পোস্টকলোনিয়াল বাঙালি মেয়েদের কবিতায় প্রান্তিক নারীমুখ
খনা যেদিন বচন লেখা শুরু করলেন সেই মূহুর্ত থেকেই বাঙালি মেয়েদের কবিতা লেখা শুরু, যে খনার খ্যাতি সহ্য করতে না পেরে স্বামী ও শ্বশুর মিলে তার জিভ কেটে নিয়েছিল মধ্যযুগের বাংলায় । বাঙালি ঘরের ছোটবেলায় মা দিদিমার কাছে আমরা সকলে শুনেছি এই কাহিনী, কিন্তু মোলায়েম সেই গল্পকথকের মধ্যে ভয়ঙ্কর ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের আভাসটকুও ছিলনা। আজ সে নিষ্ঠুর কিংবদন্তীর দিকে ফিরে তাকিয়ে ভাবি সেই বোবাকরণ শুধুমাত্র খনার ব্যক্তিগত দূর্ঘটনা ছিলনা বরং তা ছিল বাঙালি মেয়েদের কণ্ঠরোধের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া । ‘পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল’ – এর তত্ত্ব দিয়েই মধ্যযুগের সেই ঘটনাকে বুঝে নিতে হবে আমাদের । সেই থেকেই খনা আমাদের বাঙালি কবি লেখক মহিলাদের প্রান্তিকায়নের গোপন প্রতীকি আইকন । সময় পাল্টে গেছে, কিন্তু পোস্টকলোনিয়াল বাঙালি কবি মহিলাদের পাঠ্য খুঁজলে সেই বোবাকরণের রেশ আজও পাওয়া যায় । বাঙালি মেয়েদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় কিভাবে তারা এই ‘শোষণ সম্বন্ধে ও তার বিরুদ্ধে কথা বলার’ প্রক্রিয়ায় জড়িত এবং বাঙালি মেয়েদের কবিতায় সেই প্রান্তিকের প্রতিবাদ কিভাবে উঠে এসেছে, এসব খুঁজে দেখতেই নতুন করে পড়ে দেখছি কবিতা সিংহ, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, গীতা চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণা বসুর কিছু কবিতা আর তার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছি আমার নিজের লেখার অভিজ্ঞতাও । প্রান্তিক লিঙ্গের পক্ষ সমর্থনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং প্রান্তিকায়নের কিছু কিছু স্তরকে তুলে ধরার অনিবার্য তাড়ণায় কিছুটা সংকোচ হলেও লজ্জার মাথা খেয়ে নিজের কবিতার দুয়েকটি প্রসঙ্গ এনেছি। মেয়েদের যাপিত অভিজ্ঞতার কনটেক্সট ও কথামানবী-ক চেতনা নির্মিত হয়, এই দ্বিমুখি চলনকেই নতুন করে একটু ঝালিয়ে নিতে চাইছি এখানে ।
আমরা পোস্টকলোনিয়াল বাঙালি মেয়েরা কারা ? পোস্টকলোনিয়াল মেয়েদের কথা বলতে গিয়ে জিনা উইসকার বলেন, ‘আমরা আমাদের বিভিন্ন ভূমিকা যাপনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আলাদাভাবে নির্মিত, ভিন্নধরনের সাংস্কৃতিক পরিবেশে উৎপাদিত । মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক পটভূমির দ্বারাই নির্মিত ও প্রভাবিত হয় বলে সাম্প্রতিক নারীবাদী তাত্ত্বিকরা মনে করেন । ‘ একথা মাথায় রেখেই বলা হয় যে বাঙালি কবিমেয়েদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতেই তাদের পোস্টকলোনিয়াল অবস্থান নির্মিত হয় যা পশ্চিমী শ্বেতাঙ্গ পোস্টকলোনিয়াল মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার অবস্থান থেকে পুরো আলাদা এবং যাকে পশ্চিমী নারীবাদ বা শ্বেতাঙ্গ নারীর পোস্টকলোনিয়ালিজম কোনওটা দিয়েই ব্যাখ্যা করা যাবে না । ‘এ ক্রিটিক অফ দি পোস্টকলোনিয়াল রিজন : হিস্ট্রি অফ দি ভ্যানিশিং প্রেজেন্ট’ –এ গায়ত্রী স্পিভাক চক্রবর্তী বলেছেন যে ইউরো-আমেরিকান নারীতত্ত্বে তৃতীয় বিশ্বের নারী ভাষ্য অনুপস্থিত থাকে এবং ওই বিশ্বায়িত নারীতত্ত্বের সাহায্যে স্থানীয় নারী নিম্নবর্গকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না । আবার ‘আউটসাইড দি টিচিং মেশিন’এ স্পিভাক লেখেন, ফেমিনিস্ট ও পোস্টকলোনিয়াল উভয় তত্ত্বেই ‘প্রান্তিকীকরণ’কে পরমশব্দ ধরে নিয়ে সংস্কৃতি ও সাহিত্যের আলোচনা করা হয়, শোষণময় আধিপত্যের ছকে প্রান্তিকীকৃত অপর-এর অবস্থান করা হয় । মহাশ্বেতা দেবীর স্তনদায়িনী গল্পের দ্রৌপদী চরিত্রকে বোঝাতে স্পিভাক যে, ‘লিঙ্গ-নিম্নবর্গের নিঃসঙ্গতা’ ধারণা ব্যবহার করেন তার সাহায্যে ভারতীয় বাঙালি মেয়ের প্রান্তিকীকরণ ও স্থানচ্যুতির চালচিত্র ব্যাখ্যা করা সম্ভব । তার ভাষায়, ‘নিম্নবর্গ বলতে শুধু শোষিত বা অপরকে বোঝায় না, বরং বোঝানো হয় তাকে যে বানরের পিথেভাগ থেকে বঞ্চিত’। পোস্টকলোনিয়াল মতে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং প্রতিহত যেকোনও মানুষই নিম্নবর্গ ।
সুশীল নাস্তার একটি ব্যাখ্যায় দেখি যে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের সমাজে ‘নারীর আত্মজিজ্ঞাসা, মুক্তির সন্ধান ও সম্পূর্ণতার স্বপ্নকে বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল হিসেবে দেখানো হয়, শুধু সনাতন আচরণবিধি ও বিশ্বাসের প্রতি নয়, বরং জাতীয়তা ও স্বাধীনতার বৃহত্তর সংগ্রামের প্রতিও প্রতারণা হিসেবে । সুতরাং নারীবাদী হওয়ার মানে দাঁড়ায় আরেক প্রস্থ ভুমিহারানো না অন্য এক সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতি আনুগত্য দেখানো’ ।
স্বাধীনতা উত্তর বাঙালি কবিদের মধ্যে প্রথম উচ্চারিত নারীবাদী কবিতা সিংহ, কিন্তু সেইজন্যই পুরুশের-চোখে-লেখা বাংলা কবিতার বলয়ে তিনি ছিলেন প্রান্তিক ও ভূমিহারা । সমসাময়িক পুরুষ কবিদের গ্যালাক্সিতে তিনি কখনই সমান আসন পাননি। তাঁর ‘রাগী যুবতী’ চরিত্রগুলির বিষণ্ণতা ও প্রতিবাদ, রাগ ও স্পর্ধার নতুন ভাষ্য কখনই স্বীকৃতি পায়নি, না জীবদ্দশায় না তাঁর স্মরণসভায় । একটি শোকসভায় উপস্থিত থেকে নিজের কানে শুনেছিলাম তাঁর সমসাময়িকেরা রসিয়ে রসিয়ে তাঁর প্রেম কাহিনী আর শরীরের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে গেলেন, কিন্তু লেখার কথা কিছুই বললেন না । যে কারণেই হোক, সমসাময়িকেরা হয় তাঁর জেন্ডার পারস্পেক্টিভের গুরুত্ব বোঝেননি অথবা রাজনৈতিকভাবে সেটা অপছন্দ করেছেন বলেই, বাংলার প্রথম ফেমিনিস্ট কবি মারা গিয়েছেন স্বীকৃতিহীন, পুরস্কারহীন, স্থানচ্যুত, স্বর্গ থেকে নির্বাসিত ।
আমরা, পরবর্তী বাঙালিনী কবিরা প্রচুড় লড়াই করে পায়ের তলায় একটু মাটি জোগাড় করেছি ফলে আমরা নিজেদের আর বাংলা কবিতার কেন্দ্র-স্বর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করিনা । তবে মূলকেন্দ্রের সঙ্গে থেকেও মেয়েদের পাড়ায় পাড়ায় আমরা একটা নিজস্ব স্পেস তৈরি করে ফেলেছি, নিজেদের মধ্যে কথা বলার, নিজেদের কথা শোনার একটা মানবী-ক আড্ডা, যেসব কথা পুরুষ সঙ্গীরা শুনতে চায়না তেমন অনেক নীরব কোথায়, নিঃশব্দ উচ্চারণে মুখর সেই স্পেস । লেখার জোরে ও অভিজ্ঞতার অনন্যতায় আমাদের নারীস্রস্টারা কেন্দ্রে কিছুটা পাত্তা আদায় করে নিতে পেরেছেন ঠিকই কিন্তু যে কোনঠাসা অবস্থার মধ্যে গ্রামে ও শহরে এখনও প্রতিদিন কয়েক হাজার পোস্টকলোনিয়াল বাঙালি মেয়ে বাঁচার লড়াই করছে, প্রান্তিকায়নের সেই নানামাত্রিক ধূপছায়া আমাদের লেখার অক্ষরে অক্ষরে আজও দীর্ঘায়িত হয় । নিজেরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছেছি বলেই বাকি প্রান্তিক মেয়েদের অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটিয়ে আমরা লিখতে পারিনি, পারি না । কোথাও না কোথাও আজও সেই কোনঠাসাদের হাসিকান্নার সঙ্গে মিলে যায় আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাও । কালোমেয়েদের লেখার কথায় সারা সুলেরি বলেছিলেন, ‘ওঁরা শোষণকে একটি বাচনিক দোটানায় সংকেতায়িত করেছেন, অর্থাৎ, ওঁরা ওদের লেখায় অনবরতই তুলে এনেছেন ক্ষমতা ও বাচনের সঙ্গে কালো মেয়েদের সম্পর্কের প্রসঙ্গগুলি’, (suleri, 1992, in Christian and Williams, eds, Colonial Discourse and post Colonial Theory, Hemel Hempstead: Prentice Hall, 1993, p.263) ঠিক যেরকম এশীয় লেখিকাদের মধ্যেও বারবার উঠে এসেছে ‘শোষণ ও তার বিরোধিতার মেয়েদের ভূমিকা’র কথা । (suleri in Wisker,ibid, p.134)
স্পিভাক প্রশ্ন তুলেছিলেন নিম্নবর্গ কি কথা বলতে পারে ? তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত ছিল, না, নিম্নবর্গ কথা বলতে পারে না, এই অর্থে যে তাদের স্বর কারও কানে পৌছয়না । কিন্তু যখন নিম্নবর্গ ও বিশেষত নারী-নিম্নবর্গের লেখায় ক্ষমতাচক্রের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত উঠে আসে, যখন তারা দেশ, ঘর, পরিবার, মাতৃভূমি ও দাম্পত্য বিষয়ে বিকল্প ভাষ্য রচনা করে তখনই নির্মিত হয় প্রান্তিকের বিকল্প পরিসর । পোস্টকলোনিয়াল বাঙালিনী কবিদের লেখায় নারী-নিম্নবর্গের ইটচাপা স্বর ক্রমশ শ্রুতিগোচর হচ্ছে এবং তাদের বিকল্প পরিসর ক্রমশ কেন্দ্রভূমিতে ঢুকে পড়েছে । তাদের কবিতার অক্ষরে বারবার উঠে এসেছে প্রান্তিক, ভূমিহারা, কোনঠাসা বাঙালি মেয়েদের মুখ, নিজেরা শক্তি বলয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েও ওই ম্লানমুখগুলিকে ভুলতে পারেন নি কবিরা বরং তাদের ম্লান মূক মুখে ভাষা দেওয়ার দায় বোধ করেছেন । নাগরিক পোস্টকলোনিয়াল বাঙালি মেয়েদের এই সব কবিতা আসলে যন্ত্রণা ও লড়াইয়ের এক অসমাপ্ত অশ্রুভাষা যেখানে বাংলার কয়েক হাজার নিম্নবর্গ মেয়ে কথা বলে ওঠে । এই লড়াই কারও একার লড়াই নয়, এই অশ্রু কারও একার নয় । বাংলা কবিতার অভ্যস্ত ভাষা ও চিত্রকল্প আমূল পাল্টে দিয়ে কবিতা সিংহ যখন লেখেন,
“মা, হাতের উল্টোপিঠে মুছে নিয়েছি শেষবারের মতো
দুচোখ ছাপিয়ে নামা, চোখের জলের বৃথা দাগ
বেণীর সাটিন খুলে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে গেছি আমি
অশ্বক্ষুরে ঝনঝন নারীদের দর্পণ ফাটায়ে
খরকরবালে একা, পিতার রক্ষিতার মুণ্ড এনে দিতে ।”
তখন এই অক্ষরগুলিই পিতার-রক্ষিতা-জর্জরিত-শৈশব বহু বালিকার মনের কথা হয়ে ওঠে । অথবা নবনীতা দেবসেনের কবিতায় লায়নটেমারকে লক্ষ্যে করে কথা বলা আহত কোনঠাসা সিংহটি কখন যেন প্রতিরাতে মার খাওয়া মেয়েদের প্রতীক হয়ে ওঠে,
“মনে থাকবে না ? বাঃ ! সবগুলো
চাবুকের দাগ, যত কালশিটে, সব
বাদামি চামড়ার নিচে ঢাকা ।
খুব মনে আছে ।
একবার সপাৎ শুনলে, দুই পায়ে খাড়া
দু’থাবায় ভিক্ষে চাওয়া । সপাৎ সপাৎ
শুনলে কেশর টেশর শুদ্ধ শানের মেঝেয়
গড়াগড়ি, গড়াগড়ি, শীতগ্রীষ্ম
নেই । তিনবার সপাৎ শুনলে ? নির্দ্বিধায়
আগুনের ব্যূহের ফাঁদেও চমৎকার ঝাঁপ দিই । আবার ?
আবার –
“খুব মনে আছে
কানে কানে নেশাতুর আদুরে সপাৎ -
অক্লেশে লাফিয়ে পড়ি দাউদাউ
জ্বলন্ত বলয়ে । আবার ?
আবার –
অন্ধকার থেকে
নিশিডাক বেজে ওঠে, শৃঙ্খলের মতো
ঝমঝম করতালি আস্টেপৃষ্ঠে
সর্পিল জড়ায় – দুচোখ
ধাঁধিয়ে দেয় অলাতচক্রের
মায়াদ্যুতি, এমনকি আগুনও
কিছু নয় । রিং মাস্টার,
ভুলিনি কিছুই । মনে নেই
শুধু পূর্বনাম । মনে নেই
অরণ্য কেমন ?”
(লায়নটেমারকে : নবনীতা দেবসেন)
কত মেয়ের মুখে ঠিক এই ভাষায় তাদের দাম্পত্যের বর্ণনা শুনেছি, এক্সিকিউটিভের স্ত্রী থেকে রাঁধুনি মাসি । তারা যে কথা বলতে পারেনি, চুপিচুপি বলে হালকা হতে চেয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা কবিতায় কথা বলে উঠেছে। মেয়েলি আড্ডার নিভৃত আলাপে উঠে আসা এই সব করুণ মূহুর্তগুলিই নারীকবির টেক্সট নির্মাণ করে । কনটেক্সট ও টেক্সটের মধ্যে নারী-অভিজ্ঞতার এই অনায়াস যাতায়াতে তথাকথিত ‘শাশ্বত বিসয়মুখি’ সাহিত্যের পরিবর্তে তৈরি হয় আত্মমুখি নারীকেন্দ্রিক রচনার এক বিকল্প জাঁর ।
দাম্পত্যে ও পরিবারে প্রান্তিকায়িত নারী:
১৩০৫-এর বাংলায় এক ঘোমটার আড়ালে এক গৃহবধূর জীবন কি রকম ছিল ? গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় দেখি রাসসুন্দরী দেবীর বউজীবন, যখন কর্তার সামনে যাওয়ার তো কথাই ওঠে না, কর্তার ঘোড়া এসে উঠোনে দাঁড়ালেও লজ্জায় মরে সে । সদর ও অন্দরের, পাবলিক আর প্রাইভেটের বিভাজন এত প্রগাঢ় যে কর্তার ঘোড়া তার কাছে হয়ে ওঠে কর্তার প্রতিভূ,
“উঠোনে ধানের রাশি খেয়ে যায় মহিমায় ঘোড়া
কর্তার ঘোড়ার সামনে কী করে বা যেতে পারে নারী
যদি দেখে ফেলে সেই ঘোড়ার ভিতরে অধিকারী
অবাধ আলোয় দেহ এক উঠোন ধানের সন্তোষে ?
আমি যে দেখিনি তাকে কখনও রৌদ্রের দুঃসাহসে !
বকুলফুলেরা জানে, দেখনহাসিরা সব জানে,
কখনও দেখিনি তাঁকে হাওয়ার নির্ভীক অকল্যাণে
এমন স্বচ্ছন্দ আর অবাদ ঘোমটার পরপারে
নীলাজ নয়ন মেলে এক-উঠোন ধানের সংসারে ।
নষ্ট মধ্যাহ্নের বেলা রাশিরাশি ধানে যায় ভেসে
কর্তার প্রতিভূ ঘোড়া আঙিনায় দুয়ার আটকিয়ে
দাঁড়িয়েছে সব ঢেকে তেরশো পাঁচের বাংলাদেশে ।”
(কর্তার ঘোড়া দেখে রাসসুন্দরী : গীতা চট্টোপাধ্যায় )
১৩০৫ থেকে একশ বছর পেরিয়ে এসে এখনও দাম্পত্যের ভেতরে নারীর প্রান্তিকায়ন বহুমাত্রিক । এমনই এক কোনঠাসা মেয়ের মুখে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে লিখেছিলাম একটি কবিতা, সেটা কতটা কবিতা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ থাকেলও অভিজ্ঞতাটুকু সন্দেহাতীত,
“মশারি গুঁজে দিয়ে যেই সে শোয় তার
স্বামীর কালো হাত হাতড়ে খুঁজে নিল
দেহের সাপ ব্যাঙ, লাগছে ছাড় দেখি
ক্রোধে সে কালো হাত মুচড়ে দিল বুক
বলল, শোন শ্বেতা, ঢলানি করবে না
কখনও যদি ওই আকাশে ধ্রুবতারা
তোমাকে ইশারায় ডাকছে দেখি আমি
ভীষণ গাড্ডায় তুমিও পড়ে যাবে,
শ্বেতার শ্বেত ঊরু শূন্যে দুলে ওঠে
আঁকড়ে ধরে পিঠ, স্বামীর কালো পিঠ ।
(স্বামীর কালো হাত : লেখক)
প্রতিদিন প্রতিরাতে শোয়ার ঘরে রান্নাঘরে সদরে অন্দরে কোনঠাসা হতে হতে কেউ বেঁচে থাকে, কারও মৃত্যু হয় । জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘কত কৃষ্ণজননীর মৃত্যু হল রক্তে উপেক্ষায়’ । তিলে তিলে সেই মৃত্যু কিভাবে হয় ? মৃত্যুর পর কি হয় ? কৃষ্ণা বসুর কবিতা ‘মেয়েমানুষের লাশ’এ তার করুণ ছবি,
“সাঁকোর কিনারে এসে আটকে আছে লাশ
মেয়েমানুষের লাশ;
আটকে আছে, বেরুতে পারছে না ।
তার মুখ ফেরানো রয়েছে সন্তানের দিকে,
তার মুখ ফেরানো রয়েছে সংসারের দিকে,
তার মুখ ফেরানো রয়েছে পুরুষের দিকে,
প্রহারে প্রহারে তাকে পর্যুদস্ত করে গেছে যে পুরুষ
তার মুখ ফেরানো রয়েছে তার দিকে ।
বোকা অভিমানী আদর-কাঙালি মুখ
ফেরনো রয়েছে আজও জীবনের দিকে ।
সাঁকোর কিনারে এসে আটকে আছে লাশ,
মেয়েমানুষের লাশ;
আটকে আছে, বেরুতে পারছে না ।
(মেয়েমানুষের লাশ : কৃষ্ণা বসু)
প্রজনন প্রযুক্তিতে প্রান্তিকায়িত নারী:
“যে মেয়ে দাঁড়িয়েছিল নিজেরই যোনীতে দু’পা রেখে
যে মেয়েটি মেরুদণ্ড দুহাতে বাঁকিয়ে ধরেছিল
সে আজ পেরেছে তার দেহ থেকে ছিটকে দিতে ধাতু
সোনার পীড়িত গর্ভ শোভা পাচ্ছে দোকানে দোকানে
আজ তার মুক্তিদিন, আজ তার শোণিত-উৎসব
প্রজাপতি হয়ে গেছে ঠোঁটদুটি, অভ্র মাখা ডানা
উড়ে গিয়ে বসছে দুই অন্ধ চোখে, সুগন্ধি ঘিলুতে
আঙুলে আঙুলে তার ছটফটিয়ে উঠছে দশটি নদী –
জঙ্ঘা ও কুনুই বলছে পরস্পরে : সে কই ! সে কই !
সে মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে নিজের বুকেই মাথা রেখে – ”
(গর্ভপাত : মন্দাক্রান্তা সেন)
গর্ভপাত একটি পুরোপুরি পোস্টকলোনিয়াল বিষয়, যা একদিক থেকে মেয়েদের নতুন এক স্বস্তি ও নিজস্ব প্রজননচক্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে আবার অন্যদিকে অন্য কিছু মেয়ের কাছে সেটাই হয়ে উঠেছে অস্বস্তি ও বিমর্ষতার উৎস । গর্ভপাতের বিপদ ও যন্ত্রণা শুধুমাত্র মেয়েদের শরীরমনের ওপর দিয়েই বইতে থাকে, প্রজনন প্রযুক্তির অধিকাংশ ধকল মেয়েরাই বহন করে, তাই তাদের শরীর ভেঙে যায়, মন খারাপ হয় । বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের ‘বিজ্ঞাপন’ কবিতায় দেখি গর্ভপাত কিভাবে বাণিজ্যসফল হয়ে ওঠে, বিজ্ঞাপন কিভাবে এক শরীরে পাঁচবার গর্ভপাতের সম্ভবনা প্রচার করে, কিভাবে তা একটি নারীকে বিমর্ষ করে তোলে । কবিতার মেয়েটির গর্ভপাত বা ভ্রূণমোচন করতে হয়েছে, হয়তো পেটে কন্যাভ্রূণ ছিল বলেই, গভীর বিষণ্ণতায় নিজের শরীরের মধ্য থেকে উঠে আসা একটি কণ্ঠস্বর শোনা যায় সে,
“গর্ভপাত তাহলে সম্ভব পাঁচবার
বিজ্ঞাপন এমত লিখেছে
ছসপ্তাহে নস্টগর্ভ বউ
তবে কাঁদলি কেন
কেন স্তন মুখে
লেগেছিল পল্লবের কালো ?
উদরে ঘুরিয়ে রাঙা হাত
আগ্রাসী অপত্য স্নেহে গ্রহণের ছায়া
ও রাক্ষুসি, ধর্মে নইবে না
ভ্রূণকন্যা ফিরবে বারবার
বারবার উন্মুক্ত তোকে
যেতে হবে দুর্গন্ধ ক্লিনিকে ।
(বিজ্ঞাপন : বিজয়া মুখোপাধ্যায়)
ভারতীয় সমাজে নারীর প্রান্তিকায়নের এই কর্কশ ছবি থেকে বোঝা যায় কেন নারীপুরুষের সমানুপাতিক জাতীয় হারে মেয়েরা কেন ক্রমশই কমে যাচ্ছে । অনেক পরিবারই কন্যাসন্তান চায় না আর তাদের মধ্যে নিস্থুরতমরা কন্যাভ্রুণের গর্ভপাত ঘটায় । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রবল পিতৃতান্ত্রিক হিসেবনিকেশের বিরুদ্ধে জননী বেচারা গলা তুলতে পারে না, কারণ তার কথা কেউ শোনেনা, নিম্নবর্গের কথা শোনা যায় না । কোনও কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ভয়ঙ্কর নারীবিদ্বেষের জন্যই জনগণনায় মেয়েদের সংখ্যা কমেছে, ২০০১-এর সেনসাস রিপোর্টে ১০০০ পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা ৯৩৪ । এক হাজারে ছেষট্টিজন মেয়ে কম পড়লে একশো কোটির দেশে কতকোটি মেয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে অপুষ্টিতে, অবহেলায়, উপেক্ষায়, নিষ্ঠুরতায়, ভ্রূণহত্যায়, গণহত্যায়, গার্হস্থ্য হিংসায় তার অঙ্ক বড় ভয়ঙ্কর । এই সব হারিয়ে যাওয়া মেয়েরা কথা বলে মেয়েদের কবিতায় ।
“আঙুল প্রমাণ এক প্লাস্টিকের মেয়ে,
কে ফেলে দিয়েছে তাকে,
স্বপ্নে বলেছিল –
আগে আমি লম্বা ছিলাম,
বাঁশের কোঁড়ের মত শাড়ি পড়তাম,
তারপর অচেনা অসুখে খুব ছোট হয়ে গেছি
তাই আমি ফ্রক পরি ।
গালে ঠোঁটে ফুটো
গলায় পুঁতির দাগ পুতুল মেয়েটি
সেই ভূতেদের কাছে চুপিচুপি বলেছিল ।”
(ভূতেরা ও খুকি : দেবারতি মিত্র)
খুন হয়ে যাওয়া অজস্র মেয়েরা হয়তো এভাবেই চুপিচুপি কিছু জানতে চায়, জেন্ডারড সাবঅলটার্নের যে বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না । তারা শবের মতো নিঃশব্দ,
“প্রার্থনা শুরুর ঘণ্টা –
আমরা সারি বেঁধে চলেছি
প্রত্যেকের আপাদমস্তক ঢাকা
শোকের কালো পোশাকে
আমরা প্রত্যেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি
একটা করে কফিন
কফিনে আমাদের নিজেদের শব
প্রার্থনাসঙ্গীত শুরু হবে – ঘণ্টা বাজছে
আমরা শোকে স্তব্ধ, স্বর ফোটে না –”
(শব্দহীন : পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়)
এই সব সারিসারি কফিনে যেন খনার শব, খনার পোস্টকলোনিয়াল কন্যা ও শিশুকন্যাদের,
“ভ্রূণহত্যার দেশে এসেছি হঠাৎ
শিশুকন্যা ভ্রূণগুলি খুন নিখুঁত আঙুলে !
সুসভ্যতা উঠে এসে প্রাণপণে টিপে ধরে
অজাত কন্যার কচি টুটি ।”
(কন্যাভ্রুণ : কৃষ্ণা বসু )
অর্থনৈতিক-সামাজিক-লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনে প্রান্তিকায়িত নারী
“এ সংসার । গৃহাগ্নি এ । একে তুষ্ট করে রাখা আমাদের কাজ ।
রান্নাঘর তুষ্ট রাখি, আগুনের প্রভু তুষ্ট রাখি ।
যথাসাধ্য জ্বালানি দিই –
হাত-পা কেন, ক্রমে ক্রমে সমগ্র শরীর
আমাদের চুলো জুড়ে দীপ্তি দেয় । ছাই জমে ওঠে ।
ছাই মানে যা যা মেয়েদের কাজ, যেমন সন্তান ”
(দাম্পত্য : সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়)
পূর্বজাদের মতো পোস্টকলোনিয়াল মেয়েদেরও বসন্তের দিন ঝরে যায় উদয়াস্ত গৃহশ্রমের জোয়াল বইতে বইতে, যদিও প্রথাগত অর্থনীতিবিদরা গৃহশ্রমকে শ্রমের মান্যতা দেন না, তাঁর না আছে মজুরি না মর্যাদা । শ্রমবিভাজনের এই লিঙ্গবৈষম্যবাদী কাঠামো প্রতিমূহুর্তে মেয়েদের কোনঠাসা করে, এমনকি পরিবারে ও অর্থনীতিতে তাদের ভূমিহারার পর্যবসিত করে । গতানুগতিক পিতৃতান্ত্রিক শ্রমবণ্টনের এই ছকে নারীর গৃহশ্রম কখনই পুরুষের শ্রমের সমান গণ্য হয় না, এবং ফলে গৃহরচনাকারিণী নারী কখনই খাদ্যযোগানকারী পুরুষের সমান হতে পারে না । পতি-পরম-গুরু গৃহকোণে রচিত হয় উত্তম-পুরুষ আর অধম-নারীর হায়ারার্কি ।
“কষে বাঁধন দাও । আদেশমতো ঘরসংসার করব ।
হিসেব লিখব – রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করব
আঠারোমাস, এসব ছাড়া গৃহিণীর মান ইজ্জত
থাকে !”
(একটি লেখা:সেবন্তী ঘোষ)
গৃহিণীদের পক্ষ থেকে অসম শ্রমের প্রতি শ্লেষ উঠে আসে পোস্টকলোনিয়াল মেয়েদের কবিতায়,
“ তোমরা যারা বেরোজগেরে, চাকরিবিহীন, জানছ মনে মনে
ওই লোকটা ধন্য হচ্ছে টাকার গোছা হাতে তুলে দিয়ে
তোমরা যারা ডিপেন্ডেন্স তৈরি করছ ওষুধ জলের গ্লাসে
তোপসে মাছে, লাউয়ের ঘণ্টে, তোমরা যারা শরীরি মায়ায়
ঢলে পড়ছ, রাত জাগছ, কালকে ছেলের পরীক্ষা, আজ জ্বর
তোমরা যারা অনায়াসে নষ্ট করছ মানব সম্পদ
তোমরা যারা শ্রমিকশ্রেণী গৃহে গৃহে অন্দরে অন্দরে
তোমরা যারা সবাই মিলে পা ছড়িয়ে গোল হয়ে বসেছ
পরস্পরের গয়না দেখছ, শাড়ির বুনোট ধরে দেখছ, ধরে –
তোমরা, যারা ইচ্ছে করেই ছবিটা বদলাতে চাইছ না
একটিবার বদলে ফেললে কার ভালো কার মন্দ চুলোয় যাক
আর যাই হোক ও লোকগুলো হুইস্কি রাম আর বাদামভাজা নিয়ে
নিশ্চিন্তে আরাম করে নীচের ঘরে উজির মেরে
এত সময় কাটাতে পারত না –
(মেয়েদের প্রজাতন্ত্র ১ : যশোধরা রায়চৌধুরী )
কার্ল মার্কস নারীর গৃহকাজের স্বপক্ষে অনেক কথা বললেও শেষপর্যন্ত শ্রমের মর্যাদা দেন নি, এ নিয়ে সত্তর দশক থেকে নারীবাদী তাত্ত্বিকরা জোরালো প্রতিবাদ করেছেন । গৃহকাজে মা-দিদিমার চিরাচরিত অসাম্যের অভিজ্ঞতাটিই নতুনভাবে তত্ত্বের বাদপ্রতিবাদের মধ্য দিয়ে উত্তেজিত করেছিল আমাকে, তার ফল ছিল মার্কসকে খোলা চিঠির আকারে লেখা একটি কবিতা ।
“ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল
দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গম বোনা শুরু করেছিল
আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন করেছিল শিশু
সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে ?
আপনি বলুন মার্কস, কে শ্রমিক কে শ্রমিক নয়
নতুন যন্ত্রের দ্বারা মাসমাইনের কারিগর
শুধু তারা শ্রম করে !
শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল
সেই শ্রমগৃহিণী
প্রতিদিন জল তোলে, ঘোর মোছে, খাবার বানায়
হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে রাত হলে
ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে
সেও কি মানুষ নয় !
আপনি বলুন মার্কস শ্রম কাকে বলে !
গৃহশ্রমে মজুরি হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু
ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে
আর কমরেড শুধু যার হাতে কাস্তে হাতুড়ি !
আপনাকে মানায় না এই অবিচার
কখনও বিপ্লব হলে
পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাষ্ট্রহীন আলোপৃথিবীর সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে ?
প্রান্তিকায়নের বিরুদ্ধে নারী :
বাংলার অবলা বউ-মেয়েদের উঠোনে পাখি অবিশ্রাম ডাকছিল : বউ-কথা-কও । অবশেষে বউয়ের মুখে বোল ফোটে, বাংলার প্রান্তিকায়িত বধূকন্যারা চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে হেজিমনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখে । অনেকদিন ধরেই কবিতায় এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, কবিতা সিংহের ‘ঈশ্বরকে ইভ’ এমনই একটি বোল-ফোটা কবিতা । পিতৃতান্ত্রিক প্রান্তিকীকরণের প্রতিরোধ করতে বাইবেলের ইভের সঙ্গে নিজের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে নিয়েছেন তিনি । ইভের গলায় আমরা শুনতে পাই নিষেধ আর নৈতিক পাহারাদারির বিরুদ্ধে বাঙালি মেয়েদের কণ্ঠস্বর, যারা সমাজের গণ্ডিতে বাঁধা সীমায়িত স্বাধীনতার বিশ্বাসী নয়। যারা বুঝতে পেরেছে ঈশ্বর/পুরুষকে মান্য করা বা না করার সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই নিতে পারে । ইভের আত্মোপলব্ধির এই কবিতাই বাংলা কবিতায় নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম উচ্চারণ, নিম্নবর্গ অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি নারী এখানে প্রতিবাদের নতুন ভাষার কথা বলে,
“প্রিয় আমার, হে ক্রীতদাস
আমিই প্রথম ব্রাত্য নারী
স্বর্গচ্যুত, নির্বাসিত
জেনেছিলাম
স্বর্গেতর স্বর্গেতর
মানবজীবন মানবজীবন
জেনেছিলাম
আমিই প্রথম”
(ঈশ্বরকে ইভ : কবিতা সিংহ )
প্রত্যয় ও বিদ্রোহের এই নতুন মানবিক ভাষ্য থেকেই ‘স্বর্গচ্যুত নির্বাসিত’ বাংলার প্রান্তিকাদের কথা বলা শুরু । পোস্টকলোনিয়াল বাঙালি মেয়েদের কবিতায় ঘর ও পরিবার, শ্রম ও গৃহশ্রম, নিগ্রহ ও গর্ভপাত, নারী ও পুরুষ বিষয়ে বিকল্প এইসব ভাষ্য থেকেই শুরু হয় এক রাজনৈতিক লড়াই যা লিঙ্গকেন্দ্রিক আধিপত্যবাদের মহাকাহিনীকে নড়িয়ে দিতে পারে । পাকিস্থানের এক কবির কাছে শুনেছিলাম ওখানে মেয়েরা লিখতে শুরু করলে বলা হয়েছিল, গজল বা শায়েরি তো মাসুক তার মাসুকার উদ্দেশ্যে লেখে, মেয়েরা কি করে শায়েরি লিখবে ? উপমহাদেশের মেয়েরা যখন থেকে লিখতে শুরু করেছে তখন থেকেই পাল্টে গেছে এই শায়েরি-পলিটিক্স, গল্পটা পাল্টে যাচ্ছে । প্রান্তিকায়িত মহিলাদের না বলা কথাকে ভাষা দেবার জন্য বিশেষ ভূমিকা নিয়েছেন নারী কবিরা, তাদের কবিতার মধ্য দিয়েই ওই প্রান্তিকারা এতদিনের ঔপনিবেশিক নৈঃশব্দ ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন, তৈরি করেছেন কোনঠাসাদের উত্তর- ঔপনিবেশিক বহুস্বর। প্রভুর ভাষ্য ও পিতৃতান্ত্রিক মহাগল্পগুলিকে বর্জন করে তারা তৈরি করে নিচ্ছেন নিজেদের মৃদুভাষ্য ও ছোটকাহিনীর বিকল্প বলয় । জিভ কেটে রক্তক্ষরণে খনার মৃত্যু হলেও তার পোস্টকলোনিয়াল কন্যারা প্রান্তিকায়নের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে শিখেছে, বাংলা মেয়েদের কবিতার অক্ষরে অক্ষরে বোবাকরণ ও প্রান্তিকায়নের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের ছাপ আছে ।
যাঁদের কবিতা উদ্ধৃত হয়েছে :
কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেন, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, গীতা চট্টোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, কৃষ্ণা বসু, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, যশোধরা রায়চৌধুরী, মন্দাক্রান্তা সেন, সেবন্তী ঘোষ, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, ও এই অধম লেখক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন