীলের সঙ্গে উৎপলের। এখানে বলে রাখি, কবিতায় আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তির ধারাটি বিশ্বকবিতায় নতুন ছিল না। পঞ্চাশের শুরুতেই পশ্চিমী কবিতায় রবার্ট লাওয়েল ও অ্যালেন গিনসবার্গ আত্মজৈবনিক কবিতার সূত্রপাত ঘটান। তারও আগে পাউন্ডের 'পারসোনা', ইয়েটসের 'মাস্ক' ও এলিয়টের 'নৈর্ব্যক্তিকতা'র ধারাবাহিকতায় কৃত্তিবাসীয় কবিদের স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়া।

একটু অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ করলে দেখা যাবে, উৎপল পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়েননি। কবি হিসেবে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের অনুগামী, বিশেষ করে জীবনানন্দের কাছ থেকেই কাব্যকলার দীক্ষা নিয়েছেন। এই দীক্ষাটা ঘটেছে যুগপৎ কবিতার আঙ্গিক, শৈলী ও ভাবনার ক্ষেত্রে।

উৎপল বাংলা কবিতার এই বিবর্তনের পথটিও চমৎকারভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, দিয়েছেন ব্যাখ্যা। বিশ শতকের বাঙালির কাব্যভাবনা ও আন্দোলন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, বিশ শতকের প্রথম চার দশক ছিল উপনিবেশ বিরোধিতা আর 'অস্মিতা' বা আইডেনটিটির সন্ধান। শিল্পচর্চা বা কবিতাও লেখা হচ্ছিল ওই ধারায়, যেখানে উদ্দীপনা ও প্রতিবাদেরই প্রাধান্য। কিন্তু তখনই সাহিত্য, 'বিশেষত কবিতায় নতুন আঙ্গিক বা ফর্মের সন্ধান খুবই দরকারি হয়ে পড়ল।' নজরুল তখন জনপ্রিয় কবি, কিন্তু তাঁর পক্ষে ওই গভীরতর পরিবর্তনকে বোঝা সম্ভব হয়নি, রবীন্দ্রনাথও আত্মসমর্পণ করেছেন পারফরম্যান্স আর্টে। কিন্তু ঠিক তখনই বাংলা কবিতায় আবির্ভাব ঘটল এক 'আসুরিক প্রতিভার', উৎপলের নিজের ভাষায়, 'নতুন আঙ্গিক, নবীনতর উপলব্ধি এবং বোধ ও বুদ্ধির নির্মম দ্বন্দ্বকে কবিতার উপজীব্য করে তোলার প্রয়োজন হলো এক আসুরিক প্রতিভার, যাঁর নাম জীবনানন্দ দাশ। তিনি যে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি সে বিষয়ে আজ আর বিতর্কের অবকাশ নেই।' কৃত্তিবাসের কবিরাই জীবনানন্দকে আবিষ্কার করলেন। আঙ্গিকে, বিশেষ করে কবিতার ভাষায় ঘটে গেল রূপান্তর। উৎপলের কবিতাও আমরা লক্ষ করব, খুঁজে নিয়েছে নতুনতর প্রকাশভঙ্গি ও ভাষা। এও বাংলা কবিতার আরেক চমকপ্রদ ইতিহাস। আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে উৎপলের কবিতায় প্রাধান্য পেল জীবনানন্দের চিত্ররূপময়তা। 'ইমেজের আগমন' শীর্ষক প্রবন্ধেই এ কথা বলেছেন উৎপল। কবি হিসেবে তিনি নিজেকে চিহ্নিত করেছেন ইমেজিস্ট কবি বলে। আধুনিক কবিতার শুরুটাই ঘটেছিল এই চিত্রকল্পবাদ বা ইমেজিজমের মাধ্যমে, পাউন্ড ছিলেন যে কবিতার প্রধান পুরোহিত। উৎপল লক্ষ করেছেন, বাংলা কবিতায় ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল-এই ১০ বছরে বাংলা কবিতায় 'চিত্ররূপময়তা'র প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ। লিঙ্গুয়িস্ট রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার বর্তাল জীবনানন্দে; আর এভাবেই 'চিত্রকে কবিতার জগতে আহ্বান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কবিতাকে চিত্রনির্ভর করে তুললেন জীবনানন্দ।' উৎপলকুমার বসুর কবিতা এভাবেই স্থিত হয়েছে ইমেজে, তিনি খুঁজে পেয়েছেন নতুন আঙ্গিক ও ফর্ম।

কিন্তু এ তো গেল আঙ্গিক অনুসন্ধানের কথা, বিষয়ও কি পাল্টায়নি? বিষয় মানে, উৎপল যাকে বলেন 'রিয়ালিটি' বা বাস্তবতা, তাও কিন্তু কবিদের কাছে ভিন্নভাবে ধরা পড়ছিল। উৎপলের কাছেও বাস্তবতার বিষয়টি অন্য রকম হয়ে উঠছিল। কিছুটা দীর্ঘ কিন্তু উৎপলের কবিতা বোঝার জন্য এই বাস্তবতা বলতে তিনি কী বুঝেছেন, একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি : 'কবিতা নিজেকে ঘিরে যে অস্তিত্ব-জটিল বাস্তবতা তৈরি করে তাকে আমরা প্রতিবিম্ব, প্রতিফলন, ছায়াপাত বলে স্বীকার করে নিলে খানিকটা স্বস্তি পাব। কেননা আমাদের জানতে বাকি নেই যে সামান্য বাতাসে, জলবাসী প্রাণীদের সামান্য নড়াচড়ায়, ওই সুখী, স্থির পুকুরের ছবিটি টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কবিতার বাস্তবতা যেন ভেঙে পড়ার জন্যই সৃষ্টি হয়। তখন হয়তো সূর্য আরেকটু হেলে পড়েছে, বাতাস বাঁক নিয়েছে এবং জলজ প্রাণ আরো গভীর স্তরে অন্তর্হিত হয়েছে। অথবা রূঢ়ভাবে বলা যায়, জল শুকিয়ে গেছে, শুকনো পাতা উড়ছে, শকটের চাকা ফেটে দুই খান হয়ে পড়ে আছে। আর স্মৃতিবিভ্রম তৈরি করছে কবিতা। ওই দৃশ্যের ওপর দিয়ে, গ্রীষ্মের দগ্ধ অরণ্যে লুকিয়ে পড়া এবং ধরা পড়ে যাওয়া মানব-মানবীর আর্তচিৎকারের মতো, পাগল হাসির মতো যে শব্দ-উপমা-অলংকারের ধ্বনি বাতাসে ভেসে চলেছে-তাই কবিতা।'

শেষ কাব্যগ্রন্থের কথা দিয়েই শেষ করি এই লেখা। ব্যক্তিজীবন ও কবিজীবনে সহজ চেনা-জানা পথে চলবেন বলেই বেছে নিয়েছিলেন 'হাঁস চলার পথ'। শেষ কাব্যগ্রন্থের এই নামটি নির্দিষ্ট করে দেওয়ার মধ্য দিয়েই সেটা বোঝা যায়। 'চৈত্রে রচিত কবিতা' থেকেই এর শুরু, মাঝে জীবনকে সমীকৃত করেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে-নগরের শশব্যস্ত মধ্যবিত্ত কিংবা গ্রামের অলক্ষে থাকা ব্রাত্যজনচিত খণ্ড বৈচিত্র্যের নানা পরম্পরায়, 'আমি যেন বারবার জেগে উঠি লোকাল ট্রেনে-বর্ধমান, বনগাঁ, মেদিনীপুর, ডায়মন্ডহারবার যাতায়াতের পথে-লোকের কথায়, হকারের ডাকে, পিকনিক-যাত্রীদের হাসিঠাট্টায়, কলহবিবাদে, থুতু ছিটানো ক্রোধে ও অনন্ত কোলাহলে।' এই হচ্ছেন উৎপল, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন কবিতা মানেই ফর্মের খেলা নয়। মানুষের জন্য কবির মমত্ববোধ গভীর আর নিবিড় হতে হয়। তাঁর মৃত্যুতে পঞ্চাশের বাংলা কবিতার শেষ উজ্জ্বল নক্ষত্রটির পতন হলো। উৎপলকুমার বসুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন