মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
লন্ডনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২১
আমাদের এই রৌদ্রতাপিত নিদ্রাতুর নিস্তব্ধ গৃহের এক প্রান্তে বসিয়া কেমন করিয়া ধারণা করিব সেই সুরাসুরের রণরঙ্গভূমি ইউরোপীয় সমাজের প্রচণ্ড আবেগ, উত্তেজনা, উদ্যম, সহস্রমুখী বাসনার উদ্দাম উচ্ছ্বাস, অবিশ্রাম মথ্যমান ক্ষুব্ধ জীবন-মহাসমুদ্রের আঘাত ও প্রতিঘাত–তরঙ্গ ও প্রতিতরঙ্গ–ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি, উৎক্ষিপ্ত সহস্র হস্তে পৃথিবী বেষ্টন করিবার বিপুল আকাঙ্খা! দুই-একটা লক্ষণ মাত্র দেখিয়া, রাজ্যের আভ্যন্তরীণ অবস্থার মধ্যে লিপ্ত না থাকিয়া, বাহিরের লোকের মনে সহসা যে কথা উদয় হয় আমি সেই কথা লিখিয়া প্রকাশ করিলাম এবং এই সুযোগে সাহিত্য সম্বন্ধে আমার মত কথঞ্চিৎ স্পষ্ট করিয়া ব্যক্ত করিলাম।’
১২৯৯ সালে ‘সাহিত্যের প্রাণ’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ফলস্টাফ ও ডগরেরি থেকে… দৃষ্টিগোচর হয়।’
১৯৪১ সালের ২৫ এপ্রিল সাহিত্যের মূল্য-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘শেক্সপীয়রের লুক্রিস… ভিড় জমা হবে।’ ইন্দিরা দেবী চৌধুরীরানীকে
এক পত্রে রবীন্দনাথ বলেন, ‘‘সেই ছেলেবেলায় যখন আরব্য-উপন্যাস পড়তুম, সিন্ধবাদ নানা নূতন দেশে বাণিজ্য করতে বাহির হত, ভৃত্য-শাসিত আমি তোষাখানার মধ্যে রুদ্ধ হয়ে বসে বসে দুপুর বেলায় সিন্ধবাদ সঙ্গে ঘুরে বেড়াতুম, তখন যে আকাঙ্খাটা মনের মধ্যে জন্মেছিল সেটা যেন এখনো বেঁচে আছে–এই বালিচরে নৌকো বাঁধা দেখলে সেই যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ছেলেবেলায় যদি আরব্য-উপন্যাস রবিনসন ক্রুসো না পড়তুম, রূপকথা না শুনতুম, তা হলে নিশ্চয় বলতে পারি ঐ নদীতীর এবং মাঠের প্রান্তরে দূর দৃশ্য দেখে ঠিক এমন ভাব মনে উদয় হত না–সমস্ত পৃথিবীর চেহারা আমার পক্ষে আর-এক রকম হয়ে যেত।’’
আর একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘ছেলেবেলায় রবিনসন ক্রুসো পৌলভর্জিনি প্রভৃতি বইয়ে গাছপালা সমুদ্রের ছবি দেখে মন ভারী উদাসীন হয়ে যেত–এখানকার রৌদ্রে আমার সেই ছবি দেখার বাল্যস্মৃতি ভারী জেগে ওঠে। এর যে কী মানে আমি ঠিক ধরতে পারি নে, এর সঙ্গে যে কী একটা আকাঙ্খা জড়িত আছে আমি ঠিক বুঝতে পারিনে–এ যেন এই বৃহৎ ধরণীর প্রতি একটা নাড়ীর টান।’
১৯৪১ সালে ‘সাহিত্যের মূল্য’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘জীবন মহাশিল্পী। সে যুগে যুগে দেশে দেশান্তরে মানুষকে নানা বৈচিত্র্যে মূর্তিমান করে তুলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের চেহারা আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে অদৃশ্য, তবুও বহুশত আছে যা প্রত্যক্ষ, ইতিহাসে যা উজ্জ্বল। জীবনের এই সৃষ্টিকার্য যদি সাহিত্যে যথোচিত নৈপুণ্যের সঙ্গে আশ্রয় লাভ করতে পারে তবেই তা অক্ষয় হয়ে থাকে। সেইরকম সাহিত্য ধন্য–ধন্য ডন কুইক্সট্ ধন্য রবিনসন ক্রুসো।’
১৩৪০ সালে ‘সাহিত্যতত্ত্ব’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘সাংকোপাঞ্জা ডন কুইক্সোটের ভৃত্যমাত্র, সংসারের প্রবহমান তথ্যপুঞ্জের মধ্যে তাকে তর্জমা করে দিলে সে চোখেই পড়বে না–তখন হাজার-লক্ষ চাকরের সাধারণ শ্রেণীর মাঝখানে তাকে শনাক্ত করবে কে। ডন কুইক্সোটের চাকর আজ চিরকালের মানুষের কাছে চিরকালের চেনা হয়ে আছে, সবাইকে দিচ্ছে তার একান্ত প্রত্যক্ষতার আনন্দ; এ পর্যন্ত ভারতের যতগুলি বড়ো লাট হয়েছে তাদের সকলের জীবনবৃত্তান্ত মেলালেও এ চাকরটির পাশে তারা নিষ্প্রভ।’ সাহিত্যে নবত্ব-এ এ ইউরোপীয় সাহিত্যের ডাডায়িজম্ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘জল যাদের ফুরিয়েছে তাদের পক্ষে আছে পাঁক। তারা বলে, সাহিত্যধারায়
নৌকা চলাচলটা অত্যন্ত সেকেলে; আধুনিক উদ্ভাবনা হচ্ছে পাঁকের মাতুনি–এতে মাঝিগিরি দরকার নেই–এটা তলিয়ে-যাওয়া রিয়ালিটি। ভাষাটাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে, অর্থের বিপর্যয় ঘটিয়ে ভাবগুলোকে স্থানে অস্থানে ডিগবাজি খেলিয়ে, পাঠকের মনকে পদে পদে ঠেলা মেরে, চমক লাগিয়ে দেওয়াই সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ। চরম সন্দেহ নেই। সেই চরমের নমুনা ইউরোপীয় সাহিত্যের ডাডায়িজম্। এর একটি মাত্র কারণ হচ্ছে এই, আলাপের সহজ শক্তি যখন চলে যায় সেই বিকারের দশায় প্রলাপের শক্তি বেড়ে ওঠে। বাইরের দিক থেকে বিচার করতে গেলে প্রলাপের জোর আলাপের চেয়ে অনেক বেশি এ কথা মানতেই হয়। কিন্তু তা নিয়ে শঙ্কা না করে লোকে যখন গর্ব করতে থাকে তখনই বুঝি, সর্বনাশ হল বলে। ’
১৩১৯ সালে পথের সঞ্চয়-এ ‘কবি ইয়েটস্’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ইংলন্ডের বর্তমানকালের কবিদের কাব্য যখন পড়িয়া দেখি তখন ইহাদের অনেককেই আমার মনে হয়, ইহারা বিশ্বজগতের কবি নহেন। ইহারা সাহিত্যজগতের
কবি।…কবিরা যেন ওস্তাদ হইয়া উঠিয়াছে, অর্থাৎ প্রাণ হইতে গান করিবার প্রয়োজনবোধই তাহাদের চলিয়া গিয়াছে, এখন কেবল গান হইতেই গানের উৎপত্তি চলিতেছে। যখন ব্যথা হইতে কথা আসে না, কথা হইতেই কথা আসে, তখন কথার কারুকার্য ক্রমশ জটিল ও নিপুণতর হইয়া উঠিতে থাকে। আবেগ তখন প্রত্যক্ষ ও গভীরভাবে হৃদয়ের সামগ্রী না হওয়াতে সে সরল হয় না; সে আপনাকে আপনি বিশ্বাস করে না বলিয়াই বলপূর্বক অতিশয়ের দিকে ছুটিতে থাকে; নবীনতা তাহার পক্ষে সহজ নহে বলিয়াই আপনার অপূর্বতা প্রমাণের জন্য কেবলই তাহাকে অদ্ভুতের সন্ধানে ফিরিতে হয়।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গে সুইনবর্নের তুলনা করিয়া দেখিলেই আমার কথাটা বোঝা সহজ হইবে। যাঁহারা জগতের কবি নহেন, কবিত্বের কবি, সুইনবর্ন তাঁহাদের মধ্যে প্রতিভায় অগ্রগণ্য। কথায় নৃত্যলীলায় ইঁহার এমন অসাধারণ নৈপুণ্য যে, তাহারই আনন্দ তাঁহাকে মাতোয়ারা করিয়াছে। ধ্বনি-প্রতিধ্বনির নানাবিধ রঙিন সুতায় তিনি চিত্রবিচিত্র
করিয়া ঘোরতর টকটকে রঙের ছবি গাঁথিয়াছেন; সে-সমস্ত আশ্চর্য কীর্তি, কিন্তু বিশ্বের উপর তাহার প্রশস্ত প্রতিষ্ঠা নহে।’
৬ জানুয়ারি, ১৯৩৫ অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ইংরেজি সাহিত্যে একদা আমরা বিদেশীরা যে নিঃসঙ্কোচ আমন্ত্রণ পেয়েছিলুম আজ কি তা আর আছে? একথা বলা বাহুল্য প্রত্যেক দেশের সাহিত্য মুখ্যভাবে আপন পাঠকদের জন্য, কিন্তু তার মধ্যে সেই স্বাভাবিক দাক্ষিণ্য আমরা প্রত্যাশা করি যাতে সে দূর নিকটের সকল অতিথিকেই আসন জোগাতে পারে। যে সাহিত্যে সেই আসন প্রসারিত সেই সাহিত্যই মহৎ সাহিত্য, সকল কালেরই মানুষ সেই সাহিত্যের স্থায়িত্বকে সুনিশ্চিত করে তোলে, তার প্রতিষ্ঠাভিত্তি সর্বমানবের চিত্তক্ষেত্রে।
আমাদের সমসাময়িক বিদেশী সাহিত্যকে নিশ্চিত প্রত্যয়ের সঙ্গে বিচার করা নিরাপদ নয়। আধুনিক ইংরেজি সাহিত্য সম্বন্ধে আমি যেটুকু অনুভব করি সে আমার সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে, তার অনেকখানিই হয়তো অজ্ঞতা। এ সাহিত্যের অনেক অংশের সাহিত্যিক মূল্য হয়তো যথেষ্ট আছে, কালে কালে তার যাচাই হতে থাকবে। আমি যা বলতে পারি তা আমারি ব্যক্তিগত বোধশক্তির সীমানা থেকে। আমি বিদেশীর তরফ থেকে বলচি,–অথবা তাও নয়–একজন মাত্র বিদেশী কবির তরফ থেকে বলচি–আধুনিক ইংরেজি কাব্যসাহিত্যে
আমার প্রবেশাধিকার
অত্যন্ত বাধাগ্রস্ত। আমার একথার যদি কোনো ব্যাপক মূল্য থাকে তবে এই কথা বলতে হবে এই সাহিত্যের অন্য নানাগুণ থাক্তে পারে, কিন্তু একটা গুণের অভাব আছে যাকে বলা যায় সার্ব্বভৌমতা,
যাতে করে বিদেশ থেকে আমিও এ’কে অকুণ্ঠিত চিত্তে মেনে নিতে পারি। ইংরেজের প্রাক্তন সাহিত্যকে তো আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছি, তার থেকে কেবল যে রস পেয়েছি তা নয়, জীবনের যাত্রাপথে আলো পেয়েছি। তার প্রভাব আজও তো মন থেকে দূর হয়নি। আজ দ্বাররুদ্ধ য়ুরোপের দুর্গমতা অনুভব করচি আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে। তার কঠোরতা আমার কাছে অনুদার বলে ঠেকে, বিদ্রুপ-পরায়ণ বিশ্বাসহীনতার
কঠিন জমিতে তার উৎপত্তি, তার মধ্যে এমন উদ্বৃত্ত দেখা যাচ্চে না, ঘরের বাইরে যার অকৃপণ আহ্বান। এ সাহিত্য বিশ্ব থেকে আপন হৃদয় প্রত্যাহরণ করে নিয়েছে, এর কাছে এমন বাণী পাইনে যা শুনে মনে করতে পারি যেন আমারি বাণী পাওয়া গেল চিরকালীন দৈববাণীরূপে। দুই একটা ব্যতিক্রম যে নেই তা হতেই পারে না। মনে পড়ছে রবার্ট ব্রিজেসের নাম। আরো আছে।…বারে বারে এই কথা আমার মনে হয়েছে বর্তমান ইংরেজি কাব্য উদ্ধতভাবে নূতন, পুরাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীভাবে নূতন; যে-তরুণের মন কালাপাহাড়ি সে এর নব্যতার মদিররসে মত্ত, কিন্তু এই নব্যতাই এর ক্ষণিকতার লক্ষণ।…আমার পুরাতন বন্ধুদের মধ্যে আমার অন্তরের অনুরাগ সবচেয়ে অক্ষুণ্ন আছে Sturge Moore এর প্রতি। তিনি জনতার ফরমাসে নব্যতার ভেক ধরেন নি, তার মধ্যে সাহিত্যের আভিজাত্য অম্লান। আর আমি জানি আধুনিকতার কঠোর ঘর্ষণে তার সহৃদয়তায় কড়া পড়ে যায় নি।
‘নবযুগের কাব্য’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বালক-বয়সেই ইংরেজি সাহিত্যের আঙিনায় যাওয়া-আসা শুরু করেছি। ভাষার আভিধানিক বেড়াটা যেমনি পার হয়েছি অমনি ওখানকার ফলের বাগান থেকে ফল পাড়বার আনন্দে বেলা কেটেছে। যেটুকু বাধা পেয়েছি তাতে ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি বরঞ্চ ঔৎসুক্য বাড়িয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের পথে এই সর্বজনীনতার আহ্বান পেয়েছিলুম একে সমতলতা বললে অসংগত হবে। এর মধ্যে বাঁকচোর উঁচুনিচু যথেষ্ট ছিল। লেখকদের মধ্যে ব্যক্তিগত বৈষম্যের অভাব ছিল না। কিন্তু রূঢ়ভাবে কোনো দেউড়ি থেকে কোনো দ্বারী ঠেকিয়ে রাখেনি।
সেদিন গেল, এখন নতুন যুগ এসেছে। যে সাহিত্যে চলাফেরা অভ্যস্ত ছিল সেখানে হঠাৎ দেখি রাস্তা খুঁজে পাই নে। আমি বিদেশী ব’লেই যে আমাকে এই রকম ধাঁধা লাগিয়েছে তা নয়, আমার কোনো কোনো ইংরেজ বন্ধুকেও জিজ্ঞাসা ক’রে খবর পেয়েছি তাঁদের পক্ষেও আধুনিক কাব্য সহজবোধ্য নয়।
অবশ্য অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তুমি এখনকার ইংরেজ কবিদের যে সব নমুনা কপি করে পাঠাচ্চ পড়ে আমার খুব ভালো লাগচে,–সংশয় ছিল আমি বুঝি দূরে পড়ে গেছি, আধুনিকদের নাগাল পাব না–এই কবিতাগুলি পড়ে বুঝতে পারলুম আমার অবস্থা অত্যন্ত বেশি শোচনীয় হয় নি।’
জন কীটস্, (১৭৯৫ - ১৮২১)
ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী দেবীকে এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘কীটস সম্বন্ধে আমি যত ইংরাজ কবি জানি সব চেয়ে কীটসের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা আমি বেশী করে অনুভব করি।… কীটসের ভাষার মধ্যে যথার্থ আনন্দসম্ভোগের
একটি আন্তরিকতা আছে। ওর আর্টের সঙ্গে আর হৃদয়ের সঙ্গে বেশ সমতানে মিশেছে–যেটি তৈরি করে তুলেছে সেটির সঙ্গে বরাবর তার হৃদয়ের একটি নাড়ীর যোগ আছে। টেনিসন সুইনবর্ন প্রভৃতি অধিকাংশ আধুনিক কবির অধিকাংশ কবিতার মধ্যে একটা পাথরে-খোদা ভাব আছে–তারা কবিত্ব করে লেখে এবং যে লেখার প্রচুর সৌন্দর্য আছে, কিন্তু কবির অন্তর্যামী সে লেখার মধ্যে নিজের স্বাক্ষর করা সত্য পাঠ লিখে দেয় না। টেনিসনের ‘মড’ কবিতায় যে সমস্ত লিরিকের উচ্ছ্বাস–আছে সেগুলি বিচিত্র এবং সুতীব্র হৃদয়বৃত্তি-দ্বারা উচ্ছলরূপে পরিপূর্ণ বটে, কিন্তু তবু মিসেস ব্রাউনিঙের সনেটগুলি তার চেয়ে ঢের বেশি অন্তরঙ্গরূপে সত্যি। টেনিসনের অচেতন কবি যে-সমস্ত ছত্র লেখে টেনিসনের সচেতন আর্টিস্ট তার উপর নিজের রঙিন তুলি বুলিয়ে সেটাকে ক্রমাগতই আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। কীটসের লেখায় কবিহৃদয়ের স্বাভাবিক সুগভীর আনন্দ তার রচনার কলা-নৈপুণ্যের ভিতর থেকে একটা সজীব উজ্জ্বলতার সঙ্গে বিচ্ছুরিত হতে থাকে। সেইটে আমাকে ভারী আকর্ষণ করে। কীটসের লেখা সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ
নয় এবং তার প্রায় কোনো কবিতারই প্রথম ছত্র থেকে শেষ ছত্র পর্যন্ত চরমতা প্রাপ্ত হয় নি, কিন্তু একটি অকৃত্রিম সুন্দর সজীবতার গুণে আমাদের সজীব হৃদয়কে এমন ঘনিষ্ঠ সঙ্গদান করতে পারে।’
আর এক পত্রে শেলী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘শেলিকে অন্যান্য অনেক বড়োলোকের চেয়ে বিশেষরূপে কেন ভালো লাগে জানিস? ওর চরিত্রে কোনোরকম দ্বিধা ছিল না, ও কখনো আপনাকে কিম্বা আর কাউকে বিশ্লেষণ করে দেখে নি–ওর একরকম অখণ্ড প্রকৃতি। শিশুদের, এবং অনেক স্থলে মেয়েদের, এই জন্যে বিশেষরূপে ভালো লাগে তারা সহজ স্বাভাবিক, তারা নিজের মনের বিতর্ক কিম্বা থিয়োরি-দ্বারা নিজেকে ভেঙে চুরে গড়ে নি। শেলির স্বভাবের যে সৌন্দর্য তার মধ্যে তর্ক বিতর্ক আলোচনার লেশ নেই। সে যা হয়েছে, সে কেবল নিজের ভিতরকার এ অনিবার্য সৃজনশক্তির প্রভাবেই হয়েছে। সে নিজের জন্যে নিজে কিছুমাত্র দায়ী নয়–সে জানেও না সে কাকে কখন আঘাত দিচ্ছে, কাকে কখন সুখী করছে–তাকেও কোনো বিষয়ে নিশ্চয়রূপে কারও জানবার জো নেই। কেবল এইটুকু স্থির যে, ও যা ও তাই, তা ছাড়া ওর আর কিছু হবার জো ছিল না। ও বাইরের প্রকৃতির মতো স্বভাবতই উদার এবং সুন্দর এবং স্বভাবতই নিজের এবং পরের সম্বন্ধে চিন্তা ও দ্বিধা-মাত্র-হীন। সেই রকম অখণ্ড প্রকৃতির লোকের ভারী একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে। এদের সকলেই মাপ করে এবং মায়া করে–কোনো দোষ এদের স্বভাবে যেন স্থায়ীভাবে লিপ্ত হতে পারে না। এদের স্বভাব প্রথম যুগের আদম ইভের মতো আবরণহীন এবং সেই জন্যেই এক হিসাবে পরমরহস্যময়। এরা এখনো জ্ঞান বৃক্ষের ফল খায় নি বলে একটি নিত্য সত্যযুগে বাস করছে।’
শেলির শতবার্ষিকী স্মরণোৎসবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে বলেন, ‘‘শেলি সর্বাংশে…কবি ছিলেন…তাঁর ব্যবহার, তার যা কিছু আশা আকাঙ্খা, তার সমস্তই এক কবিত্বের ছাঁচে ঢেলে তৈরি করেছিলেন–এ কথা বেশ উপলব্ধি করা যায়। অনেক কবিকে জানি, একটা বিশেষ সময়ে হয়তো কবিত্বের ভুত তাঁদের পেয়ে বসলে পর কাব্য রচনা করেন এবং বেশ ভালো কাব্যও রচনা করেন।…কিন্তু শেলির জীবনের আশৈশব গতি এবং প্রকৃতি সমস্তই কবির। Imagination -এর আবহাওয়ায় তাঁর মন নিমগ্ন ছিল। কেবল তাঁর মগজের এক অংশ নয়, তার সমস্ত জীবন নিমগ্ন ছিল। এইজন্য তাঁকে লোকে খেপা বলে মনে করেছে অনেক সময়।
অন্যান্য সাধারণ বা অসাধারণ ব্যক্তির মতো শেলিরও কতকগুলি মতামত ছিল। এ কথা আমরা সকলেই জানি মতামত থাকাটা কবিত্বের পক্ষে একটা বালাই।…সেটা আমরা ওয়ার্ডসওয়ার্থে বিশেষ করে দেখেছি। যেখানে তিনি রসেতে খুব পূর্ণ হয়েছেন সেখানে তিনি মতকে চাপা দিতে পেরেছেন। কিন্তু সেই পূর্ণতা একটু খর্ব হবামাত্র তাঁর মতগুলো খাড়া হয়ে উঠে রস প্রবাহের প্রতিবাদ করতে থাকে। শেলিরও মতামত ছিল স্বাধীনতা সম্বন্ধে, মানবজাতির জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে, ধর্ম সম্বন্ধে, রাজনীতি সম্বন্ধে। কিন্তু সেই মতগুলি পাগলামির দ্বারা বেশ মজে গিয়েছিল। সে ছিল এক পাগলা কবির মতামত। সুবুদ্ধি জিনিসটা মর্তের জিনিস, কিন্তু উচ্চ অঙ্গের খাঁটি যে পাগলামি সে দৈবী। তাই বুঝি সুবুদ্ধির গড়া জিনিস ভেঙে ভেঙে পড়ে, আর পাগলামির উড়িয়ে আনা জিনিস বীজের মতো অরণ্যের পর অরণ্য সৃষ্টি করে, তাই পাগলা শেলির বাণী আজও নবীন আছে।…বিচিত্র সুখ দুঃখময় মানুষের এই জীবনটাকেও শেলি যেন একটা পর্দার মতো করে দেখেছিলেন। এর খণ্ডতা এর স্থূলতা যেন সত্যকে আবৃত করে রয়েছে। এই কুহেলিকার পর্দাখানা ছিঁড়ে ফেলে সত্যের নির্মল মূর্তি দেখবার জন্যে কবির ভারী একটা ব্যাকুলতা ছিল। কতবার সেইজন্য তিনি মৃত্যুর মধ্যে উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করেছেন। এই মুক্তি-পিপাসু কবি যেমন রাজতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রের
বাধা সইতে পারেন নি, তেমনি মানুষের জীবনের খণ্ড-চেতনা বিরাট সত্যের উপলব্ধি থেকে আমাদের চিত্তকে যে গণ্ডিবদ্ধ করে রেখেছে এও তিনি সহ্য করতে পারেন নি। এইখানে যেন শেলির মনের সঙ্গে আমাদের ভারতীয় মনের একটা মিল দেখতে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের এই ব্যবহারিক জগৎকে, এই স্থূল জগৎকে সম্পূর্ণ সত্য বলে বিশ্বাস করে না এবং এর ভিতরে অন্তরতম অন্তর্যামী যে সত্য আছে তাকেই সন্ধান করে বেড়ায়।…
শেলিকে তাঁর জীবনকালে ও পরবর্তীকালে তাঁর দেশের লোকে নাস্তিক বলে অপবাদ দিয়েছে। তার কারণ এই যে প্রচলিত ধর্মতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রকে
তিনি আঘাত করেছেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে গভীর একটা ধর্মের তৃষ্ণা ছিল, একটা আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ছিল, সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ করা যেতে পারে না। তিনি তাঁর Alastar কাব্যের মধ্যে যে সন্ধানের বেদনা প্রকাশ করেছেন সে কিসের সন্ধান।…তার যে বেদনা, সেই যে সন্ধান, তারই দ্বারা প্রমাণ হয় যে পরম সৌন্দর্যময় একটি আত্মিক সত্তা বিশ্বের মধ্যে আছে, যে সম্বন্ধে শেলির চিত্তে গভীর বেদনাপূর্ণ একটি আকৃতি ছিল।
নভেলের আয়তন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের আলোচনায় বলেন, ‘বঙ্কিমবাবুর নভেলগুলি ঠিক নভেল যত বড়ো হওয়া উচিত তার আদর্শ। ভাগ্যে তিনি ইংরাজি নভেলিস্টের অনুকরণে বাংলায় বৃহদায়তনের দস্তুর বেঁধে দেন নি, তা হলে বড়ো অসহ্য হয়ে উঠত, বিশেষত সমালোচকের পক্ষে। এক-একটা ইংরাজি নভেলে এত অতিরিক্ত বেশি কথা, বেশি ঘটনা, বেশি লোক যে, আমার মনে হয় এটা একটা সাহিত্যের বর্বরতা। সমস্ত রাত্রি ধরে যাত্রাগান করার মতো। প্রাচীনকালেই ওটা শোভা পেত। তখন ছাপাখানা এবং প্রকাশক সম্প্রদায় ছিল না, তখন একখানা বই নিয়ে বহুকাল জাওর কাটবার সময় ছিল।’’
গ্যোটের মূল রচনা অধিগত করার জন্য একসময় রবীন্দ্রনাথ জর্মন ভাষা শেখার চেষ্টা করেন ‘‘গেটে যদিও এক হিসাবে খুব নির্লিপ্ত প্রকৃতির লোক ছিল, তবু সে মানুষের সংস্রব পেত, মানুষের মধ্যে মগ্ন ছিল। সে যে রাজসভায় থাকত সেখানে সাহিত্যের জীবন্ত আদর ছিল, জার্মানিতে তখন খুব একটা ভাবের মন্থন আরম্ভ হয়েছিল–হের্ডের শ্লেগেল হুম্বোল্ট্ শিলার কান্ট প্রভৃতি বড়ো বড়ো চিন্তাশীল এবং ভাবুকগণ দেশের চারিদিকে জেগে উঠেছিল, তখনকার মানুষের সংসর্গ এবং দেশব্যাপী ভাবের আন্দোলন খুব প্রাণপরিপূর্ণ ছিল। আমরা হতভাগ্য বাঙালি লেখকেরা ভিতরকার সেই প্রাণের অভাব একান্ত মনে অনুভব করি–আমরা আমাদের কল্পনাকে সর্বদাই সত্যের খোরাক দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারি নে, নিজের মনের সঙ্গে বাইরের মনের একটা সংঘাত হয় না বলে আমাদের রচনাকার্য অনেকটা পরিমাণে আনন্দবিহীন হয়।
‘পত্রালাপ-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন: জর্জ এলিয়টের নভেল যদিও আমার খুব ভালো লাগে তবু এটা আমার বরাবর মনে হয়, জিনিসগুলো বড়ো বেশি বড়ো–এত লোক, এত ঘটনা, এত কথার হিজিবিজি না থাকলে বইগুলো আরো ভালো হত। কাঁঠাল ফল দেখে যেমন মনে হয়–প্রকৃতি একটা ফলের মধ্যে ঠেসাঠেসি করে বিস্তর সারবান কোষ পুরতে চেষ্টা করে ফলটাকে আয়তনে খুব বৃহৎ এবং ওজনে খুব ভারী করেছেন বটে এবং একজন লোকের সংকীর্ণ পাকযন্ত্রের পক্ষে কম দুঃসহ করেন নি, কিন্তু হাতের কাজটা মাটি করেছেন। এরই একটাকে ভেঙে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা ফল গড়লে সেগুলো দেখতে ভালো হত। জর্জ এলিয়টের এক-একটি নভেল এক-একটি সাহিত্যকাঁঠাল-বিশেষ। ক্ষমতা দেখে মানুষ আশ্চর্য হয় বটে, কিন্তু সৌন্দর্য দেখে মানুষ খুশি হয়। স্থায়িত্বের পক্ষে সহজতা সরলতা সৌন্দর্য যে প্রধান উপকরণ তার আর সন্দেহ নেই।’
১৭ মার্চ, ১৯৩৯ অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘ডিক্টেটরি বুদ্ধি যতই গরম হয়ে ওঠে ততই একেশ্বর নেতারা ভুলে যায় যে, বিধাতার অন্যমনস্কতায় তারা সর্বজ্ঞ হয়ে জন্মায় নি। মানুষকে চালনা করবার নেশা এমনি তাদের পেয়ে বসে যে সকল বিষয়েই মানুষকে নাকে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে উগ্রভাবে উদ্যত হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যে ডিক্টেটররা কেবল রাষ্ট্রিক ব্যাপারে নয়, সামাজিক বিধানে নয়, সাহিত্যে আর্টেও আপন শাসন রুদ্ররীতিতে প্রচার করছে। মানুষের এই বিভাগটা ছিল বিশেষভাবে গুণীদের হাতেই, পালোয়ানদের হাতে নয়। আকবর বাদশাও গানের আসরে তানসেনকে মেনে চলেছেন, সেখানে যদি তিনি বাদশাহী করতেন তাহলে সে হত সাংগীতিক ভুতের কীর্তন।’
এ ব্যাপারে সাহিত্যের স্বরূপ-এর সাহিত্যবিচার-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘আমি যখন মস্কৌ গিয়েছিলুম, চেকভের রচনা সম্বন্ধে আমার অনুকূল অভিরুচি ব্যক্ত করতে গিয়ে হঠাৎ ঠোক্কর খেয়ে দেখলুম, চেকভের লেখায় সাহিত্যের মেলবন্ধনে জাতিচ্যুতিদোষ ঘটেছে, সুতরাং তাঁর নাটক স্টেজের মঞ্চে পঙক্তি পেল না। সাহিত্যে এই মনোভাব এত বেশি কৃত্রিম যে শুনতে পাই, এখন আবার হাওয়া বদল হয়েছে।’
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০–১৮৫০)
ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ এর সঙ্গে আলেকজান্ডার পোপ এর তুলনা করে নবযুগের কাব্য-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘আলেকজান্ডার পোপ যে-ঋতুর বাহন, ওয়ার্ড্সওয়ার্থ সে-ঋতুর নন। এই বদল মনের বদলের অনুবর্তী। প্রাকৃত জগৎ ও মানস জগতকে দুই যুগের কবিরা ভিন্ন চেহারায় দেখেছেন তাই ছন্দ ও ভাষা আপনিই বদলিয়েছে তার প্রকাশভঙ্গী। আমরা সেই অধুনা-উপহসিত ভিক্টোরীয় যুগের সাহিত্যের দান গ্রহণ করেছি, দীক্ষা পেয়েছি তারই কাছ থেকে।
সাহিত্য-এর ‘পত্রালাপ’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘গোতিয়ের সহিত ওআর্ডস্ওআর্থের তুলনা করা যেতে পারে। ওআর্ডস্ওআর্থের
কবিতার মধ্যে যে সৌন্দর্যসত্য প্রকাশিত হয়েছে তা পূর্বোক্ত ফরাসিস সৌন্দর্যসত্য অপেক্ষা বিস্তৃত। তার কাছে পুষ্পপল্লব নদীনির্ঝর পর্বতপ্রান্তর
সর্বত্রই নবনব সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। কেবল তাই নয়–তার মধ্যে তিনি একটা আধ্যাত্মিক বিকাশ দেখতে পাচ্ছেন, তাতে করে সৌন্দর্য অনন্ত বিস্তার এবং অনন্ত গভীরতা লাভ করেছে। তার ফল এই যে, এরকম কবিতায় পাঠকের শ্রান্তি তৃপ্তি বিরক্তি নেই; ওআর্ডসওআর্থের কবিতার মধ্যে সৌন্দর্যের এই বৃহৎ সত্যটুকু থাকাতেই তার এত গৌরব এবং স্থায়িত্ব।
‘ইংলন্ডের ভাবুকসমাজ’-এ রবীন্দ্রনাথ এইচ. জি. ওয়েলস সম্পর্কে বলেন, ‘এখনকার কালের সুবিখ্যাত ওয়েলস সাহেবের দুই-একখানি নভেল ও আমেরিকার সভ্যতা সম্বন্ধে একখানা বই পূর্বেই পড়িয়াছিলাম। তাহাতেই জানিতাম, ইঁহার চিন্তাশক্তি ইস্পাতের তরবারির মতো যেমন ঝকঝক্ করে তেমনি তাহা খরধার।…মানুষটি সজারুজাতীয় নহে, সম্পূর্ণ মোলায়েম। দেখিতে পাইলাম, ইঁহার প্রখরতা চিন্তায়, কিন্তু প্রকৃতিতে নয়। আসল কথা, মানুষের প্রতি ইঁহার আন্তরিক দরদ আছে, অন্যায়ের প্রতি বিদ্বেষ এবং মানুষের সার্বজনীন উন্নতির প্রতি অনুরাগ আছে; সেইটে থাকিলেই মানুষের মন কেবলমাত্র চিন্তার তুবড়িবাজি করিয়া সুখ পায় না।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে লিখিত এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘Essays of Elia আমার কাছে Essay শ্রেণীর রচনার আদর্শ বলে মনে হয়। আজ পর্য্যন্ত কেউ তার নকল করতে পারেনি, এতই “নাজুক” তার রস। জাপানীতে একটা তিন লাইনের কবিতা আছে তাতে বলচে, জেলে তার চৌকোণা জাল ফেলল জলে, মাছ পড়ল ধরা কিন্তু তারার প্রতিবিম্ব সে তুলতে পারলে না। শ্যাওলা ঢাকা গভীর জলের Essay অনেক আছে, তার থেকে বড়ো বড়ো রুই কাৎলাও ধরা পড়ে আধুনিক কালের পীবরতনু উপন্যাসের মতো–কিন্তু ল্যাম্বের Essay সাহিত্যে-স্বর্গের রসসরোবর, ওতে তারার আলোর সূক্ষ্ম হাস্যলীলা। নকলবাজেরা জাল ফেলে তা ধরতে পারলে না।’
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়রির পরিশিষ্টে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমি যখন Mathew Arnold এর কবিতা পড়ি তখন মনে হয় য়ুরোপীয় সভ্যতার মধ্যে যতটুকু প্রাচীন হয়ে পড়েছে তারই যেন আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি।’
ওআল্ট্ হুইটম্যান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ‘ছন্দ্বে’-এ বলেন, ‘‘আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যে তিনি গদ্যে কাব্য রচনা করেছেন। সাধারণ গদ্যের সঙ্গে তার প্রভেদ নেই, তবে ভাবের দিক থেকে তাকে কাব্য না বলে থাকবার জো নেই।
আত্মশক্তি ও সমূহ-এর রাজা ও প্রজায় রবীন্দ্রনাথ রাডইয়ার্ড কিপলিঙ সম্পর্কে বলেন, ‘তাঁহার অসামান্য ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা বলে তিনি ইংরাজের কল্পনাচক্ষে প্রাচ্যদেশকে একটি বৃহৎ পশুশালার মতো দাঁড় করাইয়াছেন। তিনি ইংলন্ডের ইংরাজকে বুঝাইতেছেন, ভারতবর্ষীর গবর্ণমেন্ট একটি সার্কাস কম্পানি। তাঁহারা নানা জাতীয় বিচিত্র অপরূপ জন্তুকে সভ্যজগৎসমক্ষে
সুনিপুণভাবে নৃত্য করাইতেছেন। একবার সতর্ক অনিমেষ দৃষ্টি ফিরাইয়া লইলেই সব-কটা ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িবে। সুতীক্ষ্ম কৌতূহলের সহিত এই জন্তুদিগের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করিতে হইবে, যথাপরিমাণে চাবুকের ভয় এবং অস্থিখণ্ডের প্রলোভন রাখিতে হইবে এবং কিয়ৎপরিমাণে পশুবাৎসল্যেরও
আবশ্যক আছে। কিন্তু ইহার মধ্যে নীতি প্রীতি সভ্যতা আনিতে গেলে সার্কাস রক্ষা করা দুষ্কর হইবে এবং অধিকারীমহাশয়ের
পক্ষেও বিপদের সম্ভাবনা।’
অত্যুক্তিতে রবীন্দ্রনাথ আরো বলেন, ‘প্রাচ্য অত্যুক্তির উদাহরণ আরব্য উপন্যাস এবং পাশ্চাত্য অত্যুক্তির উদাহরণ রাডিয়ার্ড কিপলিঙের “কিম্” এবং তাঁহার ভারতবর্ষীয় চিত্রাবলী।… কিপলিঙ তাঁহার কল্পনাকে আচ্ছন্ন রাখিয়া এমনি একটি সত্যের আড়ম্বর করিয়াছেন যে, যেমন হলপ-পড়া সাক্ষীর কাছ হইতে লোকে প্রকৃত বৃত্তান্ত প্রত্যাশা করে তেমনি কিপলিঙের গল্প হইতে ব্রিটিশ পাঠক ভারতবর্ষের প্রকৃত বৃত্তান্ত প্রত্যাশা না করিয়া থাকিতে পারে না।
ব্রিটিশ পাঠককে এমনি ছল করিয়া ভুলাইতে হয়। কারণ, ব্রিটিশ পাঠক বাস্তবের প্রিয়।…কল্পনার নিজ এলাকার মধ্যেও ব্রিটিশ পাঠক বাস্তবের সন্ধান করে–তাই কল্পনাকেও দায়ে পড়িয়া প্রাণপণে বাস্তবের ভান করিতে হয়। যে ব্যক্তি অসম্ভব স্থান হইতেও সাপ দেখতে চায়, সাপুড়ে তাহাকে ঠকাইতে বাধ্য হয়। সে নিজের ঝুলির ভিতর হইতেই সাপ বাহির করে, কিন্তু ভান করে যেন দর্শকের চাদরের মধ্য হইতে বাহির হইল। কিপলিঙ নিজের কল্পনা ঝুলি হইতেই সাপ বাহির করিলেন, কিন্তু নৈপুণ্যগুণে ব্রিটিশ পাঠক ঠিক বুঝিল যে, এশিয়ার উত্তরীয়ের ভিতর হইতেই সরীসৃপগুলো দলে দলে বাহির হইয়া আসিল।’
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন হিসাবে নিরাসক্ত মনকে য়ুরোপ সায়ান্সে পেয়েছে, কিন্তু সাহিত্যে পায় নি। উদ্ধত কালাপাহাড়ি নব্যতার মদির রসে মত্ত অঘোরপন্থীদের কথা ভেবেই হয়ত রবীন্দ্রনাথ অনুরূপ উক্তি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের দীক্ষা, তাঁর কথায়, সেই অধুনা উপহসিত ভিক্টোরীয় যুগের সাহিত্যে এবং সেই অনুসারে যা মহৎ তাকে সন্ধান করে বিশেষভাবে বিশেষ স্থানে বিশেষ অনুষ্ঠানে তার জন্য তিনি আসন পেতেছিলেন। তিনি ভাবতেন, সেদিনের লেখকের মধ্যে বৈষম্য থাকলেও রূঢ়ভাবে কোনো দেউড়ি থেকে কোনো দ্বারী তাঁকে ঠেকিয়ে রাখে নি। পরে দ্বাররুদ্ধ য়ুরোপীয় দুর্গমতায় তিনি অনুভব করেছিলেন আধুনিক ইংরেজি কাব্যে তাঁর প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত। আবার, আধুনিক কবিদের কিছু কিছু নমুনা পড়ে তাঁর যে সংশয় হয়েছিল যে তিনি আধুনিক কবিদের নাগাল পাবেন না তা কেটে যায়। তিনি স্বস্তি পান এই ভেবে যে, তাঁর অবস্থাটা অত শোচনীয় নয়। ভিক্টোরীয় যুগে যাঁর দীক্ষা তাঁর পক্ষে পাশ্চাত্য পুঁথিপাড়ার সব তোলপাড়কে সহজে গ্রহণ করা সম্ভব না হওয়ারই কথা। মনঃসমীক্ষণ, অবচেতনতত্ত্ব, যৌনপ্রবৃত্তির
অনাবরণ বা অশ্লীলতা, বাস্তবিকতা, দারিদ্র্যবেদনা,
মার্ক্সিজম ইত্যাদি য়ুরোপীয় মতবাদের যে ঢেউ গঙ্গাতীরে এসে লেগেছিল তা তাঁর মনে কখনো সংশয়, কখনো দ্বন্দ্ব, আবার কখনো ক্ষোভের উদ্রেক করেছিল। তখনও অস্তিত্ববাদের
কথা তেমন ওঠে নি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়ে’ বলছেন, ‘রুচির প্রমাণ তর্কে হতে পারে না। রুচির প্রমাণ কালে। কালের ধৈর্য অসীম, রুচিকেও তার অনুকরণ করতে হয়।’ তাঁর বয়স যখন ত্রিশকে ছুঁইছুঁই করছে তখন তিনি চাচ্ছেন সরল সুন্দর মধুর উদার লেখা। তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’র মতো Sickly বই পড়ে কী সুখ তিনি বুঝতে পারেন না। ত্রিশ পেরিয়ে তিনি বলছেন, সমগ্র মানুষ যেখানে মুক্তিলাভ করেছে সেই সুবৃহৎ অনাবরণের মধ্যে অশ্লীলতা নেই। শেক্সপীয়র, রামায়ণ বা মহাভারত অশ্লীল নয়। কিন্তু এমিল জোলা ও ভারতচন্দ্র অশ্লীল–কেননা সেখানে মানুষ কেবল আংশিকভাবে অনাবৃত। দু-এক বছর পরে তিনি বলছেন, শেক্সপীয়রের ‘ওথেলো’ দ্বিতীয়বার পড়তে তাঁর কিছুতেই মন উঠে না। তার কারণ, ওথেলোর মধ্যে যেটুকু করুণা আছে তা তাঁকে আকর্ষণ করে, কিন্তু নাটকের শেষ অংশের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা তাঁকে বিমুখ করে। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে য়ুরোপীয় সাহিত্যে যৌনমিলনের দৈহিকতার উপদ্রব দেখে তিনি বলছেন ওর প্রেরণা বৈজ্ঞানিক কৌতূহলে, আর তা সাহিত্যে চিরকাল টিকতে পারে না। তাঁর মতে, সাহিত্যে যৌনমিলন নিয়ে যে তর্ক উঠেছে সামাজিক হিতবুদ্ধির দিক থেকে তার সমাধান হবে না, তার সমাধান কলারসের দিক থেকে। আবার সত্তর বয়সে সেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, যেখানে রূপের পূর্ণতা সেখানকার সৃষ্টি প্রকৃতির সৃষ্টির মতোই। রামায়ণের মন্থরা, মহাভারতের শকুনি ও ওথেলোর ইয়াগো প্রকৃতির উট, ব্যাং, বাদুরের মতো কুরূপ হতেও সঙ্কোচ করে না, কেননা তার মধ্যেও সত্যের শক্তি আছে।
যাঁর একসময় মনে হয়েছে, সাইকোঅ্যানালিসিসের বুলির মধ্যে সৃষ্টির অবিশ্লেষ্য সমগ্রতাকে খর্ব করবার মনোভাব জেগে উঠেছে, সেই তিনিই আবার মনস্তত্ত্বের
অপরূপ রহস্যের মধ্যে কখন তলিয়ে গেছেন–গোচরাতীত চেতনাকে ও ইন্দ্রিয়াতীত জগৎকে নানাভাবে স্পর্শ করে তাদের বার্তা নানা ছন্দে দেবার চেষ্টা করছেন। সকল সৃষ্টিতেই চেতন-অবচেতনের মিলিত লীলা লক্ষ্য ক’রে তিনি আধুনিক মনোলোকে কাব্যের প্রকাশ রহস্যকে যেমন বোঝার চেষ্টা করেন, তেমনি যেখানে তার আবির্ভাব কৃত্রিম নয়, সেখানে তাকে তিনি স্বীকারও করে নিতে চান। অবচেতন তত্ত্বের প্রভাব তিনি দেখছেন ছেলে ভোলাবার ছড়ায়,–তাঁর নিজের আঁকা ছবিতে।
রিয়ালিজম বা বাস্তবিকতা সম্পর্কে তিনি বলছেন এটা কাঁচপোকার মতো আর্টের মধ্যে প্রবেশ করে তেলাপোকার মতো তার অন্তরের সমস্ত রস নিঃশেষ করে ফেলে। তাঁর কাছে বিষয়-বাছাই নিয়ে রিয়ালিজম নয়, রিয়ালিজম ফুটবে রচনার জাদুতে। রিয়ালিটির কৃত্রিম কারি-পাউডারে তৈরি সাহিত্যের মধ্যে তিনি কেবল দেখেছেন দারিদ্র্যের আস্ফালন, আর-একটা লালসার অসংযম।
বামপন্থী সাহিত্যের আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, দারিদ্র্যবেদনা
যখন একটা ভঙ্গিমার অঙ্গ হয় তখন সেই প্রয়াসের মধ্যে লেখকেরই দারিদ্র্য প্রকাশ পায়। কবিতার জাত রেখে যদি মার্ক্সিজমের ছোঁয়াচ কারো কবিতায় লাগে তবে তাঁর আপত্তি নেই। আর যদি নাও লাগে, তবে তাঁর কথা হলো, জাত তুলে কি গাল দেওয়া শোভা পাবে! যদি কিছু সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে প্রাচীন হোক বা আধুনিক হোক বা বিশেষ কোনো মতবাদ দ্বারা প্রণোদিত হোক বা লালিত হোক তা হলে আর কোনো জবাবদিহি নেই–এই হলো কবির মোদ্দা কথা।
১৩১৪ সালে ‘সৌন্দর্য ও সাহিত্যে’ Comparative
Literature -কে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্য বলেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ কর্তৃক সুন্দরের পরিচয়, আনন্দের পরিচয়, দেশে দেশে কালে কালে সাহিত্যে সঞ্চিত হইতেছে। সত্যের উপরে মানুষের হৃদয়ের অধিকার কোন পথ দিয়া কেমন করিয়া বাড়িয়া চলিয়াছে, সুখবোধ কেমন করিয়া ইন্দ্রিয় তৃপ্তি হইতে ক্রমে প্রসারিত হইয়া মানুষের সমস্ত মন ধর্মবুদ্ধি ও হৃদয়কে অধিকার করিয়া লইতেছে যে এমনি করিয়া ক্ষুদ্রকেও মহৎ এবং দুঃখকেও প্রিয় করিয়া তুলিতেছে, মানুষ নিয়তই আপনার সাহিত্যে সেই পথের চিহ্ন রাখিয়া চলিয়াছে। যাঁহারা বিশ্বসাহিত্যের পাঠক, তাঁহারা সাহিত্যের ভিতর দিয়া সেই রাজপথটির অনুসরণ করিয়া সমস্ত মানুষ হৃদয় দিয়া কী চাহিতেছে ও হৃদয় দিয়া কী পাইতেছে, সত্য কেমন করিয়া মানুষের কাছে মঙ্গলরূপ ও আনন্দরূপ ধরিতেছে, তাহাই সন্ধান করিয়া ও অনুভব করিয়া কৃতার্থ হইবেন।’
‘মেঘনাধবদ কাব্য’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ আমরা দেখিতেছি হোমরের সময়ে শারীরিক বলকেই বীরত্ব বলিত, শারীরিক বলের নামই ছিল মহত্ত্ব। বাহুবলদৃপ্ত একিলিসই ইলিয়ডের নায়ক ও যুদ্ধবর্ণনাই তাহার আদ্যোপান্ত। আর আমরা দেখিতেছি বাল্মীকির সময়ে ধর্মবলই যথার্থ মহত্ত্ব বলিয়া গণ্য ছিল–কেবল মাত্র দাম্ভিক বাহুবলকে তখন ঘৃণা করিত। হোমরের দেখ একিলিসের ঔদ্ধত্য, একিলিসের বাহুবল, একিলিসের হিংস্রপ্রবৃত্তি; আর রামায়ণে দেখ এক দিকে রামের সত্যের অনুরোধে আত্মত্যাগ, এক দিকে লক্ষ্মণের প্রেমের অনুরোধে আত্মত্যাগ, একদিকে বিভীষণের ন্যায়ের অনুরোধে সংসারত্যাগ। রামও যুদ্ধ করিয়াছেন, কিন্তু সেই যুদ্ধঘটনাই তাঁহার সমস্ত চরিত্র ব্যাপ্ত করিয়া থাকে নাই, তাহা তাঁহার চরিত্রের সামান্য এক অংশ মাত্র। ইহা হইতেই প্রমাণ হইতেছে, হোমরের সময়ে বলকেই ধর্ম বলিয়া জানিত ও বাল্মীকির সময়ে ধর্মকেই বল বলিয়া জানিত। অতএব দেখা যাইতেছে কবিরা স্ব স্ব সময়ের উচ্চতম আদর্শের কল্পনায় উত্তেজিত হইয়াই মহাকাব্য রচনা করিয়াছেন ও সেই উপলক্ষে ঘটনাক্রমে যুদ্ধের বর্ণনা অবতারিত হইয়াছে–যুদ্ধের বর্ণনা করিবার জন্যই মহাকাব্য লেখেন নাই।’
১৯২৭ সালে ‘সাহিত্যে নবত্ব-এ’ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘হোমরের মহাকাব্যের কাহিনীটা গ্রীক, কিন্তু তার মধ্যে কাব্যরচনার যে আদর্শটা আছে যেহেতু তা সার্বভৌমিক এইজন্যেই সাহিত্যপ্রিয়
বাঙালিও সেই গ্রীক কাব্য পড়ে তার রস পায়।’
জনৈক অধ্যাপককে লিখিত এক পত্রে (বিশ্বভারতী পত্রিকা ১৩৪৯ অগ্রহায়ণ ৩৩৪) রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘প্রাচীন সাহিত্যে অনেক ভালো জিনিস নিশ্চয়ই আছে–তার কোনো কোনোটার সঙ্গে তুলনা করলে য়ুরোপীয় সাহিত্যের কোনো কোনোটাকে হার মানতেও হতে পারে। কিন্তু মস্ত কথাটা এই যে য়ুরোপীয় সাহিত্যে জীবন পদার্থ আছে, তা বেড়ে উঠছে পরিবর্ত্তিত হচ্ছে, সে মানুষের প্রতিদিনের প্রাণের ক্ষেত্রে আপনার প্রকাশ অন্বেষণ করচে। এই কারণেই তার অনুকরণ করার জন্য নয়, তার থেকে প্রাণের প্রেরণা লাভ করবার জন্যেই তার সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। যে সব থেকে অঙ্কুর বেরচ্চে তাতে প্রাণিক বস্তু আছে, যার ricket ব্যাধি তাকে সেটাতে সবল করে।…মরা সাহিত্য খুব সারবান ও সুন্দর হতে পারে কিন্তু একমাত্র তাতেই যারা মানুষ, তাদের চিত্ত রিকেটি হয়ে ওঠে–তারা যে সাহিত্য উৎপাদন করে তার চলৎশক্তি থাকে না। বঙ্কিম বাংলা সাহিত্যে যে মুহূর্ত্তে য়ুরোপীয় সাহিত্য থেকে ভিটামিন সংগ্রহ করে তার সুপ্ত প্রাণশক্তিকে
জাগ্রত করলেন অমনি দেখতে দেখতে সাহিত্য শাখায় প্রশাখায় পল্লবে বিস্তীর্ণ হয়ে উঠতে লাগল–এখন একে থামিয়ে রাখা দায়।’
য়ুরোপের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে ১৩১৪ সালের ‘সাহিত্যসৃষ্টি’তে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘য়ুরোপ হইতে একটা ভাবের প্রবাহ আসিয়াছে এবং স্বভাবতই তাহা আমাদের মনকে আঘাত করিতেছে। এইরূপ ঘাত-প্রতিঘাতে আমাদের চিত্ত জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে, সে কথা অস্বীকার করিলে নিজের চিত্তবৃত্তির
প্রতি অন্যায় অপবাদ দেওয়া হইবে। এইরূপ ভাবের মিলনে যে-একটা ব্যাপার উৎপন্ন হইয়া উঠিতেছে, কিছুকাল পরে তাহার মূর্তিটা স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাইবার সময় আসিবে।
য়ুরোপ হইতে নূতন ভাবের সংঘাত আমাদের হৃদয়কে চেতাইয়া তুলিয়াছে এ কথা যখন সত্য তখন আমরা হাজার খাঁটি হইবার চেষ্টা করি না কেন, আমাদের সাহিত্য কিছু-না-কিছু নূতন মূর্তি ধরিয়া এই সত্যকে প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারিবে না। ঠিক সেই সাবেক জিনিসের পুনরাবৃত্তি আর কোনোমতেই হইতে পারে না; যদি হয় তবে এ সাহিত্যকে মিথ্যা ও কৃত্রিম বলিব।’
১৩১৫ সালে ‘পূর্ব ও পশ্চিম’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘পশ্চিমের সংস্রব হইতে বঞ্চিত হইলে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণতা হইতে বঞ্চিত হইত। ইউরোপের প্রদীপের মুখে শিখা এখন জ্বলিতেছে। সেই শিখা হইতে আমাদের প্রদীপ জ্বালাইয়া লইয়া আমাদিগকে কালের পথে আর একবার যাত্রা করিয়া বাহির হইতে হইবে।’
ওই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ’ইংরেজের আহ্বান যে-পর্যন্ত আমরা গ্রহণ না করিব, তাহাদের সঙ্গে মিলন যে-পর্যন্ত না সার্থক হইবে, সে পর্যন্ত তাহাদিগকে বলপূর্বক বিদায় করিব, এমন শক্তি আমাদের নাই। যে ভারতবর্ষ অতীতে অঙ্কুরিত হইয়া ভবিষ্যতের অভিমুখে উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতেছে, ইংরেজ সেই ভারতের জন্য প্রেরিত হইয়া আসিয়াছে। সেই ভারতবর্ষ সমস্ত মানুষের ভারতবর্ষ–আমরা সেই ভারতবর্ষ হইতে অসময়ে ইংরেজকে দূর করিব, আমাদের এমন কী অধিকার আছে।’
ওই প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি বলেন, ‘ভারতবর্ষ আজ সকল দিক হইতে শাস্ত্রে ধর্মে সমাজে নিজেকেই নিজে বঞ্চনা ও অপমান করিতেছে; নিজের আত্মাকেই সত্যের দ্বারা ত্যাগের দ্বারা উদ্বোধিত করিতেছে না, এই জন্যই অন্যের নিকট হইতে যাহা পাইবার তাহা পাইতেছে না। এই জন্যই পশ্চিমের সঙ্গে মিলন ভারতবর্ষে সম্পূর্ণ হইতেছে না, সে মিলনে পূর্ণ ফল জন্মিতেছে না, সে মিলনে আমরা অপমান এবং পীড়াই ভোগ করিতেছি। ইংরেজকে ছলে বলে ঠেলিয়া ফেলিয়া আমরা এই দুঃখ হইতে নিষ্কৃতি পাইব না। ইংরেজের সঙ্গে ভারতবর্ষের সংযোগ পরিপূর্ণ হইলে, এই সংঘাতের সমস্ত প্রয়োজন সমাপ্ত হইয়া যাইবে। তখন ভারতবর্ষে দেশের সঙ্গে দেশের, জাতির সঙ্গে জাতির, জ্ঞানের সঙ্গে জ্ঞানের, চেষ্টার সঙ্গে চেষ্টার যোগসাধন হইবে, তখন বর্তমানে ভারত-ইতিহসের যে পর্বটা চলিতেছে, সেটা শেষ হইয়া যাইবে এবং পৃথিবীর মহত্তর ইতিহাসের মধ্যে সে উত্তীর্ণ হইবে।’
১৩২৪ সালের মাঘে ‘স্বাধীকার প্রমত্ত’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ঈর্ষার অন্ধতায় ইউরোপের মহত্ত্ব অস্বীকার করিলে চলিবে না। তার স্থান-সন্নিবেশ, তার জলবায়ু, তার জাতিসমবায়, এমন ভাবে ঘটিয়াছে যে, সহজেই তার ইতিহাস শক্তি সৌন্দর্য এবং স্বাতন্ত্র্যপরতায় সম্পদশালী হইয়া উঠিয়াছে। সেখানকার প্রকৃতিতে কঠোরতা এবং মৃদুতার এমন একটি সামঞ্জস্য আছে যে, তাহা একদিকে মানবের সমগ্র শক্তিকে দ্বন্দ্বে আহ্বান করিয়া আনে, আর-এক দিকে তাহার চিত্তকে অভিভূত করিয়া নিশ্চেষ্ট অদৃষ্টবাদে দীক্ষিত করে না। এক দিকে তাহা ইউরোপের সন্তানদের চিত্তে এমন তেজের উদ্রেক করিয়াছে যে, তাহাদের উদ্যম ও সাহস কোথাও আপন দাবির কোনো সীমা স্বীকার করিতে চায় না; অপর দিকে তাহাদের বুদ্ধিতে অপ্রমাদ, তাহাদের কল্পনাবৃত্তিতে সুসংযম, তাহাদের সকল রচনায় পরিমিতি এবং তাহাদের জীবনের লক্ষ্যের মধ্যে বাস্তবতাবোধের
সঞ্চার করিয়াছে। তাহারা একে একে বিশ্বের গূঢ় রহস্যসকল বাহির করিতেছে, তাহাকে মাপিয়া ওজন করিয়া আয়ত্ত করিতেছে: তাহারা প্রকৃতির মধ্যে অন্তরতর যে-একটি ঐক্যতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছে তাহা ধ্যানযোগে বা তর্কের বলে নয়–তাহা বাহিরের পর্দা ছিন্ন করিয়া, বৈচিত্র্যের প্রাচীন ভেদ করিয়া। তাহারা নিজের শক্তিতে রুদ্ধ দ্বার উদ্ঘাটিত করিয়া প্রকৃতির মহাশক্তিভাণ্ডারের মধ্যে আসিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে এবং লুব্ধ হস্তে সেই ভাণ্ডার লুণ্ঠন করিতেছে।
নিজের এই শক্তি সম্বন্ধে ইউরোপের দম্ভ অত্যন্ত বাড়িয়াছে বলিয়াই কোথায় যে তার ন্যূনতা তাহা সে বিচার করে না।’
১৩৩৯ সালে ‘আধুনিক কাব্যে’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে প্রথম দর্শনের কথা বলেন, ‘বাল্যকালে যে ইংরেজি কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো তখনকার দিনে সেটাকে আধুনিক বলে গণ্য করা চলত। কাব্য তখন একটা নতুন বাঁক নিয়েছিল, কবি বার্নস থেকে শুরু। এই ঝোঁক একসঙ্গে অনেকগুলি বড়ো বড়ো কবি দেখা দিয়েছিল। যথা, ওয়ার্ডসওয়ার্থ,
কোলরিজ, শেলি, কীটস।… কবি বার্নসের পরে ইংরেজি কাব্যে যে যুগ এল সে যুগ রীতির বেড়া ভেঙে মানুষের মর্জি এসে উপস্থিত। ‘কুমুদকহ্নারসেবিত সরোবর’ হচ্ছে সাধু কারখানায় তৈরি সরকারি ঠুলির বিশেষ ছিদ্র দিয়ে দেখা সরোবর। সাহিত্যে কোনো সাহসিক সেই ঠুলি খুলে ফেলে বুলি সরিয়ে পুরো চোখ দিয়ে যখন সরোবর দেখে তখন ঠুলির সঙ্গে সঙ্গে সে এমন একটা পথ খুলে দেয় যাতে করে সরোবর নানা দৃষ্টিতে, নানা খেয়ালে নানাবিধ হয়ে ওঠে। সাধু বিচারবুদ্ধি তাকে বলে ‘ধিক’।
আমরা যখন ইংরেজি কাব্য পড়া শুরু করলুম তখন সেই আচার-ভাঙা ব্যক্তিগত মর্জিকেই সাহিত্য স্বীকার করে নিয়েছিল। এডিনবরা রিভিয়ুতে যে তর্জনধ্বনি উঠেছিল সেটা তখন শান্ত। যাই হোক, আমাদের সেকাল আধুনিককতার একটা যুগান্তকাল।
তখনকার কালে কাব্যে আধুনিকতার লক্ষণ হচ্ছে, ব্যক্তিগত খুশির দৌড়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বিশ্বপ্রকৃতিতে
যে আনন্দময় সত্তা উপলব্ধি করেছিলেন সেটাকে প্রকাশ করেছিলেন নিজের ছাঁদে। শেলির ছিল প্লাটোনিক ভাবুকতা, তার সঙ্গে রাষ্ট্রগত ধর্মগত সকল প্রকার স্থূল বাধার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। রূপসৌন্দর্যের ধ্যান ও সৃষ্টি নিয়ে কীটসের কাব্য। ঐ যুগে বাহ্যিকতা থেকে আন্তরিকতার দিকে কাব্যের স্রোত বাঁক ফিরিয়েছিল।’
কবির ইংরেজ কবিদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় স্মৃতিবিধূর ও মধুর: ‘প্রথম বয়সে যে ইংরেজ কবিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল তাঁরা বাহিরকে নিজের অন্তরের যোগে দেখছিলেন: জগৎটা হয়েছিল তাঁদের নিজের ব্যক্তিগত আপন কল্পনা মত ও রুচি সেই বিশ্বকে শুধু যে কেবল মানবিক ও মানসিক করেছিল তা নয়, তাকে করেছিল বিশেষ কবির মনোগত। ওয়ার্ডসওয়ার্থের জগৎ ছিল বিশেষভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থীয়, শেলির ছিল শেলীয়, বাইরনের ছিল বাইরনিক। রচনার ইন্দ্রজালে সেটা পাঠকেরও নিজের হয়ে উঠত। বিশেষ কবির জগতে যেটা আমাদের আনন্দ দিত সেটা বিশেষ ঘরের রসের আতিথ্যে। ফুল তার আপন রঙের গন্ধের বৈশিষ্ট্য দ্বারাই মৌমাছিকে নিমন্ত্রণ পাঠায়, সেই নিমন্ত্রণলিপি
মনোহর। কবির নিমন্ত্রণেও স্বভাবতই সেই মনোহারিতা ছিল।’
দ্ব্যর্থহীনভাবে সে যুগের প্রতি কবির ঐকাত্ম প্রকাশ পেয়েছে পরবর্তী মন্তব্যগুলোতে: ‘আজকের দিনে সেই আধুনিকতাকে মধ্য-ভিক্টোরীয় প্রাচীনতা সংজ্ঞা দিয়ে তাকে পাশের কামরায় আরামকেদারায় শুইয়ে রাখবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনকার দিনে ছাঁটা-কাপড় ছাঁটা-চুলের খটখটে আধুনিকতা। ক্ষণে ক্ষণে গালে পাউডার ঠোঁটে রঙ লাগানো হয় না তা নয়, কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে, উদ্ধত অসংকোচে। বলতে চায়, মোহ জিনিসটাতে আর কোনো দরকার নেই। সৃষ্টিতে সৃষ্টিতে পদে পদে মোহ, সেই মোহের বৈচিত্র্যই নানা রূপের মধ্য দিয়ে নানা সুর বাজিয়ে তোলে। কিন্তু বিজ্ঞান তার নাড়িনক্ষত্র বিচার করে দেখেছে; বলছে মূলে মোহ নেই, আছে কার্বন, আছে নাইট্রোজেন, আছে ফিজিয়লজি, আছে সাইকোলজি। আমরা সেকালের কবি, আমরা এইগুলোকেই গৌণ জানতুম, মায়াকেই জানতুম মুখ্য। তাই সৃষ্টিকর্তার
সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছন্দে বন্ধে ভাষায় ভঙ্গিতে মায়া বিস্তার করে মোহ জন্মাবার চেষ্টা করেছি, এ কথা কবুল করতেই হবে। ইশারা-ইঙ্গিতে কিছু লুকোচুরি ছিল, লজ্জার যে আবরণ সত্যের বিরুদ্ধ নয়, সত্যের আভরণ, সেটাকে ত্যাগ করতে পারি নি। তার ঈষৎ বাষ্পের ভিতর দিয়ে যে রঙিন আলো এসেছে সেই আলোতে ঊষা ও সন্ধ্যার একটি রূপ দেখেছি, নববধূর মতো তা সকরুণ। আধুনিক দুঃশাসন জনসভায় বিশ্বদ্রৌপদীর
বস্ত্রহরণ করতে লেগেছে, ও দৃশ্যটা আমাদের অভ্যস্ত নয়।’
কবি বলেন, ‘এখনকার কাব্যের যা বিষয় তা লালিত্যে মন ভোলাতে চায় না। তা হলে সে কিসের জোরে দাঁড়ায়। তার জোর হচ্ছে আপন সুনিশ্চিত আত্মতা নিয়ে, ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যারেক্টার।
সে বলে, ‘অয়মহং ভোঃ! আমাকে দেখো।’
কবির কথা: ‘কাব্যে বিষয়ীর আত্মতা ছিল উনিশ শতাব্দীতে, বিশ শতাব্দীতে বিষয়ের আত্মতা। এই জন্যে কাব্যবস্তুর বাস্তবতার উপরেই ঝোঁক দেওয়া হয়, অলংকারের উপর নয়। কেননা অলংকারটা ব্যক্তির নিজেরই রুচিকে প্রকাশ করে, খাঁটি বাস্তবতার জোর হচ্ছে বিষয়ের নিজের প্রকাশের জন্যে।’
প্রথম মহাযুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, দেশে এবং ইংরেজ শাসকমণ্ডলীর দেশে বিলেতে অস্থিরতা, ফ্যাসিজম, নাৎসিজম ও বলশেভিজম-এর প্রভাবে কবির মনে একটা বিষণ্নতা দেখা যায়। ‘আধুনিক কাব্যে’ তিনি বলেন, ‘গত য়ুরোপীয় যুদ্ধে মানুষের অভিজ্ঞতা এত কর্কশ এত নিষ্ঠুর হয়েছিল, তার বহুযুগ প্রচলিত যত-কিছু আদব ও আব্রু“ তা সাংঘাতিক সংকটের মধ্যে এমন অকস্মাৎ ছারখার হয়ে গেল, দীর্ঘকাল যে সমাজস্থিতিকে একান্ত বিশ্বাস করে সে নিশ্চিন্ত ছিল তা এক মুহূর্তে দীর্ণবিদীর্ণ হয়ে গেল; মানুষ যে-সকল শোভনরীতি কল্যাণনীতিকে
আশ্রয় করেছিল তার বিধ্বস্ত রূপ দেখে এতকাল যা-কিছুকে সে ভদ্র বলে জানত তাকে দুর্বল বলে, আত্মপ্রতারণার
কৃত্রিম উপায় বলে অবজ্ঞা করাতেই যেন সে একটা উগ্র আনন্দ বোধ করতে লাগল–বিশ্বনিন্দুকতাকেই
সে সত্যনিষ্ঠতা বলে আজ ধরে নিয়েছে।’
আধুনিকতা সম্বন্ধে কবি বললেন, ‘আমাকে যদি জিজ্ঞাসা কর বিশুদ্ধ আধুনিকতাটা কী, তা হলে আমি বলব, বিশ্বকে ব্যক্তিগত আসক্ত ভাবে না দেখে বিশ্বকে নির্বিকার তদগতভাবে দেখা, এই দেখাটাই উজ্জ্বল, বিশুদ্ধ; এই মোহমুক্ত দেখাতেই খাঁটি আনন্দ। আধুনিক বিজ্ঞান যে নিরাসক্ত চিত্তে বাস্তবকে বিশ্লেষণ করে আধুনিক কাব্য সেই নিরাসক্ত চিত্তে বিশ্বকে সমগ্রদৃষ্টিতে দেখবে, এইটেই শাশ্বতভাবে আধুনিক।
কিন্তু একে আধুনিক বলা নিতান্ত বাজে কথা। এই-যে নিরাসক্ত সহজ দৃষ্টির আনন্দ এ কোনো বিশেষ কালের নয়। যার চোখ এই অনাবৃত জগতে সঞ্চরণ করতে জানে এ তারই।’
চার বছর পূর্বে ১৩৩৫ সালের ‘সাহিত্যরূপ’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আজকালকার দিনে য়ুরোপে নানা কারণে তার ধর্ম, সমাজ, লোকব্যবহার, স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ, অত্যন্ত বেশি নাড়া খাওয়াতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সেই-সমস্ত সমস্যার মীমাংসা না হলে তার বাঁচাও নেই। এই একান্ত উৎকণ্ঠার দিনে এই সমস্যার দল বাছবিচার করতে পারছে না। যুদ্ধের সময় সৈনিকেরা যেমন প্রয়াজনের দায়ে গৃহস্থের ঘর ও ভাণ্ডার দখল করে বসে, তেমনি প্রব্লেমের রেজিমেন্ট তাদের নিজের বারিক ছাপিয়েও সাহিত্যের সর্বত্রই ঢুকে পড়ছে। লোকে আপত্তি করছে না, কেননা সমস্যা সমাধানের দায় তাদের অত্যন্ত বেশি। এই উৎপাতে সাহিত্যের বাসা যদি প্রব্লেমের বারিক হয়ে ওঠে তবে এ প্রশ্ন মারা যায় যে, স্থাপত্যকলার আদর্শে এই ঘরের রূপটি কী। প্রয়োজনের গরজ যেখানে অত্যন্ত বেশি সেখানে রূপ জিনিসটা অবান্তর। য়ুরোপে সাহিত্যের সব ঘরই প্রব্লেমের ভাণ্ডারঘর হয়ে উঠতে চেষ্টা করছে; তাই প্রতিদিনই দেখছি, সাহিত্যে রূপের মূল্যটা গৌণ হয়ে আসছে; কিন্তু, এটা একটা ক্ষণকালীন অবস্থা–আশা করা যেতে পারে যে, বিষয়ের দল বর্তমানের গরজের দাবি ক্রমে ত্যাগ করবে এবং সাহিত্যে রূপের স্বরাজ আবার ফিরে আসবে। মার্শাল ল যেখানে কোনো কারণে চিরকালের হয়ে ওঠে, সেখান থেকে গৃহস্থকে দেশান্তর যাবার ব্যবস্থা করাই কর্তব্য। বিষয়প্রধান সাহিত্যই যদি এই যুগের সাহিত্য হয়, তা হলে বলতেই হবে, এটা সাহিত্যের পক্ষে যুগান্ত।’
১৩৪০ সালে ‘সাহিত্যের মাত্রা’য় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘পশ্চিম-মহাদেশের এই কায়াবহুল অসংগত জীবনযাত্রার ধাক্কা লেগেছে সাহিত্যে। কবিতা হয়েছে রক্তহীন, নভেলগুলো উঠছে বিপরীত মোটা হয়ে। সেখানে তারা সৃষ্টির কাজকে অবজ্ঞা করে ইনটেলেকচুয়েল কসরতের কাজে লেগেছে। তাতে শ্রী নেই, তাতে পরিমিতি নেই, তাতে রূপ নেই, আছে প্রচুর বাক্যের পিণ্ড। অর্থাৎ এটা দানবিক ওজনের সাহিত্য, মানবিক ওজনের নয়; বিস্ময়কররূপে
ইনটেলেকচুয়েল; প্রয়োজনসাধকও
হতে পারে, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবান নয়।… উপকরণের বাহাদুরি তার বহুলতায়, অমৃতের সার্থকতা তার অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্যে। আর্টেরও অমৃত আপন সুপরিমিত সামঞ্জস্যে। তার হঠাৎ-নবাবি আপন ইনটেকলেকচুয়েল অত্যাড়ম্বরে; সেটা যথার্থ আভিজাত্য নয়, সেটা স্বল্পায়ু মরণধর্মী। মেঘদূত কাব্যটি প্রাণবান, আপনার মধ্যে ওর সামঞ্জস্য সুপরিমিত।’
তাঁর গোরা ও ঘরে বাইরে উপন্যাস দ্বয়ে মনস্তত্ত্ব, রাষ্ট্রতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা সম্পর্কে ওই প্রবন্ধে কবি বলেন, ‘সাহিত্যের তরফ থেকে বিচার করতে হলে দেখা চাই যে, সেগুলি জায়গা পেয়েছে না জায়গা জুড়েছে।… গোরা-গল্পে তর্কের বিষয় যদি ঝুড়িতে করে রাখা হয়ে থাকে, তবে সেই বিষয়গুলির দাম যতই হোক-না, সে নিন্দনীয়। আলোচনার সামগ্রীগুলি গোরা ও বিনয়ের একান্ত চরিত্রগত প্রাণগত উপাদান যদি না হয়ে থাকে তবে প্রব্লেমে ও প্রাণে, প্রবন্ধে ও গল্পে, জোড়াতাড়া জিনিস সাহিত্যে বেশি দিন টিকবে না। প্রথমত, আলোচ্য তত্ত্ববস্তুর মূল্য দেখতে দেখতে কমে আসে, তার পরে সে যদি গল্পটাকে জীর্ণ করে ফেলে, তা হলে সবসুদ্ধ জড়িয়ে সে আবর্জনারূপে সাহিত্যের আঁস্তাকুড়ে জমে ওঠে। ইবসেনের নাটকগুলি তো একদিন কম আদর পায়নি, কিন্তু এখনই কি তার রঙ ফিকে হয়ে আসেনি। কিছুকাল পরে সে কি আর চোখে পড়বে। মানুষের প্রাণের কথা চিরকালের আনন্দের জিনিস; বুদ্ধিবিচারের কথা বিশেষ দেশকালে যত নতুন হয়েই দেখা দিক, দেখতে দেখতে তার দিন ফুরোয়। তখনও সাহিত্য যদি তাকে ধরে রাখে তা হলে মৃতের বাহন হয়ে তার দুর্গতি ঘটে।… য়ুরোপে অপ্রাণের বোঝা প্রাণের উপর চেপেছে অতিপরিমাণে; সেটা সইবে না। তার সাহিত্যেও সেই দশা।’
এ প্রসঙ্গে ‘নষ্টনীড়’ গল্পকার ১৮৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারির খসড়ায় Ibsen -এর নাটক সম্বন্ধে বললেন, ‘‘তাতে একটা এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখলুম–যতসব স্ত্রীলোকেরাই সমাজবিপ্লবের জন্য ব্যাকুল এবং পুরুষেরাই সমাজের প্রাচীন সংস্কার সকলের উপর আকৃষ্ট হয়ে আছে। বরাবর জানি মেয়েরাই সমাজের বন্ধন। আমার বোধ হয় বর্তমান য়ুরোপীয় সভ্যতা এমন আকার ধারণ করেছে, যাতে স্ত্রীলোকেরা বিশেষ অসুখী হয়ে আছে। জীবিকাসংগ্রাম
এতদূর প্রবল হয়েছে যে, সমস্ত শক্তি তাতেই প্রয়োগ করতে হচ্ছে, গৃহের জন্যে অতি অল্প অবশিষ্ট থাকে–লোকেরা চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে, পুরুষেরা বিয়ে করতে চাচ্ছে না–এরকম স্থলে স্ত্রীলোকের অবস্থা সেই অনুসারে পরিবর্তিত না হলে তারা সুখী হতে পারে না। এই জন্য য়ুরোপীয় মেয়েদের মধ্যে একটা বিপ্লবের ভাব দেখা দিয়েছে। নিহিলিস্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক মেয়ে আছে, তারা পুরুষের চেয়ে প্রচণ্ড।’’
আমরা লক্ষ্য করলাম যেখানে য়ুরোপীয় সাহিত্য মনঃসমীক্ষণ, অবচেতন তত্ত্ব, যৌনমিলনের দৈহিকতার উপদ্রব, বাস্তবিকতা, দারিদ্র্যবেদনা,
মার্ক্সিজম বা অন্য কোনো রাজনৈতিক মতবাদ দ্বারা দুর্গম হয়ে উঠেছে সে সাহিত্যে কবির কাছে তাঁর প্রবেশাধিকার দ্বাররুদ্ধ মনে হয়। যে কালে সাহিত্য সহজ, সরল, শাশ্বত ও সুন্দর ছিল বলে আমরা কল্পনা করি, তা অতিবাহিত হয়ে গেছে। কবির মৃত্যুর বছর, দু’দশক আগের য়ুরোপ তোলপাড়ের য়ুরোপ। জনশিক্ষা, জনচেতনা ও অধিকারের প্রসার, নারী অধিকার, শ্রমিক অধিকার, জনসংযোগ, শিল্পবিপ্লব ও উন্নয়নের ধারণা মানুষের মনকে তখন মাতিয়ে রেখেছিল। সাহিত্যে তার প্রতিফলন না পড়ে যায় না।
যখন রবীন্দ্রনাথের
কবিমন ও তাঁর শ্রেয়োবোধ আমাদের কাছে ক্ষুণ্ন মনে হয় তখন আমরা বাংলা ১৩৪০ সালের শ্রাবণে বিচিত্রা-য় প্রকাশিত তারই এক পত্র থেকে শ্রেয়স্তত্ত্ব
ও সাহিত্য সম্বন্ধে তিনি যেসব কথা বলেছিলেন তা স্মরণ করলে আমরা স্বস্তি লাভ করে প্রসন্নচিত্ত হতে পারি: ‘আদর্শ মানবচরিত্রের মাপে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতা বিচার বাংলাদেশের সমালোচক-শ্রেণী ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। মনে আছে এমন তর্ক একদা প্রায়ই শোনা যেত যে, আদর্শ সতী নারী হিসাবে ভ্রমর এবং সূর্যমুখীর চরিত্রে আধরতি পরিমাণে শ্রেষ্ঠতার তারতম্য কোন্ কথা কোন্ ভঙ্গিটুকু নিয়ে। অল্প বয়স সত্ত্বেও মনে আক্ষেপ হত যে অরসিকেষু রসস্য নিবেদনং ইত্যাদি। সাহিত্যে যে শ্রেয়স্তত্ত্বের নিখুঁত ছাঁচে ঢালাই করা পুতুল গড়বার কারখানা নয় এ কথাও কি বোঝাতে হবে। ম্যাকবেথ নাটকে দুটিমাত্র প্রধান পাত্র, ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথ। বলা বাহুল্য, দুজনের কাউকেই সুকুমারমতি পাঠকদের চরিত্রগঠনযোগ্য দৃষ্টান্তরূপে ব্যবহার করা চলবে না। অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিয়োপ্যাট্রা
শেক্সপীয়রের প্রধান নাটকের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু ক্লিয়োপ্যাট্রা প্রাতঃস্মরণীয়া
পঞ্চকন্যাদের মধ্যে স্থান পাবার অধিকারিণী হলেও তাকে সাধ্বীর আদর্শ বলা চলবে না। আর, অ্যান্টনি আপন চরিত্রের অনিন্দ্য আদর্শে আধুনিক উচ্চদরের বাংলা নভেলের নায়কদের সমশ্রেণীভুক্ত নয়, এ কথা মানতেই হবে। তথাপি এও না মেনে চলবে না যে, শেক্সপীয়রের নাটকটি উঁচুদরের বাংলা নভেলের চেয়ে অন্তত কোনো অংশে হীন নয়। মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রকে তুচ্ছ করতে পারি নে, কিন্তু মহত্ত্বে তাঁর ন্যূনতা ছিল। কারই বা না ছিল? স্বয়ম্বরসভার ব্যাপারে ভীষ্মই কি ক্ষমতার যোগ্য। এমন-কি, কবির প্রিয়পাত্র পাণ্ডবদের আচরণে কলঙ্ক খুঁজে বের করবার জন্যে অধিক তীক্ষ্ম দৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। আধুনিক বাংলাদেশে বেদব্যাস জন্মায় নি, সে তাঁর পুণ্যফলে।
‘অপর পক্ষ থেকে তর্ক করতে পারেন যে, সাহিত্য সমাজধর্ম ও শাশ্বতধর্মের
ত্রুটি দেখা দেয়, তার শোকাবহ পরিণাম প্রমাণ করবার জন্যেই। অর্থাৎ, এইটুকু দেখাবার জন্যে যে স্খলনের পথ আরামের পথ নয়। কিন্তু দেখতে পাই, আজকাল তাতেও ভালোমানুষ লোকের ক্ষোভ-শান্তি হয় না। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে সন্দীপ বা বিমলা গৌরবজনক সিদ্ধিলাভ করে নি, কিন্তু তবু লেখক সেদিন সমালোচকের দরবারে দণ্ড থেকে অব্যাহতি পেলেন না। তারস্বরে ফরমাশ এই যে, যেমন করেই হোক, শ্রেষ্ঠ আদর্শ রচনা করতেই হবে। ছেলেমানুষি আবদার একেই বলে, যে চায় লালায়িত রসনা দিয়া কেবলই চিনির পুতুল লেহন করতে।’
১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উৎসবে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘সকল দেশেই অর্থভাণ্ডারের
দ্বারে কড়া পাহারা, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের
জ্ঞানভাণ্ডারে সর্বমানের ঐক্যের দ্বার অর্গলবিহীন। লক্ষ্মী কৃপণ; কারণ লক্ষ্মীর সঞ্চয় সংখ্যাগণিতের
সীমায় আবদ্ধ, ব্যয়ের দ্বারা তাঁর ক্ষয় হতে থাকে। সরস্বতী অকৃপণ; কেননা, সংখ্যার পরিমাপে তাঁর ঐশ্বর্যের পরিমাপ নয়, দানের দ্বারা তাঁর বৃদ্ধিই ঘটে। বোধ করি, বিশেষভাবে বাংলাদেশের এই গৌরব করবার কারণ আছে যে, য়ুরোপীয় সংস্কৃতির কাছ থেকে সে আপন প্রাপ্য গ্রহণ করতে বিলম্ব করে নি। এই সংস্কৃতির বাধাহীন সংস্পর্শে অতি অল্পকালের মধ্যে তার সাহিত্য প্রচুর শক্তি ও সম্পদলাভ করেছে, এ কথা সকলের স্বীকৃত। এই প্রভাবের প্রধান সার্থকতা এই দেখেছি যে, অনুকরণের দুর্বল প্রবৃত্তিকে কাটিয়ে ওঠবার উৎসাহ সে প্রথম থেকে দিয়েছে।’
তাঁর মূলসূত্রের খেই না হারিয়ে রবীন্দ্রনাথ পরক্ষণেই বললেন, ‘আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রথম যুগে যাঁরা বিদ্বান বলে গণ্য ছিলেন তাঁরা যদিচ পড়াশোনায় চিঠিপত্রে কথাবার্তায় একান্তভাবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছিলেন, যদিচ তখনকার ইংরেজিশিক্ষিত চিত্তে চিন্তার ঐশ্বর্য ভাবরসের আয়োজন মুখ্যত ইংরেজি প্রেরণা থেকেই উদ্ভাবিত, তবু সেদিনকার বাঙালি লেখকেরা এই কথাটি অচিরে অনুভব করেছিলেন যে দূরদেশী ভাষার থেকে আমরা বাতির আলো সংগ্রহ করতে পারি মাত্র, কিন্তু আত্মপ্রকাশের
জন্য প্রভাব-আলো বিকীর্ণ হয় আপন ভাষায়।’
The Captive Lady’র কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং Rajmohan’s wife -এর লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অবশেষে আত্মপ্রকাশের
জন্য আপন ভাষাকেই বেছে নিলেন। আবার মাতৃভাষার উচ্চকণ্ঠ প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথ দূরদেশী ভাষা থেকে বাতির আলো সংগ্রহ করে ইংরেজিতে গীতাঞ্জলি অনুবাদ করে নোবেল প্রাইজ পেলেন বিশ্বসাহিত্যের পাঠকের মন অনুরঞ্জন করে। সাহিত্যের দেবী কৌতুকময়ী বটে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন