বুদ্ধদেব বসু
সাহিত্যের ইতিহাস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঁক বদলায়। সাহিত্যের বিষয় এবং বাণী প্রায় সমাজের প্রয়োজন অনুসারে বিবর্তিত হলেও একই থেকে যায়। কিন্তু সাহিত্যের যে নান্দনিক রূপায়ণ তা প্রতিভাবান, স্বকীয়তাসম্পন্ন, ঐতিহ্যকে নবায়ন করতে ইচ্ছুক লেখকের হাত ধরে বদলায়। ফলে সমকালের শক্তিমান লেখকের বিশেষত কবির চিত্রকল্প, শব্দ, ভাষারীতি একটু অচেনা ঠেকে পাঠকের নিকট। বিশেষত গতানুগতিক পাঠকের কাছে। এখানে অচেনা বলতে বোঝানো হয়েছে তার কাব্যধারা এবং চেতনার গভীরতাকে, যা পূর্বপুরুষ কিংবা কবিতাশ্রয়ী লেখকের লেখায় ছিল না। এই পরিবর্তন এবং প্রথাবিরুদ্ধ রচনা নতুন যুগের লেখকের বর্ণনা, কথা এবং ইঙ্গিতে পরিবর্তিত হতে থাকে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মার্কসিস্ট ফর্মালিজমের একটি ধারা, যেখানে সাহিত্য তথা কবিতার আঙ্গিকের বাঁক বদল প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ডিফেমিলিয়ারাইজেশন'কে। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও বিংশ শতাব্দীর এমন ধরনের নান্দনিক বাঁক বদল ঘটেছিল। এই বাঁক বদলের মূল রূপকার ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। তার আগে এবং সমকালে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ রূপকারেরা এই মতে বিশ্বাস স্থাপন করবেন যে, তিনি একাধারে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের সমসাময়িক। একই সঙ্গে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাশ এবং মাইকেলের উত্তরসূরি। তিনি নিজের কবিতা লিখতে গিয়ে এই কবিদের প্রধান রচনা আত্মস্থ করেছেন। আমরা তার মাঝে চিরকালের এবং পরবর্তীকালের নবায়নের সমস্ত সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করি। পাশাপাশি রবীন্দ্র প্রতিভা, যার নিরীক্ষা ও সঞ্চয়কে ব্যবহার করে ভিন্ন পথে যাত্রা করেছেন। ভারতীয় ঐতিহ্যকে ভিন্নধারায় সাধনার মাধ্যমে আপন করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্যকর্মে মঙ্গলের কথা বলেছেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু সাহিত্যে বিপন্ন বিষাদের আবেশ ছড়িয়েছেন নিজের মতো করে। পাশ্চাত্য সাহিত্যে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বোদলেয়ার এক মানবিক অস্থিরতা যুক্ত করেছেন। বুদ্ধদেব বসু সচেতনভাবে এই ধারা বাংলা কবিতায় ব্যবহার করেছেন। নতুন বিষয় এবং আঙ্গিকের সঙ্গে বাংলা কবিতার পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।দ্বিতীয়ত ইংরেজি সাহিত্যের প্রথমার্ধে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত হয়েছে ইয়েটস, অডেনের হাত ধরে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে এ সময়ে প্রধান উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে অবক্ষয় এবং ভঙ্গুরতা। ইলিয়ট যাকে ব্রোকেন ইমেজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ সময়ের পৃথিবীকে ওয়েস্ট ল্যান্ড বা নষ্ট জমিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। অডেনের কবিতায় চিত্রিত হয়েছে যুদ্ধংদেহী পৃথিবীর চিত্র। কবিতায় এ সময় ব্যবহৃত হয়েছে_ এক্সপ্রেসনিজম, ইম্প্রেসনিজম, অ্যাবসার্ডিজম এবং স্যুরিয়ালিজম। এই পদ্ধতিতে কবিতার এক পক্ষীয় বর্ণনা পরিত্যক্ত হলো। কবিতার বহুমুখী বর্ণনার সূত্রপাত হলো। একই কবিতা থেকে নানা অর্থের নান্দনিক ব্যবহার সূচিত হলো। কবিতাকে সারল্য থেকে মুক্তি দিয়ে নান্দনিকরূপ দান করা ছিল মূল লক্ষ্য। বুদ্ধদেব বসু সচেতনভাবে বাংলা কবিতায় ব্যবহার করলেন এই নতুন ধারা। তিনি নান্দনিক বিদ্রোহ করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। নজরুলের সামাজিক বিদ্রোহকে গ্রহণ করে তাকেও বজর্ন করলেন নানা ক্ষেত্রে। বুদ্ধদেব বসু এবং তার সমসাময়িক কবিরা রচনা করলেন আধুনিক কবিতার মেনিফ্যাস্টো_ কী ভাষা ব্যবহার করা যাবে, কী ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। যদিও তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে সেই ধারা মেনে চলতে পারেননি। বুদ্ধদেব বসু তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতা সংগ্রহের ভূমিকায় আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায়ন প্রচেষ্টা করেছেন এভাবে : '... এই আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকল শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সব ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন-ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।'
ঢাকায় অবস্থানকালে প্রকাশ করেন হাতে লেখা পত্রিকা প্রগতি। বৃত্তির কুড়ি টাকা যোগ করে ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টন থেকে প্রগতির প্রথম সংখ্যা বের হয় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে। সম্পাদক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে এখানে যোগ হয় শ্রী অজিত কুমার দত্তের নাম। প্রগতির সঙ্গী হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বিষুষ্ণ দে, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ড. মোহিতলাল মজুমদার, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, পরিমল রায়, অমলেন্দু বসু, মনীশ ঘটক, সুধীশ ঘটক, অনিল ভট্টাচার্য, ভৃগু গুহঠাকুরতা, পঙ্কজকুমার দাশগুপ্ত, সুধাংশু দাশগুপ্ত, গায়ত্রী দেবী ও সমরেন্দ্র গুপ্তসহ আরও অনেক খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবী। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক [১৯২৯ সালে] সংখ্যা ছিল প্রগতির শেষ প্রকাশনা। ১৯৩৪ সালে কলকাতা রিপন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ইতি ঘটে তার ঢাকা জীবনের। হাজার বছরের বাংলা কবিতাকে আধুনিক রূপদানকল্পে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকা রেখেছে অনন্য ভূমিকা।
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম ১৯০৮ সালে। জন্মস্থান কুমিল্লা। পৈতৃক আদি নিবাস বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রাম। শৈশব কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। ছাত্রজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ঢাকা বোর্ডে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ.পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান গ্রহণ করার জন্য পদক পান এবং এরপর এম.এ. পরীক্ষাতেও আবার প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৩১ এর পর তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শিক্ষকতাই ছিল তার পেশা। রিপন কলেজে অধ্যাপনা করেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। একবছর অধ্যাপনা করেছেন আমেরিকার পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেন্স - এ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, খ্যাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ_ এমন অনেক অস্থিরতায় দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি যখন অগি্নগর্ভ ও উত্তাল, বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেটি অদ্ভুতভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক প্রভাব ভেঙে নতুন-নতুন ধারায় লিখতে শুরু করেছিলেন অনেক লেখক, স্বাধীন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যারা সম্পূর্ণ স্বচ্ছন্দ ও আত্মবিশ্বাসী। হঠাৎ যেন বাঁধের মুখ ভেঙে উন্মুক্ত জলের তোড়ে ভেসে এসেছিল এক বিস্ময়কর নতুন যুগ, যখন রবীন্দ্রোত্তর নব্য আধুনিকেরা তাদের রচনার মধ্য দিয়ে অমঙ্গল, অশুভ, লোভ, কাম, উলঙ্গ দারিদ্র_ সব নিয়েই যে অসুন্দর বাস্তবতা তারই জয় ঘোষণা করলেন। আধুনিক বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকা যে রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক কবিদের মুখপত্র হবে সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলেন সম্পাদক-প্রকাশক এবং তার সহোযোগীরা'।কবিতা পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে সমালোচনা সাহিত্যকে নতুন রূপদান করেছেন। এর আগ পর্যন্ত সমালোচনা সাহিত্য ছিল প্রতিক্রিয়া আশ্রয়ী। সেখানে শুধুমাত্র ভালো লাগা না লাগায় সীমাবদ্ধ ছিল সমালোচনার সীমানা। ইংরেজি সাহিত্যে ক্রিটিক্যাল থিওরির উন্মেষ ঘটার ফলে বাংলা সাহিত্যেও তার জোয়ার এসেছে বুদ্ধদেব বসুর মাধ্যমে। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের সমকালীন এবং পূর্বকালীন নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। যার ফলে সাহিত্যকে তার বিষয়ভঙ্গি এবং তাৎপর্যের ভিত্তিতে বিচারের আওতায় এনে কাঠামো এবং উত্তর কাঠামোগত পরিবর্তন আনেন। বিহারীলালসহ অনেকেই সমালোচনা সাহিত্যের মননশীল ধারা রূপায়ণে সচেষ্ট ছিলেন। তার সঙ্গে বুদ্ধদেব বসু যুক্ত করলেন বৈশ্বয়িক সমালোচনার এমন এক স্বকীয় ধারা যা তাকে দিয়েছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী খ্যাতি। সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ বিচারক। কারও সুনাম করতে গিয়ে অপর কবিকে ছোট করেননি কখনও, যা বর্তমান সময়ে খুব বেশি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ যোগ্য_' কী এসে যায় তুচ্ছ মতভেদে, যখন তিনি এত ভালো কবিতা লিখছেন।' ভালো কবিতা লেখা ছাড়া অন্য কিছুই তার বিচারের আওতায় আসেনি কখনও। তার লেখনিতে বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনান্দ দাশ, অজিত দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ তার সমসাময়িক অনেকের প্রাপ্য সম্মান ও স্থান দিয়ে তাদের পাঠকের নিকটবর্তী করে দিয়েছেন। তারাও কবিতা পত্রিকার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে করেছেন সুসংহত।
শুধুমাত্র কবিতার লালন কিংবা কবিতার নতুন ধারাকে বাঙালিদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বুদ্ধদেব বসু তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেননি। বরং নতুন লিখিয়েদের প্রতি তিনি ছিলেন এক মস্ত মহীরুহ রূপে। 'কবিতা'র আশ্বিন ১৩৫৩ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছেন_'একান্ত ও অফুরন্ত-রূপে সাহিত্য থেকেই সাহিত্যের জন্ম : কী লিখবো, সে-কথা কবিকে কানে-কানে ব'লে দিয়ে যায় বিশ্ব, বা জীবন, বা, বিশ্বজীবন, বা বিশ্ব প্রকৃতি; কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে কী-লিখবো আর কেমন ক'রে লিখবো অবিভাজ্য ব'লে রচনার আদর্শ না থাকলে বক্তব্য বিষয়ও মনের মধ্যে স্পষ্ট না। 'চণ্ডীদাসের মতো লিখবো', 'ভারতচন্দ্রের মতো লিখবো', 'মধুসূদনের মতো লিখবো' এই রকম ইচ্ছার চঞ্চলতা কবিত্ব-অধিকৃত বালক বা যুবকের মনকে যখন তাড়না ক'রে বেড়ায় তখনই বলা যায় সে একটা আদর্শ পেয়েছে। ... পূর্বসূরিদের মতো লেখবার চেষ্টা করতে-করতেই বাল্য রচনার নীহারিকায় হঠাৎ একদিন তারকার জন্ম হয়, অনুকরণের কলরোল ছাপিয়ে বেজে ওঠে নতুন সুর, নিজস্ব সুর। এর উদাহরণ শেক্সপিয়র, এর উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ। ... কিন্তু শুধু অনুকরণ যথেষ্ট নয়। টি.এস. এলিঅট বলেছেন যে অপরিণত কবি অনুকরণ করেন, আর পরিণত কবি অপহরণ করেন, অর্থাৎ আত্মসাৎ করেন। সত্য কথা। কিন্তু অনুকরণ থেকে অপহরণের শক্তি আসবে কেমন ক'রে। তার জন্য অনুশীলন চাই। অনুকরণ করেন অনেকেই, অনুশীলন করেন না ব'লে ব্যর্থ হন। এই অনুশীলনের অভাব বর্তমান নবীন লেখকদের মধ্যে ভয়াবহ। 'আমিই বা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কম কিসে!' এ-কথা মনে করতে দোষ নেই, সেটা ভালোই, কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখা চাই লুপ্ত নীল খাতাটির কথা, বোলপুরে গাছের তলায় ব'সে লেখা পৃথ্বীরাজ মহাকাব্য, মনে রাখা চাই অপরিণত কবির সেই অপরিমাণ গদ্য-পদ্য, যা সঙ্গে-সঙ্গেই কালস্রোতে ভেসে গেছে। আরো মনে রাখা চাই, পরিণত রবীন্দ্রনাথের বিরামহীন চিন্তা, চেষ্টা, উৎসাহ, উদ্বেগ, আপন রচনার বর্জন, পরিবর্তন, পরিমার্জনা। এ-রকম যে পারে, কবি তো সে-ই।' মহাভারতের আধুনিকায়ন, অনুবাদ, প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কাব্যনাটক, আত্মজৈবনিক রচনা, ভ্রমণকাহিনী_ সব মিলিয়ে বুদ্ধদেব বসু অতুল বৈভবময় সৃষ্টিজগতের অধীশ্বর। তার অতুলনীয় অবদান বাংলা সাহিত্যে সমাসীন হয়ে থাকবে চিরন্তন মর্যাদার ভিত্তিতে।
তাঁর উত্তরসূরিদের এ কথা স্বীকার করা প্রয়োজন, বুদ্ধদেব বসুর ঋণ শোধ করার যোগ্যতা এককভাবে আমরা এখনো খুব বেশি অর্জন করতে পারিনি। কারণ তিনি বাংলা কবিতার এমন এক আশ্চর্য চিরনতুন শিক্ষক, যার কাছ থেকে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আমাদের খুব সহজে ফুরোবে না। বাংলাদেশে কবির সংখ্যা চিরকালই বেশি, উত্তম কবির সংখ্যাও সুপ্রচুর। অথচ কবিতার খাঁটি শিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য। এর কারণ হয়তো এই, কবিরা তাদের পাঠ, দেখা, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যা কিছু অর্জন করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কেবল তাদের কবিতার ভেতর দিয়েই প্রকাশ করেন। ক্বদাচিৎ গদ্যচর্চা করলেও, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের মধ্যে কবিতার মতো সমান বা তীব্র সাধনা খুব কম ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর। কিংবা কবির গদ্য হয়তো অনেক ক্ষেত্রে তার চিন্তার সেই অবশেষ, যা তিনি কবিতায় প্রকাশ করতে পারেন না বলে গদ্যের আশ্রয় নেন। অথবা সেগুলো হয়তো উপলরক্ষের লেখা।কিন্তু কবি বুদ্ধদেব বসুর শিল্পচর্চার অপরাপর মাধ্যমও যে সমান তীব্র এর প্রকৃষ্ট প্রামাণ্য তার প্রবন্ধ ও অনুবাদসকল। তিনি তার কবিতার সমান তাড়না নিয়েই অসামান্য সব গদ্য লিখেছেন এবং অসম্ভব সুন্দর বহু অনুবাদ করেছেন। নিজের কবিতার জন্য তিনি যে অপত্য স্নেহ লালন করেন, অন্য ভাষার, সুদূরের, অন্য সময়ের কবির কবিতার প্রতিও একই মমত্ব পোষণ করেন। আর এটা বড় পষ্টভাবেই অনুভব করা যায় তার করা অনুবাদ বইগুলির ভূমিকাসকল পাঠ করলে (যেমন : কালিদাস, বোদলেয়ার, হোল্ডারলিন, রিলকে)। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা জরুরি, বুদ্ধদেব বসু যে সময়ের কবির কবিতাই অনুবাদ করুন না, কবিতার বিষয়মূলকে অক্ষুন্ন বা অ-ব্যাহত রেখেও, তিনি বাংলায় এর রূপ দিয়েছেন তার সমকালীন ও নিজস্ব কাব্যভাষায়। ফলে, তার কবিতা ও অনুবাদ হয়ে উঠেছে অনেকটা সমার্থবোধক। এ প্রসঙ্গে তার নিজেরই এক ধরনের স্বীকারোক্তি রয়েছে কোনো এক গদ্যে, যেখানে তিনি বলেছেন, যখন দিনের পর দিন কবিতা লিখতে পারতেন না, তখন, তার স্বভাবজাত সৃষ্টিতাড়না, অনুসন্ধান ও পাঠস্বভাবহেতু, ভিনভাষী কবিদের কবিতার রস আস্বাদন করতেন এবং কখনো-সখনো অনুবাদ করতেন। এগুলোও অনেকটা তার নিজস্ব কাব্যবন্ধ্যাকালেরই সৃষ্টি, কিন্তু এগুলোর উৎস আর অজ্ঞাত বা অদৃশ্য বহুমাত্রিক উপাদান নয়, বরং তার পূর্বজ ভিনভাষী কবিদেরই সৃষ্টি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোনো কোনো একচক্ষু অধ্যাপক-সমালোচক মনে করেন, তার নিজের কবিতাও নাকি অনেকাংশে এসব কবিতারই অবশেষমাত্র। তবে এমত ধারণার নেপথ্যে বুদ্ধদেব নিজেও খানিকটা দায়ী। কারণ, তিনি অনুবাদেও এত বেশি নিখুঁত, সযত্ন, সহৃদয় আর বাঙালি যে, যদি ওইসব কবির নিজদেশী উপাদান, চরিত্র ও পুরাণকে তিনি যথাযথ ব্যবহার না করতেন তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকেও তার নিজের কবিতা বলেই চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু আমরা এখনো পর্যন্ত পশ্চিমকেই উন্নত ও শ্রেষ্ঠতর বলে ভাবি, তাই আমাদের অজান্তেই বুদ্ধদেবকে ছোট করে দেখি। তার সৃষ্টিশীলতা, নিষ্ঠা ও সততার কথা আমাদের মনেই থাকে না। অথচ তিনি তার প্রতিটি অনুবাদ-বইয়ে যেভাবে ভূমিকা ও টীকাভাষ্য দিয়েছেন, সেগুলোর জন্য যে ধরনের মেধা ও শ্রম তাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে, তার দিকে নজর দিলেই টের পাওয়া যায় তাকে কী অসাধ্যসাধন করতে হয়েছে। তবে প্রভাবের কথা বলতে হলে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি ঋণ কেবল পশ্চিম থেকেই নেননি, তার মতো সর্বভূক শিল্পসাধক আধুনিক-প্রাচীন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সবখান থেকেই তার অন্তর্জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন। সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতার কারণেই ইউরোপ থেকে তার গ্রহণের পরিমাণটা বেশি। কিন্তু এই কূপমণ্ডুক জাতির ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা তা হলো তিনি নিজেকেই কেবল ঋদ্ধ করেননি, নিজ ভাষায় নিজ জাতির জন্য সেগুলো আমৃত্যু দু হাতে অকৃপণভাবে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। এবং নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার প্রগাঢ় শিক্ষক। কারণ বুদ্ধদেব বসুর ব্যাপারটা এমন নয় যে, তিনি মাস্টারির দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে উদ্ধারের মিশন গ্রহণ করেছিলেন (যদিও তিনি পেশাগতভাবেও জীবনের অনেকটা সময় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক! বরং বলা উচিত, ভারতবর্ষে একাডেমিকভাবে তুলনামূলক সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়েছে তারই নেতৃত্বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে)।আসলে তার এই শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারটিও ছিল অনেকটা প্রাকৃতিক ঘটনার মতো। `প্রাকৃতিক’ এই অর্থে যে, প্রকৃতির যে সূত্রে তিনি কবি, সে অর্থেই তিনি কবিতারও শিক্ষক। এ দায়িত্ব তাকে কেউ অর্পণ করেনি, কিংবা তিনি যে শিক্ষকতা করছেন এই মাস্টারি-মনোভাব নিয়েও তিনি কবিতার শিক্ষকতা করতে নামেননি। বরং বিশ্বকবিতার বিস্তীর্ণ সমুদ্রে তার যে স্বভাবজাত স্নান ও ডুব দেওয়া এবং সেখান থেকে তার যে নিবিড় আহরণ, এবং পরবর্তীকালে উত্তরপুরুষের জন্য সহৃদয়হৃদয়সংবাদী করে উপস্থাপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, এটিই তাকে পরিণত করেছে এক গভীরতর শিক্ষকে।
কবিতা যে কেবল ভাব দিয়ে রচিত হয় না, একটি কবিতার কবিতা হয়ে উঠার জন্য যে অনেকগুলো অভাব মেটাতে হয়, এ কথাটি এই একুশ শতকে এসেও অনেকে বুঝতে চান না। আবার কবিতার জন্য যে শিক্ষা ও দীক্ষা প্রয়োজন এটিও কবি ও পাঠক উভয়েই বিস্মৃত হয়ে পড়েন। শিল্পকলার অপরাপর মাধ্যম যেমন : সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা ইত্যাদির ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও লেখালেখির, কবিতার স্কুল আমাদের দেশে ছিল না কোনোকালে। কিন্তু স্কুল থাক বা না থাক, না থাক প্রশিক্ষণশালা, যে জাতির রবীন্দ্রনাথ আছে, যার মধ্যে অতীত ও আগামীর অপূর্ব মিলন ঘটেছে, যিনি শুধু শিল্প-সাহিত্য-চিন্তার এক গভীর সমুদ্র ছিলেন না, বরং স্বজাতির জন্য খুব সহজ করে সেসব উপস্থাপনও করে গেছেন, সেখানে কোনো স্কুলের দরকারও তো হয় না। সেগুলো একটু কষ্ট করে আগ্রহ নিয়ে পাঠ করলেই তো হয়ে যায়। এর বাইরে প্রাচীন-নতুন অপরাপর জ্ঞান-চিন্তা-তত্ত্ব তো আছেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনো সে অজ্ঞানতার আঁধার গেল না। আশ্চর্য ব্যাপারটা হলো, এই আক্ষেপ প্রায় সত্তর বছর আগে (১৯৩৮ সালে) বুদ্ধদেব বসু তার এক লেখায় যেভাবে করেছেন, আজও প্রায় একই ভাষায় আমাদেরও আক্ষেপটা করতে হয় (দ্রষ্টব্য : `লেখার ইস্কুল’, কালের পুতুল)। এবং এর ফল এই যে, বুদ্ধদেব বসুর মতো দ্রষ্টা-শিক্ষকের কাছে আমাদের ঋণ ক্রমাগত বেড়ে চলে।এর মানে এই নয় যে, আমরা বুদ্ধদেব বসুদের পর আর এগোইনি। বরং বাংলা কবিতা আরো বহু দূর বিস্তৃত হয়েছে। তার অনেক শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই যে অগ্রগতি (যদিও তা প্রশ্নাতীত নয়, এবং আমাদের কবিতা, বিশেষত তিরিশ ও এর পরবর্তী মূলধারার কবিতায় পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ নিয়ে যে বিতর্ক, তার কথা মনে রেখেও), তার নেপথ্যে যদি কাউকে যথাযথ শিক্ষকের অভিধা দিতে হয়, তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই দিতে হবে বুদ্ধদেব বসুকে। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতাকে যেমন নতুন সম্ভাবনায়, চিন্তায়, ভাষায় আরো উত্তুঙ্গতায় পৌঁছে দিয়ে জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার নতুন দরোজা খুলে দিয়েছেন, আর সেই দরোজায় তার সমসাময়িক ও উত্তরকালের কবি-সমালোচক-পাঠকের অবাধ প্রবেশ করার জন্য যিনি সবচেয়ে বেশি জীবনপাত করেছেন তিনি বুদ্ধদেব বসু। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দেড় দশক আগে উচ্চারিত বাংলা কবিতার নীরব সাধক পঞ্চাশের দশকের কবি আজীজুল হকের একটি মৌখিক উক্তি : তিরিশের কবিতা যে আজকের বাংলা কবিতার মূলধারা, তা যতটা সে সময়ের কবিদের কবিতার জন্য, ততটাই এর সপক্ষে বুদ্ধদেব বসুর মতো কবি-গদ্যকারদের নিরন্তর গদ্যরচনার জন্য।
বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে উপনিবেশিত হওয়া অনেকটা নিয়তির মতো, যে নিয়তির আগ্রাসনে একদিন ইউরোপই ইউরোপের আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল (যেমন : জার্মানদের মধ্য থেকে ইংরেজদের পত্তন, ফরাসি জাতির ইংল্যান্ড আগ্রাসন, ইংল্যান্ডের আয়ারল্যান্ড দখল। গ্রিক-রোমান সভ্যতার চিন্তা ও ভাষাগত আধিপত্য। আপাতত তোলা থাক অন্য মহাদেশে তাদের দখল-হত্যা-লুণ্ঠন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক আধিপত্যর কথা।)। কিন্তু এতো সব নেতি উপাদানের পরও ইউরোপ থেকে তিনি যে শৈল্পিক-মানবিক গুণগুলো আত্মীকৃত করেছেন, সেগুলোর মূল্য না দিলেও বড় ধরনের অবিচার করা হবে। বুদ্ধদেব বসু অন্ধ ইউরোপপন্থি ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের মাত্রাজ্ঞান তার কী মাত্রার ছিল, তার জন্য তার মেঘদূত বইটির ভূমিকাই উৎকৃষ্ট সাী। পরন্তু শিল্পের স্বয়ম্ভুতা, যুক্তির বোধ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের যে তুলাদণ্ড তার প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেজন্য ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রতি তার আগ্রহকে আমরা বরং খানিকটা শ্রদ্ধা জানাতে পারি। কারণ, প্রত্যক্ষ উপনিবেশ লোপ পেলেও আমাদের মনোজগৎ এখনো পশ্চিমা উপনিবেশের দখলে। আজও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের যথেষ্ট কম ও নিজস্ব জ্ঞান-ঐতিহ্য-সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের চেতনবোধও পশ্চিম থেকেই আমদানিকৃত। যথেষ্ট পরিমাণ ইংরেজি জানা এবং ততটাই কম মাতৃভাষা জানা আমাদের শিক্ষা ও পাণ্ডিত্যর উচ্চ মানদণ্ড। অন্য ভাষার সাহিত্য ইংরেজি অনুবাদে পেলে আমরা যতটা উল্লসিত হই, সরাসরি বাংলায় অনুবাদ হলেও আমরা ততটা উৎসাহী হই না। পশ্চিমের ডিগ্রি এখনো মহার্ঘ্য ও পূজনীয় বস্তু। তাদের বহুমুখী আধিপত্য এখন বরং উপনিবেশ আমলের চেয়ে বহু গুণে বেশি। বুদ্ধদেব বসু বরং উপনিবেশকালের মানুষ হয়েও এতটা গদগদ ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের একটা নিজস্ব প্রক্রিয়া তার ছিল, যা পক্ষান্তরে স্বদেশ ও ভাষার পক্ষে অনেক অনুকূল ছিল। এ দিক থেকেও তিনি পরোক্ষভাবে আমাদের একজন অন্তর্গত শিক্ষক। অন্যদিকে উদারতা বুদ্ধদেব বসুর একটি বড় গুণ। যেটা যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি শিল্পগত ক্ষেত্রেও। কারণ তিনি যেভাবে তার পূর্বসূরি বা সমসাময়িক কবিদেরই নয়, বরং উত্তরসূরি কবিদেরও ক্ষান্তিহীনভাবে মূল্যায়ন আলোচনা ও সমালোচনা করেছেন, এটা এখনকার দিনে খুব বিরল ঘটনা। বরং এখনো আমরা অনেক বেশি আত্মপর। মূল্যায়ন তো পরের কথা, সমকালীন সতীর্থদের পাঠ করতেও আমাদের অনেক অনীহা। এক্ষেত্রেও তিনি আমাদের জরুরি শিক্ষক।
রবীন্দ্রনাথের পর শিল্পের নানা মাধ্যমে এত সহজ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ যেমন খুব কম লেখক করতে পেরেছেন, তেমনি নিরন্তর আত্মপাঠ-আত্মমূল্যায়ন-আত্মচেতনার মধ্য দিয়ে আমৃত্যু নবীন ও প্রবহমান থাকার ক্ষমতাও খুব কম লেখকেরই ছিল। রবীন্দ্র-পরবর্তীদের মধ্যে এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব নেওয়ার বৈধ অধিকার রাখেন। অন্যদিকে, শুধু বাংলা কবিতার বিস্তার, বিকাশ ও বিশ্লেষণে তার যে সাধনা ও অবদান, এর জন্যই তিনি আমাদের চিরপূজনীয় হতে পারেন।
কিন্তু আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণতার কারণেই হোক আর অজ্ঞানতা বা অমনোযোগের কারণেই হোক, তিনি আজও অনেকটাই অবহেলিতই রয়ে গেলেন। তাঁর জন্মের শতবর্ষ পরে এখন আমাদের সামনে এক সুবর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে তাকে ফিরে দেখার, মূল্যায়ন করার ও শ্রদ্ধা জানাবার। আর তা করা দরকার শাদা চোখে ও বাস্তবতার নিরিখে। কেবল ভক্তি বা বিরোধিতা দিয়ে বিচার করতে গেলে তা হবে আমাদের আত্মপ্রতারণারই আরেক প্রকাশ।
আমরা যখন তার অনুবাদে বোদলেয়ারের বিস্ময়কর সব পঙ্ক্তিগুচ্ছ পাঠ করি :
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ…চলিষ্ণু মেঘ…ঐ উঁচুতে… ঐ উঁচুতে…
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
অথবা,
আক্ষেপ, আক্ষেপ শুধু! সময়ের খাদ্য এ-জীবন,
যে-গুপ্ত শত্রুর দাঁতে আমাদের জীবনের ক্ষয়
বাড়ায় বিক্রম তার আমাদেরই রক্তের তর্পণ।
কিংবা হ্যেল্ডার্লিন থেকে :
তবে এসো, মধুর, কোমল সুপ্তি! হৃদয়ের অভিলাষঅত্যধিক,
অসম্ভব। কিন্তু শেষে, হে যৌবন, অস্থির, স্বপ্নিল,
তুমিও হারাবে তাপ, আর ধীরে বার্ধক্য আমাকে
দেবে শান্তি, সান্ত্বনা, বিরাম।
কিংবা রিলকে থেকে :
পাতা ঝরে, পাতা ঝরে, শূন্য থেকে ঝ`রে প`ড়ে যায়,
যেন দূর আকাশে বিশীর্ণ হ`লো অনেক বাগান;
এমন ভঙ্গিতে ঝরে, প্রত্যাখ্যানে যেন প্রতিশ্রুত।
এবং পৃথিবী ঝরে প্রতি রাত্রে গতিপথচ্যুত,
নত্রশৃঙ্খল ছিঁড়ে– নিঃসঙ্গতায়।
আমরাও ঝ`রে যাই। এই হাত– তাও পড়ে ঝ`রে।
দ্যাখো অন্য সকলেরে : সকলেই এর অংশীদার।
কিংবা পাস্তারনাক থেকে :
তোমার কঠিন পণ ভালোবাসি আমি,
আমার ভূমিকার অভিনয়ে আছি সম্মত।
কিন্তু এবার এক ভিন্ন পালা শুরু হ`লো;
এই একবারের মতো দাও আমাকে নিষ্কৃতি।
কিন্তু অঙ্কগুলির পারম্পর্য অনড়
আর পথের শেষ আমাকে মুক্তি দেবে না;
নিঃসঙ্গ আমি; সব ডুবে গেলো ধর্মান্ধের শঠতায়।
মাঠ পেরোনোর মতো সহজ নয় বেঁচে থাকা।
তখন এইসব অসামান্য ও সপ্রাণ পঙ্ক্তিগুচ্ছ আমাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন, প্লাবিত, মুগ্ধ করে যে, মনে হয় কোথায় অনুবাদ, কোথায় বোদলেয়ার, হ্যেল্ডার্লিন, রিলকে বা পাস্তারনাক– এ যেন কবি বুদ্ধদেব বসুরই এক অন্তর্গত প্রগাঢ় স্বর। পেয়েছেন জাতীয় সন্মান পদ্মভূষণ পুরস্কার। তিনি মারা যানা ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ, কলকাতায়। তাঁর বইগুলোর মধ্যে আজকাল প্রকাশনী উদ্যোগ নিয়ে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আর শ্রেষ্ট গল্প প্রকাশ করেছে। সংগ্রহে রাখার মতো দুটি বই।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মার্কসিস্ট ফর্মালিজমের একটি ধারা, যেখানে সাহিত্য তথা কবিতার আঙ্গিকের বাঁক বদল প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ডিফেমিলিয়ারাইজেশন'কে। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও বিংশ শতাব্দীর এমন ধরনের নান্দনিক বাঁক বদল ঘটেছিল। এই বাঁক বদলের মূল রূপকার ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। তার আগে এবং সমকালে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ রূপকারেরা এই মতে বিশ্বাস স্থাপন করবেন যে, তিনি একাধারে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের সমসাময়িক। একই সঙ্গে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাশ এবং মাইকেলের উত্তরসূরি। তিনি নিজের কবিতা লিখতে গিয়ে এই কবিদের প্রধান রচনা আত্মস্থ করেছেন। আমরা তার মাঝে চিরকালের এবং পরবর্তীকালের নবায়নের সমস্ত সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করি। পাশাপাশি রবীন্দ্র প্রতিভা, যার নিরীক্ষা ও সঞ্চয়কে ব্যবহার করে ভিন্ন পথে যাত্রা করেছেন। ভারতীয় ঐতিহ্যকে ভিন্নধারায় সাধনার মাধ্যমে আপন করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্যকর্মে মঙ্গলের কথা বলেছেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু সাহিত্যে বিপন্ন বিষাদের আবেশ ছড়িয়েছেন নিজের মতো করে। পাশ্চাত্য সাহিত্যে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বোদলেয়ার এক মানবিক অস্থিরতা যুক্ত করেছেন। বুদ্ধদেব বসু সচেতনভাবে এই ধারা বাংলা কবিতায় ব্যবহার করেছেন। নতুন বিষয় এবং আঙ্গিকের সঙ্গে বাংলা কবিতার পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।দ্বিতীয়ত ইংরেজি সাহিত্যের প্রথমার্ধে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত হয়েছে ইয়েটস, অডেনের হাত ধরে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে এ সময়ে প্রধান উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে অবক্ষয় এবং ভঙ্গুরতা। ইলিয়ট যাকে ব্রোকেন ইমেজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ সময়ের পৃথিবীকে ওয়েস্ট ল্যান্ড বা নষ্ট জমিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। অডেনের কবিতায় চিত্রিত হয়েছে যুদ্ধংদেহী পৃথিবীর চিত্র। কবিতায় এ সময় ব্যবহৃত হয়েছে_ এক্সপ্রেসনিজম, ইম্প্রেসনিজম, অ্যাবসার্ডিজম এবং স্যুরিয়ালিজম। এই পদ্ধতিতে কবিতার এক পক্ষীয় বর্ণনা পরিত্যক্ত হলো। কবিতার বহুমুখী বর্ণনার সূত্রপাত হলো। একই কবিতা থেকে নানা অর্থের নান্দনিক ব্যবহার সূচিত হলো। কবিতাকে সারল্য থেকে মুক্তি দিয়ে নান্দনিকরূপ দান করা ছিল মূল লক্ষ্য। বুদ্ধদেব বসু সচেতনভাবে বাংলা কবিতায় ব্যবহার করলেন এই নতুন ধারা। তিনি নান্দনিক বিদ্রোহ করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। নজরুলের সামাজিক বিদ্রোহকে গ্রহণ করে তাকেও বজর্ন করলেন নানা ক্ষেত্রে। বুদ্ধদেব বসু এবং তার সমসাময়িক কবিরা রচনা করলেন আধুনিক কবিতার মেনিফ্যাস্টো_ কী ভাষা ব্যবহার করা যাবে, কী ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। যদিও তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে সেই ধারা মেনে চলতে পারেননি। বুদ্ধদেব বসু তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতা সংগ্রহের ভূমিকায় আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায়ন প্রচেষ্টা করেছেন এভাবে : '... এই আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকল শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সব ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন-ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।'
ঢাকায় অবস্থানকালে প্রকাশ করেন হাতে লেখা পত্রিকা প্রগতি। বৃত্তির কুড়ি টাকা যোগ করে ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টন থেকে প্রগতির প্রথম সংখ্যা বের হয় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে। সম্পাদক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে এখানে যোগ হয় শ্রী অজিত কুমার দত্তের নাম। প্রগতির সঙ্গী হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বিষুষ্ণ দে, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ড. মোহিতলাল মজুমদার, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, পরিমল রায়, অমলেন্দু বসু, মনীশ ঘটক, সুধীশ ঘটক, অনিল ভট্টাচার্য, ভৃগু গুহঠাকুরতা, পঙ্কজকুমার দাশগুপ্ত, সুধাংশু দাশগুপ্ত, গায়ত্রী দেবী ও সমরেন্দ্র গুপ্তসহ আরও অনেক খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবী। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক [১৯২৯ সালে] সংখ্যা ছিল প্রগতির শেষ প্রকাশনা। ১৯৩৪ সালে কলকাতা রিপন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ইতি ঘটে তার ঢাকা জীবনের। হাজার বছরের বাংলা কবিতাকে আধুনিক রূপদানকল্পে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকা রেখেছে অনন্য ভূমিকা।
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম ১৯০৮ সালে। জন্মস্থান কুমিল্লা। পৈতৃক আদি নিবাস বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রাম। শৈশব কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। ছাত্রজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ঢাকা বোর্ডে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ.পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান গ্রহণ করার জন্য পদক পান এবং এরপর এম.এ. পরীক্ষাতেও আবার প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৩১ এর পর তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শিক্ষকতাই ছিল তার পেশা। রিপন কলেজে অধ্যাপনা করেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। একবছর অধ্যাপনা করেছেন আমেরিকার পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেন্স - এ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, খ্যাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ_ এমন অনেক অস্থিরতায় দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি যখন অগি্নগর্ভ ও উত্তাল, বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেটি অদ্ভুতভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক প্রভাব ভেঙে নতুন-নতুন ধারায় লিখতে শুরু করেছিলেন অনেক লেখক, স্বাধীন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যারা সম্পূর্ণ স্বচ্ছন্দ ও আত্মবিশ্বাসী। হঠাৎ যেন বাঁধের মুখ ভেঙে উন্মুক্ত জলের তোড়ে ভেসে এসেছিল এক বিস্ময়কর নতুন যুগ, যখন রবীন্দ্রোত্তর নব্য আধুনিকেরা তাদের রচনার মধ্য দিয়ে অমঙ্গল, অশুভ, লোভ, কাম, উলঙ্গ দারিদ্র_ সব নিয়েই যে অসুন্দর বাস্তবতা তারই জয় ঘোষণা করলেন। আধুনিক বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকা যে রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক কবিদের মুখপত্র হবে সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলেন সম্পাদক-প্রকাশক এবং তার সহোযোগীরা'।কবিতা পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে সমালোচনা সাহিত্যকে নতুন রূপদান করেছেন। এর আগ পর্যন্ত সমালোচনা সাহিত্য ছিল প্রতিক্রিয়া আশ্রয়ী। সেখানে শুধুমাত্র ভালো লাগা না লাগায় সীমাবদ্ধ ছিল সমালোচনার সীমানা। ইংরেজি সাহিত্যে ক্রিটিক্যাল থিওরির উন্মেষ ঘটার ফলে বাংলা সাহিত্যেও তার জোয়ার এসেছে বুদ্ধদেব বসুর মাধ্যমে। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের সমকালীন এবং পূর্বকালীন নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। যার ফলে সাহিত্যকে তার বিষয়ভঙ্গি এবং তাৎপর্যের ভিত্তিতে বিচারের আওতায় এনে কাঠামো এবং উত্তর কাঠামোগত পরিবর্তন আনেন। বিহারীলালসহ অনেকেই সমালোচনা সাহিত্যের মননশীল ধারা রূপায়ণে সচেষ্ট ছিলেন। তার সঙ্গে বুদ্ধদেব বসু যুক্ত করলেন বৈশ্বয়িক সমালোচনার এমন এক স্বকীয় ধারা যা তাকে দিয়েছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী খ্যাতি। সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ বিচারক। কারও সুনাম করতে গিয়ে অপর কবিকে ছোট করেননি কখনও, যা বর্তমান সময়ে খুব বেশি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ যোগ্য_' কী এসে যায় তুচ্ছ মতভেদে, যখন তিনি এত ভালো কবিতা লিখছেন।' ভালো কবিতা লেখা ছাড়া অন্য কিছুই তার বিচারের আওতায় আসেনি কখনও। তার লেখনিতে বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনান্দ দাশ, অজিত দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ তার সমসাময়িক অনেকের প্রাপ্য সম্মান ও স্থান দিয়ে তাদের পাঠকের নিকটবর্তী করে দিয়েছেন। তারাও কবিতা পত্রিকার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে করেছেন সুসংহত।
শুধুমাত্র কবিতার লালন কিংবা কবিতার নতুন ধারাকে বাঙালিদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বুদ্ধদেব বসু তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেননি। বরং নতুন লিখিয়েদের প্রতি তিনি ছিলেন এক মস্ত মহীরুহ রূপে। 'কবিতা'র আশ্বিন ১৩৫৩ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছেন_'একান্ত ও অফুরন্ত-রূপে সাহিত্য থেকেই সাহিত্যের জন্ম : কী লিখবো, সে-কথা কবিকে কানে-কানে ব'লে দিয়ে যায় বিশ্ব, বা জীবন, বা, বিশ্বজীবন, বা বিশ্ব প্রকৃতি; কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে কী-লিখবো আর কেমন ক'রে লিখবো অবিভাজ্য ব'লে রচনার আদর্শ না থাকলে বক্তব্য বিষয়ও মনের মধ্যে স্পষ্ট না। 'চণ্ডীদাসের মতো লিখবো', 'ভারতচন্দ্রের মতো লিখবো', 'মধুসূদনের মতো লিখবো' এই রকম ইচ্ছার চঞ্চলতা কবিত্ব-অধিকৃত বালক বা যুবকের মনকে যখন তাড়না ক'রে বেড়ায় তখনই বলা যায় সে একটা আদর্শ পেয়েছে। ... পূর্বসূরিদের মতো লেখবার চেষ্টা করতে-করতেই বাল্য রচনার নীহারিকায় হঠাৎ একদিন তারকার জন্ম হয়, অনুকরণের কলরোল ছাপিয়ে বেজে ওঠে নতুন সুর, নিজস্ব সুর। এর উদাহরণ শেক্সপিয়র, এর উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ। ... কিন্তু শুধু অনুকরণ যথেষ্ট নয়। টি.এস. এলিঅট বলেছেন যে অপরিণত কবি অনুকরণ করেন, আর পরিণত কবি অপহরণ করেন, অর্থাৎ আত্মসাৎ করেন। সত্য কথা। কিন্তু অনুকরণ থেকে অপহরণের শক্তি আসবে কেমন ক'রে। তার জন্য অনুশীলন চাই। অনুকরণ করেন অনেকেই, অনুশীলন করেন না ব'লে ব্যর্থ হন। এই অনুশীলনের অভাব বর্তমান নবীন লেখকদের মধ্যে ভয়াবহ। 'আমিই বা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কম কিসে!' এ-কথা মনে করতে দোষ নেই, সেটা ভালোই, কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখা চাই লুপ্ত নীল খাতাটির কথা, বোলপুরে গাছের তলায় ব'সে লেখা পৃথ্বীরাজ মহাকাব্য, মনে রাখা চাই অপরিণত কবির সেই অপরিমাণ গদ্য-পদ্য, যা সঙ্গে-সঙ্গেই কালস্রোতে ভেসে গেছে। আরো মনে রাখা চাই, পরিণত রবীন্দ্রনাথের বিরামহীন চিন্তা, চেষ্টা, উৎসাহ, উদ্বেগ, আপন রচনার বর্জন, পরিবর্তন, পরিমার্জনা। এ-রকম যে পারে, কবি তো সে-ই।' মহাভারতের আধুনিকায়ন, অনুবাদ, প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কাব্যনাটক, আত্মজৈবনিক রচনা, ভ্রমণকাহিনী_ সব মিলিয়ে বুদ্ধদেব বসু অতুল বৈভবময় সৃষ্টিজগতের অধীশ্বর। তার অতুলনীয় অবদান বাংলা সাহিত্যে সমাসীন হয়ে থাকবে চিরন্তন মর্যাদার ভিত্তিতে।
তাঁর উত্তরসূরিদের এ কথা স্বীকার করা প্রয়োজন, বুদ্ধদেব বসুর ঋণ শোধ করার যোগ্যতা এককভাবে আমরা এখনো খুব বেশি অর্জন করতে পারিনি। কারণ তিনি বাংলা কবিতার এমন এক আশ্চর্য চিরনতুন শিক্ষক, যার কাছ থেকে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আমাদের খুব সহজে ফুরোবে না। বাংলাদেশে কবির সংখ্যা চিরকালই বেশি, উত্তম কবির সংখ্যাও সুপ্রচুর। অথচ কবিতার খাঁটি শিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য। এর কারণ হয়তো এই, কবিরা তাদের পাঠ, দেখা, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যা কিছু অর্জন করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কেবল তাদের কবিতার ভেতর দিয়েই প্রকাশ করেন। ক্বদাচিৎ গদ্যচর্চা করলেও, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের মধ্যে কবিতার মতো সমান বা তীব্র সাধনা খুব কম ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর। কিংবা কবির গদ্য হয়তো অনেক ক্ষেত্রে তার চিন্তার সেই অবশেষ, যা তিনি কবিতায় প্রকাশ করতে পারেন না বলে গদ্যের আশ্রয় নেন। অথবা সেগুলো হয়তো উপলরক্ষের লেখা।কিন্তু কবি বুদ্ধদেব বসুর শিল্পচর্চার অপরাপর মাধ্যমও যে সমান তীব্র এর প্রকৃষ্ট প্রামাণ্য তার প্রবন্ধ ও অনুবাদসকল। তিনি তার কবিতার সমান তাড়না নিয়েই অসামান্য সব গদ্য লিখেছেন এবং অসম্ভব সুন্দর বহু অনুবাদ করেছেন। নিজের কবিতার জন্য তিনি যে অপত্য স্নেহ লালন করেন, অন্য ভাষার, সুদূরের, অন্য সময়ের কবির কবিতার প্রতিও একই মমত্ব পোষণ করেন। আর এটা বড় পষ্টভাবেই অনুভব করা যায় তার করা অনুবাদ বইগুলির ভূমিকাসকল পাঠ করলে (যেমন : কালিদাস, বোদলেয়ার, হোল্ডারলিন, রিলকে)। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা জরুরি, বুদ্ধদেব বসু যে সময়ের কবির কবিতাই অনুবাদ করুন না, কবিতার বিষয়মূলকে অক্ষুন্ন বা অ-ব্যাহত রেখেও, তিনি বাংলায় এর রূপ দিয়েছেন তার সমকালীন ও নিজস্ব কাব্যভাষায়। ফলে, তার কবিতা ও অনুবাদ হয়ে উঠেছে অনেকটা সমার্থবোধক। এ প্রসঙ্গে তার নিজেরই এক ধরনের স্বীকারোক্তি রয়েছে কোনো এক গদ্যে, যেখানে তিনি বলেছেন, যখন দিনের পর দিন কবিতা লিখতে পারতেন না, তখন, তার স্বভাবজাত সৃষ্টিতাড়না, অনুসন্ধান ও পাঠস্বভাবহেতু, ভিনভাষী কবিদের কবিতার রস আস্বাদন করতেন এবং কখনো-সখনো অনুবাদ করতেন। এগুলোও অনেকটা তার নিজস্ব কাব্যবন্ধ্যাকালেরই সৃষ্টি, কিন্তু এগুলোর উৎস আর অজ্ঞাত বা অদৃশ্য বহুমাত্রিক উপাদান নয়, বরং তার পূর্বজ ভিনভাষী কবিদেরই সৃষ্টি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোনো কোনো একচক্ষু অধ্যাপক-সমালোচক মনে করেন, তার নিজের কবিতাও নাকি অনেকাংশে এসব কবিতারই অবশেষমাত্র। তবে এমত ধারণার নেপথ্যে বুদ্ধদেব নিজেও খানিকটা দায়ী। কারণ, তিনি অনুবাদেও এত বেশি নিখুঁত, সযত্ন, সহৃদয় আর বাঙালি যে, যদি ওইসব কবির নিজদেশী উপাদান, চরিত্র ও পুরাণকে তিনি যথাযথ ব্যবহার না করতেন তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকেও তার নিজের কবিতা বলেই চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু আমরা এখনো পর্যন্ত পশ্চিমকেই উন্নত ও শ্রেষ্ঠতর বলে ভাবি, তাই আমাদের অজান্তেই বুদ্ধদেবকে ছোট করে দেখি। তার সৃষ্টিশীলতা, নিষ্ঠা ও সততার কথা আমাদের মনেই থাকে না। অথচ তিনি তার প্রতিটি অনুবাদ-বইয়ে যেভাবে ভূমিকা ও টীকাভাষ্য দিয়েছেন, সেগুলোর জন্য যে ধরনের মেধা ও শ্রম তাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে, তার দিকে নজর দিলেই টের পাওয়া যায় তাকে কী অসাধ্যসাধন করতে হয়েছে। তবে প্রভাবের কথা বলতে হলে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি ঋণ কেবল পশ্চিম থেকেই নেননি, তার মতো সর্বভূক শিল্পসাধক আধুনিক-প্রাচীন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সবখান থেকেই তার অন্তর্জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন। সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতার কারণেই ইউরোপ থেকে তার গ্রহণের পরিমাণটা বেশি। কিন্তু এই কূপমণ্ডুক জাতির ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা তা হলো তিনি নিজেকেই কেবল ঋদ্ধ করেননি, নিজ ভাষায় নিজ জাতির জন্য সেগুলো আমৃত্যু দু হাতে অকৃপণভাবে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। এবং নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার প্রগাঢ় শিক্ষক। কারণ বুদ্ধদেব বসুর ব্যাপারটা এমন নয় যে, তিনি মাস্টারির দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে উদ্ধারের মিশন গ্রহণ করেছিলেন (যদিও তিনি পেশাগতভাবেও জীবনের অনেকটা সময় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক! বরং বলা উচিত, ভারতবর্ষে একাডেমিকভাবে তুলনামূলক সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়েছে তারই নেতৃত্বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে)।আসলে তার এই শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারটিও ছিল অনেকটা প্রাকৃতিক ঘটনার মতো। `প্রাকৃতিক’ এই অর্থে যে, প্রকৃতির যে সূত্রে তিনি কবি, সে অর্থেই তিনি কবিতারও শিক্ষক। এ দায়িত্ব তাকে কেউ অর্পণ করেনি, কিংবা তিনি যে শিক্ষকতা করছেন এই মাস্টারি-মনোভাব নিয়েও তিনি কবিতার শিক্ষকতা করতে নামেননি। বরং বিশ্বকবিতার বিস্তীর্ণ সমুদ্রে তার যে স্বভাবজাত স্নান ও ডুব দেওয়া এবং সেখান থেকে তার যে নিবিড় আহরণ, এবং পরবর্তীকালে উত্তরপুরুষের জন্য সহৃদয়হৃদয়সংবাদী করে উপস্থাপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, এটিই তাকে পরিণত করেছে এক গভীরতর শিক্ষকে।
কবিতা যে কেবল ভাব দিয়ে রচিত হয় না, একটি কবিতার কবিতা হয়ে উঠার জন্য যে অনেকগুলো অভাব মেটাতে হয়, এ কথাটি এই একুশ শতকে এসেও অনেকে বুঝতে চান না। আবার কবিতার জন্য যে শিক্ষা ও দীক্ষা প্রয়োজন এটিও কবি ও পাঠক উভয়েই বিস্মৃত হয়ে পড়েন। শিল্পকলার অপরাপর মাধ্যম যেমন : সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা ইত্যাদির ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও লেখালেখির, কবিতার স্কুল আমাদের দেশে ছিল না কোনোকালে। কিন্তু স্কুল থাক বা না থাক, না থাক প্রশিক্ষণশালা, যে জাতির রবীন্দ্রনাথ আছে, যার মধ্যে অতীত ও আগামীর অপূর্ব মিলন ঘটেছে, যিনি শুধু শিল্প-সাহিত্য-চিন্তার এক গভীর সমুদ্র ছিলেন না, বরং স্বজাতির জন্য খুব সহজ করে সেসব উপস্থাপনও করে গেছেন, সেখানে কোনো স্কুলের দরকারও তো হয় না। সেগুলো একটু কষ্ট করে আগ্রহ নিয়ে পাঠ করলেই তো হয়ে যায়। এর বাইরে প্রাচীন-নতুন অপরাপর জ্ঞান-চিন্তা-তত্ত্ব তো আছেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনো সে অজ্ঞানতার আঁধার গেল না। আশ্চর্য ব্যাপারটা হলো, এই আক্ষেপ প্রায় সত্তর বছর আগে (১৯৩৮ সালে) বুদ্ধদেব বসু তার এক লেখায় যেভাবে করেছেন, আজও প্রায় একই ভাষায় আমাদেরও আক্ষেপটা করতে হয় (দ্রষ্টব্য : `লেখার ইস্কুল’, কালের পুতুল)। এবং এর ফল এই যে, বুদ্ধদেব বসুর মতো দ্রষ্টা-শিক্ষকের কাছে আমাদের ঋণ ক্রমাগত বেড়ে চলে।এর মানে এই নয় যে, আমরা বুদ্ধদেব বসুদের পর আর এগোইনি। বরং বাংলা কবিতা আরো বহু দূর বিস্তৃত হয়েছে। তার অনেক শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই যে অগ্রগতি (যদিও তা প্রশ্নাতীত নয়, এবং আমাদের কবিতা, বিশেষত তিরিশ ও এর পরবর্তী মূলধারার কবিতায় পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ নিয়ে যে বিতর্ক, তার কথা মনে রেখেও), তার নেপথ্যে যদি কাউকে যথাযথ শিক্ষকের অভিধা দিতে হয়, তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই দিতে হবে বুদ্ধদেব বসুকে। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতাকে যেমন নতুন সম্ভাবনায়, চিন্তায়, ভাষায় আরো উত্তুঙ্গতায় পৌঁছে দিয়ে জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার নতুন দরোজা খুলে দিয়েছেন, আর সেই দরোজায় তার সমসাময়িক ও উত্তরকালের কবি-সমালোচক-পাঠকের অবাধ প্রবেশ করার জন্য যিনি সবচেয়ে বেশি জীবনপাত করেছেন তিনি বুদ্ধদেব বসু। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দেড় দশক আগে উচ্চারিত বাংলা কবিতার নীরব সাধক পঞ্চাশের দশকের কবি আজীজুল হকের একটি মৌখিক উক্তি : তিরিশের কবিতা যে আজকের বাংলা কবিতার মূলধারা, তা যতটা সে সময়ের কবিদের কবিতার জন্য, ততটাই এর সপক্ষে বুদ্ধদেব বসুর মতো কবি-গদ্যকারদের নিরন্তর গদ্যরচনার জন্য।
বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে উপনিবেশিত হওয়া অনেকটা নিয়তির মতো, যে নিয়তির আগ্রাসনে একদিন ইউরোপই ইউরোপের আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল (যেমন : জার্মানদের মধ্য থেকে ইংরেজদের পত্তন, ফরাসি জাতির ইংল্যান্ড আগ্রাসন, ইংল্যান্ডের আয়ারল্যান্ড দখল। গ্রিক-রোমান সভ্যতার চিন্তা ও ভাষাগত আধিপত্য। আপাতত তোলা থাক অন্য মহাদেশে তাদের দখল-হত্যা-লুণ্ঠন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক আধিপত্যর কথা।)। কিন্তু এতো সব নেতি উপাদানের পরও ইউরোপ থেকে তিনি যে শৈল্পিক-মানবিক গুণগুলো আত্মীকৃত করেছেন, সেগুলোর মূল্য না দিলেও বড় ধরনের অবিচার করা হবে। বুদ্ধদেব বসু অন্ধ ইউরোপপন্থি ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের মাত্রাজ্ঞান তার কী মাত্রার ছিল, তার জন্য তার মেঘদূত বইটির ভূমিকাই উৎকৃষ্ট সাী। পরন্তু শিল্পের স্বয়ম্ভুতা, যুক্তির বোধ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের যে তুলাদণ্ড তার প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেজন্য ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রতি তার আগ্রহকে আমরা বরং খানিকটা শ্রদ্ধা জানাতে পারি। কারণ, প্রত্যক্ষ উপনিবেশ লোপ পেলেও আমাদের মনোজগৎ এখনো পশ্চিমা উপনিবেশের দখলে। আজও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের যথেষ্ট কম ও নিজস্ব জ্ঞান-ঐতিহ্য-সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের চেতনবোধও পশ্চিম থেকেই আমদানিকৃত। যথেষ্ট পরিমাণ ইংরেজি জানা এবং ততটাই কম মাতৃভাষা জানা আমাদের শিক্ষা ও পাণ্ডিত্যর উচ্চ মানদণ্ড। অন্য ভাষার সাহিত্য ইংরেজি অনুবাদে পেলে আমরা যতটা উল্লসিত হই, সরাসরি বাংলায় অনুবাদ হলেও আমরা ততটা উৎসাহী হই না। পশ্চিমের ডিগ্রি এখনো মহার্ঘ্য ও পূজনীয় বস্তু। তাদের বহুমুখী আধিপত্য এখন বরং উপনিবেশ আমলের চেয়ে বহু গুণে বেশি। বুদ্ধদেব বসু বরং উপনিবেশকালের মানুষ হয়েও এতটা গদগদ ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের একটা নিজস্ব প্রক্রিয়া তার ছিল, যা পক্ষান্তরে স্বদেশ ও ভাষার পক্ষে অনেক অনুকূল ছিল। এ দিক থেকেও তিনি পরোক্ষভাবে আমাদের একজন অন্তর্গত শিক্ষক। অন্যদিকে উদারতা বুদ্ধদেব বসুর একটি বড় গুণ। যেটা যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি শিল্পগত ক্ষেত্রেও। কারণ তিনি যেভাবে তার পূর্বসূরি বা সমসাময়িক কবিদেরই নয়, বরং উত্তরসূরি কবিদেরও ক্ষান্তিহীনভাবে মূল্যায়ন আলোচনা ও সমালোচনা করেছেন, এটা এখনকার দিনে খুব বিরল ঘটনা। বরং এখনো আমরা অনেক বেশি আত্মপর। মূল্যায়ন তো পরের কথা, সমকালীন সতীর্থদের পাঠ করতেও আমাদের অনেক অনীহা। এক্ষেত্রেও তিনি আমাদের জরুরি শিক্ষক।
রবীন্দ্রনাথের পর শিল্পের নানা মাধ্যমে এত সহজ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ যেমন খুব কম লেখক করতে পেরেছেন, তেমনি নিরন্তর আত্মপাঠ-আত্মমূল্যায়ন-আত্মচেতনার মধ্য দিয়ে আমৃত্যু নবীন ও প্রবহমান থাকার ক্ষমতাও খুব কম লেখকেরই ছিল। রবীন্দ্র-পরবর্তীদের মধ্যে এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব নেওয়ার বৈধ অধিকার রাখেন। অন্যদিকে, শুধু বাংলা কবিতার বিস্তার, বিকাশ ও বিশ্লেষণে তার যে সাধনা ও অবদান, এর জন্যই তিনি আমাদের চিরপূজনীয় হতে পারেন।
কিন্তু আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণতার কারণেই হোক আর অজ্ঞানতা বা অমনোযোগের কারণেই হোক, তিনি আজও অনেকটাই অবহেলিতই রয়ে গেলেন। তাঁর জন্মের শতবর্ষ পরে এখন আমাদের সামনে এক সুবর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে তাকে ফিরে দেখার, মূল্যায়ন করার ও শ্রদ্ধা জানাবার। আর তা করা দরকার শাদা চোখে ও বাস্তবতার নিরিখে। কেবল ভক্তি বা বিরোধিতা দিয়ে বিচার করতে গেলে তা হবে আমাদের আত্মপ্রতারণারই আরেক প্রকাশ।
আমরা যখন তার অনুবাদে বোদলেয়ারের বিস্ময়কর সব পঙ্ক্তিগুচ্ছ পাঠ করি :
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ…চলিষ্ণু মেঘ…ঐ উঁচুতে… ঐ উঁচুতে…
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
অথবা,
আক্ষেপ, আক্ষেপ শুধু! সময়ের খাদ্য এ-জীবন,
যে-গুপ্ত শত্রুর দাঁতে আমাদের জীবনের ক্ষয়
বাড়ায় বিক্রম তার আমাদেরই রক্তের তর্পণ।
কিংবা হ্যেল্ডার্লিন থেকে :
তবে এসো, মধুর, কোমল সুপ্তি! হৃদয়ের অভিলাষঅত্যধিক,
অসম্ভব। কিন্তু শেষে, হে যৌবন, অস্থির, স্বপ্নিল,
তুমিও হারাবে তাপ, আর ধীরে বার্ধক্য আমাকে
দেবে শান্তি, সান্ত্বনা, বিরাম।
কিংবা রিলকে থেকে :
পাতা ঝরে, পাতা ঝরে, শূন্য থেকে ঝ`রে প`ড়ে যায়,
যেন দূর আকাশে বিশীর্ণ হ`লো অনেক বাগান;
এমন ভঙ্গিতে ঝরে, প্রত্যাখ্যানে যেন প্রতিশ্রুত।
এবং পৃথিবী ঝরে প্রতি রাত্রে গতিপথচ্যুত,
নত্রশৃঙ্খল ছিঁড়ে– নিঃসঙ্গতায়।
আমরাও ঝ`রে যাই। এই হাত– তাও পড়ে ঝ`রে।
দ্যাখো অন্য সকলেরে : সকলেই এর অংশীদার।
কিংবা পাস্তারনাক থেকে :
তোমার কঠিন পণ ভালোবাসি আমি,
আমার ভূমিকার অভিনয়ে আছি সম্মত।
কিন্তু এবার এক ভিন্ন পালা শুরু হ`লো;
এই একবারের মতো দাও আমাকে নিষ্কৃতি।
কিন্তু অঙ্কগুলির পারম্পর্য অনড়
আর পথের শেষ আমাকে মুক্তি দেবে না;
নিঃসঙ্গ আমি; সব ডুবে গেলো ধর্মান্ধের শঠতায়।
মাঠ পেরোনোর মতো সহজ নয় বেঁচে থাকা।
তখন এইসব অসামান্য ও সপ্রাণ পঙ্ক্তিগুচ্ছ আমাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন, প্লাবিত, মুগ্ধ করে যে, মনে হয় কোথায় অনুবাদ, কোথায় বোদলেয়ার, হ্যেল্ডার্লিন, রিলকে বা পাস্তারনাক– এ যেন কবি বুদ্ধদেব বসুরই এক অন্তর্গত প্রগাঢ় স্বর। পেয়েছেন জাতীয় সন্মান পদ্মভূষণ পুরস্কার। তিনি মারা যানা ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ, কলকাতায়। তাঁর বইগুলোর মধ্যে আজকাল প্রকাশনী উদ্যোগ নিয়ে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আর শ্রেষ্ট গল্প প্রকাশ করেছে। সংগ্রহে রাখার মতো দুটি বই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন