ফরাসি কবি ও কবিতার ভাবধারা

মাইনুল ইসলাম মানিক

শিল্প ও সাহিত্যের তীর্থভূমি ফ্রান্স। এখানে শিল্প ও সাহিত্যের অসংখ্য আন্দোলন গড়ে ওঠার পর তা ছড়িয়েছে জগৎজোড়া। ফরাসি সাহিত্য তথা ফরাসি কবিতা প্রাচুর্যতাগুণে দুনিয়াজোড়া পাঠকের কাছে সমাদৃত নানা মাত্রায়। টিএস এলিয়ট বলেন,‘আমার ভেতর নিজস্ব কণ্ঠস্বর তৈরীতে যে ধরণের কবিতা পাঠ করা প্রয়োজন ছিলো, সে রকম কবিতা ইংরেজিতে ছিলো না মোটেও, ছিলো ফরাসি কবিতায়।’ কবিতা ফরাসি সাহিত্যের সুপ্রাচীন একটি শাখা হলেও মূলত ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিক হতে ফরাসি কবিতার স্বর্ণযুগ শুরু হয় এবং বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা বিরাজ করে। আধুনিক কবিতায় প্রতীকবাদ বা সিম্বলিজমের যে বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়, তা ঐ সময়ের ফরাসি কবিদের হাত ধরেই কবিতার উঠোনে প্রবেশ করে। ফরাসি কবি গিওম অ্যাপলেনিয়ার প্রথম স্যুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদের সূচনা করেন। ইংরেজ কবিদের কাছ থেকে লাভ করা ক্লাসিসিজম বা রোমান্টিসিজমকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি তাঁরা ক্লাসিসিজম ও রোমান্টিসিজমের সমন্বয়ে এক অভিনব ধারাও সূচনা করেন। এলিয়টের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী মুক্তছন্দের বিস্তার ঘটলেও মূলত ফরাসি কবি জ্যুল লাফর্গ প্রথম মুক্তছন্দের সূচনা করেছিলেন। এছাড়াও এসময় ন্যাচারালিজম, কিউবিজম, অর্ফিজমসহ অসংখ্য আন্দোলন গড়ে ওঠে। এভাবেই ফরাসি কবিতার হাত ধরে বিশ্বময় কবিতায় আসে বহুমাত্রিক প্রাচুর্যতা।

ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়া যুদ্ধের পর মোঁপাসার গল্প জার্মানদের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম দিলেও ফ্রান্সের জনগন ইংরেজদের বিরুদ্ধে দুটি কারণে সে পরিমান ঘৃণা অনুভব করেনি। কোনোরকম প্রাণহানি বা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি না ঘটিয়ে তারা নেপোলিয়নকে পরাস্ত করেছিলেন, এমন কোনো কারণ এক্ষেত্রে খুব একটা বিবেচ্য নয়। মূলত ইংরেজদের সাহিত্য তখন সমগ্র ইউরোপের জন্যে এক অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে ওঠেছিলো। তাদের একজন শেলী, একজন বায়রন ছিলো। ছিলো কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো কবি। ফরাসি কবিরাও সে প্রভাবের বাইরে যেতে পারেননি। তাই ইংরেজ বিরোধী কোনো ভাবাদর্শ তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। ইংরেজ কবিদের দ্বারা চরমভাবে প্রভাবিত হলেও একটা সময় ফরাসি কবিরা ধীরে ধীরে সে প্রভাব বলয় ছিন্ন করেছেন, তৈরী করেছেন নিজস্ব কক্ষপথ। ফরাসি কবিতার উঠোনে দাপিয়ে বেড়ানো কবিদের মধ্যে হুগো, গঁতিয়ে’ মালার্মে, ভের্লেন, বোদলেয়ার, র‌্যাবো, ভেলেরি, নেরভাল, অ্যাপলেনিয়ার, প্রুধম ও মিস্ত্রালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ঊনিশ শতকের শুরুতে ভিক্টর হুগোর হাত ধরে ফরাসি কবিতার জগতে রোমান্টিক ধারার যাত্রা লাভ করে। এধারাটিকে আরো সমৃদ্ধ করেন নেরভাল, তিয়োফিল গঁতিয়ে, আলফ্রেদ দ্য ম্যুসে‘র মতো কবিগন। হুগো ছিলেন নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সন্তান। মাত্র বিশ বছর বয়সে ‘ওড অ্যাট পোয়েজিস ডাইভারসেস’ লিখে সমগ্র ফ্রান্সে সাড়া ফেলে দেন। এই কাব্যটির জন্যে মাত্র বিশ বছর বয়স হতেই তিনি রাজকীয় সম্মানী পেতেন। কিন্তু বইটি ব্যাপকার্থে সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়তে পারেনি। মূলত ১৮২৬ সালে তাঁর ‘ওডস অ্যাট বালাডস’ প্রকাশিত হলে তিনি সমালোচকদের সহানুভূতি লাভ করেন। এই বইটি প্রকাশের পর তিনি কবিখ্যাতি লাভ করেন এবং ফরাসি কবিতার জগতে রোমান্টিক ধারার প্রবর্তন ঘটে। তাঁর ‘লা কনটেম্পেশন্স’ এবং ‘লা লিজেন্ড ডেস সাইফলস’ গ্রন্থ দুটি ফরাসি কবিতার জগতে রোমান্টিক ধারার ভিত্তিমূলকে আরো সুসংহত করে। তিনি ফরাসি কবিতায় রোমান্টিক ধারার প্রবর্তক হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এমনকি তিনি ফরাসি রাজপরিবারের নৈকট্যও লাভ করেছিলেন। রাজপরিবারের নৈকট্য পাওয়ার পর তিনি সার্বজনীন ভোটাধিকার, বিনা খরচে পড়াশোনা এবং মৃত্যুদ- রদ করা নিয়েও কাজ করেছিলেন। কিন্তু ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট নিজেকে স¤্রাট ঘোষণা করলে হুগোকে দুই দশকের জন্যে ব্রিটিশ চ্যানেলের একটি দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কাব্যপ্রতিভার পাশাপাশি আরো দুটি তথ্য সংযোজন না করলে হুগোর প্রতি অবিচার হতে পারে। হুগো ছিলেন প্রতিভাবান চিত্রকর এবং তিনি প্রায় চার হাজার চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি কতোটা সফল, তাঁর ‘লা মিজেরাবল’ সে সাক্ষ্য দেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। সাহিত্যকর্ম দিয়ে ফরাসির মানুষকে তিনি এতোটা ঘোরের মাঝে রেখেছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর বিশ লাখ মানুষ তাঁর কফিন বহন করার জন্যে রাস্তায় নেমে এসেছিলো।

অৎঃ ভড়ৎ ধৎঃ’ং ংধশব বা ‘শিল্পের জন্যে শিল্প’ মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন তিয়োফিল গঁতিয়ে। লেখালেখির প্রথম দিকেই বিখ্যাত লেখক নেরভালের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে গঁতিয়ের। নেরভাল তাঁকে হুগোর কাছে নিয়ে যান এবং পরিচয় করিয়ে দেন। হুগোর দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছিলেন গঁতিয়ে। তিনি বিভিন্ন সময়ে এই সত্যটি স্বীকারও করেছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় তিনি নিজের পথটি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতেন, জগতের পরিবর্তন সাধন কবির কাজ নয়। সীমাহীন যুক্তির গুমোট ভেঙে কবিতাকে জ্ঞান, উপদেশ ও হিতৈষণার ভারমুক্ত করে স্বপ্রতিষ্ট করাই ছিলো তাঁর লক্ষ্য। রোমান্টিকতার লক্ষ্যই ছিলো কবিতাকে পা-িত্যের সংলাপ থেকে বের করে এনে স্বাধীন ও শিল্পিত করে তোলা। রোমান্টিক ধারাকে মনে ও মননে ধারণ করে আঠারো শতকের উচ্ছিষ্টের উপর দাঁড়িয়ে কবিতার বাঁক বদলের অন্যতম পুরোধা হতে পেরেছিলেন তিনি।

রোমান্টিক কবিদের কবিতা দ্রষ্টার গুণে দরিদ্র না হলেও তাতে আবেগের প্রবহণ ছিলো অসীম। তাই অকবিতার চাপে সেগুলো মন্ময়তা ও মনোমুগ্ধতার স্তর ছাড়িয়ে বেশি দূর এগোতে পারেনি। তাদের এই সীমাবদ্ধতা প্রথম অনুভব করেছিলেন শার্ল বোদলেয়ার। কাব্যকলায় রোমান্টিসিজম ও ক্লাসিসিজমের সমন্বয়ে রবীন্দ্রনাথ কিংবা গ্যেটের মতো প্রতিভাবানরা সম্পূর্ণরূপে উতরে যেতে না পারলেও বোদলেয়ার সফল হয়েছিলেন। ক্লাসিক ও রোমান্টিকের চিরাচরিত দ্বৈতকে লুপ্ত করে তিনি এদের মধ্যে গড়ে দেন এক শুদ্ধতম শিল্পবন্ধন । অ্যাঁতুর র‌্যাবো বোদলেয়ারের মৃত্যুর চার বছর পর লিখেছিলেন, ‘তিনি প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের স¤্রাট, এক সত্য দেবতা।’ ১৮৫৭ সালে বোদলেয়ার প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘ফ্লর দ্যু ম্যাল’। এই কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে পল ভের্লেন মন্তব্য করেছিলেন, এটি ‘অলৌকিক শুদ্ধতাসম্পন্ন’। আঁদ্রে জিদ লিখেছিলেন, ‘যে জীবন এক অভূতপূর্ব শুদ্ধতা আর পবিত্রতায় ঢেকে গিয়েছিলো, তার প্রথম মন্ত্রোচ্ছারণ শুরু হয়ে গেছে।’ পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে তাকে নতুনভাবে চেনালেন উইসম্যান্স, লামেৎর, লাফর্গের মতো কবিগণ। বোদলেয়ারের অনুরণন শুধুমাত্র ফরাসি সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা সংক্রমিত হয়েছিলো খোদ ইউরোপেও। পশ্চিমা কবিতায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘুরেফিরে আসে বোদলেয়ারের কবিতার নির্যাস। বোদলেয়ারের কবিতা সীমাবদ্ধ থাকেনি শুধু সাহিত্যেও। রদাঁ, মাতিস ও রুয়োর মতো চিত্রকরগণ তাঁর কবিতা অবলম্বনে অসংখ্য বিখ্যাত ছবি এঁকেছিলেন। বোদলেয়ারের মতো বিশ্বময় আরো কোনো ফরাসি কবি আজ পর্যন্ত এতো জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। পৃথিবীর বহু দেশে বহু ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে, হচ্ছে এখনো। খোদ ইংরেজি ভাষায় এপর্যন্ত তাঁর কোনো কোনো কবিতা কয়েক শতাধিক বার পর্যন্ত অনূদিত হয়েছে। লন্ডনে রাইমার্স ক্লাবের গোড়াপত্তনের মূলমন্ত্র হিসেবে ইয়েটস গ্রহণ করেছিলেন, ‘যা কিছু কবিতা নয়, তা থেকে কবিতাকে মুক্তি দিতে হবে। লিখতে হবে ভের্লেন ও বোদলেয়ারের মতো।’ ইয়েটস ফরাসি জানতেন না । আর্থার সাইমন্স তাঁর স্বকৃত বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদ শোনাতেন তাকে। এভাবেই ফরাসি কবিতা হতে নিজের আকাঙ্খিত বিষয়গুলো শিখে নিয়েছিলেন ইয়েটস।

বোদলেয়ারের কবিতায় কোনো নতুন ধারার প্রবর্তন হয়নি, প্রকরণ ও বিষয়বস্তুতেও খুব বৈচিত্র্য নেই একথা অনস্বীকার্য। তিনি গঁতিয়ে বা মালার্মের মতো কোনো গোষ্ঠিীর গুরুও নন। পাউন্ড বা এলিয়টের মতো তিনি কোনো আন্দোলনেরও পুরোধা নন। কিন্তু কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি মানবসত্ত্বার গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। তাঁর অন্বেষণ ছিলো দূরস্পর্শী। তিনি কীটস, শেলীদের মতো করে নিজের দুঃখের কারণ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চাননি। তিনি দুঃখের কারণ হিসেবে নিজেকেই ভাবতেন এবং দুঃখকে জীবনের জন্যে অনিবার্য প্রয়োজন হিসেবে অনুভব করেছিলেন। মানুষের অস্থির সত্ত্বাকে তিনি দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। তিনি ছাড়া আর কেইবা বলতে পারে ,‘নিরন্তর আমার মনে হয় আমি যেখানে আছি সেখানে ছাড়া অন্য কোথাও সুখী হতে পারি।’ বোদলেয়ার তুলে এনেছিলেন খুনী, মাতাল, লম্পটসহ প্রায় সকল স্তরের মানুষকে। বোদলেয়ার চাইতেন, মানুষ তার স্বরূপ জানুক। সকলে জানবে না, জানতে চাইবে না, না জানুক। কিন্তু কবিরা জানুক। এভাবেই মূলত বোদলেয়ার আধুনিক সাহিত্যের অভিজ্ঞান স্পষ্ট করে গেছেন।

বোদলেয়ার কর্তৃক ‘ফ্লর দ্যু ম্যাল’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সিম্বলিজমের সূচনা হলে স্তেফান মালার্মে দারুণভাবে আকৃষ্ট হন। তিনিও হয়ে ওঠেন অন্যতম সিম্বলিস্ট পোয়েট। মালার্মের বিষাদঘন পারিবারিক জীবন তাঁর সাহিত্যকর্মে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মা‘কে হারানোর পনের মাস পর বাবা আবার বিয়ে করেন। বয়স পনের হতে না হতেই বয়সে দু‘বছরের ছোট একমাত্র বোনটির মৃত্যু হয়। একুশে পা রাখার পর হারান বাবাকে। এর কিছুদিন পরই লিখেন ‘লা ফ্যানেট্রেস’। বিষাদ বেদনা আক্রান্ত বাস্তব পৃথিবী থেকে বেরিয়ে মালার্মে চাইতেন সুখ ও সুন্দরের কাল্পনিক পৃথিবী। ‘লা ফ্যানেট্রেস’ এর প্রথম অর্ধেকে তুলে এনেছেন একজন মৃতপ্রায় মানুষের কক্ষ হতে জানালার বাইরের মুক্ত আকাশ দেখার প্রচেষ্টা। তিনি নিজেই বিশ্বাস করতেন,‘চড়বঃৎু রং ঃযব ষধহমঁধমব ড়ভ ধ ংঃধঃব ড়ভ পৎরংরং.’ মালার্মে বাস করতেন প্যারিসের রু দ্য রুম সড়কের একটি বাড়িতে। বাড়িটিতে নিয়মিত সালোন বসতো। সালোন ফরাসি ভাষার শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে আড্ডা। প্রতি মঙ্গলবার সমমনা লেখক, শিল্পী, সমালোচকদের নিয়ে আড্ডা বসতো মালার্মের বাড়িতে। আইরিশ কবি ইয়েটস, জার্মান কবি রিলকে, ফরাসি কবি পল ভালোরি, গঁতিয়ে, আঁদ্রে জিদ, স্তেফান জর্জ, চিত্রশিল্পী এদওয়ার্দ মানেসহ অসংখ্য গুণীজন অংশ নিতেন আড্ডায়। আড্ডার মধ্যমনি ছিলেন মালার্মে। তিনি অনর্গল কথা বলতেন শিল্প ,সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে। ফরাসি ভাষায় মঙ্গলবারকে বলা হয় ‘মারদি’। তাই মঙ্গলবারের আড্ডায় যারা অংশ নিতেন তাদেরকে বলা হতো ‘মারদিসতেস’। মালার্মের বাড়িটি হয়ে উঠেছিলো শিল্প সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র। প্রতীকবাদী আন্দোলনকে বাস্তববাদের বিরুদ্ধে প্রবল দ্রোহে রূপ দিয়েছিলেন মালার্মে। ফরাসি প্রতীকবাদী সাহিত্যের অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে মালার্মের ‘দ্য আফটারনুন অব অ্যা ফাউন’ কবিতাটি। রোমান মিথ অনুযায়ী লিখিত এই কবিতাটিতে এক বিকেলে ফাউনের ঘুম ভেঙে যায়। ফাউন হলো নির্জন স্থানের অপদেবতা। সে সমুদ্রপরীদের সাথে সাথে যৌন সংলাপের বর্ণনা দেয় স্বগত সংলাপের মধ্য দিয়ে। এই কবিতাটি নিয়ে ক্লদ দেবসি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ গদ্যটি লিখেছিলেন। মালার্মের শিল্পদর্শন পরবর্তী যুগের দাদাবাদ ও স্যুরিয়ালিজমকেও প্রভাবিত করেছিলো।

প্রতীকবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন অ্যার্তুর র্যাঁবো। লেখালেখি শুরু করেছিলেন ষোল বছর বয়সে। একুশ বছর বয়সে লেখালেখি ছেড়ে দেন চিরতরে। মাত্র পাঁচ বছর লিখলেন। এত কম সময় লেখালেখির মাধ্যমে পৃথিবীতে আর কোনো সাহিত্যিক এতোটা আলো ছড়াতে পারেননি। মাত্র ষোল বছর বয়সে লিখেছিলেন ‘অ্যা সিজন ইন হেল’। কৈশোরকালের পীড়নের উচ্ছ্বাস থেকে এটি লিখেছিলেন এক নতুন জগৎ বিনির্মানের প্রচেষ্টা হিসেবে। কিন্তু তাঁর সমূহ প্রচেষ্টার ব্যর্থতার দলিল হয়ে আছে এটি। র্যাঁবোর এই বইটি বারুদে ঠাসা আগুনের মৃদুকম্পন। এরকম র্দাশনিকতা সমৃদ্ধ সাহিত্যকর্ম আসে আমাদের কল্পনাকে ছাড়িয়ে কালেভদ্রে। অপ্রত্যাশিত গোলেযোগের মতো। এমন কিছু মর্মপীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা র্যাঁবোকে ‘অ্যা সিজন ইন হেল’ লিখতে বাধ্য করেছিলো যেখানে তিনি জীবনকে দেখেছিলেন অন্য কোনো ভাবে, অন্য কোনো রূপে। আর এই কাব্যটি তাঁর জীবনের সমস্ত অতীতকেই দাঁড় করিয়ে দেয় প্রশ্নের মুখোমুখি। ষোলতম জন্মদিনের প্রাক্কালে র্যাঁবো প্যারিসে এসে দেখা করেন একুশে পা রাখা তরুন কবি ভের্লেনের সাথে। ভের্লেন স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে রেখে র্যাঁবোর সাথে উঠেন পশ্চিম তীরের ভাড়া করা বাড়িতে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের এক উশৃঙ্খল জীবন যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো মধ্যরাত, মদ, ড্রাগ আর সমকামিতা। উশৃঙ্খলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের সম্পর্কের তিক্ততাও বাড়তে থাকে। দুই বছর পর একদিন ভের্লেন র্যাঁবোকে হত্যার চেষ্টাও করেন। এতে র্যাঁবো সামান্য জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যান। হত্যা চেষ্টার অপরাধে ভের্লেন দুই বছরের সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হন। র‌্যাঁবো এরপর তার মায়ের খামারে ফিরে এসে ‘অ্যা সিজন ইন হেল’ বইটি লেখা সমাপ্ত করেন। পরবর্তী তিন বছরে তিনি ‘দ্য স্লিপার ইন দ্য ভ্যেলি’ ছাড়াও আরো বেশ কিছু বিখ্যাত কবিতা লিখেন। বয়স একুশ পেরুবার পর আর তিনি কখনোই কলম হাতে তুলে নেননি। জড়িয়ে পড়েছিলেন পুঁজিবাদের ফাঁদে। সওদাগরী, অ¯্র পাচার, এমনকি, দাস ব্যবসার সাথেও জড়িয়ে পড়িেছলেন। সাইত্রিশ বছর বয়সে তিনি যখন মারা যান, তখন তাঁর কোমরে জড়ানো মানিবেল্টে সারাজনমের সঞ্চিত সামান্য লাভের টাকা পাওয়া গিয়েছিলো।
পল ভের্লেন প্রথমে রোমান্টিসিজম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তুমুলভাবে। তিনি মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে রোমান্টিক কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন হুগোর কাছে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রতীকবাদী কবি মালার্মে এবং অ্যাতুর র্যাঁবোর সান্নিধ্যে এলে তাঁর কবিতা এক অভিনব ধারায় রূপ নেয়। তিনি রোমান্টিসিজম ও সিম্বলিজমের সমন্বয়ে এক নতুন ধারার গীতিকবিতার সফল সূচনা করেন। এই ধারাটিকে তিনি ‘আর্ট পোয়েটিকা’ নামে অভিহিত করেন। প্রতিভাবান ভের্লেন মাদক, অ্যালকোহল ও দরিদ্রতায় এক বিপর্যস্ত জীবনযাপন করেছিলেন। হাসপাতালে দীর্ঘবাসের পর একান্ন বছর বয়সে মারা যাওয়া ভের্লেন রেখে গেছেন অসাধারণ কিছু গীতিকবিতা।
অক্সিটান তথা প্রোভঁসাল সাহিত্যের পুনরুজ্জীবনের জন্যে কাজ করেছিলেন ফরাসি কবি ফ্রেডেরিখ মিস্ত্রাল। তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিলেন আরো বেশ কয়েকজন তরুণ কবি। তারা সবাই মিলে শুরু করেন ফরাসি সাহিত্য বিপ্লব। মিস্ত্রালকে এজন্যই ‘ঈযধসঢ়রড়হ ভড়ৎ ৎবংঃড়ৎরহম ভরৎংঃ ষরঃবৎধৎু ষধহমঁধমব ড়ভ পরারষরুবফ ড়িৎষফ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। মিস্ত্রাল একটানা বিশ বছর চেষ্টার পর একটি প্রোভঁসাল শব্দকোষ তৈরী করেন। এই সময়ে তিনি রচনা করেন ‘মিরেইও’ মহাকাব্যটি। এরপর একে একে আরো তিনটি মহাকাব্য লিখেন তিনি। অক্সিটান সাহিত্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম না হলেও মিস্ত্রাল একটি নিজস্ব কবিতার ভাষা তৈরী করতে পেরেছিলেন। কবিতায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সাহিত্যে ১৯০৪ সালে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁকে নোবেল দেয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটির ব্যাখ্যা হচ্ছে,‘ ওহ ৎবপড়মহরঃরড়হ ড়ভ ঃযব ভৎবংয ড়ৎরমরহধষরঃু ধহফ ঃৎঁব রহংঢ়রৎধঃরড়হ ড়ভ যরং ঢ়ড়বঃরপ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ, যিরপয ভধরঃযভঁষষু ৎবভষবপঃং ঃযব হধঃঁৎধষ ংপবহধৎু ধহফ হধঃরাব ংঢ়রৎরঃ ড়ভ যরং ঢ়বড়ঢ়ষব, ধহফ, রহ ধফফরঃরড়হ, যরং ংরমহরভরপধহঃ ড়িৎশ ধং ধ চৎড়াবহপধষ ঢ়যরষড়ষড়মরংঃ.’
ফরাসি কবিতার আলোচনায় কবি সুলি প্রুধোমের নাম অনিবার্যভাবে উঠে আসে। ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে ফরাসি কবিতা যখন রোমান্টিকতার চর্চায় ভরপুর, নতুনত্বের প্রয়োজনীয়তা তখন আবশ্যক হয়ে ওঠে। এই আবশ্যক প্রয়োজনীয়তা প্রুধোমই প্রথম অনুভব করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞান ও দর্শনের সমন্বয়ে এক শক্তিশালী নিজস্ব রচনাশৈলী তৈরী করতে পেরেছিলেন। ১৮৬৬ সালে তাঁর প্রথম কাব্য ‘ঝঃধহুধং ড়ভ ঢ়ড়বসং’প্রকাশ হলেও চার বছর পরই মূলত তাঁর ব্যক্তিগত ও সাহিত্য জীবনে এক নাটকীয় মোড় নেয়। ১৮৭০ সালেই তিনি তাঁর মা, একমাত্র বড় বোন এবং যে চাচার কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা সবাই পর্যায়ক্রমে মারা যান। একই বছরে স্বজন ও প্রেমিকাকে হারানোর বেদনা নিয়ে তিনি ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ার যুদ্ধে যোগ দেন। সেবছরই যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর ভুল চিকিৎসায় তিনি সারা জীবনের জন্যে পঙ্গু হয়ে যান। এসব বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে একই বছরে লিখেছিলেন তাঁর সাড়া জাগানো কাব্য ‘ইমপ্রেশানস্ অব ওয়ার’। এরপর আরো দুই দশক অবিরত চলতে থাকে তাঁর কলম। ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার চালু হলে প্রথম সাহিত্যিক হিসেবে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের মর্যাদা লাভ করেন।

ফরাসি কবিদের মধ্যে জ্যুল লাফর্গ প্রথম মুক্তছন্দে কবিতা লিখেন। ১৮৮০ সালের শেষের দিকে তিনি মুক্তছন্দে বেশ কিছু কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সিম্বলিজম দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হলেও তিনি সিম্বলিজম ও ইম্প্রেশনিজমের সমন্বয়ে কবিতায় একটা নিজস্ব ধারা তৈরী করেছিলেন। এজন্য অনেক সাহিত্যবোদ্ধাই তাঁকে ‘হাফ-সিম্বলিস্ট’ ও ‘হাফ-ইম্প্রেশনিস্ট’ হিসেবে অভিহিত করতেন। তাঁর কবিতার শৈলী পৃথিবীর খ্যাতনামা সাহিত্যিকদেরকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলো। এলিয়ট তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই মুক্তছন্দে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। এলিয়ট তাঁর প্রথম জীবনের লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন,‘১৯০৮-০৯ সালের দিকে আমি যে আঙ্গিকে লেখা শুরু করি, তা আমার ভিতরে এসেছে সরাসরি লাফর্গ পাঠ থেকে এবং এলিজাথেীয় নাটক পাঠ হতে। আর কেউ এমন একটি জায়গা থেকে শুরু করেছেন কি না আমার জানা নেই।’ ১৮৮৫ সালে লাফর্গ লিখেছিলেন খ’রসরঃধঃরড়হ ফব ঘড়ঃৎব-উধসব ষধ খঁহব কাব্যটি লিখেন। সাহিত্যবোদ্ধারা এটিকে তাঁর মাস্টারপিস হিসেবে অভিহিত করেন। লাফর্গের মাত্র ছয় বছরের লেখালেখি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে সাতাশ বছর বয়সে অকাল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

ফরাসি প্রতীকবাদী আন্দোলনের সর্বশেষ প্রবক্তা হিসেবে ধরা হয় কবি পল ভেলোরিকে। প্রতিভাবান ভেলোরি ১২বার নোবেল পুরস্কারের জন্যে মনোনয়ন পেলেও তাঁর ভাগ্যের শিকেয় ছিঁড়েনি। ভেলোরির শতাধিক কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো যার মধ্যে নয়টি কবিতা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলো। ১৮৯৮ সালে মালার্মের মৃত্যুতে এক নাটকীয় নিরবতা নেমে আসে ভেলোরির জীবনে। পরবর্তী বিশ বছরে তিনি একটি শব্দও প্রকাশ করেননি। ১৯১৭ সালে দীর্ঘ নাটকীয়তা ভেঙে তিনি যখন খধ ঔবঁহব চবৎয়ঁব প্রকাশ করেন, তখন তাঁর বয়স ছেচল্লিশ। ৫১২ লাইনের এই দীর্ঘ গীতিকবিতাটি লিখতে তাঁর সময় লেগেছিলো চার বছর। উত্তম পুরুষে লেখা এই কবিতাটিকে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর কবিতা আমেরিকান কবি অ্যাডগার বাওয়ারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলো। অস্কার বিজয়ী জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক মিয়াজাকি তাঁর ‘দ্য উইন্ড রাইজেস’ মুভিটির শিরোনাম ভেলোরির ‘খধ াবহঃ ংব ষবাব’ কবিতা থেকে গ্রহণ করেছিলেন ।

বিশ্বব্যাপী পরাবাস্তবতা বা স্যুরিয়ালিজমের যে জোয়ার বইছে, ফরাসি কবি গিওম অ্যাপোলেনিয়ার সেটি সর্বপ্রথম ১৯১৭ সালে তাঁর ‘ঞযব নৎবধংঃং ড়ভ ঞরৎবংরধং’ নাটকে ব্যাবহার করেছিলেন। মূলত নাটকটি ১৯০৩ সালে লেখা হলেও সেটি ১৯১৭ প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়। নাটকটির ভূমিকায় তিনি বলেন,‘আমার নাটকটির চরিত্র নির্দেশ করার জন্যে আমি একটা নতুন শব্দ ব্যবহার করেছি, এর জন্য পাঠক আমাকে মার্জনা করবেন কারণ আমি এটি খুব একটা ব্যবহার করি না বললেই চলে। আর আমি এই বিশেষণটির নাম দিয়েছি স্যুরিয়ালিজম। এটি কোনোভাবেই প্রতিকী নয়।.... মানুষ যখন হাঁটার ব্যাপারটিকে অনুকরণ করতে চাইলো, তখন সে সৃষ্টি করলো চাকা যা দেখতে পায়ের মতো নয়। এভাবে সে না জেনে যা করেছে তা-ই স্যুরিয়ালিজম।’ অ্যাপোলেনিয়ার তাঁর প্রায় প্রতিটি কবিতায় স্যুরিয়ালিজমের সফল ব্যবহার করেন। এছাড়া অ্যাপোলেনিয়ারকে অর্ফিজমের ¯্রষ্টা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। কিউবিজমকে শিল্প আন্দোলনে পরিণত করার ক্ষেত্রেও অ্যাপোলেনিয়ারকেই সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী হিসেবে ধরা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত হয়ে দুই বছর সেই ক্ষত বয়ে বেড়ানোর পর ১৯১৮ সালে অ্যাপোলেনিয়ারের ৩৭ বছরের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ।

দেশ ও কালের বৃত্ত ছাড়িয়ে বিশ্বময় পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন এমন আরো অসংখ্য কবি রয়েছেন ফরাসি কবিতারাজ্যে, যাদেরকে এই ক্ষুদ্র পরিসরের আলোচনায় অর্ন্তভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত যে সময়কালজুড়ে ফরাসি কবিতার চিরযৌবন বিরাজিত ছিলো, এই আলোচনায় শুধুমাত্র সেসময়টুকু আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ফরাসি কবিদের কবিতা পাঠ না করলে যে কোনো পাঠকই কবিতাকাননের উজ্জ্বল গোলাপের ঘ্রাণমদিরতা হতে বঞ্চিত হবেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
---------------------------------------------------------------------------------------------------
আরো পড়ুন :

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন