চিত্রকল্পের জানালায়

কে এম রাকিব


সূচনাপর্ব (ভূমিকা পর্বের ভূমিকা)
যদি বলা হয় বকধার্মিক, তাহলে ভাষা সচেতন ব্যক্তির মনে কি সেই একপায়ে দাঁড়ানো বকটির ছবিই ভেসে ওঠে না? -যার ধ্যানী সুলভ মূর্তি, ভাবখানা এমন দুনিয়ার কিছুতেই আগ্রহ নাই, কিন্তু মওকা পেলেই যে ২-১টি মাছ ছো মেরে নিয়ে যাবে জলাশয় থেকে? কিংবা গড্ডলিকা প্রবাহ বলা মাত্র কি মনে পড়ে না গড্ডলের (ভেড়ার) সেই নির্বোধ অনুকরণ প্রবাহের দৃশ্য?
আমরা সংবেদী অঙ্গের (sensory organ) ব্যবহার করে বাগধারা কিংবা যেকোন শব্দবন্ধের অর্থ আরো সম্যক ভাবে উপলব্ধি করি। কারন তা আমাদের কল্পনাকে উসকে দেয়। তাই বকধার্মিক বলতে শুধু ভন্ডই বুঝি না, কিংবা গড্ডলিকা প্রবাহ বলতে অনেকের বিবেচনাহীন জোয়ারে গা ভাসানোই বুঝি না, আরো বেশি কিছু অনুভব করি।
এই যে শব্দের চিত্রধর্মিতার মাধম্যে অন্যের সাথে যোগাযোগ এটা আধুনিক কবিদের এক বড় হাতিয়ার। তাই চিত্রকল্প আধুনিক কবিতার এক অনিবার্য উপাদান। এ যুগে চিত্রকল্প ছাড়া কবিতা কল্পনা করাও কঠিন। সব কবিই এ যুগে চিত্রকল্প ব্যবহার করে থাকেন, কেউ সচেতনভাবে, কেউবা অসচেতনভাবে। কারন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান বলছে, ভাষা যত আধুনিক হচ্ছে তত এর প্রতীকধর্মীতা ও চিত্রধর্মীতা বাড়ছে। তাই কবিতায় এর প্রভাব পড়বে বই কি! চিত্রকল্পের সাথে পরিচিত থাকাটা তাই জরুরী হয়ে পড়ে। ‘চিত্রকল্পের জানালায়’ লেখায় চিত্রকল্পের জানালা দিয়ে কবিতার আকাশে উঁকি দিতে চেষ্টা করা হবে। আশা করা যায়, ৪/৫ টি পর্বের মধ্যে আলোচনা শেষ করতে পারব। প্রথম পর্বে ভূমিকা থাকল। এর পর, কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহার, চিত্রকল্পের বিবর্তন, মূর্ত, বিমূর্ত ও উত্তরাধুনিক চিত্রকল্প, চিত্রকল্পের মানসিক অভিঘাত, চিত্রকল্প ব্যবহারের কৌশল ও নানা দিক প্রভৃতি আলোচনার ইচ্ছা থাকল। ক্রমবর্ধমান পড়াশোনার চাপ ও নিজের কিংবদন্তি-পর্যায়ের আলস্যের কথা মনে রেখেও শুরু করলাম! দেখা যাক।

চিত্রকল্প: There are pictures in poems and poems in pictures [Chinese Proverb]

চিত্রকল্প শব্দটি বাংলায় সাধারণত Image এর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাহিত্য সমালোচকদের কেউ কেউ image-এর অন্য বাংলা প্রতিশব্দ প্রস্তাব করেছেন, যেমনঃ সুশীলকুমার গুপ্ত ‘ভাবরূপচিত্র’ সত্যেন্দ্রনাথ রায় ‘মানস প্রতিবিম্ব’ অমলেন্দু বসু ‘বাকপ্রতিমার এছাড়া ‘বানী শিল্প’ ‘রূপকল্প’ ‘শব্দকল্প’ ইত্যাদি নামও পাওয়া গেছে। তবে চিত্রকল্প নামটিই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বেশি।

উইন্ডহ্যাম লুইস চিত্রকল্পকে কবিতার ‘Primary pigment‘ অর্থাৎ প্রাথমিক রঞ্জক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার চিত্রকল্পকে কবিতার প্রাণ বলে অভিহিত করেছেন স্টিফেন জে. ব্রাউনঃ This must surely be obvious as regards poetry: imagery is its very life.

কবিরা খুবই সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। কবির সংবেদনের গভীরে লুকিয়ে থাকে অভিজ্ঞতার নির্যাস ও সৃষ্টিশীল আকাঙ্ক্ষা। এই অভিজ্ঞতা যখন অসাধারণ শব্দচিত্রের মাধ্যমে কবিতায় বহুমাত্রিক বোধ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয় তখনই তাকে চিত্রকল্প বলে অভিহিত করা যায়।
চিত্রকল্প নিয়ে আলোচনার আগে এর ইতিহাস আগে দেখে নেয়া যেতে পারে।

চিত্রকল্পের ধারনা
চিত্রকল্পের ধারনাটি এসেছে আধুনিক সময়ে। প্রাচীন আলংকারিক ভাষার চিত্রধর্মিতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, বর্নাঢ্য চিত্রকল্পের জন্মও দিয়েছেন। কিন্তু তারা চিত্রকল্পের চরিত্র নিয়ে ভেবেছেন বা ব্যাপক নিরীক্ষা করেছেন বলে মনে হয় না। চিত্র সৃষ্টির প্রবণতা বহু প্রাচীন। প্রাচীন কবি বক্তব্যের বিষয়টিকে অলংকারপূর্ণ মাহাত্ম্যে পরিবেশন করার জন্য শব্দচিত্র সৃষ্টি করেছেন। একটি প্রাচীন কবিতায় আছে:

স্তন যুগমশ্রুস্নাত সমীপতরবর্ত্তি হৃদয়শোকাগ্নে।
চরতি বিমুক্তাহারাং ব্রতমিব ভবতো রিপুস্ত্রীনাম।।
অর্থাৎ হৃদয়ে যে শোকের আগুন জলছে তার খুব নিকটবর্তী ও হারবিমুক্ত এবং অশ্রু স্নাত স্তন যুগল যেন নিজের শত্রু-স্ত্রীদের বৈধব্য ব্রত পালন করছে।

প্রাচীন কবিতায় কাহিনীর প্রয়োজনে প্রচুর শব্দ চিত্র আকতে হয়েছে কবিদের। কিন্তু চিত্রকল্পকে কেন্দ্র করে প্রথম কাব্য-আন্দোলনের সূত্রপাত হয় পাশ্চাত্যে ১৯০৮ সালে। বিশ শতকের শুরুরর দিকে ইল্যান্ডে এজরা পাউন্ডের নেতৃত্বে আন্দোলন ঘটে তাকে সমালোচকেরা ইমেজিসম বা চিত্রকল্পবাদ বলে থাকেন। টি. ই হিউম ছিলেন পাউন্ডের প্রধান সহযোগী। এছাড়া উইন্ডহাম লুইস, এমি লোয়েল, হ্যারিয়েট মনরো এর সহ অনেকে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।

ইমেজিস্ট কাব্য আন্দোলনের সাথে জড়িতরা কবিতার বিষয় ও আঙ্গিক সম্পর্কে নির্দিষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। সাহিত্যের একটি বিশ্বকোষ চিত্রকল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এজরা পাউন্ডের বক্তব্য তুলে ধরেছে:
1. Direct treatment of the ‘thing’ whether subjective or objective
2. To use absolutely no word that does not contribute to the presentation
3. As regarding rhythm: to compose in the sequence of the musical phrase, not in the sequence of a metronome.
(ইশতেহার দিয়ে সাহিত্য বা কবিতা হয় কিনা,সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। আমাদের আলোচনা যেহেতু, ইমেজ বা চিত্রকল্প কেন্দ্রিক তাই ইমেজিস্ট মুভমেন্ট সম্পর্কে উল্লেখ করা)
১৯১৩ সালের মার্চে এফ. এম. ফ্লিন্ট এবং এজরা পাউন্ড মার্কিন পত্রিকা ‘পোয়েট্রি’র পাতায় উপর্যুক্ত আন্দোলনের মূলনীতি প্রকাশ করেন। তারা কবিতায় বস্তুগত বা ভাবগত যেকোন বিষয়ে শব্দের প্রত্যক্ষ ও শব্দের সঠিক ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন।

ইমেজিস্টদের প্রতিনিধিত্বমূলক দুটি কবিতা দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রায়শই উল্লেখ করা হয়ঃ
A touch of cold in the autumn night
I walked abroad,
And saw the ruddy moon lean over a hedge
like a red faced farmer.
I didn’t not stop to speak, but nodded;
and round about were the wishful stars
with white faces like town children.
[T. E. Hulme, Autumn]
শীতের আলতো ছোঁয়া হেমন্তের রাতে
বাইরে হাঁটছিলাম আমি
দেখলাম টুকটুকে চাঁদ
লালমুখো চাষীর মতো,
আমি তাকে থামতে বলিনি কথা বলতে
তবে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম শুভরাত্রি
শহরের শিশুদের মত শুভ্র মুখ
চারদিকে তৃষ্ণার্ত নক্ষত্র।
(হুমায়ুন কবির-এর অনুবাদ অনুসরণে সরকার আমিনের অনুবাদ)

ইমেজিস্ট আন্দোলনের সদস্য এডোয়ার্ড স্টোরার কবিতাঃ

Forsaken Lovers,
Burning to a chase white moon,
Upon storage pyres of loneliness and drought.
পরিত্যক্ত প্রেমিকেরা
সহজ শুভ্র চাঁদের নিচে
একাকিত্ব ও শুষ্কতার আধার চিতার ওপর জ্বলছে।
(হুমায়ুন কবির-এর অনুবাদ অনুসরণে পোস্ট দাতার অনুবাদ)

উপর্যুক্ত দুটি কবিতাই ইমেজিস্টদের মানসিকতাকে প্রকাশ করে। আরো প্রকাশ করে চিত্রকল্পের অনেক বৈশিষ্ট্য যেমনঃ কবিতায় শব্দে আঁকা চিত্রমাত্রই চিত্রকল্প নয়। ‘চিত্রশিল্প যেমন শুধু চোখকে তৃপ্ত করে না, উদ্বুদ্ধ করে কল্পনাকেও, জন্ম দেয় তৃতীয় মাত্রার- চিত্রকল্পও তেমনি তৃতীয় মাত্রার জনয়িতা’ তার মানে চিত্রকল্পের চিত্রাতীত নান্দনিকতা ও চিত্রাতীত বাস্তবতা থাকে। সেনসিবিলিটি, সময় চেতনা, চিন্তার নরম আলো থাকে উৎকৃষ্ট চিত্রকল্পের মধ্যে।

চিত্রকল্প ও প্রতীক
চিত্রকল্প ও প্রতীকের মধ্য মিল থাকলেও এরা আলাদা। যে কোন শব্দই সংকেতের কাজ করে। প্রতীকের করে, আরো ফোকাসড হয়ে। কিন্তু প্রতীকের মধ্যে গতিশীলতা নাই, যা আবার চিত্রকল্পের প্রাণ। এছাড়া চিত্রকল্পের উদ্বুদ্ধকরণ শক্তি অনেক বেশি। চিত্রকল্পের সাংকেতিক ক্ষমতাও বেশি কেননা এর রয়েছে দৃশ্য নির্মাণের প্রশস্ত ভূমি।

চিত্রকল্প আলাদা কোন অলংকার নয়:
অনেকে চিত্রকল্পকে আলাদা একটি অলংকার বিবেচনা করলেও চিত্রকল্প আলাদা কোন অলংকার নয়। বরং এটি একাধিক অলংকারের নির্যাস। চিত্রকল্পে থাকতে পারে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ইত্যাদি অর্থালংকার থাকতে পারে থাকতে পারে যেকোন শব্দালংকারও। তবে কবিদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় একটি সাদৃশ্য মূলক অলংকার উপমা, কারন এই অলংকারের রয়েছে চিত্রময়তা ও অন্তর্গত ভাবকে মূর্ত করার অনুপম ক্ষমতা। তাই চিত্রকল্পকেও উপমার ব্যবহার বেশি।

চিত্রকল্পকে সবসময় দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোন কথা নেই:
দৃশ্যমানতা চিত্রকল্পের সবচেয়ে বড় গুন হলেও চিত্রকল্পকে সবসময় প্রকটভাবে দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু চোখ নয়, কান, জিভ ও স্পর্শ ইন্দ্রিয় ও অনুপ্রেরণা পারে জাগাতে। এমনকি মানুষের বিশ্বাস ও যাপন থেকেও অস্পষ্ট, বিমূর্ত অবয়ব কিন্তু যা বোধ ও চেতনাকে স্পর্শ করে যায় এমন চিত্রকল্প সৃষ্টি হতে পারে। এমন কি একই সাথে একাধিক সংবেদী অঙ্গকে ছুঁয়ে যেতে পারে কবির বোধ। (ইংরেজিতে একে বলে Synesthesia, বাংলায় কি বলে জানি না, জানলে জানান প্লিজ) যখন কেউ বলে, তোমার ‘গলাটা ভারী শোনায়’ কিংবা কারো ‘শীতলকণ্ঠ’ এর কথা বলে তখন কিন্তু একাধিক সংবেদী অঙ্গের অনুভূতিই আমরা পাই। এমিলি ডিকিনসনের’ ‘Light laughs the breeze in her castle of sunshine’ লাইনটি অথবা এডিথ সিটওয়েলের ‘dull blunt wooden stalactite / Of rain creaks, hardened by the light. পড়লে আমরা টের পাই সিনেস্থিসিয়ার ব্যবহার। জীবনানন্দ যখন চিলের ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ’ মুছে ফেলার কথা শোনান, কিংবা বলেন, ‘…নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার’ কিংবা ‘ধূসর চালের গন্ধে তরঙ্গেরা ঝরেছে দুবেলা’ তখনও একই ভাবে সিনেস্থিসিয়ার ব্যবহার উপলব্ধি হয়।

এটা ঠিক যে শুধুমাত্র চিত্রকল্প তৈরির উৎকর্ষই কবিতাকে উৎকৃষ্ট কবিতা বানায় না কিন্তু বেশির ভাগ আধুনিক কবিতায় চিত্রকল্পের নৈপুণ্য দেখা যায় কোন না কোন ভাবে। কবিতার অন্যান্য উপাদানের সাথে চিত্রকল্পের ব্যবহার তাই গুরুত্ব বহন করে।

কবিতাকে মনে করি শিল্পের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। কবিতা কী? কবিতা কাকে বলে ? এখন আর এসব প্রশ্ন ভাবার অর্থ আছে বলে মনে হয় না। তবে কবিতায় নিজের কৌতূহলের কারনে কবিতার যাবতীয় উপাদান, কাজকারবার, পাঠকের মানসিক অভিঘাত, ছন্দ ও অলঙ্কারের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে পড়তে, জানতে, শিখতে, বুঝে নিতে আগ্রহী। ব্লগে এ আলোচনার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, যা বুঝতে চেয়েছি শুধু তা শেয়ার করা, বরং ধারনা গুলোকে যাচাই করে নেয়া, সহ ব্লগারদের থেকে নতুন কিছু জানা.

তথ্যসূত্র 
The world of imagery ,Stephen J. Brown
The poetic image, C. Day Lewis
বাংলাদেশের কবিতায় চিত্রকল্প, বাংলা একাডেমী প্রকাশিত।
The struggle of the modern, Stephen Spender
Discovering poetry, Elizabeth Drew
নির্বাচিত প্রবন্ধ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ।

[এই তথ্যসূত্র খুব একটা ভ্যালিড না, কারন লেখার সময় দু'একটা ক্ষেত্র ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্মৃতি থেকে টুকটাক তথ্য নেয়া হয়েছে, বিভিন্ন উৎস ঠিক ঠাক মনে থাকার কথা না। তবে বইগুলো প্রাসঙ্গিক এবং ভাল বই সেই হিসেবে নাম করা যায়]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন