পাড়াগাঁয়ের মাইনর স্কুল। মাঝে মাঝে ভিজিট করতে আসি, আর কোথাও থাকবার জায়গা নেই, হেডমাস্টার অবিনাশবাবুর ওখানেই উঠতে হয়। অবিনাশ বাবুকে লাগেও ভালো। বছর বিয়াল্লিশ বয়েস, একহারা চেহারা, বেশ ভাবুক লোক। বেশি গোলমাল ঝঞ্ঝাট পছন্দ করেন না। কাজেই জীবনের পথে বাধা ঠেলে অগ্রসর না হতে পেরে দেবলহাটি মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক-রূপে পনেরো বছর কাটিয়ে দিলেন এবং পনেরোটা বছর যে আর এখানেই কাটাবেন তার সম্ভাবনা ষোল আনার ওপর সতেরো আনা।
কার্ত্তিক মাসের শেষে হেমন্তসন্ধ্যা। স্কুলের বারান্দাতে ক্লাস-রুমের দুখানা চেয়ার টেনে নিয়ে আমরা গল্প করছিলাম। সামনে একটা ছোট মাঠ, একপাশে একটা বড় তুঁতগাছ, একপাড়ে একটা মজা পুকুর। সামনের কাঁচা রাস্তাটা গ্রামের বাজারের দিকে গিয়েছে, স্থানটা নির্জন।
—চায়ের কো নো ব্যবস্থা এখানে হওয়া সম্ভব নয়, তা জানি। একটি গরিব ছাত্র হেডমাস্টারের বাসায় থেকে পড়ে আর তাঁর হাটবাজার করে। সে এসে দুটো রেকাবিতে ঘি-মাখানো রুটি আলুচচ্চরি আর গুড় রেখে গেলো। আমি বললুম—অবিনাশবাবু, বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে—বেশ গরম মুড়ি খাবার ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু...
—হ্যাঁ, হ্যাঁ—সার্টেনলি—ওরে ও কানাই, শোন, শোন, যা দিকি একবার গঙ্গার বোয়ের বাড়ি, আমার নাম করে বলগে দুটি গরম মুড়ি ভেজে দ্যায়—এক্ষুনি...
আমি বললুম—অভাবে চাল ভাজা—
তারপর বললুম—অভাবে চাল ভাজা—
তারপর গল্পগুজবে আধঘণ্টা কেটে গেল। অবিনাশবাবু কথা বলতে বলতে কেমন অন্যমনস্কভাবে মাঝে মাঝে বাঁ ধারের মজা পুকুরটার দিকে চাইছিলেন। হঠা ৎ বললেন... মুড়ি আসুক, একটা গল্প বলি ততক্ষণ! শুনুন, ইনস্পেকটার বাবু! এই রকম শীতের সন্ধ্যাতেই কথাটা মনে পড়ে। আপনাকে পেয়ে মনে এত আনন্দ হয়... এখানকার লোকজন দেখছেন তো? সব দোকানদার, লেখাপড়ার কোনো চর্চা নেই, ছেলেপিলেকে লেখাপড়া শেখায় এই জন্যে যে কোনো রকমে ধারাপাত আর শুভঙ্করীটা পাশ করাতে পারলেই দাঁড়ি ধরাবে। কারুর সঙ্গে কথা বলে সুখ পাইনে, ঝালমসলার দরের কথা কাঁহাতক আলোচনা করি বলুন। ভদ্র ঘরের ছেলে, না-হয় এসে পড়েছি পেটের দায়ে এই পাণ্ডববর্জিত দেশে কিন্তু তা বলে মনটা তো কলেজের দুই-চার ক্লাস চোখে দেখেছিলামও তো—পড়াশোনা না-হয় না-ই করেছি...
দেখলাম অবিনাশবাবু কলেজের দিনগুলোর কথা এখনও ভুলতে পারেননি। বেচারীর জীবনে জাঁকজমক নেই, আত্মপ্রতিষ্ঠার দুরাশা নেই, সে সাহসও বোধ-করি নেই। তার যা-কিছু অভিজ্ঞতা, যা-কিছু কর্মনৈপুণ্য, সবই এক অনাড়ম্বর সরল জীবনধারাকে আশ্রয় করে। কলেজের দিনগুলোতে শহরের মুখ দেখেছিলেন, আড়ম্বর বা বিলাসিতা—মনেরই বলুন বা দেহেরই বলুন—ঐ কলেজের কটা বছরেই তার আরম্ভ শেষ। সে দিনগুলো যত দূরে গিয়ে পড়ছে, রঙিন স্মৃতির প্রলেপ তাদের ওপর যে তত বিচিত্র ও মোহময় হয়ে পড়বে এটা খুব স্বাভাবিক বটে।
অবিনাশবাবু তামাক ধরিয়ে আমার হাতে দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।
হুগলী জেলার কোনো এক গ্রামে ছিল আমার মামার বাড়ি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম—‘ছিল’ কেন? এখন নেই?
— সে কথা পরে বলছি—না, এখন নেই ধরে নিতে পারেন। কেন যে নেই তার সঙ্গে গল্পের একটা সম্বন্ধ আছে, গল্পটা শুনলেই বুঝবেন।
হুগলী জেলার কোনো এক গ্রামে আমার মামার বাড়ি ছিল। ছেলেবেলায় যখন সর্বপ্রথম মায়ের সঙ্গে সেখানে যাই, তখন আমার বয়স বছর পাঁচেক। আমাদের মামার বাড়ির পাড়ায় আট-নয় ঘর ব্রাহ্মণের বাস, ঘেঁষা-ঘেঁষি বসতি, একচালে আগুন লাগলে পাড়াসুদ্ধ পুড়ে যায়, এমন অবস্থা। কোঠাবাড়ি ছিল কেবল আমার মামাদের, আর-সব খড়ের ছাউনি, ছোট-বড় আটচালা ঘর, এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া যাবার পথে একটা বড় আম-কাঁঠালের বাগান, বনজঙ্গল, সজনে গাছ ও দুই-একটা ডোবা। বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেক দূর গেলে তবে ও পাড়ার প্রথম বাড়িটা। সেই বনজঙ্গলের মধ্যে কাঁদের একটা কোঠাবাড়ি খানিকটা গাঁথা হচ্ছে।
সেবার কিছুদিন থেকে চলে আসবার পর আবার যখন মামার বাড়ি গেলুম, তখন আমার আট বছর। গ্রামটা অনেক দিন পরে দেখতে বেরিয়ে চোখে পড়ল এ-পাড়া ও-পাড়ার মধ্যে বাঁ দিকে ডোবার ধারে একটা জায়গা। একটু অবাক হয়ে গেলাম। ডোবার পাড়ের জঙ্গল অনেকটা কাটানো, কাদের একটা কোঠাবাড়ি খানিকটা গাঁথা অবস্থায় দাঁড়িয়ে, কিন্তু মনে হলো অনেক দিন গাঁথুনির কাজ বন্ধ আছে যে জন্যই হোক, কারণ ভিতের গায়ে ও ঘরের মেঝেতে ছোটচ-বড় ভাঁটশেওড়ার গাছ গজিয়েছে, চুন-সুরকি মাখার ছোট খানাতে পর্যন্ত বনমূলার চারা। মনে পড়ল, সেবার এসে বাড়িটা গাঁথা দেখেছিলুম। এখনো গাঁথা শেষ হয়নি তো! কারা বাড়ি তুলছে?
ছুটে গিয়ে দিদিমাকে জিজ্ঞেস করলুম।
—কারা ওখানে বাড়ি করছে দিদিমা, সেবার এসে দেখে গিইছি, এখনও শেষ হয়নি?
—তোর এত কথাও মনে আছে!...ও তো ভণ্ডুলমামা বাড়ি করছে। এখানে তো থাকে না, তাই দেখাশোনার অভাবে গাঁথুনি এগোচ্ছে না।
আমার ভারী কৌতূহল হলো, সাগ্রহে বললুম—তবে বাড়ি গাঁথা হচ্ছে না কেন? মুখুজ্জেরা তো দেখলেই পারে?
—তা নয়, সব সময় তো টাকা পাঠাতে পারে না। যখন পাঠায়, তখন মিস্ত্রী লাগানো হয়।
কি জানি কেন সেই থেকে এই ভণ্ডুল মামা ও তাঁর আধগাঁথা বাড়িটা আমার মনে একটা অদ্ভুত স্থান অধিকার করে রইল। রূপকথার রাজপুত্রের মতোই এই ভণ্ডুলমামা হয়ে রইলেন অবাস্তব, স্পর্শের অতীত, দর্শনের অতীত, এক মানসরাজ্যের অধিবাসী, তাঁর চাকরীর স্থান লালমণিরহাট, মায় তাঁর ছেলেমেয়েসুদ্ধ। তাঁর টাকা পাঠাবার ক্ষমতা বা অক্ষমতাও যেন কোথায় আমার ব্যক্তিগত সহানুভূতির বিষয়ীভূত হয়ে দাঁড়াল, অথচ কেন এসব হলো তার কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণ আজও মনের মধ্যে খুঁজে পাই না।
কতবার দিদিমাদের চিলেকোঠার ছাদে শুয়ে দিদিমার মুখে রূপকথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে ভেবেছি—লালমণিরহাট থেকে আবার কবে ভণ্ডুলমামা টাকা পাঠাবে বাড়ি গাঁথার জন্যে? ... না, এবার বোধহয় নিজে আসবে। মুখুজ্জেরা বোধহয় ভণ্ডুলমামার টাকা চুরি করে, তাই ওদের হাতে আর টাকা দেবে না। বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর গল্পের ফাঁকে কখনো বা জিজ্ঞেস করি—লালমণিরহাট কোথায় দিদিমা? দিদিমা অবাক হয়ে বলেন—লালমণিরহাট! কেন, তাতে তোর হঠাৎ কি দরকার পড়ল? ... তা কি জানি বাপু কোথায় লালমণিরহাট! নে নে, ঘুমুস তো আমায় রেহাই দে, রাত্তিরে এখন গিয়ে আমায় দুটো মোচা কুটে রাখতে হবে, ঠাকুরঘরের বাসন বের করতে হবে, ছিষ্টির কাজ পড়ে রয়েছে—তোমায় নিয়ে সারারাত গল্প করলে তো চলবে না আমার।
আমি অপ্রভিতের সুরে বলতুম—না, দিদিমা, গল্প বল, যেও না, আচ্ছা মন দিয়ে শুনছি।
এরপরে আবার মামার বাড়ি গেলুম বছর দুই পরে। ওই দুবছরের মধ্যে আমি কিন্তু ভণ্ডুলমামার বাড়ির কথা ভুলে যাইনি। শীতের সন্ধ্যায় গোয়ালে সাঁজালের ধোঁয়ায় আমাদের পুকুরপাড়টা ভরে কুয়াশা হয়েছে বুঝি আজ, সেই দিকে চাইলেই আমার অমনি আমার মনে পড়ত ভণ্ডুলমামার সেই আধ তৈরি কোঠাবাড়ির কথা—এমনি শেওড়াবনে ঘেরা পুকুরপাড়ে—এতদিনে কতটা গাঁথা হলো কে জানে। এতদিন নিশ্চয় ভণ্ডুলমামা মুখুজ্জে বাড়ি টাকা পাঠিয়েছে।
মামার বাড়িতে রাতে এসে পৌঁছলাম। সকালে ঐ পথে বেড়াতে গিয়ে দেখি—ও মা, এ কি, ভণ্ডুল মামার বাড়িটা যেমন তেমনি পড়ে আছে! চার পাঁচ বছর আগে যতটা গাথা দেখে গিয়েছিলুম, গাঁথুনির কাজ তার বেশি আর একটুও এগোয়নি, বনে জঙ্গলে একেবারে ভর্তি, ইটের গাঁথুনির ফাঁকে বট-অশত্থের বড় বড় চারা! আহা ভণ্ডুলমামা বোধ হয় টাকা পাঠাতে পারেনি আর।
ভণ্ডুল মামার সম্বন্ধে সেবার অনেক কথা শুনলুম। ভণ্ডুল মামা লালমণিরহাটে নেই, শান্তাহারে বদলি হয়েছে। তার এখন দুই ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলেটি আমারই বয়সী, ভণ্ডুল মামার মা সম্প্রতি মারা গিয়েছে। বড় ছেলেটির পৈতে হবে সামনের চৈত্র মাসে। সেই সময়ে ওরা দেশে আসতে পারে।
কিন্তু সেবার চৈত্র মাসের অনেক আগেই দেশে ফিরলুম। ভণ্ডুল মামার সঙ্গে দেখার যোগাযোগ হয়ে উঠল না।
বছর তিনেক পরে। দোলের সময়। মামার বাড়ি দোলের মেলা খুব বিখ্যাত। নানা জায়গা থেকে দোকানপসারের আমদানি হয়। আমি মায়ের কাছে আবদার শুরু করলুম, এবার আমি একা রেলে চড়ে মেলা দেখতে যাব মামার বাড়ি। আমায় একা ছেড়ে দিতে বাবার ভয়ানক আপত্তি, অবশেষে অনেক কান্নাকাটির পর তাঁকে রাজি করানো গেল। সারাপথ সে কি আনন্দ। একা টিকিট কেটে রেলে চড়ে, মামার বাড়ি চলেছি। জীবনে এই সর্বপ্রথম একা বাড়ির বার হয়েছি সেই আনন্দেই সারাপথ আত্মহারা।
কিন্তু এ সুখ সইল না। মামার বাড়ির স্টেশনে নেমেই কি রকম হোঁচট খেয়ে প্লাটফর্মের কাঁকরের উপর পড়ে গিয়ে আমার হাঁটু ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল। অতি কষ্টে মামার বাড়ি পৌঁছে বিছানা নিলুম। পরদিন সকালে উঠতে গিয়ে দেখি আর উঠতে পারিনে—দুই হাঁটুই বেজায় টাটিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে জ্বর। কোথা দিয়ে দোল কেটে গেল টেরও পেলুম না। দিদিমাকে অনুরোধ করলুম, বাড়িতে যেন তারা চিঠি না লেখেন যে আমি আসবার সময় স্টেশনে পড়ে গিয়ে হাঁটু কেটে ফেলেছি।
সেরে উঠে বেড়াতে বেরিয়ে একদিন দেখি ভণ্ডুল মামার বাড়িটা অনেকদূর গাঁথা হয়ে গেছে। কাঠ-থামাল পর্যন্ত গাঁথা হয়েছে, কিন্তু কড়ি এখনও বসানো হয়নি।
হঠাৎ এত খুশি হয়ে উঠলাম যে আছাড় খেয়ে হাঁটু কাটার কথা টের পেলে বাবা কি বলবেন, তখনকার মতো সেই দুশ্চিন্তা মন থেকে মুছে গেল। উৎসাহে ও কৌতূহলে এক দৌড়ে ভণ্ডুল মামার বাড়িতে গিয়ে হাজির। গাঁথুনি অনেকদিন বন্ধ আছে মনে হলো, গত বর্ষার পরে আর বোধ হয় মিস্ত্রী আসেনি। ঘরের মেঝেতে খুব জঙ্গল গজিয়েছে, গাঁথুনির ফাঁকে ফাকে আমরুল শাকের গাছ; বাড়ির উঠোনে বড় একটা সজনে গাছে প্রথম ফাল্গুনে ফুলের খই ফুটেছে। ঘুরে ঘুরে দেখলুম, ভণ্ডুল মামার বাড়িতে তিনটে ঘর, একটা ছোট দালান, মাঝে একটা সিঁড়ির ঘর। আট-দশ ধাপ সিঁড়ি গাঁথা হয়ে গেছে। ওদিকের বড় ঘরটা বোধ হয় ভণ্ডুলমামার, মাঝের ঘরটাতে ছেলেমেয়েরা থাকবে। ভণ্ডুলমামার বাপ আছে? কে জানে! তিনি বোধ হয় থাকবেন সিঁড়ির এপাশের ঘরটাতে। রান্নাঘর কোথায় হবে? বোধ হয় উঠোনের এক পাশে ওই সজনে গাছটার তলায়। ভণ্ডুল মামা ছেলেমেয়ে নিয়ে যখন এসে বাস করবে, তখন এদের উঠোনে কি আর এমন জঙ্গল থাকবে! ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি দৌড়োদৌড়ি করে খেলবে, হয়তো বাড়িতে সত্যনারায়ণের সিন্নি দেবে পূর্ণিমায় কি চৈত্র সংক্রান্তিতে। পুকুরপাড়ের এই জংলী চেহারা তখন একেবারে বদলে যাবে যে! আমার মামার বাড়ির এ-পাড়াতে এক ঘর লোক বাড়বে...ও-পাড়া থেকে খেলা করে ফেরবার পথে, সন্ধ্যা হয়ে গেলেও আর ভাবনা থাকবে না...ওদের বাড়িতে আলো জ্বলবে, ছেলেমেয়েরা কথা বলবে, কিসে আর তখন ভয়? দিব্যি চলে যাব।
আর বছর দুই কেটে গেল। থার্ড ক্লাসে পড়ি। মামার বাড়ি একাই গেলুম। একাই এখন সব জায়গায় যাই। ভণ্ডুল মামার বাড়ির ছাদ-পেটানো হয়ে গিয়েছে, সিমেন্টের মেঝে, দালানের বাইরে রোয়াক হয়েছে কবে আমি দেখিনি তো! রোয়াকের উপর কেমন টিনের ঢালু ছাদ! কেবল একটুখানি এখনও বাকি, দরজা জানালায় এখনও কপাট বসানো হয়নি। বাঃ ভণ্ডুলমামার বাড়ি তাহলে হয়ে গেল!
ভণ্ডুলমামা নাকি আজকাল বড় সুদখোর হয়ে উঠেছেন, মাঝে মাঝে গাঁয়ে আসেন, চড়া সুদে লোকজনকে টাকা ধার দেন, বাড়ি দেখাশোনা করেন, আবার চলে যান। মাস কতক পরে আবার কাবুলীওয়ালার মতো চড়াও হয়ে সুদ আদায় করেন। গাঁয়ের লোক তাঁর নাম রেখেছে রত্নদত্ত।
তারপর এল একটা সুদীর্ঘ ব্যবধান। ছেলেবেলার মতো মামার বাড়িতে আর ততো যাইনে, গেলেও এক আধদিন থাকি। সেই এক আধদিনের মধ্যে পথে যেতে যেতে হয়তো দেখি, জঙ্গলের মধ্যে ভণ্ডুলমামার বাড়িটা তেমনি জনহীন পড়ে আছে—বনজঙ্গল চারিপাশে আরও গভীরতর, কেউ কোনোদিন ও বাড়িতে পা দিয়েছে বলে মনে হয়না...একটা ছন্নছাড়া লক্ষ্মীছাড়া চেহারা, শীতের সন্ধ্যায়, বর্ষার দিনে, চৌত্র-বৈশাখের দুপুরে কতবার ও-বাড়িটা দেখেছি, সেই একই মূর্তি...
এমনি করে বছর কয়েক কেটে গেল।
ক্রমে এন্ত্রেস পাশ দিয়ে কলকাতায় এসে কলেজে ঢুকলুম। সেবার সেকেন্ড ইয়ারের শেষ, এফ-এ দেব, কি একটা দরকারে মামার বাড়ি গিয়েছি।
বোধ করি মাঘ মাসের শেষ। দুপুরে পূর্বের ঘরে জানালার ধারে খাটে শুয়ে আছি, বোধ হয় একখানা লজিকের বই পড়ছি। এমন সময় একজন কালো শীর্ণকায় প্রউঢ় লোক ঘরে ঢুকলেন। বড় মামীমা বললেন—এই তোর ভণ্ডুলমামা, প্রণাম কর।
আমার সে ছেলেবেলাকার মনের অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল—বয়েস হয়েছে, কলেজে পড়ি; নানা ধরনের লোকের সঙ্গে মিশেছি, সুরেন বাঁড়ুজ্জে ও বিপিন পালের বক্তৃতা শুনেছি, স্বদেশী মিটিঙে ভলান্টিয়ারি করেছি, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গিই গেছে বদলে—তখন মনের কোন গভীর তলদেশে আরও পাঁচটা পুরনো দিনের আদর্শের ও কৌতূহলের বস্তুর স্তুপের সঙ্গে ভণ্ডুলমামা ও তাঁর বাড়িই চাপা পড়ে গিয়েছে। তাই ঈষৎ অবজ্ঞামিশ্রিত চোখে সামান্য একটু কৌতূহলের সঙ্গে চেয়ে দেখলুম মাত্র—ভণ্ডুল মামার বয়স পঞ্চাশের উপর হবে, টিকিতে একটা মাদুলি বাঁধা, গলায় কিসের মালা, কাঁচা-পাকা একমুখ দাড়ি। এই সেই ছেলেবেলাকার ভণ্ডুলমামা! উদাসীনভাবে প্রণামটা সেরে ফেললুম।
ভণ্ডুল মামা কিন্তু আমার সঙ্গে খুব আলাপ করলেন, একটু গায়ে পড়েই যেন। আমি কোন কলেজে পড়ি, কোন মেসে থাকি, কবে আমার পরীক্ষা—ইত্যাদি নানা প্রশ্নে আমার জ্বালাতন করে তুললেন। আজকাল তিনি কলকাতায় চাকরি করেন, বাগবাজারে বাসা, তাঁর বড় ছেলেও এবার ম্যাট্রিক দিয়ে ফার্স্টইয়ারে পড়ছে—এ-সব খবরও দিলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, আপনাদের এখানকার বাড়িতে ছেলেমেয়ে আনবেন না?
ভণ্ডুল মামা বললেন—আনব, শিগগিরই আনব বাবা। এখনও একটু বাকি আছে, একটা রান্নাঘর আর একটা কুয়ো করতে পারলেই সব এনে ফেলি। কলকাতায় বাসভাড়া আর দুধের খরচ জোগাতেই...সেইজন্যেই তো খেয়ে না-খেয়ে দেশের বাড়িটা করলুম, তবে ঐ একটুখানি যা বাকি আছে...তা ছাড়া চিলেকোঠার ছাদটা এখনও...এইবারেই ভাবছি শ্রাবণ মাসের দিকে ওটাও শেষ করব।
বলে কি! এখনও বাকি! জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত দেখে আসছি ভণ্ডুলমামার বাড়ি উঠছে। এ তাজমহল নির্মাণের শেষ বেঁচে থেকে দেখে যেতে পারব তো!
ভণ্ডুলমামা আপন মনেই বলে যেতে লাগলেন—সামান্য চাকরি, ছা-পোষা মানুষ বাবা, কাচ্চাবাচ্চা খাইয়ে যা থাকে তাতেই তো বাড়ি হবে? এখন তো বাসায় বাসায় কাটছে, আজ যদি চাকরি যায় তবে ছেলেপুলে নিয়ে কোথায় দাঁড়াব, তাই ভেবে আজ চৌদ্দ–পনেরো বছর ধরে একটু একটু করে বাড়িটা তুলছি। তা এইবার আর দেরি হবে না, আসছে বছর সব এনে ফেলব। জায়গাটা বড় ভালোবাসি।
ভণ্ডুলমামা বললেন তো চৌদ্দ-পনেরো বছর, কিন্তু আমার মনে হ লো ভণ্ডুল মামার বাড়ি উঠছে আজ থেকে নয়, জীবনের পিছন থেকে ফিরে চেয়ে দেখলে যতদূর দৃষ্টি চলে ততকাল ধরে...যেন অনাদিকাল, অনাদি যুগ ধরে ভণ্ডুলমামার বাড়ির ইট একখানির পর আর একখানি উঠছে...শিশু থেকে কবে বালক হয়েছিলুম, বালক থেকে কিশোর, কৈশোর কেটে গিয়ে এখন প্রথম যৌবনের উন্মেষ, আমার মনে এই অনাদ্যন্ত মহাকাশ বেয়ে কত শত জন্মমৃত্যু, সৃষ্টি ও পরিবর্তনের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ভণ্ডুলমামার বাড়ি হয়েই চলেছে... ওর বুঝি আদিও নেই, অন্তও নেই।
পরের বছর আবার ভণ্ডুলমামার সঙ্গে কলকাতাতেই দেখা। আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। ভণ্ডুলমামা বললেন—এস একবার আমাদের বাসায়। তোমার মাসি তোমায় দেখলে খুশি হবে। সামনের রবিবার তোমার নেমন্তন্ন রইল, অবিশ্যি যাবে।
গেলুম, ভণ্ডুলমামার ছেলেদের সঙ্গে আলাপ হলো। ভণ্ডুলমামা অনুযোগের সুরে বললেন,-- ওদের বলি, যা একবার এই সময়ে। আষাঢ় মাসে দেশে গিয়ে উঠোনে খাসা বরবটি আর শিম লাগিয়ে রেখে এসেছি, মাচাও বেঁধে রেখে এসেছি, তা কেউ কি কথা শোনে!
মামিমা ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন—যাবে সেখানে কেমন করে শুনি? কোনো ঘরে বাস করবার জো নেই, ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়ে। জলের ব্যবস্থা নেই বাড়িতে, শুধু শিম আর বরবটির পাতা চিবিয়ে তো মানুষে... তাতে বাড়ি হাট আলগা, পাঁচিল নেই।
ভণ্ডুলমামা মৃদু প্রতিবাদের সুরে ভয়ে ভয়ে যা বললেন, তার মর্ম এই যে, মানুষ বাস না করলেই বাড়িতে বট-অশত্থের গাছ হয়, ছাদ আঁটা হয়ে গেছে আজ অনেক দিন, কিন্তু কেউ বাস তো করে না। বাড়ি কাজেই খারাপ হয়ে থাকে। তবুও তিনি বছরে দুই-তিনবার যান বলে এখনও ঘরদোর টিকে আছে। পাতকুয়োর আর কত খরচ? চৈত্র মাসের দিকে না-হয় করে দেয়া যাবে। আর তোমরা সবাই যদি যাও, পাঁচিল আষাঢ় মাসেই করে দেয়া যাবে।
বুঝলুম পাতকুয়া এখনও বাকি। ভণ্ডুলমামার বাড়ি এখনও শেষ হয়নি, এখনও কিছু বাকি আছে। কিন্তু এতদিন ধরে ব্যাপারটা চলছে যে একদিক গড়ে উঠতে অন্য দিকে ধরেছে ভাঙন।
এরপর মামার বাড়ি গিয়ে দুই-একবার দেখেছি ভণ্ডুলমামা দুই-পাঁচদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসে আছেন। এটা সারাচ্ছেন, ওটাতে বেড়া বাঁধছেন, এ-গাছটা খুঁড়ছেন, ও-গাছটা কাটছেন। ছেলেরা আসতে চায় না কলকাতা ছেড়ে। নিজেকেই আসতে হয়, দেখাশুনা করতে হয় বলে একদিন সলজ্জ কৈফিয়ত দিলেন। পাঁচিল? হ্যাঁ, তা পাঁচিল—সম্প্রতি একটু টানাটানি যাচ্ছে... সামনের বর্ষায়... ঘরদোর বেঁধেছি সারাজীবন খেটে, ওই আমার বড় আদরের জায়গা—তোরা না থাকিস, আমিই গিয়ে থাকি।
আমি বললুম—ওখানে কেমন করে থাকেন, সারা গাঁয়েই তো মানুষ নেই, মামার বাড়ির পাড়া তো একেবারে জনশূন্য হয়ে গেছে।
-- কি করি বাবা, ওই বাড়িখানার ওপর বড় দম আমার যে। দেখ, চিরকাল পরের বাসায়, পরের বাড়িতে মানুষ হয়ে ঘরের কষ্ট বড় পেয়েছিলাম—তাই ঠিক করি বাড়ি একখানা করবই। ছেলেবেলা থেকেই ওই গাঁয়েই কাটিয়েছি, ওখানটা ছাড় আর কোথাও মন বসে না। চিরকাল ভাবতুম রিটায়ার করে ওখানেই বাসা করব। একটা আস্তানা তো চাই, এখন না-হয় ছেলেপিলে নিয়ে বাসায় বাসায় ঘুরছি, কিন্তু এর পরে দাঁড়াব কোথায়? তাই জলাহার করেও সারাজীবন কিছু কিছু সঞ্চয় করে ওই বাড়িখানা করেছিলুম। তা ওরা তো কেউ এল না—আমি নিজেই থাকি। না থাকলে বাড়িখানা তো থাকবে না—আর এককালে না এককালে ছেলেদের তো এসে বসতেই হবে বাড়িতে! কলকাতার বাসায় তো চিরকাল কাটবে না।
তারপর মামাদের মুখে ভণ্ডুলমামার কথা আরও সব জানা গেল। ভণ্ডুলমামা একা বিজন বনের মধ্যে নিজের বাড়িখানায় থাকেন। তাঁর এখনও দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর ছেলেরা শেষ পর্যন্ত ওই বাড়িতেই গিয়ে বাস করবে। তিনি এখনও এ-জায়গাটা ভাঙছেন, ওটা গড়ছেন, নিজের হাতে দা দিয়ে জঙ্গল সাফ করছেন। ছেলেদের সঙ্গে বনে না—ওই বাড়ির দরুনই মনান্তর, স্ত্রীও ছেলেদের দিকে। ছেলেরা বাপকে সাহায্য করে না। ভণ্ডুলমামা গাঁয়ে একখানা ছোট মুদির দোকান করেছিলেন—লোক নেই তার কিনবে কে? যা দুই-একঘর খদ্দের জুটেছিল—ধার নিয়েই দোকান উঠিয়ে দিলে। এখন ভণ্ডুলমামা এ-গাঁ ও-গাঁ বেড়িয়ে কোনো চাষার বাড়ি থেকে দু কাঠা চাল, কারুর বাড়ি পাঁচটা বেগুন—এই রকম করে চেয়েচিন্তে এনে বাড়িতে হাঁড়ি চড়িয়ে দুটো ফুটিয়ে খান।
তারপর ধীরে ধীরে অনেক বছর কেটে গেল। আমি ক্রমে বি-এ পাশ করে চাকরিতে ঢুকলুম। মামার বাড়ি আর যাইনে, কারণ সে গ্রাম আর যাবার যোগ্য নেই। মামার বাড়ির পাড়ায় গাঙ্গুলীরা, রায়েরা, ভড়েরা সব একে একে মরে হেজে গেল, যারা অবশিষ্ট রইল তারা বিদেশে চাকরি করে, ম্যালেরিয়ার ভয়ে গ্রামের ত্রিসীমানা মাড়ায় না। ও-পাড়াতেই তাই জীবন মজুমদারের প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ির ছাদ ভেঙে ভূমিসাৎ হয়ে গিয়েছে, শুধু একদিনের দোতলা সমান দেয়ালটা দাঁড়িয়ে আছে। যে পুজোর দালানে ছেলেবেলায় কত উৎসব দেখেছি, এখন সেখানে বড় বড় জগডুমুরের গাছ, দিনেই বোধ হয় বাঘ লুকিয়ে থাকে। বিখ্যাত রায়দীঘি মজে গিয়েছে, দামে বোঝাই, জল দেখা যায় না, গোরুবাছুর কচুরিপানার দামের উপর দিয়ে হেঁটে দিব্যি পার হতে পারে।
সন্ধ্যা রাতের গ্রাম নিশুতি হয়ে যায়। দুই-এক ঘর নিরুপায় গৃহস্থ যারা নিতান্ত অর্থাভাবে এখনও পৈত্রিক ভিটেতে ম্যালেরিয়া জীর্ণ হাতে সন্ধ্যাদীপ জ্বালাচ্ছে, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হতে-না-হতেই তারা প্রদীপ নিভিয়ে শয্যা আশ্রয় করে—তারপর সারারাত ধরে চারিধারে শুধু প্রহরে প্রহরে শৃগালের রব ও নৈশ পাখির ডানা ঝটাপটি।
আমার মামারাও গ্রামের ঘরবাড়ি ছেড়ে শহরে বাসা করেছেন। ছোটমামার ছেলের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে সেখানে একবার গিয়েছি! ব্রহ্মণভোজনের কিছু আগে একজন শীর্ণকায় বৃদ্ধ একটা পুটলি হাতে বাড়িতে ঢুকলেন। এক পা ধুলো, বগলে একটা একটা ময়লা সাদা কাপড় বসানো বাঁশের বাঁটের ছাতা। প্রথমটা চিনতে পারিনি। পরে বুঝলুম ভণ্ডুলমামা। এত বুড়ো হয়ে পড়েছেন এর মধ্যে! শহরে এসে মামাদের নতুন, সভ্য সৌখীন, আলাপী বন্ধুবান্ধব জুটেছে, তাদের পোশাক পরিচ্ছদের ধরনে ও কথাবার্তার সুরে ভণ্ডুলমামা কেমন ভয় পেয়ে সঙ্কোচের সঙ্গে নিমন্ত্রিত হয়েই এসেছিলেন বটে, কিন্তু মামারা তখন শহুরে বন্ধুদের আদর অভ্যর্থনায় মহা ব্যস্ত, তাঁর আগমন কেউ বিশেষ লক্ষ্য করেছে, এমন মনে হলো না।
আমি গিয়ে ভণ্ডুলমামার কাছে বসলুম। চারিধারে অচেনা মুখের মধ্যে আমার দেখে ভণ্ডুলমামা খুব খুশি হলেন। জিজ্ঞেস করলুম—আপনি কি কলকাতা থেকে আসছেন?
ভণ্ডুলমামা বললেন—না বাবা, আমি রিটায়ার করেছি আজ বছর পাঁচেক হবে। গাঁয়ের বাড়িতেই আছি। ছেলেরা কেউ আসতে চায় না।
অন্নপ্রাশন শেষ হয়ে গেল। ভণ্ডুলমামা কিন্তু মামার বাড়ি থেকে আর নড়তে চান না। চার-পাঁচ দিন পরে কিছু চাল-ডাল ও বাসি সন্দেশ রসগোল্লা নিয়ে দেশে রওনা হলেন। পায়ে দেখি কটক থেকে কিনে আনা বড় মামার সেই পুরনো চটি-জুতো জোড়া। আমায় দেখিয়ে বললেন, নবীন কটক থেকে এনেছে, দেখে বড় শখ হলো, বয়েস হয়েছে, কবে মরে যাব, বললুম তা দাও নবীন, জুতো-জোড়াটা পুরনো হলেও এখনও দুই-তিন মাস যাবে। বাড়িতে একজোড়া রয়েছে, আঙুলে বড় লাগে বলেই খালি পায়েই—
তিনি বাড়ির বার হয়ে গেলেন! আমি চেয়ে চেয়ে দেখলুম শীর্ণকায় ভণ্ডুলমামা ভারী চাল-ডালের মোটের ভারে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে চটিজুতোর ফটাং ফটাং শব্দ করতে করতে স্টেশনের পথে চলেছেন। হঠা ৎ আমার মনে তাঁর উপরে আমার বাল্যের সেই রহস্যময় স্নেহ ও অনুকম্পার অনুভূতিটুকু কতকাল পরে আবার যেন ফিরে এল। আমি চেঁচিয়ে বললুম—একটু দাঁড়ান মামা, আপনাকে তুলে দিয়ে আসি। ভণ্ডুলমামার পুঁটলিটা নিজের হাতে নিলুম, টিকিট করে তাঁকে গাড়িতে তুলে দিলুম। ট্রেনে উঠবার সময় একমুখ হেসে বললেন—যেও না হে একদিন, বাড়িটা দেখে এস আমার খাসা করেছি—কেবল পাঁচিলটা এখনও যা বাকি। কি করি, আমার হাতে আজকাল আর তো কিছু নেই, ছেলেরা নিজেদের বাসার খরচই চালিয়ে উঠতে পারে না—অবিশ্যি ওদের জন্যেই তো সব, দেখি, চেষ্টায় আছি—সামনের বছরে যদি...
ভণ্ডুলমামার সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। কিন্তু এর মাস-কতক পরে তাঁর বড়ছেলে হরিসাধনের সঙ্গে কলকাতায় দেখা হয়েছিল। ম্যাকমিলান কোম্পানির বাড়িতে চাকরি করে, জিনের কোট গায়ে, হাতে বইয়ের আকারের খাবারের কৌটা, মুখে একগাল পান—বৌবাজারের ফুটপাত দিয়ে বেলা দশটার সময় অফিসে যাচ্ছে। আমিই ভণ্ডুলমামার কথা তুললাম। হরিসাধন বললে—বাবা দেশের বাড়িতেই আছেন—আমরা বলি আমাদের সংসারে এসে থাকুন, তাতে রাজি নয়। বুদ্ধিসুদ্ধি তো কিছু ছিল না বাবার, নেইও—সারা জীবনে যা রোজগার করেছেন, ওই জঙ্গলের মধ্যে এক বাড়ি করতে গিয়ে সব নষ্ট করেছেন, নইলে আজ হাজার চার-পাঁচ টাকা হাতে জমত। ও-গাঁয়ে যাবেই বা কে? ব্যামোঃ যেমন জঙ্গল তেমনি ম্যালেরিয়া—তাছাড়া লোকজন নেই, অসুখ হলে একটা ডাক্তার নেই, চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে বাড়ির পিছনে, বেচতে গেলে এখন ইট-কাঠের দরেও বিক্রি হবে ভেবেছেন? কে নিতে যাবে, পাগল আপনি!
আমি বললুম-- কথাটা ঠিক বটে। কিন্তু ভেবে দেখ, তোমার বাবা যখন বাড়িটা প্রথম আরম্ভ করেছিলেন, তখন জাজ্বল্যমান গ্রাম। বাড়িটা তৈরি করতে এত দেরি হয়ে গেল যে ইতোমধ্যে গাঁ হয়ে গেল শ্মশান, লোকজন উঠে অন্যত্র চলে গেল, সেই সময় তোমাদের বাড়ির গাঁথুনিও শেষ হলো। কার দোষ দেবে?
তারপর ভণ্ডুলমামার আর কোনো সংবাদ রাখিনি অনেক কাল। বছর তিনেক আগে একবার মেজমামা চেঞ্জে গিয়েছিলেন দেওঘরে। পুজোর ছুটিতে আমিও সেখানে যাই। তাঁর মুখেই শুনলাম ভণ্ডুলমামা সেই শ্রাবণেই মারা গিয়েছেন। অসুখ-বিসুখ হয়ে দুদিন ঘরের মধ্যেই ছিলেন, কেউ বিশেষ দেখাশুনো করেনি, আর আছেই বা কে গাঁয়ে যে দেখবে? এ অবস্থায় ঘরের মধ্যে মরে পড়ে ছিলেন, দুই-তিন দিন পরে সবাই টের পায়, তখন ছেলেদের টেলিগ্রাম করা হলো। ভণ্ডুলমামার এখানেই শেষ।
এরপর আমি আর কখনও মামার বাড়ির গ্রামে যাইনি, হয়তো আর কোনোদিন যাবও না, বাড়িটাও আর দেখিনি, কিন্তু জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত যে বাড়িটা গাঁথা হতে দেখেছি, সেটা আমার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্থান অধিকার করে আছে। আমার কল্পনা দেশের মামার বাড়ির গ্রামের, একগলা বনের মধ্যে শীতের দিনের সন্ধ্যায় ভণ্ডুলমামার বাড়িটা একটা কায়াহীন, অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন রূপ নিয়ে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে সেই গাছ-গজানো উঠোনটাতে ঢোকবার পথ বনে ঢাকা, দরজা-জানালার কপাটও নেই, থামে থামে কাঠ-থামাল পর্যন্ত গাঁথা হয়েছে। ...
আমার জীবনের সঙ্গে ভণ্ডুলমামার বাড়িটার এমন যোগ কি করে ঘটল, সেটা আজ ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাই—আমার গল্পের আসল কথাই তাই অমন একটা সাধারণ জিনিস কেন আমার মন জুড়ে বসে রইল, অথচ কত বড় বড় ঘটনা তো বেমালুম মন থেকে মুছেই গিয়েছে!
বিশেষ করে এইসব শীতের সন্ধ্যাতেই মনে পড়ে এইজন্যে যে, পাঁচ বছর বয়সে এই শীতের সন্ধ্যাবেলাতেই বাড়িটা প্রথম দেখি।
অবিনাশবাবুর ছাত্রটা মুড়ি নিয়ে এল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন