জাঁ পল সার্ত্রেকে লেখা সিমন দ্য ব্যুঁভোয়ার চিঠি

জাঁ পল সার্ত্রেকে লেখা সিমন দ্য ব্যুঁভোয়ার চিঠি

অদিতি ফাল্গুনী

মূল ফরাসী থেকে অনুবাদ
ভূমিকা: সিমন দ্য ব্যুঁভোয়া (১৯০৮-১৯৮৬), অগ্নিময়ী নারীবাদী ও অস্তিত্ববাদের অনিবার্য সমর্থক, তাঁর চির সখা ও পরামর্শদাতা জাঁ পল সার্ত্রের (১৯০৫-১৯৮০) সাথে গোটা জীবন জুড়েই ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সন্ত জার্মেইনের এই দুই অনুরাগী পরষ্পরের প্রতি প্রায় অর্দ্ধ-শতকের এক আশ্চর্য বন্ধনের জীবন যাপন করেছেন, দু’জনের ভেতর প্রবল ¯স্বাধীণতা আবার তীব্র আবেগী পারষ্পরিক নির্ভরতার এক সম্পর্ক। তাঁদের সম্পর্কের আলেখ্য যেমনই হোক না কেন, ‘প্রিয় ছোট্ট বন্ধু’-কে লেখা ক্যাস্টরের (সিমন দ্য বু্যঁভোয়া) চিঠিগুলো থেকে একে অন্যের প্রতি আবেগের যথার্থতা বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয় না। নিচে সার্ত্রকে লেখা সিমনের তেমন একটি চিঠিই অনুবাদ করা হলো।
এই চিঠিটি ব্যুঁভোয়া যখন সার্ত্রেকে লিখছেন, তখন কিছুদিনের জন্য ঝড়ো প্রেমের বন্ধনে সময় কাটাচ্ছেন তাঁর দীর্ঘকায়, সুদর্শন ও বয়সে এক বছরের ছোট মার্কিনী প্রেমিক নেলসন আলগ্রেনের সাথে। ওদিকে বেঁটে-খাটো, বয়সে তিন বছরের বড় তবে দেখতে আহা মরি কিছু নন তবে প্রবল প্রজ্ঞাবান সার্ত্রের জন্যও অনুতাপে পুড়ে মরছেন সিমন। সার্ত্রে যদি হন তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা, নেলসন আলগ্রেন তবে উল্কা। আমরা এটাও জানি যে আলগ্রেনকে ছেড়ে পুনরায় সার্ত্রের কাছেই ফিরবেন সিমন। প্রায় ৭০০-৮০০ শব্দের এই পরিমিত আয়তন চিঠিতে সিমন শুরুতেই বলছেন সার্ত্রে সিমনের জীবনে আদৌ কোনো ‘শ্বেত সমাধি’ বা সাদা পাথরে বাঁধানো কবর নন। অনুমান করা যাচ্ছে যে আগের কোনো চিঠিতে অভিমানী সার্ত্রে হয়ত সিমনকে লিখেছেন যে সিমনের জীবনে তিনি এখন ‘শ্বেত মর্মরে বাঁধাই কবর মাত্র।’ নেটে সিমনকে লেখা সার্ত্রের চিঠি টুকটাক ফরাসীতে দু/একটা যা পাচ্ছি, তার ভেতর এমন কিছু এখনো চোখে পড়েনি। তবে সিমনের চিঠি থেকে তেমনটাই বোধ হচ্ছে। সার্ত্রের পাঠানো অভিমানী চিঠি তাঁকে অনুতপ্ত করে তুলছে। তবু সিমন ও সার্ত্রের পারষ্পরিক অকপটতাও বিষ্ময়কর। কিছু লুকোচ্ছেন না সিমন। আলগ্রেনের সাথে কোন্ সমুদ্র শহরে বেড়িয়ে আসলেন, শীতটা শিকাগোতে কেমন কেটেছে, সামনে নিউ অরলিয়ন্স যাবেন আর এখন ওহিয়োর সিনসিনাত্তিতে আছেন- সবই জানাচ্ছেন। আলগ্রেনের সাথে শয়নকক্ষে বসেও সার্ত্রেকে চিঠি লিখছেন। আশা প্রকাশ করছেন যে আর্জেন্টিনার রিও ডি জেনিরোতে সার্ত্রের সাথে তাঁর আবার দেখা হবে। মানুষের জীবনকে যদি এক মহাবিশ্ব হিসেবে আমরা ধরে নিই, তবে সেখানে ধূমকেতু যেমন আসে, থাকে নীল ধ্রুবতারাও। সার্ত্রে ছিলেন সিমনের ধ্রুবতারা। উল্কার টানে খানিকটা কক্ষপথ বিচ্যূত সিমন এখানে তবু তাঁর জীবনের ধ্রুবতারাকে চিঠি লিখে চলেছেন। সেটাই তাঁর সত্যতম সম্পর্ক।
একটি ছুটির দিনে অবসর কাটাতে এই চিঠি অনুবাদই আনন্দ দিলো আমাকে। এক বছর তৃতীয় ভাষাটির সাথে সম্পর্ক না রাখার দূরত্ব ঘোচানোরও কিছু চেষ্টা। যদিও আমি ভেবেছিলাম সিমন-সার্ত্রের চিঠি মানে কঠিন সব দর্শণের ক্লাস করে ফেলবো কয়েকশো শব্দে, দেখলাম সাধারণ মানব-মানবীর মতই প্রেম, অভিমান নিয়েই কথা বেশি এই চিঠিতে। দু/একটা জায়গায় পড়া-শোনা কী করছেন বা লিখছেন তেমন আলাপ আছে। যাহোক, ‘নারী’-র পাঠকদের পড়তে দিলাম এটা।
১৫ই মে ১৯৪৮
‘আমার ছোট্ট মিষ্টি মানুষ, আমার ছোট্ট প্রিয় আত্মা ওগো,
আপনি আমাকে যে ছোট্ট, সজীব চিঠিটি লিখেছেন সেটি কেমন যে আমার মনকে নাড়া দিলো কারণ আমি জানি এই চিঠি পুরোটাই সত্য না, আপনি ত’ কোনো শ্বেত সমাধি নন, আপনি অন্য এক হৃদয়, এবং আমি রামাতুয়েল্লেতে আবার ভালো বোধ করছিলাম এবং আমি এটাও জানি যে আপনাকে আমি কোনোদিন হারাবো না, জীবনে যেই আসুক বা যা কিছুই ঘটুক না কেনো আপনি সবসময়ই থাকবেন আমার ছোট্ট বন্ধু, আপনি আমার অন্য আমি, এবং আমিও নই কোনো শ্বেত মর্মরে বাঁধাই কোনো সমাধিস্থল, আমার হৃদয় আমূল ডানা মেলে উড়ছিল অথচ হাত দু’টো কাঁপছিল যখন ডাকবাক্স থেকে আপনার লেখা চিঠি খুঁজে বের করলাম আর খুললাম। একটি সময়ের জন্য এই ত’ যথেষ্ট, আর কিছু না হোক ডাকঘর ত’ আছে। আমি সকাল নয়টায় জাগি যদিও আলগ্রেন আরো কিছুটা সময় ঘুমোয়, আমি দৌড়ে পোস্ট অফিসে চলে আসি যেখানে এক কর্মচারী আমাকে দেখলেই বলবে যে আমার কাছে একটি চিঠি এসেছে। পোস্ট অফিসের পাশেই ওষুধের দোকানটিতে বসে আমি আপনার চিঠি পড়ে ফেলি এবং কিছু একটা পান করার সাথে সাথে হাঁটতে থাকি এবং এভাবেই সিনসিন্নাতিতে আমার সময় দারুণ কাটছে যখন কিনা আমার মাথায় সবসময়ই আমাকে বলা আপনার সব কথা ও আমার সব উত্তর ঘুরপাক খেতে থাকে আর এই মফস্বল শহর আমার কাছে তখন কী যে সুন্দর লাগে যদিও আজকের সকালটি ছিল কিছুটা আর্দ্র। তারপর হোটেলে ফিরে আসি ও লবিতে বসে লিখি। হ্যাঁ, আপনি আমার অভাব বোধ করছেন জেনে সত্যিই অভিভূত বোধ করছি, প্রেম আমার! কারণ যদি কখনো এমন হয় যে একটি বারের জন্যও আপনি আমার অভাব বোধ করছেন না, যেহেতু এই দিনগুলোয় আপনার জন্য কোনো জায়গা আমার রাখা হচ্ছে না, তবু আপনি আমার দিগন্ত, আমার মহাবিশ্ব এবং আমার জীবনে আনন্দময় যা কিছু আসে তা’ যে আপনার আলোতেই আলোকিত। সত্য এটাই যে আমি আপনাকে কখনো ছেড়ে যাই নি, আমি আপনাকে কখনো ছাড়তে পারি না, আপনি আমার আর একটি জীবন।
আমার মনে হয় আমার শেষ চিঠিটি ছিল খানিকটা কাঠখোট্টা, আপনি ত’ জানেন কীভাবে লিখেছি: রান্না করতে করতে চিঠিটি লেখা, আলগ্রেনের সাথে শয়নকক্ষে বসে লেখা চিঠিগুলো সবই যেনো প্রতারণার অপবাদে দুষ্ট, তবু আলগ্রেন গভীর মিত্রতার সাথে আপনার কথা বলে এবং আমাকে আপনার জন্য উপহার হিসেবে একটি দারুণ পাইপ উপহার দিয়েছে; এমন আরো কতো কী! আজ সকালে আগের চেয়ে ভাল লাগছে যেহেতু এখন আমি একা, তবু এই চিঠির মাধ্যমে আপনার সাথে যোগাযোগ থেকে যাওয়াটাই কেমন এক ব্যভিচারের স্বাদ যোগাচ্ছে। এটা সত্যি যে সারা জীবনে আমি কখনোই ততো ভালো, তত মানিয়ে চলা অথবা সবসময় হাসি-খুশি হয়ে থাকার মতো মানুষ ছিলাম না যেমনটা আমি আলগ্রেনের সাথে আছি যেহেতু আমার জীবনের পটভূমিতে আপনি এবং আমার সত্যকারের জীবন, আর সেখানেই মিথ্যে ও প্রতারণার শুরু। ভাল। এই মূহুর্তে আর এটা আমাকে পোড়াচ্ছে না। শুধুমাত্র যখন আপনার কোনো চিঠি থেকে আমি আঘাত পাই অথবা যখন আপনাকে আমি সেই একই রকম আঘাত করার মনোবৃত্তি থেকে কোনো চিঠি লিখি, তখনি কেবল অন্তর্দাহ শুরু হয়।

শিকাগোতে আবহাওয়া পুরো সময়টাই ছিল ধূসর ও রুক্ষ তবু আপনাকে ত’ বলেইছি যে দিনগুলো বই পড়ে, গান শুনে এবং গল্প-স্বল্প করে ভালই কেটেছে (...)।
আমার ছোট্ট বাবু, উপন্যাসটা ভালই এগোচ্ছে বলে মন ভাল আছে, গায়িকা সুজি সলিডর আপনার গান নিউইয়র্কে গেয়েছে দেখে শিহরিত বোধ করছি, ভাল লাগছে যে এই ‘বালিকা’ বেশ শান্ত এবং কোনো রকম নাটকীয়তা ছাড়াই জীবন যাপন করছে। আপনার জন্য সামনে সব কিছুই ভাল হতে যাচ্ছে তেমন এক সুগন্ধী আভাস যেনো হাওয়ায় মিলছে; আপনাকে আপনার চিঠিতে একটু নার্ভাস মনে হলো। হতে পারে সেই দিনটিই আসলে আপনাকে বিরক্ত করে তুলছিলো। আর্জেন্টিনা সামনে এগোলে আমরা খুশি হবো আর নিজেদের হয়ত আবার খুঁজে পাবো রিও ডি জেনিরো-তে, তবু যেকোনোভাবে আপনাকে খুঁজে পেলে আমি কতো যে খুশি হবো, প্রিয় আমার, হয়ত আমার ছোট ছোট সমস্যাগুলো তখনো থাকবে, আমার আত্মায় তখনো হয়ত কলঙ্ক মাখা, তবু আমি জানি যে আপনাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না যেহেতু আপনাকে আমি কখনোই ছেড়ে যাব না এবং বাকিটা মেরামত করতে আপনিই আমাকে সাহায্য করবেন। আমার ছোট্ট মানুষ, আপনি আমাকে দিয়েছেন সুন্দর ভ্রমণের এক উপহার, এবং আমাকে দিয়েছেন সরল ও আনন্দময় এক জীবন যেখানে শুধুমাত্র আপনি আছেন বলেই বা আপনার অস্তিত্বের জন্যই সবকিছু আনন্দের হয়ে ওঠে। প্রেম আমার, অনেক ধন্যবাদ। কাউকে আস্থার সাথে ভালবাসতে পাবার সুযোগ পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যপার। আমাকে আপনার চিঠির জন্যও ধন্যবাদ এবং মোহন মৃদু যতো কথা আপনি আমায় বলেছেন তার জন্যও, সেই যতো মৃদু বচন আমার হৃদয়কে ঝাঁকুনি দিয়েছে। ভাবছি এই চিঠি যখন আপনি পাবেন তখন নিউ অর্লিয়ন্সে এমন কেউ আছে যাকে আপনি খুব ভালবাসেন: যা আপনাকে অতীতে একটা সময় কিছুটা কাব্যতাড়িত করেছিলো। বিদায়, আমার ছোট্ট কোমল, ছোট্ট বন্ধু। ভালভাবে কাজ করুন, সন্তের মত বিবেচক ও প্রজ্ঞাবান থাকুন, বিমানে উঠে নিজের মৃত্যু ডেকে আনবেন না যেনো: আর আপনি সহৃদয় হয়ে থাকলে ২৪ থেকে ২৫ তারিখ নাগাদ অবশ্যই নিউ অরলিয়ন্সে একটি ট্রেলিগ্রাফ করবেন যেনো আমার রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে না হয়। আমি আপনাকে নৌকায় বসে লিখবো। আর আগামী শনিবারই আমি ডাকঘরে ছুটব। আমার সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে আপনাকে আলিঙ্গন করছি। আপনাকে ভালবাসি।
আপনার ‘বিনোদিনী’ ক্যাস্টর।
রামাতুয়েল্লে : দক্ষিণ ফ্রান্সের এক সমুদ্র সৈকত যা মধ্যযুগে মুর বা মুসলিমরা স্থাপণ করেছিল বলে মনে হয়। ‘রহমতউল্লা’ বা ‘আল্লাহর রহমত’ নামে মুরদের প্রতিষ্ঠিত এই সমুদ্র শহর এখন ‘রামাতুয়েল্লে’ নামে পরিচিত।
> নেলসন আলগ্রেন: সিমনের তরুণ প্রেমিক যার সাথে কিছুদিন বসবাস করলেও অন্তিমে সার্ত্রেকে ছেড়ে থাকতে পারেন নি সিমন। ফিরে এসেছেন সার্ত্রের কাছেই।
>সিনসিনাত্তি: আমেরিকার ওহিয়ো বা ওহাইয়ো রাজ্যের একটি বড় শহর। রামেতুয়েল্লে থেকে বেড়িয়ে সিমন দ্য বু্যঁভোয়ার তাঁর মার্কিনী প্রেমিক নেলসন আলগ্রেনের সাথে এই শহরে কিছুদিন থাকেন। সেসময়ের লেখা এই চিঠি।
> সুজি সলিডর (১৯০০-১৯৮৩)। সমকামী এই নারী ছিলেন ফ্রান্সের এক সময়কার বিখ্যাত গায়িকা ও নায়িকা।
নিউ অরলিয়ন্স: এখানে ব্যুঁভোয়ার নিজের কথাই বলছেন যেহেতু সিনসিনাত্তিতে ভ্রমণ শেষ হলে আলগ্রেনের সাথে তিনি আবার নিউ অরলিয়ন্স শহরে ফিরবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন