নারীবাদ সম্পর্কে

ভূমিকা :
একজন মানুষ হিসেবে নারীর তার পরিপূর্ণ অধিকারের দাবি হল নারীবাদ। নারী স্বাধীনতা আলোচনা প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নারীবাদ। বিশ্বজুড়ে যে বিদ্যমান লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাগ পুরুষের উপর রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এসব সামাজিক পরিমন্ডলের দায়িত্ব অর্পন করে এবং নারীকে গোটা সংসারের বোঝা বহনকারী বিনা মজুরীর বাদিগীরির দিকে ঠেলে দেয় তাকে চ্যালেঞ্জ করে নারীবাদ। নারীবাদ বিরাজমান ক্ষমতা কাঠামো, আইন-কানুন, রীতি-নীতি যা নারীকে বশ্য, অধীনস্ত ও হীন করে রাখে ; তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নারীবাদ হলো একটি সামাজিক আন্দোলন যা নারীর গৎবাধা ভূমিকা ও ইমেজের পরিবর্তন, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিলোপ এবং পুরুষের মতো নারীর সমান অধিকার অর্জনের প্রয়াসী। নারীর স্বাধীনতা অর্থবহ করার লক্ষ্যে যে আন্দোলন, যুক্তি ও তত্ত্ব বিভিন্ন চিন্তবিদগণ প্রদান করেছেন তাকে সাধারণভাবে নারীবাদ আখ্যা দেয়া যায়। নারীবাদ নারীর সামগ্রীক কল্যাণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। নারীবাদ ও নারী স্বাধীনতা অভিন্ন নয়। নারীবাদী গবেষকদের মধ্যে মত ও পথের ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক নারীবাদী গবেষক নারীর কল্যাণের লক্ষ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মতবাদ দিলেও তাদের উদ্দেশ্য হলো নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।



নারীবাদ সংক্রান্ত ধারণাঃ 

নারীবাদ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দFeminism. Feminism শব্দটি এসেছে ফরাসী শব্দFemmenisme থেকে। Femme অর্থ নারী, isme অর্থ মতবাদ। ১৮৮০ এর দশকে ফ্রান্সে শব্দটি গৃহীত হয়। পরে ইংরেজি ভাষায় গৃহীত হয়।
নারীবাদ সমাজে নারীর অবস্থান পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। নারীবাদী Christina Hoff Sommers এর মতে, নারীবাদ হচ্ছে, A concern for women and a determination to see them fairly treated.' বিশিষ্ট নারীবাদী চিন্তাবিদ ` Kamla Basin ও Nighat Said Khan তাদের Workshop on South Asian Womenএ নারীবাদ সম্পর্কে বলেন, '

An awareness of women's oppression and exploitation in society, at work and wothin the family, and conscious action by women and men to change this situation.'

Olive Banks তার Faces of Feminism গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন যে, গোষ্ঠী নারীর অবস্থান কিংবা নারী সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা পরিবর্তনে প্রয়াসী তাদের নারীবাদী বলে আখ্যা দেয়া হয়।
Rosemarie Putnam tong তার Feminist Thoughtগ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন,

No doubt feminist thought will eventually shed these labels for others that better express its intellectual and political commitments to women.

নারীর অধ:সত্মন অবস্থা পরিবর্তনের প্রচেষ্টার ঘটনার সঙ্গে নারীবাদ সম্পর্কিত। নারীবাদ হল _ পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সমাজে নারীর উপর শোষণ-নিপীড়ন সম্বন্ধে সচেতনতা এবং এই অবস্থা বদলের লক্ষ্যে নারী (পুরুষের) সচেতন প্রয়াস।

নারীবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশঃ 

পাশ্চাত্যে নারীর মূল্য নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলেন ফরাসী রাজসভার নারী সদস্য Christin de Pizan. ১৪০৫ সালে তিনি The book of the city of Ladies নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৬৬২ সালে ওলন্দাজ নারী মার্গারেট লুকাস রচিত 'নারী ভাষণ'(Famel orations) হলো বিশ্বের জ্ঞাত ইতিহাসের প্রথম নারীবাদী সাহিত্য যেখানে নারীর পরাধীনতা ও অসম অধিকারের বিষয়টি বিধৃত হয়েছে। নারীবাদের ইতিহাসে প্রথম নারীবাদীরূপে যার নাম পাওয়া যায় তিনি হলেন সতের শতকের ফরাসি নারী পলেইন ডিলা ব্যারে। পশ্চিমে নারী মুক্তির লড়াই একটি সুসংগঠিত রূপ নেয় সাফ্রাজেট এন্দালনের মাধ্যমে। নারীবাদকে প্রথম সংগঠিত আকারে উপস্থিত করেন ইংল্যান্ডের মেরি ওফেস্টোনক্রাফট তাঁর বিখ্যাত সারা জাগানো নারীবাদী গ্রন্থ 'নারীর অধিকারের ন্যায্যতা' ((Vindication of reights of women)) গ্রন্থে ১৭৯২ সালে। ১৮৪০ সাল থেকে আমেরিকার দাস প্রথা ও মদ্যপান বিলোপ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীবাদী চেতনা আরো বিকশিত হয়। ১৮৯১ সালে এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন আরো ২৩ জন নারীসহ মিলিতভাবে রচনা করেন 'THE WOMAN'S BIBLE'। ১৮৬৮ সালে নর-নারীর অভিন্ন অধিকার প্রচারের লক্ষ্যে নারীবাদী সাময়িকী 'দি রেভোলিউশন' প্রকাশ করেন।
ঊনবিংশ শতব্দীর শেষার্ধে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীগণ বেশ কিছু মৌলিক তত্ত্ব প্রচার করেন। ব্রিটেনে উদারনৈতিক সংস্কারবাদী জন স্টুয়ার্ট মিল রচিত The Subjection of Women', জার্মানির অগাষ্ট বেবেল রচিত Woman and Socialism এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস রচিত The Origin of the family, Private Property and the State শিরোনামের গ্রন্থাবলী উলেস্নখযোগ্য। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফ্রান্সে সিমন দ্যা বুভ্যেয়ার রচনা করেন The Second Sex' নামক গ্রন্থ।
১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লেখক কেট মিলেট 'Sexual Politics' নামে সাড়া জাগানো গ্রন্থ রচনা করেন। এর বহু পূর্বে ১৮২৫ সালে ইংল্যান্ডে নারীর অধিকারের পক্ষে প্রথম পুরুষ দার্শনিক উইলিয়াম টমসন এর বই 'The half portion of mankind women's appeal to the rest portion gainst male chauvinism' প্রকাশিত হয়। আধুনিক নারীবাদীদের মধ্যে ভার্জিনিয়া উল্ফ এর সাহিত্যকম, ১৯৬৬ সালে বেটি ফ্রাইডান রচিত 'The Feminine Mystic ১৯৭০ সালে জার্মেইন গ্রিয়ার এর 'The Female Eunac, গুলাস্মিথ ফায়ারস্টোন-এর 'ডায়ালেকটিকস অব সেঙ্', আলেকজান্দ্রা কোলনতাই এর 'Sexual Relation and Class Struggle, এরিকা ইয়ং রচিত 'Fear for Flying', কেটি বোইফে এর Beauty myth ও 'Fire with Fire' প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থ নারীবাদের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে। মরক্কোর ফাতিমা মেরনিসসির 'মুসলমানের অবচেতনায় নারী' এবং মিসরের নওএল সাদাওয়ির 'আরব বিশ্বে নারী' ও 'হাতওয়ায় লুকানো মুখ' ইত্যাদি গ্রন্থে নারীবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে।

১৮৩৭ সালে আমেরিকায় প্রথম দাসপ্রথা বিরোধী নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যার মাধ্যমে মার্কিন নারীরা রাজনীতি করার অধিকার ও সুযোগ পায়। ১৮৪৮ সালের ১৯-২০ জুলাই নারীবাদীদের উদ্যোগে নিউইয়র্কের সেনেকো ফলস এ বিশ্বের প্রথম নারীর অধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা করে। ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হয়। ১৯১০ সালে জামর্ান কমিউনিষ্ট নেত্রী ক্লারা জেডকিন নেত্রী কর্তৃক আনত্মর্জাতিক শ্রমজীবী নারী সম্মেলনে উত্থাপিত প্রসত্মাব অনুযায়ী ১৯১৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৮ মার্চ আনত্মর্জাতিক নারী দিবস পালনের সিদ্ধানত্ম গৃহীত হয়। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আনত্মর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
১৮৮৫ সালে মেরী কার্পেন্টারের নেতর্ৃত্বে নারীদের মানবিক অধিকারের জন্য সংগঠন তৈরি হয় এবং আন্দোলন অব্যাহত থাকে যা নারীবাদী আন্দোলনরূপে পরিচিতি লাভ করে। ১৯০৩ সাল নাগাদ এমিলিন প্যাঙ্কখাস্টের নেতর্ৃত্বে ইংল্যান্ডে নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক ইউনিয়ন গঠন এবং নারীর ভোটাধিকার আন্দোলন তীব্র হয়। ফ্রান্সে নারীবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ৩০-এর দশকে। ১৮৪৮ সালে নিবয়েট এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'Women Voice' পত্রিকা। জার্মানিতে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী ও আনত্মর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চের ঘোষক ক্লারা জেটকিন মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে নারীবাদের সেতুবন্ধন ঘটান। ১৮৬৬ সালে দার্শনিক ও আইনজ্ঞ স্টুয়ার্ট মিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট সদস্য হবার পর নারীর ভোটাধিকারের পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন পার্লামেন্টে। ১৮৭৯ সালে বিখ্যাত নাট্যকার হেনরি ইবসেন এর কালজয়ী নাটক 'পুতুলের খেলাঘর' (The Dolls House) এর নায়িকা নোরা চরিত্রটির মাধ্যমে আধুনিক নারীবাদী চেতনা মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। অগাস্ট বেবেল এর 'নারী: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত' গ্রন্থটি নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দিকদর্শনরূপে চিহ্নিত হয়েছে।
নারীবাদী পুরম্নষ _ রাজা রামমোহন রায় ১৮১৮ সালে কলিকাতায় 'সহমরণ' বা 'সতীদাহ' প্রথা বিলোপের উদ্যোগ নেন। যার ফলে ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মেরী ককের সঙ্গে মিলে মোট ৪৩টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৮৫০_৫৫ এ সময়ে বিধবা বিবাহের সপক্ষেও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৮৬৭ সাল নাগাদ নিজে ৬০টি বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন। ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৩৭ সালে কুমিলস্নায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয় ও ১৮৯৩ সালে মহিলা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার প্রথম নারীবাদী সংগঠন 'সাখ সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন স্বর্ণকুমার দেবী ১৮৮৫ সালে এবং তিনি লাঠি খেলা ও অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীর মধ্যে দেশপ্রেম সঞ্চারিত করার চেষ্টা করেন। ১৮৮৯ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে ৬ জন নারী যোগদান করেন। সরোজীনি নাইডু ও সরলা দেবী চৌধুরাণী প্রমূখ নারী নেত্রীরা কংগ্রেসের সভাপ্রধানের পদেও উন্নীত হন। ১৮৮৯ সালে ভারতবর্ষের প্রথম নারীবাদী আন্দোলনের সংগঠিত রূপকার মহারাষ্ট্রের পন্ডিত রমাবাঈ প্রকাশ্য আন্দোলনে নামেন।
বাংলার প্রথম নারীবাদীরূপে খ্যাত সরলা দেবী চৌধুরানী ১৯১০ সালে সর্বভারতীয় নারী সংগঠন 'ভারত স্ত্রী মহামন্ডল' প্রতিষ্ঠিত করেন। আর বেগম রোকেয়া আধুনিক অর্থে বাংলার প্রথম প্রকৃত নারীবাদী নারী। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে তাই রোকেয়া সাখাওয়াত, সরলা দেবী এবং পন্ডিত রমাবাঈ হলো তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের নারীবাদী চিনত্মার জনক।
১৯১৭ সালে তৎকালীন ভারতে নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯১৯ সালে এই দাবিতে নারীদের একটি প্রতিনিধিদল বৃটেনে গমন করেন। ১৮৬৯ সালে মেরী মূলার নামের এক বৃটিশ মহিলা ভোটের অধিকারের দাবিতে নারী সমাজকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে একটি প্রচারপত্র ছেপেছিলেন নিউজিল্যান্ডে। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৮৯৪ সালে নিউজিল্যান্ডে মেয়েদের সীমিত ভোটাধিকার দেয়। বাসত্মবে তা কার্যকরী হয় ১৯২৮ সালে। এর আগে ১৮৮২ সালে বিবাহিত মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দেয়া হয়। এ্যামেলিন প্যাংখারষ্ট ১৯০৩ সালে ভোটাধিকারের দাবিতে বিপস্নবী নারী সংগঠন গড়ে তোলেন। বার্থা ফন সাটনার (১৮৪৩ _ ১৯১৪) ১৮৮৯ সালে 'তোমার অস্ত্র সমর্পন করো' নামে একটি বই লিখেন। অনেকের ধারণা এই বইয়ের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেল শানত্মি পুরস্কার প্রবর্তন করেন এবং বার্থা ফন সাটনার সে পুরস্কারটি পান। তিনিই প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী।

নারীবাদের বিভিন্ন ধারাঃ 

নারীবাদ একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দর্শন। আর পৃথিবীর ইতিহাসে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারা লক্ষ্য করা যায়। যেমন _

উদারনৈতিক নারীবাদঃ 

Marej Wollstone Craft, John Stuart Mill, Harriet Taylor Liberal Feminism এর প্রবক্তা। Betty Friedman মূলত রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর সমর্থক ছিলেন। বিদ্যমান সমাজ কাঠামোকে অক্ষুণ্ন রেখে পুরুষের মত নারীরও সমান অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করাটা হলো এর মূল বৈশিষ্ট্য। এরা মূলত সংস্কারে বিশ্বাসী। তাদের আশা বিদ্যমান সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আইন-কানুন বিধি ব্যবস্থা সংস্কার সংশোধন করে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য ও অসমতা দূর করা সম্ভব।

মার্কসীয় নারীবাদ Marxist Feminismঃ

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস মার্কসবাদী মতাদর্শ হলো এ নারীবাদের ভিত্তি, লেনিন, অগাস্ট বেবেল, ক্লারা জেটকিন, আলেকজান্ডার কোলনতাই প্রমূখ এই মার্কসীয় নারীবাদের ভিত্তি নির্মান করেছে। এরা শ্রেণী বৈষম্যকে নারী নির্যাতনের কারণ বলে চিহ্নিত করেন। Capitalism উচ্ছেদ করে শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে নারী মুক্তি সম্ভব বলে এরা মনে করেন। এদের কাছে নারীমুক্তি আন্দোলন পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, পুুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং পুরুষতান্ত্রিক পুিুঁজবাদী সামাজিক সম্পর্কের বিরূদ্ধে।
আমূল নারীবাদ (Redical Feminism)ঃ

বিংশ শতাব্দীর ৬০-এর দশকে এই নারীবাদী ধারার উদ্ভব ঘটে পাশ্চাত্যে। Shula mittle Fierstone এই ধারার জনক। Kate Millet, Marilyn French এ মতবাদের প্রবক্তা। এই নারীবাদের মূল কথা হলো, পুরুষ নারীকে শোষণ করে Sexual oppressionএর মাধ্যমে। এরা নারী ও পুরুষের বিচ্ছেদে বিশ্বাসী। পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং পুরুষের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক অস্বীকার করে নারীর স্বাতন্ত্র্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিদার। এখানে পুরুষকে প্রতিপক্ষরুপে চিহ্নিত করে প্রচলিত বৈবাহিক সম্পর্ককে অস্বীকার করা হয়। তারা উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা কৃত্রিম উপায়ে মাতৃগর্ভের বাইরের সনত্মান জন্মদানের পক্ষে যাতে করে রাষ্ট্র এবং পুরুষদেরও মানব প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার দায় সমানভাবে বহন করতে হয়। নারীকে যৌন সামগ্রী হিসেবে পুরুষ 'যৌন রাজনীতি' (Sexual politics) মাধ্যমে যে শোষণ চালায় তার আমূল বিলোপ সাধনই নারী মুক্তির মূলকথা। এরা (Homosexual) সমকামে বিশ্বাসী এবং মাতৃতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন লালন করে যা বর্তমান পরিবারের বিলুপ্তি ঘটাবে। তারা বিশ্বাস করে, পিতৃতন্ত্র ও তার অনুসারী সমাজ ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটিত করে নারী ও পুরুষের সমতা আনা সম্ভব। এই ধারাকে অনেকে উগ্র নারীবাদ (Ultra left feminism) বলে চিহ্নিত করে থাকে।
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ (Socialist Feminism)ঃ

রেডিক্যাল এবং মার্কসীয় নারীবাদের এক ধরনের মিলিত রূপ হলো সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ। এরা মনে করে যে, ধনতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের জটিল মিথস্ক্রিয়া নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণ এবং ধনতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র উভয়ের বিলোপ সাধন না করে নারী মুক্তি সম্ভব নয়। এরা বিশ্বাস করে যে, নারীর প্রকৃত স্বাধীনতাই সমাজের সমতা অর্জন নিশ্চিত করতে পারে। এই নারীবাদকে অনেকে Social Feminism রূপেও অভিহিত করে থাকে।
সাংস্কৃতিক নারীবাদ (Cultural Feminism) ঃ

কিছুটা Radical Feminism এবং কিছুটা Socialist Feminismএর মিলিতরূপ এই Cultural Feminism মনে করে যে, জেন্ডার সম্পর্ক সাামজিক ও ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্ট এবং তা পরিবর্তনযোগ্য। নারী-পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্যজনিত বাসত্মবতা নয়, মনসত্মাত্তি্ব গড়নই নারীর অধিনসত্মতার কারণ। এই নারীবাদ কখনো মাতৃত্বকে অবমুল্যায়ন এবং নারী সুলভ গুণাবলীকে ধ্বংস করার পক্ষপাতি নয়। অবশ্য এরাও পুরুষকে তাদের শত্রুরূপে বিবেচনা করে।
পরিবেশ নারীবাদ (Eco Feminism )ঃ

নারী ও প্রকৃতির উপর সমানত্মরালভাবে বিদ্যমান পুরুষ প্রাধান্যের অবসান দাবি করে এই নারীবাদ। ভারতের বন্দনা শিবা, মারিয়ামিজ প্রমূখ এই পরিবেশ নারীবাদের অন্যতম প্রবক্তা। পরিবেশ নারীবাদ নারী এবং পরিবেশকে অভিন্ন মাত্রায় সংযোজন করে। এর মল বক্তব্য হলো নারী ও প্রকৃতি উভই পিতৃতন্ত্রের নির্মম শিকার।
বৈশ্বিক নারীবাদ (Global Feminism)ঃ

এই ধারা নারীদের অবস্থানকে বৈশ্বিকভাবে দেখার একটি দিক-নির্দেশনা প্রদান করে। তারা মনে করে লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজ নির্মানের কর্মকৌশল এমন একটি বৈশিষ্ট্যকে সাপোর্ট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে যেখানে প্রতিটি সমাজের নারীরা তাদের সমস্যাবলীকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করা ও সমাধানের উপায় খুঁজে বের করাই এ মতবাদের মূল বক্তব্য।

বাংলাদেশে নারীবাদ ; একটি পযর্ালোচোনা: 

বাংলাদেশে নারীবাদের ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত একটি বিষয় তবে পৃথিবীর অন্যান্য নারীবাদের তুলনাই একটু ব্যতিক্রম। যদিও বাংলাদেশে Redical Feminism এর প্রভাব নেই তবে এখানে নারীবাদের ইতিহাসে Redical change এসেছে। উপমহাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের ইতিহাস বিশেস্নষণ করলে দেখা যাবে, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে পিতৃতন্্ত্রের উত্থানই নারীর ওপর পারিবারিক নির্যাতনের সূচনা এবং তার বিরুদ্ধে নারীবাদ আন্দোলন এর সূচনা ঘটিয়েছে। অঞ্চল, সমপ্রদায়ভেদে এর বাহ্যিক রূপের হেরফের ঘটলেও অনত্মর্নিহিত রম্নপের কোনো তারতম্য ঘটেনি। পারিবারিক কাঠামোতে প্রতি পদে পদে পুরূষতন্ত্র নারীর পায়ে নির্যাতনের বেড়ি পরিয়েছে কখনো ধমের নামে, কখনো সমাজের নামে, কখনো বেহেশত বা স্বর্গের লোভ দেখিয়ে, কখনো সামাজিক সুনামের লোভ দেখিয়ে। এছাড়াও কতক জঘন্য সামাজিক কুসংস্কার এ দেশের নারী সমাজকে পদদলিত করেছিল। যেমন সতীদাহপ্রথা, বিধবা বিবাহ ইত্যাদি। যার ফলস্বরূপ এ দেশে বিভিন্ন ধরণের নারীবাদ এবং নারীবাদীর জন্ম হয়। বিশষত যে নারীবাদ এখানে তা আসলে উদারনৈতিক নারীবাদ। আর পর্ূেব যে সকল নারীবাদী দেখা যায় তারা হলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া ইত্যাদি । মাঝেমধ্যে আমূল নারীবাদ ও দেখা যায়। এদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন তসলিমা নাসরিন। বাংলাদেশে নারীবাদ বিষয়ে যারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন- সারা হোয়াইট, ক্রিস্টার্ন ওয়েস্টগার্ড ও ভ্যানশেন্ডেল , বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর , নায়লা কবির , রওনক জাহান , মাহমুদা ইসলাম , নাজমা চৌধুরী , খালেদা সালাহ উদ্দীন , মেঘনা গুহ ঠাকুরতা , আনু মুহম্মদ প্রমুখ। এদেশের মানুষ ধর্মভিরু এবং স্থানীয় সাংস্কৃতির প্রতি বেশী অনুরাগ থাকায় আমূল নারীবাদীরা তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু উদারনৈতিক নারীবাদীরা খুবই সমাদৃত হয়েছেন বা হচ্ছেন।

সামপ্রতিক কালে বাংলাদেশে নারীবাদের বহুল আলোচিত প্রপঞ্চটি হচ্ছে "নারীর ক্ষমতায়ন"। কেবল মানবেতর অবস্থা থেকে নারীর মুক্তি বা নারী উন্নয়নের জন্যই নয়, নারীর ক্ষমতায়নকে এখন সামাজিক উন্নয়নের সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। "নারীর ক্ষমতায়ন" এর ব্যপ্তি ও স্বরুপ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনসত্মাত্তি্বক ইত্যাদি নানা স্তরে এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। দু'জন মহিলার শীর্ষ বিন্দুতে অবস্থান স্বভাবতই এই ধারণার জন্ম দেয় যে, বাংলাদেশে ব্যাপক পরিসরে নারীরা ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বাসত্মবতা বিশেস্নষণে যে চিএ বেরিয়ে আসে তা পুরোপুরি বিপরীত। বরং প্রত্যেক পরিসরে পেছনে পড়ে আছে। তাই বর্তমানে বাংলাদেশের নারীবাদীরা যে আন্দোলন শুরু করেছে তার অর্থটা একটু ব্যাপক। তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীবাদী আন্দোলনের প্রভাবও রয়েছে এদেশে। তারা তাদের বিশ্বাস ও আদর্শ দ্বারাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।

উপসংহারঃ
মর্যাদা ও সমতার ভিত্তিতে সমাজে নারীর অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নারীবাদ তৎপর, নারীবাদী আন্দোলন নারী স্বাধীনতা, নারীর অধিকার প্রভৃতি বহুবিধ বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি নারীর আত্মসম্মানের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছে। নারীবাদী চর্চার প্রয়োগ রাজনৈতিক এবং প্রথা অনুযায়ী অরাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। নারীবাদীরা প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন প্রকার আইন বিরোধী কর্মকান্ড বিশেষত: অন্যান্য কর্মকান্ড সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। নারীবাদ সাক্ষাৎকার পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার পুনরার্বিভাবের জন্য প্রদত্ত যুক্তিসমূহ সাক্ষাৎকার, পর্যবেক্ষণ সংক্রানত্ম ধারণাকে প্রভাবিত করেছে। নারীবাদের বিভিন্ন ধারার বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে নারীবাদের মধ্যকার এবং বাইরের অনেক চিনত্মাবিদদের মধ্যেই তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তাই সমাজ, সংস্কৃতি, জনমানুষের বিদ্যমান বাসত্মবতাকে বিবেচনা করে যৌক্তিক ব্যাপারগুলো গুরুত্ব দেয়াতেই কল্যাণ। ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিককে বিশেস্নষণ করেই সঠিক সিদ্ধানত্ম নেয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে সকলকে সজাগ ও সচেতন হতে হবে।
http://www.somewhereinblog.net/blog/sksali/29898700

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন