জালালুদ্দিন মুহাম্মদ রুমির জীবন ও দর্শনচিন্তা

আরিফ ইকবাল তোফা

জালালুদ্দিন রুমিকে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের এক অন্যতম কিংবদন্তীর কবি হিসেবে। কোন কবির কাব্যচর্চার ধরণ এবং জীবন দর্শনকেই তাঁর সাথে তুলনা করা যায় না। কাব্যচর্চার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সুফি এবং চিন্তক। পাশ্চাত্য বিশ্বে বর্তমানকালে তাঁকে নিয়ে উপন্যাস এবং চলচিত্র তৈরী হচ্ছে, তাঁর কাজগুলো অনুবাদিত হচ্ছে এবং সেগুলো অনেক খ্যাতিও পাচ্ছে। এতো হচ্ছে পাশ্চাত্য বিশ্বে তাঁর অবস্থান, কিন্তু মুসলিম বিশ্বে তাঁর কাব্যচর্চা ও দর্শন যোগ করেছিল এক নতুন মাত্রার। তাঁর জীবন দর্শন ও কাব্যচর্চা “মেভলেভী” নামের  এক সূফীবাদী ধারার সূচনা করেছিল।


চিত্রঃ জালালুদ্দিন মুহাম্মদ রুমি
চিত্রঃ জালালুদ্দিন মুহাম্মদ রুমি
জালালুদ্দিন রুমি ১২০৭ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর উত্তর পারস্যের খোরাশান প্রদেশের বালখে জন্মগ্রহণ করেন। বালখ এ সময়ে অনেক সমৃদ্ধ নগরী ছিল। ধারণা করা হয় নবম শতকেই বালখে ৪০ টিরও বেশী মসজিদ ছিল। অনেক আরব বালখকে নরগরীগুলোর মাতা বলে চিহ্নিত করেছেন। ১২২০ সালে মোঙ্গল আক্রমণে এই নগরী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, বর্তমানে এটি একটি ক্ষুদ্র শহর।রুমির পরিবার ছিল সে সময়ের বালখের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সম্রান্ত পরিবার। রুমির দাদা দাবী করেছিলেন, তাঁরা ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রঃ) এর বংশধর। রুমির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাঁর পুত্র সুলতান ওয়ালাদ “ইবতিদা নামাহ” বা “সূচনার গ্রন্থ” নামে একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা থেকে রুমি সম্পর্কে বিস্তর জানার সুযোগ হয়। রুমির জীবনী সম্পর্কে জানার জন্য আরেকটি বিখ্যত গ্রন্থ হল, “শারহি-হাল-ই-মওলানা” বা “আমাদের প্রভুর জীবনী” যেটি ১৯৩২ লিখেছিলেন পারস্যের বিখ্যাত পণ্ডিত বাদি আল-জামান ফুরুজানফার।

রুমি সম্বন্ধে যতদূর জানা যায় ১২ বছর বয়সে ১২১৯ সালে তিনি পিতার সাথে বালখ ত্যাগ করেন। রুমির পরিবারের বালখ ত্যাগের কারণ সম্পর্কে জানা যায়, তাঁর পিতা অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন এবং আধ্যাতিক অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, একসময়ে শাসক শ্রেণীর সাথে তাঁর মতানৈক্য হয়, এজন্য তিনি বালখ ত্যাগ করেন। সে যাই হোক রুমির পরিবার বালখ ত্যাগের পরবর্তী বছরেই বালখে মোঙ্গল আক্রমণ হয় যার দরুণ বালখের অনের সম্রান্ত পরিবারকেই বালখ ত্যাগ করতে হয়। পরবর্তীতে রুমির পরিবার বাগদাদ, মক্কা ও দেমাস্কাস সফর করে। যাত্রাপথে রুমির পরিবারের সাথে বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও আধ্যাত্মবাদী ইবনে আরাবির সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। আরাবি দেখেছিলেন রুমি তাঁর বাবার পেছন পেছন হাটছেন। পরবর্তীতে আরাবি লিখেছিলেন,

“সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র, একটি সমুদ্র একটি জলাশয়কে অনুসরণ করছে!”

পরবর্তীতে রুমির পরিবার কয়েক বছর জারান্দাহে অবস্থান করে। এসময়ে রুমি বিবাহ করেন এবং সুলতান ওয়ালাদকে জন্ম দেন। পরবর্তীতে ১৫২৬ এর দিকে রুমির পরিবার তুরস্কের কোনিয়াতে স্থানান্তরিত হয়, যা ছিল পশ্চিম সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী। এসময় কোনিয়া মোঙ্গল আক্রমণের ফলে পালিয়ে আসা অনেক জ্ঞানী, গুণী, আধ্যাত্মবাদী ও পন্ডিত লোকের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়। তৎকালীন সেলজুক সুলতান রুমির পিতা বাহাউদ্দিনকে অনেক সম্মান দিয়েছিলেন। ১৫৩০ সালের দিকে রুমির পিতা পরলোকগমণ করেন। এসময়ে তিরমিদ থেকে বুরহানুদ্দিন মুহাক্কিক নামক এক পীর কোনিয়াতে এসে পৌঁছান।রুমি তাঁর শীষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তী দশ বছরে রুমি সূফীবাদের যতগুলো পর্যায় আছে সব শেষ করেন এবং নিজেও একজন পীরে পরিণত হন। রুমি ছিলেন দৃঢ়, মন্ত্রমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের অধিকারী, যাকে লোকে আকর্ষণ করেছিল এমনকি সেলজুক সুলতানও তাঁর বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল। রুমির আধ্যাত্মবাদী ক্ষমতার জন্য লোকে তাঁকে “মাওলানা” বা “আমাদের প্রভু” বা “মেভলেভী” বলে ডাকত।

রুমির যখন ৩৯ বছর বয়স তখন শামস আল দীন তাব্রেজি নামক এক আধ্যাত্মবাদী পুরুষের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রুমির জীবন দর্শনের উপর এই মহাপুরুষের যথেষ্ঠ প্রভাব ছিল, যিনি অল্প সময়েই রুমির একজন যোগ্য সহকারীতে পরিণত হয়েছিলেন। রুমির গৌরবের উজ্জ্বল শিখরে পৌছানোর জন্য প্রয়োজন ছিল একজন নিখুঁত মানুষের সাথে মেলামেশার, যে শূন্যতাটি পূরণ করেছিলেন শামস। নিখুঁত মানুষ বা “আল-ইনসান-আল-কামিল” বলতে এমন একজনকে বুঝাত যার মধ্যে সৃষ্টির সকল নিপুনত্ব থাকবে, যার সাথে মেলামেশা করলে স্রষ্টার সাথে মেলামেশার রাস্তা তৈরী হবে, যার মাধ্যমে স্রষ্টার অলৌকিক নূরের অংশ হওয়া যাবে। রুমির কাব্য ও দর্শনের মধ্যে এই সত্যটিই বের হয়ে এসেছিল। পরবর্তীতে রুমির এক শীষ্য শামসকে হত্যা করে, রুমি খুবই ব্যাথিত হন। শামসের মৃত্যুশোক রুমির জীবনে নতুন ধারার সূচনা করে এবং রুমির কলম দিয়ে ঝরনা ধারার মতো কবিতা বেরোতে থাকে।  এসময় থেকেই “মেভলেভী” ধারার যাত্রা শুরু হয়।

যদিও মেভলেভী ধারার স্রষ্টা ছিলেন রুমি নিজেই, তবে এটিকে একটি পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন রুমির পুত্র সুলতান ওয়ালাদ, যেটির প্রধাণ বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় নৃত্য বা “সামা”। এই প্রক্রিয়ায় নলখাগড়ার বাঁশীর তালে তালে ধর্মীয় নৃত্য করে সূফিরা ধ্যানের এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হতেন, যেখানে আছে আধ্যাতিক উন্মাদনার জগৎ, আর এই পর্যায়ে রুমিই প্রথম পৌঁছেছিলেন। পররবর্তীতে রুমি তাঁর বিখ্যাত কর্ম “দিওয়ান-ই-শামস-ই তাব্রিজ” বা “তাব্রিজের শামসের কবিতাগুচ্ছ” রচনা করেন এবং এই কাব্যগ্রন্থ  শামসকে উৎসর্গ করেন। শামসের পরে রুমি আরেকজন আধ্যাত্মবাদী পুরুষ সালাউদ্দিন ফারদিদুন জারকুবকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাকে “মেভলেভী” ধারার খলিফা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১২৬১ সালে সালাউদ্দিনের পরে, রুমির জীবনের শেষার্ধের সময়গুলোতে হুসাম আল দীন হাসান তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। এই সময়ে রুমি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগাথা “মাতনাওয়ি” রচনা করেন, যেটাকে তিনি বলেছিলেন “হুসামের বই”। ১২৭৩ সালে রুমির মৃত্যুর পর থেকে ১২৮৪ সালে সুলতান ওয়ালাদ তাঁর স্থান নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হুসাম হয়েছিলেন মেভলেভী ধারার প্রধাণ। “মাতনাওয়ি” রুমির এক অনন্য কর্ম, যা ২৫০০০ মিত্রাক্ষরযুক্ত শোককাব্য গাথা, এর সূচনার্ধের পংক্তিগুলো হলঃ-

“শোন, এই অবহেলিত নলখগড়া উদ্ভিদের নিঃশ্বাসের শব্দ,
ভালোবাসা এবং বেদনা নিয়ে প্রবল বেগে বেড়ে উঠা
আমার গানের রহস্য, যদিও নিকটে, কেউ দেখতে বা শুনতে পায় না
ওহে, একজন বন্ধুর জন্য শুধু আমিই জানি কিভাবে মন ও আত্মার মিলন হয়
ভালোবাসার আগুণ আমাকে রাগান্বিত করে, ভালোবাসার মদ আমার প্রেরণা যোগায়
যা আমকে শেখায় প্রেমিক কিভাবে রক্ত ঝরায়, শোন, শোন অবহেলিত নলখগড়ার কথা!”

রুমি নিজের কবিতাকে দেখতেন আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব প্রকাশের যান হিসেবে। অনেকে তাঁর কবিতাকে দেখেছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে। রুমি বিশ্বাস করতেন লোকেদের উচিৎ স্বর্গীয় অভিভাবকত্বে বিশ্বাস রাখা, তা কুরআনের মাধ্যমেই হোক কিংবা আধ্যাত্মিক গুরুর মাধ্যমেই হোক। তবে তিনি ধর্মীয় জ্ঞানে বিজ্ঞদের প্রতি খুব একটা উৎসাহ দেখাতেন না, জীবন থেকে শিখতে বলতেন, আদিপিতা আদম থেকে শিখতে বলতেন। রুমির মতে উলেমারা শুধু ঘটনা ব্যাখ্যায় ব্যস্ত থাকে, তাঁরা কিছু শেখায় না। যেমন রুমি তাঁর কবিতায় লিখেছেনঃ-
“নিজের পিতার কাছ থেকে শেখ, তিনি মিথ্যা গর্ব করেন নি
দুঃখের কান্নায় তার সকল পাপ ধুয়ে মুছে গিয়েছিল
যেমনটা ইবলিশ এবং তাঁর অনুসারীরা ঘৃণ্য হয়েছে
তাঁদের স্রষ্টার সাথে বাকবিতন্ডা ও বিদ্রোহ করে
যারা আশীর্বাদপ্রাপ্ত তাঁরা জানে কি শিখতে হবে
শয়তানের যুক্তি থেকে ও আদমের ভালোবাসা থেকে!”

রুমির কাব্য “মাথনাওয়ি” যেখানে চরিত্রগতভাবে নির্দেশনামূলক, “দিওয়ান” সেখানে আবেগপ্রবণ। রুমি ছিলেন ধর্মীয় শংকীর্ণতার উর্দ্ধে, তিনি বহুজাতি ও বহুধর্মের লোকদের কথা ভাবতেন। তাঁর কাছে সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ছিল একই রকম। যারা রুমির কাছে আধ্যাত্মবাদের শিক্ষা নিতে আসতেন রুমি তাঁদের নিয়মানুবর্তিতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, ঈশ্বরের একত্ববাদ, সৌজন্যতা, চারিত্রিক দৃঢ়তার শিক্ষা দিতেন। তিনি সৃষ্টিকূলের সকল মানুষের মধ্যে আত্মিক বন্ধন গড়ে তুলতে চাইতেন। এমন নজির তাঁর কবিতাতে রয়েছেঃ-
“মুসলিমরা, আমাকে বল কি করা উচিত
আমি জানি না নিজেকে কিভাবে সনাক্ত করবো
না আমি খ্রিস্টান, না ইহুদী, না প্যাগন, না মুসলিম
আমি অভিবাদন করি না, পূর্বে কিংবা পশ্চিম হতে
আমি আসিনি ভূমি কিংবা সাগর থেকে
আমি এই পৃথিবীর কোন সৃষ্টি নই!”

যদিও রুমির দর্শনচিন্তা আরবীয় সুফিদের মনে খুব একটা সাড়া জাগাতে পারেনি, তবুও পারস্যে এটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। রুমি মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সুলতান ওয়ালাদের চেষ্টায় মেভলেভী ধারা তুর্কি সাম্রাজ্যে এবং পারস্যে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।ধীরে ধীরে এই ভাবধারা মিশর, সিরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এক বিস্তর জায়গা করে নেয়। ভারতীয় উপমহাদেশের চিশতীয় ধারার অনুপ্রেরণা ছিল রুমি প্রদত্ত আধ্যাত্মবাদের ধারণা। রুমির লিখনী এবং জীবন দর্শন ভবিষ্যতে অনেক রাষ্ট্রনায়কের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। যেমন, কামাল আতার্তুকের ধর্মনিপপেক্ষতা, আকবরের দীন-ই-ইলাহী ধর্ম প্রবর্তন। রুমির কাব্য অনুপ্রেরণা দিয়েছে অনেক কবি ও সাহিত্যিককে। যেমন, ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত কবি ইকবালের কাব্যের মূল অনুপ্রেরণা ছিল রুমি নির্দেশিত নিখুঁত মানুষের ধারণা, যা ইকবাল বিশ্বাস করতেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন