কিউবিজম

মুর্তজা বশীর

কিউবিজম (cubism)-এর মূল কথাটা কী? ইউরোপীয় শিল্পকলার ক্ষেত্রে একটি রীতি দাঁড়িয়েছিল—চিত্রে একটা কাহিনি থাকতে হবে। এবং বিশ শতকের গোড়ায় ইউরোপীয় চিত্রকলায় বিধিনির্দিষ্ট রীতিবাহুল্যের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ দেখা দেয়, তার প্রথম লক্ষণটাই ছিল এই কনভেনশনের বিরুদ্ধে। উনিশ শতকের ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমির শিল্পীদের ক্ষেত্রে ছবিতে কথকতা এতটা প্রশ্রয় না পেলেও সে সময়কার অনেক ফরাসি শিল্পীর চিত্রে এমনকি কুর্বে (Gustave Courbet), মানে (Edouard Manet) বা দেগার (Edgar Degas) মতো প্রগতিশীল শিল্পীদের কাজেও প্রকৃতির হুবহু প্রতিচিত্রণের দৃষ্টিভঙ্গিটাই ছিল প্রধান।


ইউরোপীয় রেনেসাঁস-এর সময়কার শিল্পীদের ছবির কম্পোজিশনগুলো হতো বিভিন্ন ধরনের কতগুলো জ্যামিতিক  ছাঁচ বজায় রেখে। পিকাসো (Pablo Picasso) আর ব্রাকের (Georges Braque) কিউবিস্ট ছবিগুলিতে সেই জ্যামিতিক প্যাটার্নই হয়ে উঠল মূল ছবি। এর জন্যে বস্তুরূপের শুধু বিমূর্ত আভাসটুকুই অনেক ছবিতে নিতে হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে বস্তুরূপকে বিকৃত করতে হয়েছে, এমনকি সরাসরি অস্বীকারও করতে হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। কিউবিজম চিত্র-আন্দোলন মূলত দ্বি-মাত্রিক পটভূমিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার ফর্মের দৃঢ়সঙ্গতি। তাঁরা নিখুঁত শিল্পকলা সৃষ্টিতে উত্সাহী ছিলেন না, বাস্তবধর্মী সৃষ্টির জন্য নানারকম জ্যামিতিক আকার গ্রহণ করেন।

কিউবিজম চিত্র-আন্দোলন প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু পর্যন্ত অর্থাত্ ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বেশ জোরালো ছিল। ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত পাবলো পিকাসো এবং জর্জ ব্রাক—এই দুজন শিল্পী সেজাঁ (Paul Cezanne)-এর চিন্তাধারাকে অর্থাত্ প্রকৃতির সবকিছুকেই Cylinder, sphere ও cone-এর মাধ্যমে ব্যবহার করতে হবে—সবকিছুই সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে, যাতে বহু বা সমপৃষ্ঠের প্রত্যেকটি পার্শ্ব মধ্যবিন্দুর দিকে নির্দিষ্ট হয়—এই ভিত্তিতে ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯০৮ সালে আঁকা ব্রাকের একটা ছবি দেখে চিত্র-সমালোচক লুইস্ ভকেসলস (Louis Vauxcelles) কিউবিজম এই শব্দটি ব্যবহার করেন এবং পরবর্তীকালে ১৯১৩ সালে ফরাসি সমালোচক ও কবি অ্যাপোলিনেয়র (Guiillaume Apollinaire) ‘কিউবিস্ট চিত্রগোষ্ঠী’ এই নামে তাঁদের সমর্থনে আন্দোলন শুরু করেন। ব্রাক ও পিকাসোর সঙ্গে গ্রি (Juan Gris), লেজে (Feand Leger) বিংশ শতাব্দীর চিত্র-আন্দোলনের পরিবর্তনের পুরোধা লা ফ্রেসনে (Roger de la Fresnaye), দিলোনে (Robert Delaunay), ভিলোঁ (Jacques Villon), দুসাম্প (Marcel Duchamp) প্রমুখ শিল্পীগণ এই ভাবধারায় ছবি আঁকা শুরু করেন।

 

কিউবিজম আন্দোলনকে মূলত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়ে থাকে :

ক) ১৯০৬-৯ সাল অবধি কিউবিজম-এর অঙ্কুরিত সময়। ব্রাক, পিকাসো ও সেজাঁ-র কম্পোজিশনের কাঠামোকে ভিত্তি করে চিত্র রচনা করেন। এই সময়ে তাঁদের কাজে আদিম চিত্রের অর্থাত্ নিগ্রো ও আইবেরিয়ান ভাস্কর্য ও মুখোশের বেশ প্রভাব ছিল এবং এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে পিকাসোর ১৯০৭ সালে তেল রঙে আঁকা অ্যভিনয়ের রমণীরা (Demoislles d' Avignon) এ চিত্রটির মাধ্যমে। এই সময়ের চিত্রগুলিতে স্বতন্ত্র ফর্মগুলোকে তীক্ষ কোণবিশিষ্ট সমতলে স্থাপত্য সদৃশ ব্যঞ্জনায় মৌলিক সরণীকরণে দ্বিমাত্রিকতায় আঁকা হয় এবং এই চিত্রগুলিতে সাধারণত লালচে বাদামি ও সবুজ রঙ প্রথম দিকে এবং পরবর্তীকালে খাকি, ইস্পাতধূসর রঙের প্রাধান্য ছিল। চিত্রের গভীরতা বোঝানোর জন্য এক কেন্দ্রিক সরল পরিপ্রেক্ষিতের পরিবর্তে কিছুটা মান হ্রাস করে গাছ ও ঘরবাড়ি একটার ওপর আরেকটা একধারে তুলে এবং আকৃতির পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়েছিল। ১৯১০ সালে Salon des Independants-এ এই গোষ্ঠী প্রথম গ্রুপ প্রদর্শনী করে।

কিউবিজম-এর দ্বিতীয় পর্যায় বিশ্লেষণধর্মী (analytical) কিউবিজম শুরু হয় ১৯০৯ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত। প্রাকৃতিক দৃষ্টিগোচরতা সমতল জমির গঠন প্রণালীতে একত্র বিন্যাস। এভাবে প্রাকৃতিক জগত্, অর্থপূর্ণ ফর্মে রূপান্তরিত হয়ে প্রকৃত রূপে প্রকাশিত হয়। তাই অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজম হলো বাস্তবতার (realism) থেকে জন্ম নেয়া, চাক্ষুস প্রত্যক্ষকরণের ভেতর দিয়ে বস্তুর গঠন বিন্যাসের রূপান্তরণ। এই সময় পিকাসো ও ব্রাক একযোগে এই আন্দোলনের জন্য কাজ শুরু করেন, ফলে তাদের কাজ সহজেই চেনা খুবই মুশকিল ছিল। জড়জীবন, নৈসর্গচিত্র এবং ফিগার-এর অঙ্কনপদ্ধতি দেখে মনে হতো যেন ছাঁচে ঢালাই করা। এই সময় এই পর্যায়ে অনেক নবীন শিল্পী লেজে, গ্লেইজে (Albert Gleizes), লরেন্স (Henri Laurens), পিকাবিয়া (Francis Picabia) দিলোনে, মেটজিংগার (Jean Metzinger) ও জোয়ান গ্রি কিউবিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজম-এর উত্পত্তি হয়েছিল যেহেতু তাঁরা ফর্মের বিশ্লেষণের জন্য বেশ কিছু জ্যামিতিক আকার যেমন, ঘন (cube), বর্তুল (sphere) এবং সমতল ব্যবহার করেছিলেন। এই সময়কার ছবির বিষয়বস্তু ছিল দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারযোগ্য জিনিস, বোতল, গ্লাস, বাদ্যযন্ত্র ও নৈসর্গচিত্র ও মানবদেহ। প্রথম দিকে বস্তুর প্রকৃত রূপ বা সাদৃশ্য বিদ্যমান ছিল কিন্তু অতি স্বল্প সময়েই এই জায়গায় স্থান করে নিলো মানসিক বা কল্পিত স্বরূপে। তাঁরা বিভিন্ন বিষয় বা বস্তুর সংক্ষিপ্ত বহির্রেখা ও সূক্ষ সমতলে কখনো স্বচ্ছ বা ওপরের দিকে তুলে ধরে খণ্ড খণ্ড নানা ভঙ্গিতে, নানা বিকৃতিতে অংশগুলি প্লাস্টিক ফর্মে পুনর্গ্রথিত করে কিংবা পাশাপাশি স্থাপন করে বস্তুর বৈশিষ্ট্যমূলক মূল সত্যকে তুলে ধরলেন। তাঁরা রেনেসাঁ যুগের বিধিসম্মত পরিপ্রেক্ষিতকে অগ্রাহ্য করে দৃষ্টিকে একটিমাত্র বিন্দুতে লক্ষ্য না করে একাধিক বিন্দুতে দৃষ্টির নৈকট্য স্থাপন করে সমতল আয়তনে আকৃতিকে নানাভাবে ভাঙলেন। পিকাসো ও ব্রাক আকার, আকৃতি, খুঁটিনাটি এবং বাইরের ও ভেতরের চতুর্থ দিক অর্থাত্ সময়কে খুঁজে পাওয়া গেছে। ইতালির ফ্লোরেন্সের শিল্পী ম্যাসাচ্চোর (Masaccio 1401-28) সময় থেকে সাধারণত এক বা দুই কেন্দ্র বিশিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত চিত্রে ব্যবহার করা হতো কিন্তু কিউবিস্টপন্থিরা অত্যাবশ্যক বস্তুকে তুলে ধরার জন্য নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বস্তুকে অঙ্কন করেন। সেজাঁ যেমন চিত্রের সমন্বয়ের জন্য সম্মুখের সমতলকে পেছনের পটভূমির সঙ্গে কোনাকুনি বা বক্র ভগ্ন সমপৃষ্ঠ ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরাও তা-ই করলেন। অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজম-এর মূল লক্ষ্য ছিল, বস্তুর স্বাভাবিক সাদৃশ্যকে হ্রাস করে সমপৃষ্ঠের উপরিভাগে অঙ্গস্থাপন করা। ফলে, বস্তুর বাহ্যিক রূপ ও আকৃতিকে এমনভাবে তার নিজস্ব তাত্পর্যপূর্ণ ফর্মে লঘুকরণ করা হতো যার জন্য বস্তুর মূল চারিত্রিক সত্তা উন্মোচিত হতো। অবশেষে বস্তু তখন কম্পোজিশনের মূল বা উত্সরূপে চিহ্নিত হতো না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন