আবদুল মান্নান সৈয়দ
৭২ বছর বয়সে তরুণদের লেখা আর পড়া হয় না তেমন। উপায় নেই। তবু বছর কয়েক আগে তরুণদের কিছু গল্প-উপন্যাস পড়তে হয়েছিল। এদের কারো কারো নতুনত্ব আছে। একটি বিষয় লক্ষ্য করে অবাকই হয়েছিলাম, এদের অনেকেই সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর ধারাবাহিকতায় পুষ্ট ও বর্ধিত হচ্ছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে যার লেখা আমাকে বিষ্মিত ও আশান্বিত করেছিল তিনি হচ্ছেন শহীদুল জহির। এতেও একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম, আমাদের সমসাময়িক বন্ধু প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং অন্য বহু গুণে গুণান্বিত হায়াৎ মামুদও শহীদুল জহিরের লেখা পছন্দ করেছিলেন। যে বইটি আমাদের দু'জনেরই পরস্পরের অজ্ঞাতসারে ভালো লেগেছিল, সেটি হচ্ছে শহীদুল জহিরের গল্পগ্রন্থ 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প'।
শহীদুল জহিরের প্রশংসা শুনি কিন্তু এর বেশ আগে। শিল্পতরু থেকে আবিদ আজাদ প্রকাশ করেছিল তার উপন্যাস 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল'। শিল্পতরু পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলাম আমি। কিন্তু ওই বই যখন বেরোয় তখন আমি ওই পত্রিকা থেকে সরে এসেছি, যদিও নাম ছাপা হয়ে যাচ্ছিল। প্রাবন্ধিক-সমালোচক-শিশুসাহিত্যিক আহমাদ মাযহারদের মুখে ওই বইটির সুনাম শুনতাম। কিন্তু একই সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর ধারাবাহিকতার কথাও শোনা যেত। 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' নামটিও সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর স্মারক। সে জন্য আমি বইটি পড়ার খুব একটা চাড় বোধ করিনি। কিন্তু 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প' পড়ে মনে হয়েছিল, ওয়ালীঊল্লাহ প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে উপস্থিতি সত্ত্বেও শহীদুল জহির নতুন কিছু করেছেন। এখানেই তার স্বকীয় কৃতিত্ব।
সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ খুব বেশি গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখেননি। আমাদের তদানীন্তন কথাশিল্পীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে শক্তিশালী। তার ধারাবাহিকতা অংশত সৈয়দ শামসুল হকে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসে, শহীদুল জহিরে এবং তরুণ কথাশিল্পীদের মধ্য দিয়ে চলেছে। সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর গল্প-উপন্যাস-নাটকের তিলতম প্রভাব নেই পশ্চিমবাংলার কথাসাহিত্যে। পশ্চিমবাংলায় তার বইপত্র কিছু প্রকাশিত হলেও তিনি তেমনভাবে স্বীকৃত বা প্রচারিত হননি। অথচ তার উত্থান ও বিকাশ কিন্তু পশ্চিমবাংলাতেই। আমি তার সমসাময়িক কথাশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে একবার কলকাতায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওয়ালীঊল্লাহর লেখা তিনি পড়েছেন কি-না। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী তার নামই শোনেননি মনে হয়েছিল। কলকাতাতেই দেখেছিলাম সুগভীর প্রাবন্ধিক-সমালোচক দেবীপদ ভট্টাচার্যের অগাধ শ্রব্দা সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর প্রতি। একবার তিনি ট্যাক্সিতে বাসায় ফিরতে ফিরতে সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসের নামটির অসামান্য একটি দীর্ঘ বিশ্লেষণ করেছিলেন আমার কাছে। তিনি তখন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ওই বিবেচনা লেখার সময় ছিল না তার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার দেবীপদ ভট্টাচার্য ওয়ালীঊল্লাহ সম্পর্কে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকায় তা মুদ্রিত হয়েছিল। দেবী বাবুর অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম। আমি প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ করি শিল্পতরু পত্রিকায়।
ওয়ালীঊল্লাহ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ আমি রচনা করি, 'সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ' (১৯৮৬/২০০১)। সেই অধিকারে, আশা করি এ কথা বললে অপরাধ হবে না যে, সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ ছিলেন না সমরেশ বসু। কেন একথা লিখলাম, সেটা পরে বলছি।
তখন আমার সামনে শহীদুল জহিরের দুটি গল্পগ্রন্থ 'শহীদুল জহির নির্বাচিত গল্প' (২০০৬) এবং 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প' (২০০৪)। এ দুটি গল্পগ্রন্থে গল্পের সংখ্যা মাত্র ২০টি। তার মধ্যে 'আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস' দুটি গ্রন্থেই আছে কাজেই এটি জমবে আরো। 'চতুর্থ মাত্রা' গল্পটিও আসলে গল্প নয় একাঙ্ক নাটক। আবার ওয়ালীঊল্লাহ স্মরণীয়। ওয়ালীঊল্লাহ কিছু একাগ্ধক নাটক লিখেন। গল্প ও একাগ্ধক নাটক সহবাসী। এক সময় গল্পকাররা একাঙ্ক নাটকও লিখতেন। অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, বনফুল, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ, সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রমুখ চমৎকার সব একাঙ্ক নাটক লিখেছেন। আকাশ-সংস্কৃতির পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে এ চমৎকার সাহিত্য মাধ্যমটি লুপ্তপ্রায়। শহীদুল জহিরের আরো গল্প থাকতে পারে। আপাতত এ ১৮টি গল্পই পাচ্ছি।
দুটি বই, কিন্তু আসলে শহীদুল জহিরের তিনটি গল্পগ্রন্থ : 'পারাপার', 'ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প'। এই দুটি বই নিয়ে 'শহীদুল জহিরের নির্বাচিত গল্প' বইটি সংকলিত হয় আর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ 'ডলু নদীর হাওয়া...'।
দেখা যাচ্ছে : শহীদুল জহিরের প্রথম গল্পগ্রন্থের রচনাকাল বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক; দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থের রচনাকাল ওই শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক আর তৃতীয় গল্পগ্রন্থের রচনাকাল (একটি গল্প বাদে) একবিংশ শতাব্দীর প্রথম/শুন্য দশক।
শহীদুল জহিরের জীবৎকাল ১৯৫৩-২০০৮। বয়সের হিসেবে, লেখার হিসেবেও, তিনি সত্তরের দশকের। কিন্তু তার পরিচিতি ঘটে বেশ পরে। আদি গল্প রচনার কাল ১৯৭৪ এবং অন্তিম গল্প রচনার কাল ২০০৩। এই তিরিশ বছরে ব্যাপ্ত ১৮টি গল্পে তিনি কত পরিণত হয়েছেন সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ১৯৭৪ সালে রচিত 'ভালোবাসা' এবং ২০০৩ সালে প্রণীত 'ডলু নদীর হাওয়া'র মধ্যে অনেক ব্যবধান। আবার তার তাবৎ গল্প থেকে শহীদুল জহিরের একটি চারিত্রই উদ্ভাসিত হয় সমাজের অন্তবাসী মানুষের জীবনযাপনের চিত্রনই তার লক্ষ্য। বহির্জীবনই অনেকখানি, তারই মধ্য দিয়ে অন্তলোকে যাত্রা। এ বহির্জীবনের পটভূমি বাংলাদেশ, শুধু ঢাকা শহর নয় ঢাকার বাইরেরও কোনো কোনো স্থান নির্বাচন করে নিয়েছেন এবং গভীর সততা ও নিবিষ্টতার সঙ্গে তার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন।
'ভালোবাসা' এবং 'ডলু নদীর হাওয়া' গল্প দুটির অতি সংক্ষিপ্ত একটি বিচার এখানে উপস্থাপন করা যাক।
তার প্রথম গল্কেপ্পই ছোটগল্কেপ্পর লিখনকুশলতা তার সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত। 'ভালোবাসা' গল্পের সূচনা বিন্দু 'বাবুপুরা বস্তির গলির মুখে আসতেই মওলার চোখে পড়ে গেল হাফিজদ্দি।/কি করে হাফিজদ্দি, ওইটা কইথন আনলি? চিৎকার করল মওলা' থেকে গল্পের উপাত্ত বাক্য 'উবু হয়ে আসা আবেদার ঠোঁট তহুরার কপাল ছোঁয়' পর্যন্ত একেবারে টান-করে-বাঁধা। মাত্র ৫ পৃষ্ঠা গল্প, কিন্তু অন্তর্গত ব্যাপ্তি অনেক। হাফিজদ্দি, তার স্ত্রী আবেদা ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে, আর ওদের কন্যা তহুরা এই তিনজনকে ঘিরে গল্পটি আবর্তিত। মওলা ওদের বস্তির পান-সিগারেটের দোকানদার, চেনা প্রতিবেশী। যে জিনিসটা নিয়ে এসেছিল হাফিজদ্দি, সেটা বস্তিতে কেউ আনে না, একটা একান্ত হলদে রঙের ডালিয়া ফুল। এই ডালিয়া ফুলটাই গল্পের কেন্দ্র। ওদের দারিদ্র্যমথিত জীবনে এক বিষ্ময়ের মতো উদিত হয়। বর্ণনা অল্প, কিন্তু লক্ষ্যভেদি। বাস্তবতার চিত্রণ : 'তাড়াতাড়ি পানি ঢালা ভিজা চুলগুলো ও খোঁপায় গুছিয়ে ফেলল। আঁশের মতো পাতলা আর রুক্ষ চুলগুলোর কথা ভেবে ওর (আবেদার) মন খারাপ হয়। যে ছিরি চুলের, এই চুলে কি ফুল মানায়?' কিংবা 'ভেজা শাড়ি দিয়ে চুল মোছে (আবেদা)। ধনুকের ছিলার মতো করে নিয়ে চুল ঝাড়ে চটাস চটাস শব্দ করে। বিন্দু বিন্দু জলকণা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে।' অথবা 'রাতের খাবার ডাল আর রুটি। ডাল নামিয়ে রুটি সেঁকতে সেঁকতে আঁধার নামে।' লুকিয়ে ডালিয়া ফুলটা খোঁপায় পরার চেষ্টা করেছিল আবেদা, কিন্তু চুল পাতলা হয়ে যাওয়ায় পরতে পারেনি। সেটা বুকে ফ্যালে হাফিজদ্দি। স্বভাবসুলভ ক্রুব্ধ উক্তির পরেও 'হঠাৎ হাফিজদ্দি বলে, ফুলটা তরে দিয়া দিলাম যা।' আর তার ফলেই এরকম উপমা রচিত হয় : 'হঠাৎ-ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মতো আবেদার মনে হয় কি আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়।' এরই পরিণতি গল্পের শেষ বাক্যটিতে আবেদার সন্তানের প্রতি মমতা প্রকাশে। একটি ডালিয়া ফুল বস্তির এই দরিদ্র পরিবারটিকে করে তোলে এক আনন্দিত সংসার। কিন্তু বাস্তবতা এক ফোঁটা টাল খায় না। এমনকি স্বগতোক্তিতেও উপভাষার প্রয়োগ পুরো বিষয়টিকে বাস্তবসম্মত করে তোলে : 'আবেদা বলে উঠতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করে। তহুরাটাকে পেটাতে ইচ্ছা করে ওর। হারামজাদি, একটা কথা প্যাটে থাকে না।'
গ্রন্থধৃত সর্বশেষ গল্প 'ডলু নদীর হাওয়া' ২০০৩ সালে রচিত। প্রথম গল্পের ৩০ বছর পর লেখা এ গল্পে দেখা যাবে শহীদুল জহিরের গল্প বুননের দক্ষতা তো অটুট আছেই, উপরন্তু তার বিষয় ও বিন্যাস হয়ে উঠেছে জটিল ও রহস্য গাঢ়। এ গল্পও বাস্তবকে পরিপূর্ণ স্পর্শ করে আছে, প্রথম গল্পটি ঢাকার পটভূমিকায় রচিত, শেষ গল্পের পটভূমি চট্টগ্রাম। স্থানিক, বর্ণনাত্মক ও উপভাষা গল্পটিকে জীবন্ত জাগ্রত করেছে। যে প্রাথমিক অভিজ্ঞান গল্প লেখকের জন্য আবশ্যিক, তার কোনো ব্যত্যয় নেই দুটি গল্কেপ্পই। 'ডলু নদীর হাওয়া' গল্পের কেন্দ্র চরিত্র দু'জন : আহম্মদ তৈমুর আলী চৌধুরী আর তার স্ত্রী সমর্ত বেগম, যে আসলে মগ মেয়ে, যার আসল নাম এলাচিং। ১৭ পৃষ্ঠার এ গল্পে আরো অনেক চরিত্র : তৈমুরের মাতা গোলেননূর বেগম, এলচিঙের প্রেমিক সুরুত জামাল, কবিরাজ শ্যামাপদ, স্বর্ণ ব্যবসায়ী জ্যোতিভূষণ দাস, তৈমুর ও সমর্তের কনিষ্ঠতম পুত্র মিরাজ আলী চৌধুরী প্রমুখ। পুরো গল্পটি একটি রাহসিকতায় আবর্তিত। প্রথম গল্পের সারল্য আর অবশিষ্ট নেই এখন। গল্পের অন্তর্বিষয়ে এবং লেখকের বর্ণনায়ও একটি জটিলতা দেখা দিয়েছে পরষ্পরে আলিঙ্গিত। গল্পের আরম্ভ বাক্য : 'ডলু নদীতে এখন অনেক পানি অথবা হয়তো পানি তেমন নাই' এরকম কূটাভাষিকতায়। পুরো গল্পের 'অথবা/হয়তো/কিংবা/বা' ইত্যাদি শব্দের পৌনঃপুনিক প্রয়োগে রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে আরো। শহীদুল কৃতিত্ব বাস্তবতা কোথাও হারায় না : উপভাষা প্রয়োগে, স্থানিকতার সমর্থ ব্যবহারে, চরিত্রায়নে।
এই রাহসিকতার বা অন্তর্যাত্রার সম্মোহ যে সব সময় সুফল বয়ে এনেছে, তা নয়। 'কাঠুরে ও দাঁড় কাক' গল্পের সূচনা বাক্যাংশ 'ঢাকা শহরের প্রবীণ অধিবাসীরা স্মরণ করতে পারে যে, বহু দিন পূর্বে ঢাকা শহর একবার কাকশুন্য হয়ে পড়ে' প্রথমেই যে রকম বানানো তেমনি গল্পের কেন্দ্র চরিত্র কাঠুরে আকালু ও তার স্ত্রী টেপিকে নিয়ে যে রূপকথা ফাঁদেন, তা রূপকথাই থেকে যায়, তার ভিতরার্থ বড় বেশি আরোপিত মনে হয়। বাস্তব জ্ঞান শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে লাগে না।
তারপরও শহীদুল জহিরকে শেষ পর্যন্ত সফল গল্পকারই বলব। এরকম শক্তিশালী একজন গল্পকারের অকাল প্রয়াণ আমাদের সামগ্রিক সাহিত্যের সস্তা চটুল প্রচারপ্রবণ আবহে সমূহ ক্ষতিই ডেকে আনল বলে মনে হয়। তার প্রশংসা করা এ জন্যও যে, তার 'বক্তব্য' তিনি পেশ করেছেন নিরুচ্চারে যা স্লোগানধর্মিতার অবসান মানে না, যা ছিল সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর মধ্যেও। স্লোগানধর্মিতা আমাদের অনেক সম্ভবনাশীল ছোট গল্পকে, অনেক খ্যাতনামাকেও, শেষ পর্যন্ত বিনষ্ট করেছে।
বিজুর (পাঠক সমাবেশ) কাছে শহীদুল জহিরের ছায়া ঢাকা ব্যক্তি জীবনের কিছু ইতিবৃত্ত জানা গেল : অকৃতদার, অসম্ভব সৎ, সৎকর্মনিষ্ঠ, আত্মবৃত একজন মানুষ। আমাদের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কোলাহলের বাইরে থেকে, তিনি, মনে হয় আজ ভালোই করেছেন। লিখতেন গোপনে, নির্জনে। যদি অসামাজিক না হতেন তাহলেও কি কিছু গল্পের উপচার পেতেন না? কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল যে-জীবনের রূপদানের, সে বিষয়ে তন্নিষ্ট ছিলেন সেও বলতেই হবে এবং যার যার পথ তার নিজস্ব।
শহীদুল জহিরের প্রশংসা শুনি কিন্তু এর বেশ আগে। শিল্পতরু থেকে আবিদ আজাদ প্রকাশ করেছিল তার উপন্যাস 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল'। শিল্পতরু পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলাম আমি। কিন্তু ওই বই যখন বেরোয় তখন আমি ওই পত্রিকা থেকে সরে এসেছি, যদিও নাম ছাপা হয়ে যাচ্ছিল। প্রাবন্ধিক-সমালোচক-শিশুসাহিত্যিক আহমাদ মাযহারদের মুখে ওই বইটির সুনাম শুনতাম। কিন্তু একই সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর ধারাবাহিকতার কথাও শোনা যেত। 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' নামটিও সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর স্মারক। সে জন্য আমি বইটি পড়ার খুব একটা চাড় বোধ করিনি। কিন্তু 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প' পড়ে মনে হয়েছিল, ওয়ালীঊল্লাহ প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে উপস্থিতি সত্ত্বেও শহীদুল জহির নতুন কিছু করেছেন। এখানেই তার স্বকীয় কৃতিত্ব।
সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ খুব বেশি গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখেননি। আমাদের তদানীন্তন কথাশিল্পীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে শক্তিশালী। তার ধারাবাহিকতা অংশত সৈয়দ শামসুল হকে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসে, শহীদুল জহিরে এবং তরুণ কথাশিল্পীদের মধ্য দিয়ে চলেছে। সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর গল্প-উপন্যাস-নাটকের তিলতম প্রভাব নেই পশ্চিমবাংলার কথাসাহিত্যে। পশ্চিমবাংলায় তার বইপত্র কিছু প্রকাশিত হলেও তিনি তেমনভাবে স্বীকৃত বা প্রচারিত হননি। অথচ তার উত্থান ও বিকাশ কিন্তু পশ্চিমবাংলাতেই। আমি তার সমসাময়িক কথাশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে একবার কলকাতায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওয়ালীঊল্লাহর লেখা তিনি পড়েছেন কি-না। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী তার নামই শোনেননি মনে হয়েছিল। কলকাতাতেই দেখেছিলাম সুগভীর প্রাবন্ধিক-সমালোচক দেবীপদ ভট্টাচার্যের অগাধ শ্রব্দা সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর প্রতি। একবার তিনি ট্যাক্সিতে বাসায় ফিরতে ফিরতে সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসের নামটির অসামান্য একটি দীর্ঘ বিশ্লেষণ করেছিলেন আমার কাছে। তিনি তখন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ওই বিবেচনা লেখার সময় ছিল না তার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার দেবীপদ ভট্টাচার্য ওয়ালীঊল্লাহ সম্পর্কে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকায় তা মুদ্রিত হয়েছিল। দেবী বাবুর অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম। আমি প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ করি শিল্পতরু পত্রিকায়।
ওয়ালীঊল্লাহ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ আমি রচনা করি, 'সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ' (১৯৮৬/২০০১)। সেই অধিকারে, আশা করি এ কথা বললে অপরাধ হবে না যে, সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ ছিলেন না সমরেশ বসু। কেন একথা লিখলাম, সেটা পরে বলছি।
তখন আমার সামনে শহীদুল জহিরের দুটি গল্পগ্রন্থ 'শহীদুল জহির নির্বাচিত গল্প' (২০০৬) এবং 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প' (২০০৪)। এ দুটি গল্পগ্রন্থে গল্পের সংখ্যা মাত্র ২০টি। তার মধ্যে 'আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস' দুটি গ্রন্থেই আছে কাজেই এটি জমবে আরো। 'চতুর্থ মাত্রা' গল্পটিও আসলে গল্প নয় একাঙ্ক নাটক। আবার ওয়ালীঊল্লাহ স্মরণীয়। ওয়ালীঊল্লাহ কিছু একাগ্ধক নাটক লিখেন। গল্প ও একাগ্ধক নাটক সহবাসী। এক সময় গল্পকাররা একাঙ্ক নাটকও লিখতেন। অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, বনফুল, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ, সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রমুখ চমৎকার সব একাঙ্ক নাটক লিখেছেন। আকাশ-সংস্কৃতির পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে এ চমৎকার সাহিত্য মাধ্যমটি লুপ্তপ্রায়। শহীদুল জহিরের আরো গল্প থাকতে পারে। আপাতত এ ১৮টি গল্পই পাচ্ছি।
দুটি বই, কিন্তু আসলে শহীদুল জহিরের তিনটি গল্পগ্রন্থ : 'পারাপার', 'ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প'। এই দুটি বই নিয়ে 'শহীদুল জহিরের নির্বাচিত গল্প' বইটি সংকলিত হয় আর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ 'ডলু নদীর হাওয়া...'।
দেখা যাচ্ছে : শহীদুল জহিরের প্রথম গল্পগ্রন্থের রচনাকাল বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক; দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থের রচনাকাল ওই শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক আর তৃতীয় গল্পগ্রন্থের রচনাকাল (একটি গল্প বাদে) একবিংশ শতাব্দীর প্রথম/শুন্য দশক।
শহীদুল জহিরের জীবৎকাল ১৯৫৩-২০০৮। বয়সের হিসেবে, লেখার হিসেবেও, তিনি সত্তরের দশকের। কিন্তু তার পরিচিতি ঘটে বেশ পরে। আদি গল্প রচনার কাল ১৯৭৪ এবং অন্তিম গল্প রচনার কাল ২০০৩। এই তিরিশ বছরে ব্যাপ্ত ১৮টি গল্পে তিনি কত পরিণত হয়েছেন সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ১৯৭৪ সালে রচিত 'ভালোবাসা' এবং ২০০৩ সালে প্রণীত 'ডলু নদীর হাওয়া'র মধ্যে অনেক ব্যবধান। আবার তার তাবৎ গল্প থেকে শহীদুল জহিরের একটি চারিত্রই উদ্ভাসিত হয় সমাজের অন্তবাসী মানুষের জীবনযাপনের চিত্রনই তার লক্ষ্য। বহির্জীবনই অনেকখানি, তারই মধ্য দিয়ে অন্তলোকে যাত্রা। এ বহির্জীবনের পটভূমি বাংলাদেশ, শুধু ঢাকা শহর নয় ঢাকার বাইরেরও কোনো কোনো স্থান নির্বাচন করে নিয়েছেন এবং গভীর সততা ও নিবিষ্টতার সঙ্গে তার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন।
'ভালোবাসা' এবং 'ডলু নদীর হাওয়া' গল্প দুটির অতি সংক্ষিপ্ত একটি বিচার এখানে উপস্থাপন করা যাক।
তার প্রথম গল্কেপ্পই ছোটগল্কেপ্পর লিখনকুশলতা তার সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত। 'ভালোবাসা' গল্পের সূচনা বিন্দু 'বাবুপুরা বস্তির গলির মুখে আসতেই মওলার চোখে পড়ে গেল হাফিজদ্দি।/কি করে হাফিজদ্দি, ওইটা কইথন আনলি? চিৎকার করল মওলা' থেকে গল্পের উপাত্ত বাক্য 'উবু হয়ে আসা আবেদার ঠোঁট তহুরার কপাল ছোঁয়' পর্যন্ত একেবারে টান-করে-বাঁধা। মাত্র ৫ পৃষ্ঠা গল্প, কিন্তু অন্তর্গত ব্যাপ্তি অনেক। হাফিজদ্দি, তার স্ত্রী আবেদা ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে, আর ওদের কন্যা তহুরা এই তিনজনকে ঘিরে গল্পটি আবর্তিত। মওলা ওদের বস্তির পান-সিগারেটের দোকানদার, চেনা প্রতিবেশী। যে জিনিসটা নিয়ে এসেছিল হাফিজদ্দি, সেটা বস্তিতে কেউ আনে না, একটা একান্ত হলদে রঙের ডালিয়া ফুল। এই ডালিয়া ফুলটাই গল্পের কেন্দ্র। ওদের দারিদ্র্যমথিত জীবনে এক বিষ্ময়ের মতো উদিত হয়। বর্ণনা অল্প, কিন্তু লক্ষ্যভেদি। বাস্তবতার চিত্রণ : 'তাড়াতাড়ি পানি ঢালা ভিজা চুলগুলো ও খোঁপায় গুছিয়ে ফেলল। আঁশের মতো পাতলা আর রুক্ষ চুলগুলোর কথা ভেবে ওর (আবেদার) মন খারাপ হয়। যে ছিরি চুলের, এই চুলে কি ফুল মানায়?' কিংবা 'ভেজা শাড়ি দিয়ে চুল মোছে (আবেদা)। ধনুকের ছিলার মতো করে নিয়ে চুল ঝাড়ে চটাস চটাস শব্দ করে। বিন্দু বিন্দু জলকণা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে।' অথবা 'রাতের খাবার ডাল আর রুটি। ডাল নামিয়ে রুটি সেঁকতে সেঁকতে আঁধার নামে।' লুকিয়ে ডালিয়া ফুলটা খোঁপায় পরার চেষ্টা করেছিল আবেদা, কিন্তু চুল পাতলা হয়ে যাওয়ায় পরতে পারেনি। সেটা বুকে ফ্যালে হাফিজদ্দি। স্বভাবসুলভ ক্রুব্ধ উক্তির পরেও 'হঠাৎ হাফিজদ্দি বলে, ফুলটা তরে দিয়া দিলাম যা।' আর তার ফলেই এরকম উপমা রচিত হয় : 'হঠাৎ-ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মতো আবেদার মনে হয় কি আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়।' এরই পরিণতি গল্পের শেষ বাক্যটিতে আবেদার সন্তানের প্রতি মমতা প্রকাশে। একটি ডালিয়া ফুল বস্তির এই দরিদ্র পরিবারটিকে করে তোলে এক আনন্দিত সংসার। কিন্তু বাস্তবতা এক ফোঁটা টাল খায় না। এমনকি স্বগতোক্তিতেও উপভাষার প্রয়োগ পুরো বিষয়টিকে বাস্তবসম্মত করে তোলে : 'আবেদা বলে উঠতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করে। তহুরাটাকে পেটাতে ইচ্ছা করে ওর। হারামজাদি, একটা কথা প্যাটে থাকে না।'
গ্রন্থধৃত সর্বশেষ গল্প 'ডলু নদীর হাওয়া' ২০০৩ সালে রচিত। প্রথম গল্পের ৩০ বছর পর লেখা এ গল্পে দেখা যাবে শহীদুল জহিরের গল্প বুননের দক্ষতা তো অটুট আছেই, উপরন্তু তার বিষয় ও বিন্যাস হয়ে উঠেছে জটিল ও রহস্য গাঢ়। এ গল্পও বাস্তবকে পরিপূর্ণ স্পর্শ করে আছে, প্রথম গল্পটি ঢাকার পটভূমিকায় রচিত, শেষ গল্পের পটভূমি চট্টগ্রাম। স্থানিক, বর্ণনাত্মক ও উপভাষা গল্পটিকে জীবন্ত জাগ্রত করেছে। যে প্রাথমিক অভিজ্ঞান গল্প লেখকের জন্য আবশ্যিক, তার কোনো ব্যত্যয় নেই দুটি গল্কেপ্পই। 'ডলু নদীর হাওয়া' গল্পের কেন্দ্র চরিত্র দু'জন : আহম্মদ তৈমুর আলী চৌধুরী আর তার স্ত্রী সমর্ত বেগম, যে আসলে মগ মেয়ে, যার আসল নাম এলাচিং। ১৭ পৃষ্ঠার এ গল্পে আরো অনেক চরিত্র : তৈমুরের মাতা গোলেননূর বেগম, এলচিঙের প্রেমিক সুরুত জামাল, কবিরাজ শ্যামাপদ, স্বর্ণ ব্যবসায়ী জ্যোতিভূষণ দাস, তৈমুর ও সমর্তের কনিষ্ঠতম পুত্র মিরাজ আলী চৌধুরী প্রমুখ। পুরো গল্পটি একটি রাহসিকতায় আবর্তিত। প্রথম গল্পের সারল্য আর অবশিষ্ট নেই এখন। গল্পের অন্তর্বিষয়ে এবং লেখকের বর্ণনায়ও একটি জটিলতা দেখা দিয়েছে পরষ্পরে আলিঙ্গিত। গল্পের আরম্ভ বাক্য : 'ডলু নদীতে এখন অনেক পানি অথবা হয়তো পানি তেমন নাই' এরকম কূটাভাষিকতায়। পুরো গল্পের 'অথবা/হয়তো/কিংবা/বা' ইত্যাদি শব্দের পৌনঃপুনিক প্রয়োগে রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে আরো। শহীদুল কৃতিত্ব বাস্তবতা কোথাও হারায় না : উপভাষা প্রয়োগে, স্থানিকতার সমর্থ ব্যবহারে, চরিত্রায়নে।
এই রাহসিকতার বা অন্তর্যাত্রার সম্মোহ যে সব সময় সুফল বয়ে এনেছে, তা নয়। 'কাঠুরে ও দাঁড় কাক' গল্পের সূচনা বাক্যাংশ 'ঢাকা শহরের প্রবীণ অধিবাসীরা স্মরণ করতে পারে যে, বহু দিন পূর্বে ঢাকা শহর একবার কাকশুন্য হয়ে পড়ে' প্রথমেই যে রকম বানানো তেমনি গল্পের কেন্দ্র চরিত্র কাঠুরে আকালু ও তার স্ত্রী টেপিকে নিয়ে যে রূপকথা ফাঁদেন, তা রূপকথাই থেকে যায়, তার ভিতরার্থ বড় বেশি আরোপিত মনে হয়। বাস্তব জ্ঞান শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে লাগে না।
তারপরও শহীদুল জহিরকে শেষ পর্যন্ত সফল গল্পকারই বলব। এরকম শক্তিশালী একজন গল্পকারের অকাল প্রয়াণ আমাদের সামগ্রিক সাহিত্যের সস্তা চটুল প্রচারপ্রবণ আবহে সমূহ ক্ষতিই ডেকে আনল বলে মনে হয়। তার প্রশংসা করা এ জন্যও যে, তার 'বক্তব্য' তিনি পেশ করেছেন নিরুচ্চারে যা স্লোগানধর্মিতার অবসান মানে না, যা ছিল সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর মধ্যেও। স্লোগানধর্মিতা আমাদের অনেক সম্ভবনাশীল ছোট গল্পকে, অনেক খ্যাতনামাকেও, শেষ পর্যন্ত বিনষ্ট করেছে।
বিজুর (পাঠক সমাবেশ) কাছে শহীদুল জহিরের ছায়া ঢাকা ব্যক্তি জীবনের কিছু ইতিবৃত্ত জানা গেল : অকৃতদার, অসম্ভব সৎ, সৎকর্মনিষ্ঠ, আত্মবৃত একজন মানুষ। আমাদের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কোলাহলের বাইরে থেকে, তিনি, মনে হয় আজ ভালোই করেছেন। লিখতেন গোপনে, নির্জনে। যদি অসামাজিক না হতেন তাহলেও কি কিছু গল্পের উপচার পেতেন না? কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল যে-জীবনের রূপদানের, সে বিষয়ে তন্নিষ্ট ছিলেন সেও বলতেই হবে এবং যার যার পথ তার নিজস্ব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন