ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ও মেরি শেলি

বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মেরি শেলির জন্ম ১৭৯৭ সালের ৩০ আগস্ট। তার লেখা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন 
পৃথিবীজুড়ে বহুল আলোচিত উপন্যাস। মেরি শেলি ও ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নিয়ে লিখেছেন 
সুরাইয়া নাজনীন 
মেরি শেলির বিখ্যাত উপন্যাস ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রকাশ হয় ১৮১৮ সালে। উপন্যাসটির নাম ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস হলেও ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামে সর্বাধিক পরিচিত। এর মাধ্যমে শুরু হয় সায়েন্স ফিকশনের জয়যাত্রা। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। ১৮১৮ সালে মেরি শেলি এই উপন্যাসটি রচনা করেন। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত ইংরেজ কবি পি বি শেলির স্ত্রী। স্বামী ও স্বামীর বন্ধু লর্ড বায়রনের উৎসাহে তিনি এটি রচনা করেন।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছিলেন বিজ্ঞানী। পৃথিবীকে তাক লাগানো আবিষ্কারের নেশায় তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে চাইলেন। ফল হলো বিপরীত। তিনি যাকে সৃষ্টি করলেন সেটি মানুষ না হয়ে হলো দানব। ভয়ে এবং হতাশায় ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তাকে ত্যাগ করলেন। অপরদিকে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক পরিত্যক্ত ও নিঃসঙ্গ দানব প্রতিশোধের জন্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আপনজনদের হত্যা করে, কিংবা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তার ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু দানবের হাত থেকে মৃত্যুর আগে কখনো রেহাই পাননি। তার জীবন জ্বলন্ত নরকে পরিণত হয়। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ও তার দানবের আশা-আকাক্সক্ষা ও দুঃখ-বেদনা এতই মর্মস্পর্শী যে এই কল্পকাহিনী প্রায় দু’ শ’ বছর ধরে পৃথিবীতে অমর কাহিনী হিসেবে টিকে আছে। মানুষ অপরিণামদর্শী হলে তাকে কি ফল ভোগ করতে হয় তা বুঝাতেও ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ও তার দানবের ঘটনাকে উল্লেখ করা হয়। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে মাত্র ১৮ বছর বয়সী এক তরুণীর অসামান্য কল্পনাশক্তি আর সৃজনশীল লেখনীর যোগসূত্রে যে উপন্যাসের জন্ম হয়েছিল, তা বহুলাংশে বদলে দিয়েছে সভ্যতার গতি-প্রকৃতি আর সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার ধারা। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বা সায়েন্স ফিকশন যে নামেই মেরি শেলির দুনিয়া কাঁপানো উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’কে অভিহিত করা হোক না কেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আবহমান ধারায় তা আজো এক বিস্ময়।
শতাব্দীজুড়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বিশ্বজোড়া কীর্তি আর জনপ্রিয়তার সেই ইতিহাস সত্যিই অভাবনীয়। মৃতের বুকে প্রাণ আনতে গিয়ে ক্ষ্যাপাটে এক বিজ্ঞানীর ভয়ঙ্কর দানব তৈরির গা হিম করা কাহিনী বিনোদনের প্রায় সব ধারায় আজো বেশ দাপটের সঙ্গেই তার প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব কী করেনি এই ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’কে নিয়ে! সাহিত্য, শিল্পকলা, সংগীত, থিয়েটার থেকে শুরু করে টেলিভিশন ছাড়িয়ে সিনেমার রূপালী পর্দা, কার্টুন-কমিকস থেকে শুরু করে ভিডিও গেম সবখানেই রয়েছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবের অবাধ ও সফল পদচারণা। তবে অষ্টাদশ শতকের গথিক আর রোমান্টিসিজমের অপূর্ব সংমিশ্রণের ফসল এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ব্যাপ্তি সাহিত্য আর চলচ্চিত্রেই সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা সংস্কৃতির সীমানা ডিঙিয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন জন্ম দিয়ে গেছেন এর নিজস্ব, অসংখ্য শাখা-প্রশাখা আর নিত্যনতুন দুর্ধর্ষ সব গল্পের।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মূল কাহিনী বা একে ঘিরে যত ছবি নির্মিত হয়েছে তাতে কিন্তু মেরি শেলির উপন্যাসের মূল চরিত্র ব্যারন ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের হাতে জন্ম নেয়া ভয়ঙ্কর দানবটির কোনো নাম ছিল না। অথচ মজার ব্যাপার হলো-এই দানব চরিত্রটি পাঠক আর দর্শকদের মনে এমনই ছাপ ফেলেছে যে, এখনো এর ভক্তকুলের কাছে ওই দানবই কিনা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামে পরিচিত। যেন এক ‘অযাচিত সৃষ্টি’ দখল করে নিয়েছে তার দুষ্ট স্রষ্টার নাম! এই ভুল ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত কিংবা ভালোবাসার টানেই হোক না কেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে হরর আর সায়েন্স ফিকশন ধারায় ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ আজো এক কিংবদন্তি নাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন