মিহির সেন গুপ্ত
যে বিষয়টি নিয়ে আপনারা আমাকে বক্তৃতা করতে অনুজ্ঞা করেছেন, তার মান আমি কতোদূর
রক্ষা করতে পারবো জানি না। বক্তৃতা করা আমার ধাতে নেই। ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং আমার
জন্ম প্রায় একইসঙ্গে। দুটো ঘটনাই এখন ইতিহাস। শুধু তার বহতাটা এখনও বাস্তব। আমার
বহতাটা এক সময় শেষ হবে, কিন্তু দেশভাগের বহতার যে চোরাস্রোত আমাদের দুই পারের
বাঙালির জীবনকে দীর্ঘকালব্যাপী বিষণ্ন করে রেখেছে তা কোনোদিন শেষ হবে কিনা জানি
না।
আমি সমাজেতিহাসের ছাত্র বা চর্চাকারী নই। ঐ বিষয়ের যেটুকু আমার সামান্য লেখালেখিতে
এসেছে, তার প্রায় সবটাই স্মৃতি-আলেখ্যকে আশ্রয় করে। বর্তমান কথনেও আমি সেই পন্থাই
অবলম্বন করবো। জানিনা, তা আপনাদের আদৌ তৃপ্ত করবে কিনা।
এখানে ইতিহাস শাস্ত্রে সুপণ্ডিতজনেরা রয়েছেন, তাঁদের সাক্ষাতে এই বিষয়ে নতুন কী
কথা আমি বলতে পারি, অনেক ভেবেও কিনারা করতে পারিনি। অবশেষে সাব্যস্ত করলাম আমার
তিনখানা গ্রন্থে এই দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নানান কথা নিয়ে যে আবোলতাবোল
কথকতা আমি করেছি, সেই বিষয়ে কিছু বাচালতা করবো। গ্রন্থ তিনখানা, আপনারা অনেকেই
জানেন, সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, বিষাদবৃক্ষ এবং ধানসিদ্ধির পরণকথা। আপনারা আমাকে
দেশভাগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার ইচ্ছেমতো বলতে বলেছেন। কিন্তু সেই অর্থে জন্মভূমিকে
টুকরো করে কাটার এবং সেখানের মানুষকে ভাগ করার কলঙ্কে কলঙ্কিত ১৯৪৭-এর বিষয়ে তো
আমার সাক্ষাৎ কোনো অভিজ্ঞতা নেই বা থাকারও কথা নয়। ঐ ঘটনাটা আর আমি তো সমবয়সী। তবে
টুকরো দুটির এক অংশে শৈশব, কৈশোর এবং পৌগণ্ড কালের দীর্ঘ ষোলো সতেরো বছরের যে
অভিজ্ঞতা, তা নিয়ে আমার বিষাদবৃক্ষের নির্মাণ হয়েছে। ইতিপূর্বের সিদ্ধিগঞ্জের
মোকাম এবং পরবর্তীকালের ধানসিদ্ধির পরণকথাও সেই ছন্দ রক্ষা করেই চলেছে। যদিও
সেখানে ব্যবহারগত ভিন্নতা আছে। দেশভাগ বিষয়ে আমার আন্তরিক প্রতিক্রিয়া এবং
অভিজ্ঞতা বলে যদি কিছু থাকে, তার কথা ওখানেই বিবৃত করেছি। এর সবকিছুই ১৯৪৭-এর সেই
কালিমালিপ্ত দিনটির ফলাফলের জন্য অগণিত হিন্দুমুসলমান মানুষ যে জীবনব্যাপী ট্রম্যা
ভোগ করছে অথবা ভোগ করে করে এক সময় শেষই হয়ে গেছে, তারই বিবরণ প্রচেষ্টা। দিনটি
যাদের জন্য ট্রায়াম্ফ্ নিয়ে এসেছিল তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ যোগ ছিল না বলে, তা নিয়ে
কিছু বলতে পারি নি। তাদের কথা স্বতন্ত্র। ‘কালিমালিপ্ত’
কথাটির জন্য কেউ ক্ষুব্ধ হবেন না বা অপরাধ নেবেন না। যেহেতু ১৯৪৭ স্বাধীনতার সঙ্গে
হিন্দুমুসলমান সাধারণবর্গের মধ্যে একটা প্রায় স্থায়ী ভেদ নিয়ে এসেছিল এবং বাঙালীকে
অত্যন্ত তুচ্ছতার সঙ্গে ব্যবহার করেছিল, তাই শব্দটি প্রয়োগ করা। বস্তুত বাঙালীর
অস্মিতা তখন কোনো মর্যাদাই পায়নি। বরং বলা যায়, জাতি রাষ্ট্রের অধীর
ক্ষমতা-কামুকেরা বাঙালীকে ভ্রাতৃঘাতি সংঘর্ষের পথে ঠেলে দিয়েছিল।
এই নিবন্ধে, সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, বিষাদবৃক্ষ ইত্যাদির জন্য অনেক মানুষ আমাকে যেসব
বার্তা পাঠিয়ে থাকেন দেশ বিদেশের নানা স্থান থেকে, সেইসব খবর কিছু আপনাদের দেব।
সেইসব মানুষ সব-ছেড়ে-যাওয়া গ্রামীণ জীবনের সুখস্মৃতির নস্টালজিক কাহিনী নিয়ে বড়ো
বড়ো চিঠি লেখেন। দূরভাষে দীর্ঘ সময় ধরে নানা স্মৃতি রোমন্থন করেন। তার মধ্যে,
বলাবাহুল্য, আমার লেখা বিষয়ে বেশ উচ্চাঙ্গের প্রশংসা থাকে, যার অনেকটাই মেনে নিতে,
বিশ্বাস করুন, আমার বেশ লজ্জা হয়। শাস্ত্রে যে বলা হয়েছে ‘সব প্রশংসা ঈশ্বরের প্রাপ্য’ তা অনেক চিন্তা ভাবনা করেই বলা হয়েছে। তিনি যদি
নিরাকার না হতেন তবে প্রশংসার আতিশয্যে তাঁর অবস্থা সঙ্গিন হতো। কিন্তু মানুষ কেন
যে অন্য একজন মানুষকে প্রশংসা করে বিব্রত করে, বুঝি না। তাছাড়া আমি আবেগে স্পর্শিত
হলেও আবেগসর্বস্ব নই এবং আমার কাজটা যে প্রশংসা পাবার যোগ্য এমনও ভাবি না।
কোথাও কোথাও প্রতিক্রিয়াটা এমনও হয় যে, তখন আহ্লাদে আত্মহারা হয়েও যাই। কিন্তু
সেসব কথার সঙ্গে হৃদয় বড়ো ওতপ্রোত। বিষাদবৃক্ষ যেহেতু সমধিক তোল্লাই পেয়েছে,
সুতরাং সেটিকেই মূলধারে রেখে মূল বক্তব্যে যাই। বলে রাখা ভাল, আমার বক্তব্যে মননের
তীক্ষ্ণতা থাকবে না। থাকবে শুধু খাপছাড়া কিছু বোধের কথা।
বিষাদবৃক্ষ আমার এবং আমার দুঃখিনী জন্মভূমির দুঃখের আলেখ্য, বিষণ্নতার ব্রতকথা।
অতিশৈশব কাল থেকে সেই ব্রতকথার বিষাদমগ্নতা আমার যে আত্মাটিকে আতুর করে রেখেছে,
তাকে বয়ে বয়ে, ক্লান্ত হয়ে, অবশেষে বেলা যখন প্রায় আঁধার হয়ে এসেছে, তখন সবার
সামনে তাকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি ধন্য, অনেকেই তা ধৈর্য ধরে, কান পেতে
শুনেছেন, শুনে চোখের জলে ভেসেছেন, বলেছেন, এ গল্প, কাহিনী তো আমারও, এতো আমিই
বলছি। বহু যোজন দূরের, অনেক নদী, সমুদ্র পেরিয়ে যে দেশে যেতে হয়, সেখানকার
প্রবাসীরাও কেউ কেউ হঠাৎ দূরভাষে পরিচয় দিয়ে জানিয়েছেন, আমরা তোমার আত্মীয়। আমাদের
বাড়ি হচ্ছে, ঐ তুমি যে লিখেছো, দিঘির পারের পঞ্চদেবতার খোলা, জাতকরণী খোলা, যেখানে
চৈতি-সংক্রান্তিতে মেলা বসতো, তার পাশের বাড়িটার কথা, সেটাই। আচ্ছা, আমাদের বাড়ির
সামনের বাগিচায় যে নারকোলি কুল গাছটার কথা লিখেছো, সেটা এখনো আছে?-বরিশালে, আমাদের
অংশের গ্রামগুলোতে আমরা কুলকে বলতাম ‘বড়ই’,
আর নারকোলি কুলকে ‘নারকোলি
বা নাইরখোলি বড়ই’।
কথাটা মনে করিয়ে দিতে, সেকী আহ্লাদ আর উচ্ছ্বাস তার! এ রকমই কেউ আমেরিকার প্রবাস,
কেউবা অস্ট্রেলিয়ার কিম্বা ইল্যান্ডের কোনো স্থান থেকে জানতে চান বিষাদবৃক্ষের
বিষাদ ভূমির কথা। এইসব খবরাখবর আসলে নস্টালজিয়ার প্রকোপ। শুনলে বিষণ্নতা গাঢ় হয়।
তবে সেটাই আমার প্রতিপাদ্য নয়, কিন্তু অন্য যাঁরা, ভারতের নানা স্থানে প্রবাসী,
এখনো ঘর গুছিয়ে বসতে পারেন নি, তাঁরা যখন চিঠি লিখে বা দেখা করতে এসে, দিনমান
দেশের গল্প কথা বলেন, তাঁদের ব্যাপারটা শুধু নস্টালজিয়ারই নয়। তার মধ্যে থাকে একটা
দেশবহতা। এই রকমই একজন, মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুর থেকে একখানা চিঠি দিয়েছিলেন। তাঁদের
বাড়ি নাকি আমার পাশের গাঁয়ে, দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হয়েছিল তাঁদের। সেখান থেকে পালিয়ে
বিলাসপুরে স্থায়ী হয়েছেন। তাদের দেশ ছাড়ার কাহিনী সবিস্তারে লিখে, অনুরোধ করেছেন,
আমি যেন আমার দেশ ছাড়ার গল্পটাও তাঁকে চিঠিতে জানাই। তাঁর বক্তব্য এবং অনুযোগ, আমি
বিষাদবৃক্ষে সে কথা কেন লিখি নি। কথাটা সত্য। কিন্তু সেই কাহিনীটা বড়ো কষ্টের
কাহিনী বলে লিখি নি। আমি তো দেশ ছাড়ি নি, ‘দেশ’
‘রাষ্ট্র’ হয়ে রাষ্ট্র করে দিয়েছিল যে সে আমাকে, আমার মতো জনদের উরংড়হি
করেছে। প্রত্যাখ্যান করেছে। যাহোক, দেশছাড়ার গল্পটা আগে বলি। দেশ খোঁজারটা পরে
বলবো।
সেটা ছিল আমার ট্রম্যা এবং যারা রাষ্ট্রলাভ করেছিল তাদের ঞৎরধসঢ়য-এর ষোড়শ বর্ষ।
১৯৬৩-র জানুয়ারি। আমাদের ওখানকার শেখের হাট নামক স্থানের স্টিমার ঘাটটা ঠিক
প্রথাসম্মত স্টেশান নয়। তবে বরিশাল এঙপ্রেস নামক স্টিমারটা সেখানে একটা হল্ট দিত।
সামান্য দু’একজন যাত্রী এখান থেকে ওঠানামা করতো। কেউ কেউ
কাছাকাছির। কেউবা খুলনা পর্যন্ত যেতো, বা সেখান থেকে ফিরতো। খুলনার ঘাট পর্যন্তই
বরিশাল এঙপ্রেসের গতি। খুলনা থেকে দূরে যারা যাবে, তারা কেউ ট্রেনে, কেউবা বাসে
করে যাবে। বিশেষ করে যারা পশ্চিমবঙ্গ যাত্রী তারা ট্রেনে শিয়ালদা অবধি যায় এভাবে-এ
রকম শুনেছি। অতি ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে একবার কোলকাতা এভাবে গিয়েছিলাম। তখনকার
স্মৃতি খুব ঝাপসা। তবে ‘ইস্টিমার’ আর রেলগাড়ির ছবি দুটো বড়ো উজ্জ্বল হয়ে আছে
এখনও। সে এক মজার স্মৃতি। তার কোনো বিষণ্নতার অনুষঙ্গ নেই। সেটা ছিল বেড়াতে যাবার
ব্যাপার, দেশত্যাগ করে শেষ যাওয়া তো নয়।
এবারের যাত্রাটা একেবারেই ভিন্ন। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আমি যেন নিমাই, আমি দেশ
ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাচ্ছি। ‘সন্ন্যাসী
না হইও নিমাই, বৈরাগী না হইও, ঘরে বসে অভাগীরে মা বলে ডাকিও।’ এই রকম একটা করুণ বোধ। এই গানটা আমার মা খুউব
গাইতেন। আমার দেশছাড়ার ব্যাপার নিয়ে যখন কথা উঠেছিল, তখন মা প্রায়ই এই গানটা
গাইতেন। এখন তাঁদের সবাইকে ছেড়ে যাবার সময়, এই নদীতীরে বসে, লাইন ক’টি যেন মায়ের গায়কীতে মাথার মধ্যে ঘুরপাক
খাচ্ছিল। শীতের পড়ন্ত বেলা এমনিতেই বিষণ্ন থাকে। তার উপর এইসব ছেড়ে চলে যাওয়ার
অনুষঙ্গ, দেশভাগের ফলাফলের এই অভিজ্ঞতা এবং তা আমার ক্ষেত্রেই, হায়! আমি তো দেশ
ছাড়তে চাইছি না, কেউ জবরদস্তি তাড়িয়েও দিচ্ছে না, অথচ যেতেই যে হচ্ছে, এ যে কী এক
বোবা যন্ত্রণা! প্রতিটি স্মৃতি আজও মনে আছে।
এই ঘাটে কোনো জেটি নেই, প্রথাসম্মত ঘাট নয় বলে নদীতীরে কোনো ‘শেড’ও নেই বসার। শুধু থাকার মধ্যে আছে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ। তার শিকড়ের
উপর বসে আমরা তিনটি প্রাণী, আমাদের চলনদার সাবি পিসি, আমার বন্ধু বাচ্চু এবং আমি।
সাবি পিসি আমাদের গ্রাম সুবাদে পিসি। এই চরিত্রটি আমার বিভিন্ন লেখায় বিভিন্নভাবে
আছে। সাধারণের চোখে ভ্রষ্টা এই নারীকে আমি এক অসামান্য চরিত্র হিসেবেই দেখেছি।
তাঁকে প্রকৃতভাবে উদ্ঘাটন আমার এখনো শেষ হয় নি। পশ্চিমবঙ্গে মাঝে মাঝে যাতায়াত আছে
তাঁর। তিনি আমাদের পৌঁছে আবার ফিরে আসবেন। বাচ্চু আর আমি যাচ্ছি জন্মের শোধ। এখন
থেকে আমরা আর এদেশের কেউ না। আমরা হিন্দুস্থানী হতে যাচ্ছি। হিন্দুস্থান নাকী
আমাদের নিজের দেশ। কী জানি, হবে হয়তো।
বটগাছটাকে বড়ো আত্মীয় মনে হচ্ছিল। বাড়ি এবং গ্রামের আত্মজন, পড়শী বান্ধবজন, খেলার
সঙ্গীসাথী, সহপাঠী-পাঠিনী সবার চোখের জলে বিদায় নিয়ে এখন এই বটগাছটাকে আঁকড়ে ধরে
আছি। ধরে আছি তার শিকড়টাকে। সেও যেন আমাকে ছাড়বে না, এমন এক বোধ। মনের এই
অনুভূতিটিকে সঙ্গের জনেদের সাথে ভাগ করে নিতে পারছিলাম না। বাচ্চুকে খুশিই মনে
হচ্ছিলো। ও কি এই ঘটনাটায় কিছুমাত্র কষ্ট অনুভব করছিল না? কী জানি! সাবি পিসির
কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি প্রায়ই ওদেশে যাতায়াত করেন। সেজন্য তাঁর
পাসপোর্ট, ভিসা কিছুরই দরকার হয় না। আমরাও বিনে পাসপোর্ট ভিসা বা মাইগ্রেশানেই
যাচ্ছি। যা ব্যবস্থা সাবি পিসিই করবেন। তাঁর কে এক ভাইপো ওদেশের অশোকনগরের
কল্যাণগড় কলোনীতে থাকে। তারা পঞ্চাশের দাঙ্গার সময়কার উদ্বাস্তু। কল্যাণগড়ে এতদিনে
তাদের কলোনী হয়েছে। আমি ততদিনেও জানিনা কলোনী, উদ্বাস্তু, এসব কাকে বলে, মানে কী
এসব শব্দের। সাবি পিসিকে জিজ্ঞেস করতে সব বুঝিয়ে দেন। বলেন, ‘এই, তোরাও কিন্তু এখন উদ্বাস্তু, রিফুজি।’ কথাটা ধক করে যেন বুকে লাগলো। তাহলে যারা গ্রাম
ছেড়ে, ভিটেমাটি ছেড়ে হিন্দুস্থানে চলে যায় তারা সব উদ্বাস্তু বা রেফিউজি? ভাল করে
জানি না।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুনেছি এবং শিখেছি পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য, হিন্দুস্থান
হিন্দুদের জন্য। এদেশে যারা হিন্দু আছে, তাদের সবাইকে একদিন অবশ্যই হিন্দুস্থানে
চলে যেতে হবে। তাহলে কী তারা সবাইই উদ্বাস্তু হয়ে যাবে? সব কিছু মাথার মধ্যে কী
রকম যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। পরে জেনেছি, ব্যাপারটা সেরকম নয়। যারাই ওদেশে যাচ্ছে,
তাদের সবাই উদ্বাস্তু নয়। যাদের ওখানে কোনো রকমই সহায়-সম্বল নেই, বাড়ি বা বাসা
নেই, ক্যাম্পে, শেয়ালদা স্টেশান নামে একটা রেল স্টেশানের চত্বরে পড়ে থাকে, তারাই
শুধু উদ্বাস্তু। হিন্দুস্থানের সরকার তাদের জন্য সব সুখ-সুবিধের বন্দোবস্ত করে।
সেখানের গভর্নমেন্ট হিন্দু কী না তাই! আমাদের সংখ্যালঘুদের মধ্যে ঐ সময় এ রকম কথা
খুব চলতো।
বরিশাল শহরে কলেজে পড়ার সময়, স্টিমার ঘাটের আশেপাশে কিছু ভিনদেশী মানুষ দেখেছি।
সেখানে তাদের ‘মোহাজের’ বলতো সবাই। আমরা জানতাম তারা বিহারী মুসলমান। পাকিস্তান
মুসলমানদের দেশ বলে এখানে থাকতে এসেছে হিন্দুস্থান ছেড়ে। অনেক পরে জেনেছি যে তারাও
দাঙ্গার হাত থেকে বাঁচার জন্য এদেশে এসেছে, যেমন এদেশের হিন্দুরা হিন্দুস্থান
যাচ্ছে। তখন আমার বয়স ষোল সতেরো, কিন্তু তখনো হিন্দুস্থান পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়
চরিত্রগত ব্যাপার-স্যাপারগুলো ঠিকমতো বুঝতাম না। পঞ্চাশ একান্নর সময়, যখন বয়স পাঁচ
ছয় বছর, কী একটু বেশি, তখনকার দাঙ্গার আতঙ্কের স্মৃতি কিছু মনে আছে। কিন্তু
পাকিস্তানে যতদিন ছিলাম, আমাদের অঞ্চলে দাঙ্গার কোনো অভিজ্ঞতা হয় নি। আতঙ্ক এবং
গুজব অবশ্য বরাবরই ছিল। এসব কথা বিষাদবৃক্ষে সবিস্তারে লিখেছি, পুনরুল্লেখের
প্রয়োজন নেই। তবে প্রধান কথা যেটা সেটা হলো, আমার এই দেশত্যাগের পিছনে দাঙ্গার
কোনো ভূমিকা নেই। আমাকে অন্তত কেউ মেরে তাড়ায়নি।
আমার এই দেশছাড়ার ব্যাপারটা হঠাৎই ঠিক হয়েছিল। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর যে আতঙ্ক এদেশে
হিন্দুদের মধ্যে সর্বগ্রাসী প্রভাব ফেলেছিল সেই আতঙ্কেই আমার দাদা দিদিদের
পশ্চিমবঙ্গে, কোলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। তখন বোঝার বয়স হয় নি, খুব বায়না ধরেছিলাম
তাদের সঙ্গে চলে যাবার। তারপর বারো বছর কেটে গেছে, এখন এই নদীতীরে স্টিমারের জন্য
অপেক্ষায় বসে বসে বুঝতে পারছি, প্রয়োজন যত তীব্রই হোক, দেশ ছেড়ে যাওয়া মানে কী।
নানা কার্যকারণ পরম্পরায় এটা বুঝেছিলাম আমার বা আমাদের মতো ছেলেদের এই দেশে কিছু
হওয়ার নেই। এমনকী রাষ্ট্র যদি কিছু সুযোগ দেয়, তাও নয়। কারণ বাল্যাবধি নিজ সমাজ
এবং পরিবারের যে কুশিক্ষায় বড়ো হয়েছি, তাতে ওই সময়, এই দেশটিকে, আমরা আর নিজেদের
সত্যিকারের দেশ বলে ভাবতে পারছিলাম না, চাইছিলামও না বোধহয়। এর জন্য সংখ্যাগুরু
সমাজের সামপ্রদায়িকতাবাদিরা এবং রাষ্ট্র যেমন দায়ী, দায়ী আমার হিন্দুসমাজের
সামপ্রদায়িকতাবাদীরাও। তারা কেউই সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে নি। ফলে,
আমাদের প্রজন্মের হিন্দু সন্তানদের মানসিকতা দোদুল্যমানতার মধ্যেই ছিল, দেশ ছাড়ব,
না থাকবো-আমাকে বাস্তবে যে সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করতে হয়েছে সেগুলোই সাতকাহন বলছি
বটে, কিন্তু পরিস্থিতির গভীরে যে আরো সত্য আছে, তার উদ্ঘাটন খুব সহজ নয়, আর সহজ নয়
বলেই এ ব্যাপারে নিয়ত নিজেকে নানাভাবে খুঁড়তে হয়। আমার বিষাদবৃক্ষ সেই খোঁড়াখুঁড়ির
ফল, এ রকম বলা আমার পক্ষে বোধহয় খুব আত্মশ্লাঘার হবে না। খোঁড়াখুঁড়িটা ঠিকমতো না
হলে, আমরা বড়ো বাজে কথা বলি। সেইসব বাজে কথা বলার মতো মানুষ উপমহাদেশে নেহাৎ কম
নেই। তারা কেউই নিজেকে খোঁড়েন না, কথাটা উপমহাদেশে আজও সত্য।
মেট্রিক পাশ করে, এক বছর কলেজে পড়াশোনার চেষ্টা চালিয়েও যে নানা কারণে সুবিধা করতে
পারিনি তার জন্য আমার নিজের নির্বুদ্ধিতা, অভিভাবকদের উদাসীনতা, বাহ্যিক যেসব
কারণের কথা বিষাদবৃক্ষে উল্লেখ করেছি, তার চাইতে কম দায়ী ছিল না। কিন্তু সময়টাই
ছিল তখন একটা অদ্ভুত সৃষ্টিছাড়া ধরনের। একেই বোধহয় সার্বিক অবক্ষয় বলে, যা ভেতর
এবং বাইরে থেকে যুগপৎ আক্রমণে সব উদ্যমকে বিষণ্নতার তামসে ঢেকে দিতে চায়। তাই
সিদ্ধান্ত হিন্দুস্থানে গিয়ে যদি কিছু ভাগ্য পরিবর্তন হয়। কারণ আগেই বলেছি ঘরে
বাইরে শেখানো সেই বুলি, হিন্দুস্থান হিন্দুর এবং পাকিস্তান মুসলমানদের। সুতরাং
হিন্দুস্থানে গিয়ে রাজা হবার খোয়াব। মানসিকতার দিক থেকে তখনকার তথাকথিত ভদ্র
হিন্দু সন্তানেরা সত্যই সেরকমই খোয়াব দেখতাম, যেটা সামপ্রদায়িক শিক্ষার ফল।
কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়ে যাবার পর বুঝতে পারছিলাম, চিরদিনের মতো দেশ ছেড়ে চলে যাবার
মানসিকতাটা কখন যেন অন্তর্হিত হয়েছে। যদিও গ্রামগুলো ততদিনে শূন্যপ্রায়, ভাললাগার
মতো, মনে আনন্দ সৃষ্টি করার মতো কিছুই আর এখানে অবশিষ্ট নেই। তথাপি মাঠ, মাটি,
ঘাস, গাছপালা, অবশিষ্ট হতভাগ্য এবং কালের বলি হিন্দু পরিবারগুলো, যে ভূমিহীন
মুসলমান চাষী পরিবারের মানুষজন দেশভাগের কোনো প্রসাদ পায়নি আজাদির নামে তারা, কী
ভীষণভাবেই না সবাই আমার সঙ্গে ওতপ্রোত। তারা কেউই ছাড়তে চাইছে না আমাকে। ভালয়
মন্দে এরাই তো আমার স্বদেশ, এরাই স্বজন।
সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, বিষাদবৃক্ষ এবং ধানসিদ্ধির পরণকথা, এই তিনখানি গ্রন্থেই আমার
মুখ্য চরিত্ররা বেশির ভাগই প্রান্তিক অবস্থানের। যাঁরা আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকামের
ছোমেদ বয়াতি, গেঁজেল কার্তিক, কীর্তনীয়া সুধীর গাইন, খলিল, ইত্যাদি চরিত্রগুলোর
কথা মনে রেখেছেন, তাঁরা স্বীকার করবেন, আমি যতটুকু লেখালেখি করেছি, তার সবটাই
যাদের নিম্নবর্গ/বর্ণ বলা হয় তাদের নিয়েই। অন্য বই দুখানিতেও এরা এবং অন্যরূপ
চরিত্ররাই ভিড় করে রয়েছে। এর প্রধান কারণ, ঐ সময়টায় অমি তাদের শ্রেণীরই একজন হয়ে
গিয়েছিলাম। দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং নিজ শ্রেণীতে সঙ্গীহীনতার সুবাদেই তা পেয়েছিলাম।
কিন্তু তা কী পুরোপুরিভাবে? অবশ্যই নয়। কিছু দোষ রক্তে ছিলই।
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় আমার মা, ভাইবোনদের সঙ্গে আমার এইসব সঙ্গীসাথীরাও আমাকে
নিরস্ত করতে চাইছিল। কিন্তু হায়, তা যে আর সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাদের মতো
মানুষদের যে আমি কোনোদিন ভুলে যাইনি, তার প্রমাণ এতদিন পরেও তারা আমার লেখার
উপজীব্য হয়েছে। আমি এখনো তাদের কাছেই আসি। অবশ্য তারা ছাড়া উপজীব্য করার মতো ঐ
প্রান্তিক জগতে আমার আর কীই-বা ছিল। লেখালেখির মধ্যে এসে এখন ভাবি, যদি তাদের
জীবনের সঙ্গে আরো বেশি করে সম্পৃক্ত হতে পারতাম! যদি আরো একাত্ম হতাম তাদের সঙ্গে!
গ্রাম ছাড়ার শেষ মুহূর্তটার কথা আজও মনে পড়ে। বিষাদবৃক্ষে যে বড়ো খালটার কথা
বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে, তার পারে দাঁড়িয়ে আমার ছোট ছোট ভাইবোনেরা এবং খালের দুই
পারের নিবাসী ভূমিহীন দরিদ্র চাষী ঘরের বন্ধুরা সবাই যেন তাদের স্বজন বিচ্ছেদের
ব্যথায় শোকাকুল। এরা সবাই দরিদ্র। দরিদ্র আমার অনুজ-অনুজারাও। আশ্চর্য! আমার ঐ সব
সঙ্গীসাথীরা, যাদের আশ্রয়ে আমার শৈশব কৈশোরের দিনগুলো, এই শূন্য অঞ্চলেও মুখর হতে
পেরেছিল, যারা আক্ষরিক অর্থেই আমার ও আমার এইসব অনুজ-অনুজাদের ক্ষুধায় নানান বনজ
আহার্য যুগিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে, তারা ওদের সান্ত্বনা দিচ্ছিল যে আমার
অনুপস্থিতিতে তারাই ওদের দেখবে। এর অনেক আগে থেকেই আমাদের পরিবার চরম দারিদ্র্যে
আপতিত হয়েছিল এবং এই সব নিম্নবর্গ/বর্ণীয়রাই তাদের ক্ষুধার খাদ্যের ভাগ দিয়ে
আমাদের বাঁচিয়েছে। হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে নিম্নবর্গীয় এইসব মানুষেরা, যখন আমরা মধ্যস্বত্বভোগী
বা তালুক-মুলুকের অধিকারী ছিলাম, আমাদের কাছ থেকে কিছু সহায় সাহায্য পেয়েছে।
কিন্তু সেসব ছিল তাদের শ্রমের বিনিময়ে। কিন্তু এই সময়টায় তারা যে সহায়তা আমাদের
করেছে, তার কোনো বিনিময় মূল্য ছিল না। সহায় সাহায্য যা পেয়েছিল, তার জন্য তাদের
বাপ-চাচাদের অপরিসীম পরিশ্রম করতে দেখেছি। আজ বুঝি, সে-তুলনায় তারা কিছুই পায় নি।
বরং অবহেলা, ঘৃণা, লাঞ্ছনাই ছিল তাদের একমাত্র প্রাপ্য। তথাপি আমাদের দারিদ্র্যে
তারা দাঁড়িয়েছিল আমাদের পাশে কোনো বিনিময় মূল্য ব্যতিরেকেই। শুধু এক প্রকাণ্ড
হৃদয়ানুভূতিই ছিল তাদের এই সহযোগিতা, সহমর্মিতার উৎস। পৃথিবীর অন্যকোনো দেশের
শোষক-শোষিতের মধ্যে এ রকম সম্পর্কের কথা জানি না। যে শ্রেণীতে আমার জন্ম, সেই
শ্রেণীটা বোধহয় ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং তার অব্যবহিত পরের পঞ্চাশের দাঙ্গার
ঐড়ষড়পধঁংঃ-টা না প্রত্যক্ষ করলে কোনোদিন এই নিম্নবর্গ/বর্ণের উপর তাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত
অন্যায়ের মাত্রাটা জানতেই পারতো না। দৈবনির্বন্ধের গেরো যে ঘটনাটা দুর্ভাগ্যক্রমে
ঘটলো ধর্মকে উপলক্ষ করে, আসলে ঘটাতো উচিত ছিল বহু আগেই শ্রেণীবিদ্রোহের মাধ্যমে।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই যে আমার অঞ্চলের নিম্নবর্গ/বর্ণ এই ঐড়ষড়পধঁংঃ-এর
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গোটা এলাকাকে রক্ষা করেছিল, অথচ তাদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল ঐ
সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পতনোন্মুখ মধ্যস্বত্বভোগী তথা তালুকদার-জমিদারদের বিরুদ্ধে
তাদের পুরুষানুক্রমের ক্রোধকে চরিতার্থ করা। কিন্তু তারা তা করে নি, বরং রক্ষকের
ভূমিকায়ই দেখা গিয়েছিল তাদের। তথাপি আমার শ্রেণী কি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল? এ
কথাটা আমি শুধু উচ্চবর্গ, নিম্নবর্গের সম্পর্কে বলছি না, উচ্চবর্গ, নিম্নবর্গ
নির্বিশেষে মুসলমান এবং হিন্দু সমপ্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের নিরিখেও বলছি।
পরবর্তীকালে, এই নিয়ে চিন্তাচিন্তনের সময় আমি আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি যে এ অঞ্চলে
কোনোদিন সে অর্থে কোনো কৃষক বিদ্রোহ ঘটেনি, জানি না, এর কারণ খোঁজার জন্য
নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চাকারীরা কোনো গবেষণাকর্ম করেছেন কিনা। সব বিষয়ের মতোই, এই
বিষয়টিরও পড়াশোনায় আমি বড়োই দরিদ্র।
আমার চলে আসার সময় আমার অনুজ-অনুজারা সবাই নিতান্তই শিশু। আশ্চর্য এবং হায়, ঐটুকু
শিশুরা, আমি চলে গেলে, কে তাদের খাওয়ার জোটাবে সেই চিন্তায় ভাবিত। রাষ্ট্র
মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বত্ব আইনবলে লোপ করেছে, কিন্তু তার ওপর নির্ভরশীল সাধারণ
গৃহস্থদের বা তাদের সহায়তার এই নিম্নবর্গ/বর্ণের যারা সামান্য জীবিকা অর্জনের
মাধ্যমেও বেঁচে থাকতো, তাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা রাখে নি। জানিনা, একটা
শ্রেণীকে ইতিহাসগতভাবে উৎসৃষ্ট করতে হলে, তাদের শারীরিকভাবে মেরে ফেলার পরামর্শ এই
রাষ্ট্র পুরুষদের কোনো ক্রান্তদর্শী দার্শনিক দিয়েছিলেন কি না। নচেৎ একটা শ্রেণীকে
না-খাইয়ে মারার এই বৈপ্লবিক কর্মের হেতু কী? উদ্দেশ্য তো সমাজটাকে পাল্টানো।
শেষ বিদায় নিয়ে মায়ের আলিঙ্গনচ্যুত আমি, হিন্দুসংস্কারবশত, আশপাশ সমগ্র বস্তু,
অবস্তু, প্রাণী, অপ্রাণীকে প্রণাম জানিয়ে মনে মনে বলেছিলাম, ক্ষমা কর, ক্ষমা কর।
হে গৃহ, হে পার্শ্বস্থ বৃক্ষ, হে লতাগুল্মের ঝোপ, হে দিগন্তব্যাপী ঘাস এবং
তৃণশম্প, হে আমার দুর্দিনের আর নিঃসঙ্গ দিনগুলোর সাথী রাখাল, কিষাণবৃন্দ, তোমরা
পলায়নপর এই অক্ষম জাতককে করুণা কর, ক্ষমা কর। আমি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের
আক্রমণ থেকে আমার অনুজ-অনুজাদের বাঁচাবার জন্য দেশ ত্যাগ করছি। আমি তোমাদের সবার
কাছে আবার ফিরে আসবো। তোমরা ততোদিন সবাই সুস্থিত থেকো।
কিন্তু তথাপি যেন পরিপার্শ্বস্থ আমার স্বজনেরা, সুজন বৃক্ষেরা, দিঘির ঘাটের
বিস্তীর্ণ চত্বর, তার পারের মন্দির শ্রেণী, তাদের আশপাশের ফুলের বাগিচা, পথ,
পথমধ্যস্থ নানা বন্ধুরতা, কোনো বিশেষ পরিচিতি গর্ত, রাস্তার বাঁক এবং এমনকী
প্রতিটি রজঃকণা যেন আমাকে আঁকড়ে রাখতে চাইছিলো। ঠাকুরদা ঠাকুরমার মাটির চিতা দু’টি, ঠাকুরদা মশাইয়ের আশ্রম বাড়ি, বাগান, যেন
বলছিল, তিষ্ঠ ক্ষণমিহ। কোথায় যাবে? কিসের আশায়? যেখানে যাবে, সেখানে সুস্থিতি আছে?
শান্তি, স্বস্তি আছে আরও ঢের? অনিশ্চয়তা, অসম্মান, গ্লানি সেখানেও নেই নাকী? না,
এর কিছুই আমাকে আটকে রাখতে পারে নি। আমি বেরিয়ে এসেছিলাম। পারিবারিক রীতি মেনে,
কোনো পুরোহিত উচ্চারণ করে নি সেই পরিচিত মন্ত্রগীতি, ধেনুর্বৎস্য প্রযুক্তা,
পুষ্পমালা পতাকা, দ্বিজ নৃপ গণিকা, সদ্যোমাংস ঘৃতংবা দক্ষিণাবর্ত্মবহ্নিঃ...
ইত্যাদি। না এ রকম আয়োজনের দিন তো সেই কবেই শেষ, আমার সম্বল হলো শুধু সবার চোখের
জল।
এখন আত্মীয় বলতে এই বট বৃক্ষটিই একমাত্র, যে আমাকে শেষ বিদায় জানাবে। আমি মনে মনে
উচ্চারণ করবো, ্তুগু ঈড়ঁহঃৎু, ভধৎববিষষ !্থ তারও আর বিলম্ব নেই। ১৯৪৭-এর অবদান এক
দলের জন্য ট্রম্যা আর একদলের জন্য ট্রায়াম্ফ্। আমি ট্রম্যার বোঝা ঘাড়ে করে
এক্ষুনি স্টিমারের মধ্যে ঢুকে পড়ে হাজার উদ্বাস্তুর একজন হয়ে যাব। আমার নিজস্ব
কোনো পরিচিতি আর থাকবে না। অমি তখন অমুক গ্রামের অমুক বাড়ির একজন বললে কেউ আমাকে
চিনবে না। আরও অজস্র ছিন্নমূলের মতো আমি একটা প্রকাণ্ড ‘না’-এর মধ্যে মিলিয়ে যাব।
বেলা প্রায় শেষ। হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড ভোঁ-এর শব্দে আমার তন্ময়তা ভাঙলো। ঐ শব্দটায়
সেদিন বুকের মধ্যে যে প্রবল আলোড়ন উঠেছিল, আজও মনে পড়লে তার কাঁপুনি টের পাই। সেই
অনুভূতির বর্ণনা দিতে পারবো না। যারা জীবনে একবার সেই আওয়াজ শুনেছে, তারাই সেটা বুঝবে।
আর খানিকক্ষণের মধ্যেই স্টিমার এসে নোঙর ফেললো এবং আমার নিজস্ব মাটির সঙ্গে সব
সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলে, ঘোর গর্জায়মান জলযানের ভিতরে আমরা হারিয়ে গেলাম। বরিশাল
এঙপ্রেস আর একবার প্রবল নাদে ভোঁওও বাজিয়ে তার যাত্রা পথ ধরলো। এই হলো আমার দেশ
ছাড়ার গল্প।
মাননীয় শ্রোতৃবর্গ, এবার আমার দেশ খোঁজা নিয়ে কিছু আলোচনা আপনাদের সামনে রাখবো।
এতক্ষণ যে আবেগের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলাম, সে আবেগ আমার মতো হাজার লক্ষ মানুষের
ক্ষেত্রেই একদিন বাস্তব ছিল, বাস্তব ছিল হিন্দুর কাছে, বাস্তব ছিল মুসলমানের
কাছেও। কালের নিয়মে একসময় তা স্বাভাবিকভাবেই একটা সমে এসেছে। কখনো কখনো সেই
দুঃখানুভূতি হঠাৎ করে তাদের মন উদাসীন করে দেয়। তখন হয়তো তারা তাদের
দেশ-হারানোজনিত দুঃখের ঝাঁপি খুলে কিছু অতীতচারিতায় মগ্ন হয়। তার কারুর-বা
কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত, তারা এই বিরাট গ্রহটিকেই নিজস্ব জ্ঞানে গ্রহণ করার মতো
ঔদার্যের অধিকারী। কিন্তু আমার মতো কিছু মানুষ আছে, যারা সম্ভবত কৌম সমাজের
ক্ষুদ্র আবেষ্টনীর আকর্ষণ পরিত্যাগ করে তার বাইরে যেতে পারে না। তাদের কাছে
নাগরিকত্ব, জাতি, জাতি রাষ্ট্র ইত্যাদির ধারণাগুলো বোধহয় খুব পরিষ্কার নয়। সুতরাং ‘দেশ’ বিষয়ক ধারণা ‘দেশের
মানুষ’ বিষয়ক আত্মীয়তাবোধ ইত্যাদির পরম্পরাই তাদের
ভালবাসার জগৎ, বোধের জগৎ। সেটা হারিয়ে তারা চিরকাল বিষণ্নই থেকে যায়, সমে আর আসে
না। প্রতিক্ষণেই তাল, লয়, ছন্দ কেটে যায়।
অনেকবারই খুঁজতে এবং বুঝতে চেয়েছি, আমার মতো মানুষেরা ‘দেশ’ বলতে ঠিক কি বুঝি? সেটা কী আমাদের গ্রাম? আমাদের কৌম সংস্কৃতির
মোহ কাটাতে না পেরেই কী আমরা দেশ দেশ করে বিষণ্ন হই? অথবা আমরা কি সত্যিই
কূপমণ্ডূক, যেমন নাগরিক বিদ্বজ্জন আমাদের অভিহিত করে রেখেছেন? কিন্তু আমাদের মতো
মানসিকতার বহু মানুষকে তো আমরা দেখেছি, দেখছিও, যাঁরা নিজেদের বিশ্বনাগরিকের স্তরে
উন্নীত করেও, যথেষ্ট জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধিকারিক হয়েও ঐ দেশ বোধটাকে বিসর্জন দিতে
পারেন না। এখানে আমি দু’জন
প্রথিতযশা মানুষের নাম উচ্চারণ করবো, যাঁর একজন সমপ্রতি প্রয়াত প্রায় শতাব্দীর
বয়সী রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, অন্যজন তপন রায়চৌধুরী। আমি এঁদের জীবন এবং প্রজ্ঞার
বিষয়ে এখানে কিছু বলার প্রয়োজন দেখিনা, আপনারা সারস্বতজনেরা তাঁদের বিষয় এবং
তাঁদের রচনার বিষয় সম্যক জানেন। আমি এঁদের খুব কাছ থেকে দেখে, আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে
নানান প্রশ্ন করে দেখেছি, তাঁরা যতই বিশ্ব নাগরিকত্ব অর্জন করুক না কেন, ‘দেশ’এর কথায় তাঁরা অশ্রুপ্লাবিত হন। ঠিক এমনটিই দেখেছি প্রয়াত
শিবনারায়ণ রায়ের আচরণে। আমাদের মতো, বিশেষ করে আমার মতো একশ’ ভাগ কৌম সংস্কৃতির চরিত্রের একজন কূপমণ্ডূক
হয়তো প্রাক-স্বাধীনতা কালের জাতিগঠনকারী মনীষীদের ্তুঘধঃরড়হ রহ ঃযব সধশরহম্থ-এর
শিক্ষা গ্রহণ করে একজন প্রকৃত নাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু তাঁরা? আমি জানিনা
আপনারা আমার বক্তব্যে সহমত হবেন কীনা, কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে পাশ্চাত্য আদর্শে
জাতি রাষ্ট্র গঠনে কোথায় যেন অনেকটাই ফাঁক থেকে গিয়েছিল। সামপ্রদায়িকতার ভূতেরা
কখনোই যেন জাতি রাষ্ট্রের উপর থেকে তাদের দখলদারি ছাড়ে নি। ভূত ছাড়াবার রোজাদের,
স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুতেই যেসব ভূতেরা মগজ দখল করে নিয়েছিল, তারা সেই দখলদারি
থেকে কোনোদিনই যেন আর নড়ে বসলো না। যাহোক, এই বিষয়টিতে বিশদ হওয়া বুদ্ধির কাজ হবে
না। তাছাড়া স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যেখানে হালে পানি পাননি, আমি কোন হনু? প্রসঙ্গত,
১৯০৬-এর পর থেকে লেখা তাঁর তাবৎ রচনার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অনেক
ঢক্কানিনাদ করেও বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের উগ্র কষাঘাত থেকে তাঁকে বাঁচানো
যায়নি।
পাকিস্তান আমলে যতদিন এদেশে ছিলাম, স্কুল কলেজে জাতীয়তার একরকম পাঠ পেয়েছি। যখন
হিন্দুস্থানে গিয়েছি তখন পেয়েছি অন্যরকম। কোনোটাই মজ্জা মগজে যে তেমন ঢুকেছে এমন
নয়। সর্বত্রই আমার ধারণা হতো, আমি যখন এ দেশের নাগরিক, তখন ঐ দেশের সবাই আমার
শত্রু। সে অর্থে, পরবর্তী জীবনে আমি যাকে বাংলাদেশ মুক্ত হবার সদ্য সদ্য পরে বিয়ে
করি, পাকিস্তানী নাগরিক থাকা অবস্থায় তিনি আমার এবং হিন্দুস্থানী নাগরিক হিসেবে আমি
তাঁর শত্রু। পরস্পর বিবাহিত স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটা গূঢ় শত্রুতা থাকে, এ রকম
ভুক্তভোগীরা বলে থাকেন। কিন্তু তার মানে কী এই? জেনেশুনে শত্তুর বিয়ে করবো? তাছাড়া
ছোটবেলা থেকে যাদের সঙ্গে বড়ো হয়েছি, স্কুল-পাঠশালায় পড়েছি, খেলাধুলা করে, খালে
ঝাঁপিয়ে, ফুটবল পিটিয়ে, তারাও আমার শত্রু? এই হিসেব মেলাতে মেলাতে চাকরি-বাকরিতে
ঢোকার যখন বয়স হলো, তখন একবার কথা উঠেছিল ‘এয়ারফোর্সে’
চেষ্টা করে দেখবো। সেই সময়েই শত্রুর সমস্যাটা প্রবল হয়েছিল। সেটা ১৯৬৫ সাল। কিন্তু
বায়ুসৈনিক হয়ে কার ওপর বোমা ফেলবো আমি? বিশ্বাস করুন, এ রকম একটা মন-খারাপ-করা
চিন্তা, তার অজস্র ডালপালা নিয়ে মাথায় ভিড় করেছিল সেদিন এবং ঐ প্রচেষ্টাটা আর
কোনোদিন করি নি। আমি হয়তো করি নি ঠিকই, কিন্তু তাতে কী এলো গেলো? পঁয়ষট্টির যুদ্ধ
জয়ের দাবি নিয়ে দুই পক্ষের নির্বোধ তরজা তাতে কী কিছু কম হয়েছে, না পূর্ব
পাকিস্তান থেকে আগত কোনো উদ্বাস্তু হিন্দুস্থানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে গুলি,
বোমা কিছু কম ছুঁড়েছে, অথবা বিপরীতক্রমেও অনুরূপ ঘটে নি?
পশ্চিমবঙ্গে, আমাকে কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, ষাট বছরের অধিককাল হলো দেশটা ভাগ হয়েছে,
আজও তা নিয়ে জাবরকাটা, নস্টালজিক হওয়ার কারণ কী? যে-দেশটাতে থাকি তাকে কী নিজের
বলে ভাবা যায় না? অতো দেশ দেশ করাই-বা কেন?
কথাটা নিয়ে চিন্তা করেছি ঢের। উত্তর যা পেয়েছি, সেটা প্রকাশ করতে পারি এমন যুক্তি
বা ভাষা আয়ত্তে নেই। বরং একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের শোনাই। গত বছর মার্চের
শেষে ঢাকায় এসেছিলাম। সর্বকনিষ্ঠ ভাইটি দীর্ঘ তিন বছর ক্যানসার রোগে ভুগে সদ্য
প্রয়াত হয়েছেন। শোকের তীব্রতা দূর করতেই আসা, ওখানে মন টিকছিল না। বিভিন্ন
তরুণ-তরুণী লেখকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছিল। (প্রায় প্রত্যেকেই বেশ ভাল লেখেন)।
তাঁদের মধ্যে একজন স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমাকে দেখভাল করার এবং সমমনস্ক
বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবার। সেই তরুণটি বলেছিলেন তার মায়ের গল্প।
বর্ধমানের মেয়ে। আমার বিষাদবৃক্ষ পড়ে নাকি তাঁর খুব ভাল লেগেছে। তরুণটি বলেছিলেন, ‘মা এমনিতেই কথায় কথায় আমার দেশ, আমার দেশ করেন।
বিষাদবৃক্ষ পড়ে তার মাত্রাটা যেন অনেক বেড়ে গেছে।’ ছেলেটি জানিয়েছিলেন যে বর্ধমানে তাঁর নানা আছেন। কোলকাতা এলে,
আমাকে নিয়ে, মায়ের বাপের বাড়ির দেশ দেখিয়ে আনবেন।
অনেকের ধারণা যে গ্রামীণ লোকেরা ‘দেশ’ বলতে গাঁয়ের বাড়ি বোঝে এবং অন্যদের বোঝায়ও।
কথাটার মধ্যে সত্যতা আছে, তবে আমি নিশ্চিত, ব্যাপারটা ঐটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। এই
কথাটা নাগরিকজনদের একটু বুঝে দেখতে হবে। মহিলার এবং আমার একটা জায়গায় ভীষণভাবে
একটা কামারাদারি আছে। আমাদের ‘বোধের
দেশ’ একটাই, তাকে ১৯৪৭-এর করাতটা দু’ভাগ করতে পারে নি। কিন্তু টেনে, হিঁচড়ে শিকড়টা
ছিঁড়তে পেরেছে খানিক। ওখানেই আমাদের হার হয়েছে। ঐ ছেঁড়া অংশের শিকড়টুকুর জন্যই
আমাদের দেশ দেশ করা। নইলে যেখানে পারি সেখানে থাকি, তাতে আর কী এসে যায়? বাঙালি তো
জন্মসূত্রেই উদ্বাস্তু, সমপ্রদায় নির্বিশেষেই।
এই টেনে হিঁচড়ে শিকড় ছেঁড়ার ইতিহাস যদি খুঁড়তে যাই, দেখবো শুধুই সামপ্রদায়িকতার
তীক্ষ্ণ নখ নয়, সেখানে আছে আরো ঢের জঞ্জাল, সবচাইতে বড়ো যেটা সেটা হলো, আমাদের
পরম্পরাগত দেশচেতনাকে তার নিজস্ব উপযুক্ত বিকাশের পথে পরিচালিত না-করে, ভুলভাল
পদ্ধতিতে পাশ্চাত্য জাতি রাষ্ট্রীয় ছাঁচে ঢেলে সমপ্রদায় নির্বিশেষকে জাতি হিসাবে
মর্যাদা দেবার প্রচেষ্টা। তাতে ক্ষমতা পাওয়া গেছে ঢের, তবে জাতি হিসেবে মর্যাদা?
কী জানি? জাতি গঠনটাই কী হলো?
আমার অগ্রজা সেই মহিলা বা আমি, বা আমার মতো জনেরা কী ঘধঃরড়হ, ঘধঃরড়হ ঝঃধঃব,
ঈরঃরুবহ ইত্যাদি পরম্পরায় কোনোদিন ছিলাম? আমরা ছিলাম ‘দেশের মানুষ’। আমাদের সেই বোধের দেশের কোনো সীমান্তরেখা নেই, সীমান্তরক্ষী
প্রহরী নেই, নির্ধারিত কোনো মানচিত্র নেই। সেই দেশের পরিধি শুধু হৃদয়ের পরিধির
সঙ্গে বাড়তেই থাকে এবং এক প্রাচীন প্রগাঢ় মন্ত্রে আমাদের ঋদ্ধ করে, ‘আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্তম্ জগৎতৃপ্ততু।’ সর্ববৃহৎ সত্তা থেকে তৃণশীর্ষ পর্যন্ত সবার
তৃপ্তি হোক। সেই দেশ আমাদের পরম্পরাগত বোধের দেশ। জাতিবৈর সেই দেশের ধর্ম
নয়।
আমার এই কথাগুলো আপনাদের হয়তো ইউটোপীয় ভাবালুতার উচ্চারণ বলে বোধ হবে এবং তা যে
অন্যায় এমনও মনে করিনা। জগতে বাস্তবের সমস্যা, ইতিহাসের জটিলা কুটিলাদের কৌটিল্য,
ইত্যাদি নানান ফ্যাক্ড়া আছে। সেইসব পাশে ঠেলে রেখে, আমাদের মতো ‘দেশপাগলাদের’ প্রলাপ শুনতে বয়ে গেছে আপনাদের, বিশেষ, আমাদের এই ছিঁচকাঁদুনির
যখন কোনো সামপ্রতিক বাস্তবতা নেই, অন্তত যাঁরা বর্তমানের সমস্যাদির সমাধানের কথা
ভাবেন, তাঁদের কাছে। কিন্তু আমাদের এই মানসিক সমস্যাটার সমাধান নেই বলে, এর কোনো
নথি থাকবে না কেন? জাতীয় অভিলেখাগারে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী একদিন খুঁজবে না আমাদের
মতো হতভাগা হতভাগীদের আকাঙ্ক্ষার দেশ কী ছিল, তার স্বরূপ জানতে চাইবে না তারা?
মানসিকতার, ভাবের, ভাবালুতার বা যদি আমাদের এই ব্যাপারটাকে কেউ ‘দেশ’খ্যাপামিই বলেন, সেসবের কী ইতিহাস হয় না, না সেসব ইতিহাস রচনা করতে
নেই? আমার মনে হয় নিম্নবর্গ/বর্ণ বা তাদের মধ্যে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের এই বিষয়ক
মানসিকতার ইতিহাস রচনা খুবই জরুরি।
আমার এই দেশখ্যাপামির জন্যই যে গ্রন্থত্রয়ের উল্লেখ সমানে করে যাচ্ছি, সেসবের
নির্মাণ। অন্তরস্থ আকুতি তাতে কতোটা রূপ পেয়েছে, তা আপনারা জানেন। তবে কিছু কিছু
ক্ষেত্রে আমি এমন কিছু মানুষের প্রতিক্রিয়া পেয়েছি যে তার গল্প আপনাদের না শোনালেই
নয়। আপনাদের ধৈর্যের উপর আরেকটু অত্যাচার না হয় করলাম। তারা নিম্নবর্গ/বর্ণের সব
প্রান্তিক মানুষ।
হুগলী জেলার যে মফঃস্বল অঞ্চলটিতে আমার বর্তমানে যাবজ্জীবনের প্রবাস, তার কাছেই
একটি গ্রামে মাঝে মাঝেই সান্ধ্যভ্রমণ উপলক্ষ্যে যাই। এই অঞ্চলটির শতকরা নব্বই বা
একশ ভাগই কৈবর্ত বা জেলে জাতীয় মানুষের দ্বারা অধ্যুষিত। তারা সবাই এক সময়ে
বৃহত্তর বরিশাল জেলার বাখরগঞ্জের অধিবাসী ছিল। এখান থেকেই আশপাশ শহরতুল্য
বাবুবসতিগুলোর পরিচারিকা, পরিচারকের জোগান হয়। আমার বাড়িতে যে জেলে বৌটি
পরিচারিকা, তার খুব কৌতূহল, ‘দাদায়
দিন রাইত উব্বুর অইয়া অতো ল্যাহে কী?’ সেই সময়টা ছিল আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম রচনার কাল। যাঁর কাছে
প্রশ্ন, তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘ঐ
দেশের কথা নিয়ে একখানা বই লিখছেন।’ খাঁটি স্বদেশী বুলিতে পরিচারিকার পুনঃউক্তি এবং দাবি, ‘দ্যাশের বাড়ির কতা? বেশ। তয় যুদি বাংলা বই অয়,
ছাপলে মোরে একখান দেওন লাগবে। মুই বাংলা বই পড়থে পারি।’ দিয়েছিলাম। পরে একদিন সান্ধ্যভ্রমণ শেষে বাসায়
ফিরছি। পথে একটা ছোট্ট বাজারমতো, সেখানের ছোট্ট একটি ঘরে দেখি, জনা আটদশেক লোক এক
বৃদ্ধকে ঘিরে বসে পুথি শুনছে। একটি হ্যারিকেনের আলোয় বৃদ্ধ বইয়ের গানগুলো তখন যেন
ছোমেদ বয়াতি হয়ে গেয়ে যাচ্ছিলেন। শ্রোতারা সবাই জেলে কৈবর্ত জাতীয়, সারাদিনের
শ্রমের ক্লান্তি অপনোদন করছে। কৌতূহলী হয়ে দরজায় দাঁড়াতে একজন উঠে এসে আমায় ভেতরে
নিয়ে বসালো এবং খুব গর্বের সঙ্গে সবাইকে জানালো, ‘এই দাদায়ই বইহান ল্যাখছেন।’ বৃদ্ধ বসে বসে খানিকক্ষণ যেন চোখে আশীর্বাদ বর্ষণ করে আমায়
দেখলেন, তারপর আস্তে আস্তে উঠে এসে আমাকে খুব সহজেই জড়িয়ে ধরলেন। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে
জিজ্ঞেস করলেন, ‘মোগো
এই ভাষা, এই ইতিয়াস আপনে জানলেন কী করইয়া? এতো একছেরই ‘মোগো পরণকতা।’ এই বোধের মধ্যেও দেশ দেশভাগ। এবং তাঁর খোঁজ। আমারও মতো জনেদের ‘দেশটা’র ধরন এ রকমই।
আমি যতটা না লেখক, তার চাইতে বোধহয় একটু বেশিই প্রশংসা এবং সুখ্যাতি পেয়েছি এবং তা
দেশে ও বিদেশে। প্রকৃত লেখকরা জানেন, আমি অতোটার উপযুক্ত নই। সে যাহোক, তাহোক, ঐ
সন্ধ্যায় আমি যে আনন্দ আর গৌরবের অধিকারী হয়েছিলাম, তেমনটি আর কক্ষনো ঘটেনি। সেদিন
খানিকক্ষণের জন্য হলেও, আমি আমার বোধের দেশ এবং সেই দেশের মানুষদের পেয়েছিলাম।
আমার মনে পড়ে গিয়েছিল, আমি একদিন এইসব নিম্নবর্গ এবং বর্ণের মানুষদের আশ্রয়ে বড়ো
হয়েছিলাম। তাই তাদের ইতিহাস এবং ভাষা আমি ভুলে যাইনি, তাদেরকেও ভুলিনি। এই অনুভবটি
আমার আনন্দের আর তৃপ্তির কারণ হয়েছিল।
বইখানিতে কৈবর্তদের নিয়ে অনেক কথা কথকতা ছিল। হিন্দু জেলে এবং মুসলমান নিকিরিদের
মধ্যে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার ঢের বার্তা ছিল এবং তার কোনো কিছুই নিছক ইচ্ছাপূরণের
গপ্পো ছিল না, ছিল নিম্নবর্গ/বর্ণের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের ইতিহাস, যা তাদের জীবন
কাহিনী থেকে ছোমেদ বয়াতির কথকতা বা গানের মারফত আমি সংগ্রহ করেছি। এখন ঐ বৃদ্ধ যখন
‘আমাগো ইতিয়াস, আমাগো ভাষা’র কথাগুলো উচ্চারণ করলেন, আমার মনে পড়লো ভগবান
তথাগতের বিখ্যাত উপদেশ তাঁর শিষ্যদের প্রতি, ‘সকায় নিরুত্তিয়া পরিয়া পুনিতম্’-লোকব্যবহার তথা লোক শিক্ষার জন্য তথাকথিত দেবভাষার পরিবর্তে,
সাধারণের বোধ্য, সাধারণের দ্বারা ব্যবহৃত লোকায়ত নিরুক্তির প্রয়োগ চেয়েছিলেন তিনি।
আমার রচনার ক্ষেত্রে ‘সকায়
নিরুত্তিয়া’ অথবা নিম্নবর্গের নিরুক্তিটাই ব্যবহারে আনতে
চেয়েছি আমি। কিছু যে সফল হয়েছি সেটা স্বীকার না করাটা একটু বেশি বিনয় হয়ে যাবে।
সেই সার্থকতাটুকু যদি না পেতাম, বৃদ্ধের ঐ অকপট বাক্যটি উচ্চারিত হতো না। এর মধ্যেই
আমার দেশ খোঁজা এবং তার খানিকটা অন্তত আভাস পাওয়ার সার্থকতা। এর থেকেই আমার
দুঃসাহস হয়েছিল বিষাদবৃক্ষের ব্রতকথা রচনা করার, বা ধানসিদ্ধির পরণকথা নির্মাণের,
যা রচনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণই ব্রাত্য পথগামী তথা সাহিত্য-ইতিহাস-সমাজতত্ত্বের
প্রথাগত তত্ত্ববিবর্জিত। প্রথাগত তত্ত্বে আমার দখলও নেই, আস্থাও নেই।
শ্রদ্ধেয় প্রিয় সুহৃদবৃন্দ। এতক্ষণ আপনাদের ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার প্রতি যথেষ্ট
অত্যাচার করেছি। আমার এই ‘দেশখ্যাপামি’র প্যাচাল ও কাহিনী জবরদস্তি না থামালে শেষ হবার
নয়। আর একটি ছোট্ট কাহিনী বলে, বক্তব্যের উপসংহার টানছি। গল্পটি মনোজ বসুর ‘মুখস্থ বক্তৃতা’ নামক একটি গল্প।
১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। গ্রামের শিক্ষিত যুবকেরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে
সভা ডেকেছে। সভাপতি করেছে গ্রামের পাঠশালার পণ্ডিতকে। তিনি রাজনীতির ব্যাপার
স্যাপার তেমন বোঝেন না। তাই তাঁর বক্তৃতা উদ্যোক্তারা কঠিন শব্দসহযোগে লিখে
দিয়েছে, পণ্ডিত মশাই রাত জেগে সেই বক্তৃতা মুখস্থ করেছেন। প্রথম বাক্যটি ছিল, ‘বিদেশী শাসকের খড়গাঘাতে মাতৃঅঙ্গ দ্বিখণ্ডিত।’ উত্তেজক ঐ বক্তৃতা বেশীদূর অগ্রসর হয় নি-পুলিশ
লাঠি চালিয়ে সভা ভেঙে দেয়, পণ্ডিতকে গ্রেপ্তার করে। গ্রামবাসী তাঁর নামে জয়ধ্বনি
করে বিদায় জানায়। কারাবাস থেকে ফিরে আসার পরও তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয়।
বিয়াল্লিশ বছর পর দেশ স্বাধীন হয়েছে। প্রথম স্বাধীনতা দিবসে সংগ্রামী স্বদেশী
হিসাবে পণ্ডিত মশাইকেই পতাকা উত্তোলনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। তিনি তখন দন্তহীন
বৃদ্ধ। বক্তৃতা দিতে উঠে সেই মুখস্থ বক্তৃতা আবার, ‘বিদেশী শাসকের খড়গাঘাতে আজ মাতৃঅঙ্গ দ্বিখণ্ডিত’ শোনামাত্র সমবেত জনতা হৈ হৈ করে তাঁকে টেনে
বসিয়ে দিল। প্রথম স্বাধীনতা দিবসে মানুষ আনন্দের বার্তা শুনতে চায়, দ্বিখণ্ডিত
মাতৃভূমি নিয়ে কাঁদুনি গাওয়ার সময় সেটা নয়। বৃদ্ধ পণ্ডিত ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে
তাকিয়ে রইলেন, প্রায় সমজাতীয় প্রেক্ষিতে ১৯০৫ সালে গ্রামের লোক তাঁকে নিয়ে
উচ্ছ্বসিত হয়েছিল, আজ সেই একই বক্তৃতা তাঁর জন্য অপমান ডেকে আনলো কেন, তা তাঁর
কাছে বোধগম্য হলো না। গল্পটি বরাক উপত্যকার প্রখ্যাত গবেষক-লেখক, সমপ্রতি প্রয়াত
সুজিত চৌধুরী মশাইয়ের একটি প্রবন্ধে উদ্ধৃত পেয়ে ঋণ হিসেবে নিলাম। আমি নিজে গল্পটি
পড়িনি। তবে পণ্ডিত মশাইয়ের মতো আমারও ব্যাপারটি সারা জীবনে ঠিক বোধগম্য হলো
না।
১৯৬৩-তে সীমান্ত পারাপার করার সময় নো-ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল যে,
সেটা যেন একটা মস্ত হা-মুখ ফাটল, যেখানে আমার দেশ নামক বোধটা চিরদিনের মতো তলিয়ে
গেছে দুপাশে দুটো নির্বোধ, হৃদয়হীন, চৈতন্যহীন রাষ্ট্রকে রেখে যারা মানুষকে বাদ
দিয়ে শুধু রাষ্ট্রের ক্ষমতার কথা ভাবে। তার কোনোটিতেই দেশজাতক আমার কোনো অস্তিত্ব
বা অস্মিতার চিহ্নমাত্র নেই-দেশের মানুষ বলে। কেউ যেন আর কোনোদিন জানতে চাইবে না,
তোমার দেশ কোথায়? ভদ্রাসন কোথায় ছিল তোমার?
মাননীয় শ্রোতৃবৃন্দ, ঘৃণ্য জাতিরাষ্ট্রীয় রাজনীতির পরম্পরায় নয়, মানবতায় ঋদ্ধ
সাংস্কৃতিক এক মেল-বন্ধনে আসুন আমরা ভিন্নভাবে আমাদের বোধের দেশকে নির্মাণ করি এবং
এভাবেই আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের নির্বুদ্ধিতার প্রায়শ্চিত্ত করে প্রকৃত বাঙালী
হয়ে উঠি। এ কথা নিশ্চয়ই সবাই মানবেন যে, আমরা এখনও জাতিগতভাবে পূর্ণ বাঙালী হিসেবে
গড়ে উঠিনি, যদিও সেটাই আমাদের হাজার বছরের সাধনা বা তপস্যা। বাংলাদেশ এবং তার
অধিবাসীদের সর্ববিধ কল্যাণ হোক। আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনকে আমার আন্তরিক
শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। সব্বে সত্তা সুখিতা হন্তু অবেরা
হন্তু...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন