নোরা : একটি নারীবাদী কবিতা

মাসুদুজ্জামান 

My book is poetry, and if it is not poetry, then it will be.
Henrik Ibsen
.................................................................................................
বিশ্বসাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি হেনরিক ইবসেনের (১৮২৮-১৯০৬) আ ডলস্ হাউজ (১৮৭৯)। নোরা হেলমার চরিত্রকে ঘিরেই এর যত খ্যাতি। শেক্সপীয়রের কালজয়ী নাটকের চরিত্রগুলোর পরে আর কোনো নাট্যচরিত্র নিয়ে এতটা আলোড়ন তৈরি হয়নি। শেক্সপীয়র তাঁর নাটকের কাহিনী গ্রহণ করেছিলেন ইতিহাস থেকে। অন্যদিকে সমকালীন মানুষের জীবনযাপন ছিল ইবসেনের নাট্যকাহিনীর উৎস। ইবসেনকে তাই বলা হয় ইউরোপীয় বাস্তববাদী নাট্যধারার জনক। লক্ষ করলে দেখা যাবে নোরা চরিত্রের মাধ্যমেই এই বাস্তবতার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ঘটেছিল। নোরা এমনই এক সৃষ্টি, কালের পরম্পরায় যার আবেদন এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
 আ ডলস্ হাউজনাটকের একেবারে শেষে নোরা তার স্বামীর বাড়ির দরোজা বন্ধ করে দিয়ে সেই যে পথে বেড়িয়ে পড়েন, মনে করা হয় সেটাই ছিল নারীমুক্তির সরণি, অচির কালের মধ্যে যার সূত্র ধরে দেশে দেশে নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত আর জয়ী হতে থাকে। ইবসেন অবশ্য নিজে একে নারীমুক্তি না বলে ‘মানবমুক্তি’ বলেই উল্লেখ করেছেন। মহান শিল্পীর মহৎ উক্তিই বটে! নারীবাদীরা এখন তো একথাই বলছেন, নারীমুক্তি মানে মানবমুক্তিই। কিন্তু ইবসেন তাঁর আ ডলস্ হাউজকে নারীবাদের প্রচারপত্রে পরিণত করেননি। নোরাও হয়ে ওঠেনি সেই প্রচারণার মুখপাত্র। শিল্পের দায় মিটিয়েই ইবসেন তাঁর এই নাটকটি রচনা করেন। নোরা একারণেই দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে চিরায়ত হয়ে উঠতে পেরেছে। নারী হিসেবেই তার মানবিক সংগ্রাম উপজীব্য হয়েছে আ ডলস্ হাউজ নাটকে।

সাহিত্যে নারীভাবমূর্তি নারীবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ (Code 2000: 309-11)। কিন্তু ইবসেন শুধু এই ভাবমূর্তি নয়, নারীবাদকেই আ ডলস্ হাউজ নাটকের বিষয়বস্তু করে তুলেছেন। সাহিত্যে নারীকে পারিবারিক-সামাজিক পরিম-লে যে ভূমিকায় দেখানো হয়, সেই ভূমিকা বিচার বিশ্লেষণ করেই সমালোচকেরা কোনো বিশেষ রচনা নারীমুক্তি বা মানবমুক্তির ইশারা দেয় কিনা, তা বিবেচনা করে থাকেন। বিশেষ করে নারীর সনাতন পারিবারিক ভূমিকা — যেমন কন্যা, ভগ্নি, প্রেমিকা, স্ত্রী আর মা হিসেবে নারীকে সাহিত্যে কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেসব বিবেচনা করাই নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার প্রধান লক্ষ্য। মনে করা হয়, এই সমালোচনার মাধ্যমেই নারী-পুরুষের সম্পর্ক সম্বন্ধে লেখকের বদ্ধ বা মুক্তদৃষ্টির (যার মূল কথা নারী-পুরুষের সমতা, ন্যায্যতা, সমানাধিকার ইত্যাদি) পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়। দাম্পত্য জীবনে সমতা, সম্পদের উপর স্বত্ব, দায়িত্ববোধ ও দায়িত্ব পালন, কাজের অধিকার ইত্যাদি নারী-পুরুষের একইরকম কি-না সাহিত্যে নারীবাদীরা এসবেরই অনুসন্ধান করে থাকেন। বিশেষ করে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রধান সূত্র– সংঘাতমূলক পুরুষালি এবং নারীত্বসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি সাহিত্যে কীভাবে, কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, নারীবাদী সাহিত্য সমালোচকেরা সেটাই দেখতে চেয়েছেন (Rogers 1985: 81)। এসব দিক থেকে লক্ষ করলে দেখা যাবে আ ডলস্ হাউজ থেকে ঘোস্ট বা হেড্ডা গ্যাবলার পরম্পরিত পরিপূরক নাটক, যেখানে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে নানাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঘোস্ট নাটকে যেখানে নৈতিক দিক থেকে নারী পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়, সেখানে হেড্ডা অন্য অনেক নায়িকার মতো পরিস্থিতির শিকার হয়ে শুধু নিজের প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে নিজের এবং অন্যদের সর্বনাশ ডেকে আনে। নোরার ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্র যে পুরুষের স্বার্থে নারীদের কীভাবে গৃহের অভ্যন্তরে আটকে দিয়ে তার আত্মবিকাশকে রুদ্ধ করে দেয়, তার সর্বজনীন ছবি পাওয়া যায়।


নোরার কাহিনী, বলা বাহুল্য, একেবারেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নারী-পুরুষের সম্পর্কের গ্রন্থিমোচন এবং আত্মআবিস্কারের মধ্য দিয়ে নোরার যে ব্যক্তিক আত্মোপলব্ধি আর মানবিক আত্মপ্রতিষ্ঠা ঘটে, সেটাই এই নাটকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। পুরুষতন্ত্রের জাল ছিন্ন করেই মানবিক হয়ে ওঠে সে। কিন্তু এর পেছনে কী ইবসেনের নারীবাদী ভাবনা সক্রিয় ছিল কিংবা ইবসেন কী নারীবাদী ছিলেন? সেকাল থেকে একাল– এই প্রশ্নে আ ডলস্ হাউজ-এর সমালোচকেরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ইবসেন বেঁচে থাকতেও তাঁকে এই প্রশ্ন করা হয়েছে। ১৮৯৮ সালের ২৬ মে নিজের সত্তরতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত নওরোজিয়ান উইমেন রাইটস্ লিগের ভোজসভায় ইবসেন এ প্রসঙ্গে বলেন :

I thank you for the toast, but must disclaim the honor of having consciously worked for the women’s rights movement…True enough, it is desirable to solve the woman problem, along with all the others; but that has not been the whole purpose. My task has been the description of humanity. (Ibsen 1964: 337)
এই উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বলা বাহুল্য যে কুড়ি বছর আগে ইবসেনের আ ডলস্ হাউজ নাটকটি রচনার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, তা ব্যাখ্যা করা হয়। ইবসেনের দুনিয়াখ্যাত সমালোচক ও জীবনীকার মরিস ভ্যালেন্সি, মাইকেল মেয়ার, জেমস ম্যাকফারলেন নোরাকে কেন্দ্র করে ইবসেন যে নারীবাদী ভাবনার প্রকাশ ঘটাননি, বারবার তা বলবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নোরার চরিত্রের বিকাশ এবং আ ডলস্ হাউজ রচনার পূর্বাপর ইতিবৃত্ত লক্ষ করলে দেখা যাবে যে তাঁদের ধারণা আংশিক সত্য, মূল সত্য নয়।


কোনো সন্দেহ নেই ইবসেন নারীবাদী প্রচারপত্র লেখেননি, লিখেছেন নাটক। ফলে নোরার যে দ্বন্দ্ব তা নারীর সাধারণ দ্বন্দ্বের চেয়েও আরও অনেক গভীর। কিন্তু অনেকেই এর তাৎপর্য বুঝে উঠতে পারেননি। ইবসেনের মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পর (১৯৫৭) একজন সমালোচক লিখছেন, নোরার সংকটের সঙ্গে “নারী-পুরুষের সম্পর্কের কোনো সম্বন্ধ নেই”। এই নাটকে “একজন নারী কী করে ব্যক্তি হয়ে উঠলো” সেকথাই বলা হয়েছে (Adams 1957)। এর আরও কুড়ি বছর পর, নারীবাদ যখন আন্তর্জাতিক আন্দোলনে রূপ নিয়ে ফেলেছে, মার্কিন-স্ক্যান্ডেনেভীয় সাহিত্যের প্রথিতযশা সমালোচক এইনার হাউজেন লিখলেন :
Ibsen’s Nora is not just a woman arguing for female liberation; she is much more. She is embodies the comedy as well as the tragedy of modern life. (Haugen 1979: vii)
এরও বেশ কয়েক বছর পর মার্কিন সমালোচক ইভোনে শেফার নোরার চরিত্রকে শুধুমাত্র নারীবাদের দ্বারা সংকীর্ণ করে ফেলা হয় বলে তার সমালোচনা করেন (Shafer 1985: 32)। এলাইন হোফমান এরই প্রেক্ষাপটে বলেছেন যে ইবসেনের এই নাটক “আমাদের সময়ের মীথকে ধারণ করে আছে।” তিনি নোরার চরিত্রের মধ্য দিয়ে নারীবাদের সর্বোচ্চ রূপ প্রকাশ পেলেও নাটকটিকে নারীবাদী নাটক বলতে চাননি। প্রখ্যাত ব্রিটিশ নাট্যকার বার্নাড শয়ের মন্তব্যও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি ইবসেনকে “মানবাত্মার সত্যনিষ্ঠ কবি” বলে আখ্যায়িত করেছেন। সমালোচক রবার্ট ব্রুসটেইন নোরাকে অবশ্য আরও চমকপ্রদ এক বিশেষণে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মনে করেন নোরার মধ্য দিয়ে নারীর প্রশ্নটা খুব বড়ো করে দেখেননি ইবসেন। বরং নোরা হচ্ছে “ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীক”। ইবসেনের প্রখ্যাত জীবনীকার হ্যাল্ভডান কোত শেষপর্যন্ত নোরা সম্পর্কে তাই এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন যে নারী সংক্রান্ত তর্কবিতর্ক নয়, “শিল্প আর মানবিক সম্পর্কই” এই নাটকের মূল বিষয়। এসব সমালোচনা, বলা বাহুল্য যে নারী হিসেবে নোরার সংগ্রামকে অনেক ছোট করে দেখেছে। নোরা প্রথমে নারী, তারপরে কীভাবে তার মধ্যে মানবসত্তার স্ফুরণ ঘটলো, কীভাবে তার চরিত্রটি মানবিক হয়ে উঠলো, সেসব লক্ষ করা যেতে পারে। তার নারীসত্তাকে অগ্রাহ্য করে মানবসত্তার ব্যাখ্যা তাই অপব্যাখ্যারই নামান্তর বলা যেতে পারে।

কিন্তু বেশকিছু সমালোচক নারী হিসেবে নোরার সত্তাকে শুধু অগ্রাহ্য নয়, নিন্দামন্দ করে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তাকে আত্মকেন্দ্রিক, অস্বাভাবিক, খ্যাপাটে, হিস্টিরিয়া-আক্রান্ত নারী বলেও চিহ্নিত করেছেন তারা। সমকালের রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা অংশও নোরার পরিণামকে মেনে নিতে পারেনি, বিশেষ করে আ ডলস্ হাউজের শেষাংশ সম্পর্কে তাদের ছিল প্রবল আপত্তি যেখানে নোরা স্বামী ও সন্তানদের ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। ফলে নোরা নয় তার স্বামী টোরভাল্ডই দর্শকদের সহানুভূতি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ইবসেন মূলত এরই চাপে এই নাটকের শেষাংশের নানা পরিবর্তন ঘটান। বিকল্প পাঠ দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্ত সমাজ নয়, শেষ পর্যন্ত শিল্পের জয় হয়। ফলে এসব চেষ্টার পর চূড়ান্ত পরিমার্জন শেষে নাটকটি যখন মঞ্চায়িত হতে থাকে তখন খোদ নরওয়েতো বটেই, জার্মানি, ইংল্যান্ড, অর্থাৎ পুরো ইউরোপ জুড়ে সাড়া পড়ে যায়। এমনকি আমেরিকা ও জাপানেও তার ঢেউ এসে লাগে।

ইবসেন শুধু পরিবারতন্ত্রের ধ্বংস নয়, ঈশ্বরবিরোধী নৈতিকতার অবনতি ঘটিয়েছেন বলেও এই নাটকের মূল বক্তব্যকে রক্ষণশীলরা নাকচ করে দিতে চেয়েছেন। নোরার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো আক্রমণটা করা হয় নৈতিকতার মানদ-ে। ফ্রয়েডবাদের (ফ্রয়েডের নারী-পুরুষ সম্পর্কিত তত্ত্ব) আবির্ভাবের আগে তাকে অনৈতিক, লোভী, মিথ্যেবাদী, স্বার্থপর, ভালোবাসা পাওয়ার অযোগ্য নারী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু ফ্রয়েডবাদের পরে তাকে ‘অস্বাভাবিক’, ‘অপরিপক্ক’, ‘পাগলাটে’, ‘ছিটগ্রস্ত’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। নোরা স্বাভাবিক কোনো নারী নয় বলেই অনেকে মত প্রকাশ করেন। ফলে নোরা একশ্রেণীর সমালোচকের কাছে এই নাটকের ‘নায়িকা’ আর নারীবাদের প্রতিনিধি হবার উভয় যোগ্যতাই হারায়। সমালোচকেরা অবশ্য নোরাকে এরকম তীব্রভাবে আক্রমণ করলেও তার অভিঘাত অগ্রাহ্য করতে পারেননি। বিশেষ করে নারীদের কাছে নোরার গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। নোরাকে নিন্দার যত বিশেষণেই আক্রমণ করা হোক না কেন, এই চরিত্রটি সমকালের নারী ও পুরুষদের মধ্যে নতুন কালের নতুন মানবিক সম্পর্কের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে।
সমকালের বিভিন্ন সমালোচক, যারা আ ডলস্ হাউজকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি, তারা এই নাটকটিকে নোরার “মানবিক” হয়ে ওঠার কাহিনী বলে মনে করেছেন। তাদের মতে মানবিকতার ব্যাপারটি তো নারী-পুরুষ যে-কারো ক্ষেত্রেই হতে পারে। এখানে সেক্সের (নারী ও পুরুষের শারীরিক পার্থক্য) কোনো গুরুত্ব নেই, জেন্ডারেরও নয়। এই নাটকে বরং আত্মআবিস্কার ও ব্যক্তিসত্তাই (সেল্ফ) প্রধান। ফলে নাটকটি নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়নি, নোরার মধ্যেও নারীবাদ আবিস্কার করতে যাওয়া ঠিক হবে না। এই মতের সপক্ষে তাদের যুক্তি হলো, প্রথমত, সত্যিকার শিল্প কখনও বিতর্কমূলক হতে পারে না, ফলে নারীবাদীও নয়। তাদের মতে মানবাধিকারের সংগ্রামের কথা বাদ দিয়ে শুধু নারীর সমঅধিকারের কথা বললে, শারীরিক ও সামাজিক দিক থেকে নারীকে দেখলে, সেই দেখা সংকীর্ণ হয়ে যায়। নারীর অধিকারকে তাই পুরুষের অধিকারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিল্পের দোহাই দিয়ে বলা হলো নারীর সমঅধিকারের আন্দোলন ট্র্যাজেডি বা কবিতার বিষয় হতে পারে না। কেননা এই বিষয়টি সর্বজনীন নয়। নারীপ্রধান যেসব নাটক আছে– যেমন শেক্সপীয়রের ক্লিওপেট্রা, রেসিনের ফায়েদ্রা, স্ট্রিন্ডবার্গের জুলি, বার্নাড শ’র ক্যানডিডার পরিণতি যে কোনো পুরুষেরও হতে পারতো। ফলে কোনো চরিত্র নারী কিনা সেদিক থেকে নয়, শিল্পের বিচারে উত্তীর্ণ চরিত্র কিনা সেটাই মূল কথা। নোরা হেলমারও সেদিক থেকে বলতে গেলে শুধু নিজের কথাই ভেবেছে, নিজের স্বার্থেই স্বামী-সংসার ত্যাগ করে চলে গেছে। উনিশ শতকের ইউরোপীয় (বা নওরোজীয়) বিবাহিত নারী হিসেবে বা শুধু নারী হিসেবে নোরার দ্বন্দ্ব তাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। নোরার পরিণাম সম্পর্কে তাদের, অর্থাৎ দর্শকদের বিচলিত না হলেও চলে। কিন্তু এসব সমালোচনা, বলাবাহুল্য যে একেবারেই একপেশে, একচক্ষুবিশিষ্ট। অত্যন্ত ইবসেন যা মনে করেছেন এবং নাটকের কাহিনীর বিকাশ যেভাবে ঘটেছে, নারী-পুরুষের সম্পর্কের যে মাত্রা এতে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে নাটকটি লেখাই হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। ইবসেনই জানিয়ে গেছেন সেই বিশেষ উদ্দেশ্যের কথা, “আমি যদি সততার সঙ্গে বলি তাহলে বলতে হয় যে শেষ দৃশ্যের জন্যই আসলে পুরো নাটকটি লেখা হয়েছে।” এই দৃশ্যটিই, বলা বাহুল্য, নারীবাদী ভাবনা ও বিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। লক্ষ করলে দেখা যাবে, তিনটি দিক থেকে আ ডলস্ হাউজ নারীবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লেখা হয়েছে।

প্রথমত, প্রথম দিকের নারীবাদীরা নারী-পুরুষের তুলনামূলক অবস্থার বিবরণ তুলে ধরছিলেন। কেউ কেউ নারীর করুণ অবস্থার জন্য পুরুষদের প্রতি অভিযোগের আঙুলও তুলছিলেন। নোরাকেও দেখা যায়, তার করুণ অবস্থার জন্য সে তার বাবা এবং স্বামীকে অভিযুক্ত করছে। সে জানাচ্ছে যে তারা দুজনেই পাপ করেছে, “আমার বাবা এবং তুমি আমার প্রতি ভয়ানক অন্যায় করেছ। তোমাদের পাপেই তোমাদের দোষেই আমার জীবনে কিছু হল না।” মেরি উলস্টোনক্রাফট্ও অভিযোগ করেছেন যে নারীর জন্ম হয়েছে বুঝি শুধু পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। নারীকে এজন্য হয় “ভদ্র-নম্র, গৃহপালিত পশু”। নোরাও নিজেকে অনেকটা এরকমই ভেবেছে– তার মনে হয়েছে সে যেন এক পুতুল-স্ত্রী, যাকে ফন্দিফিকির করে বাঁচতে হয়। মার্গারেট ফুলারও এরকমই একটা উপমা ব্যবহার করেছেন নারীদের সম্বন্ধে, “পুরুষেরা কোনো নারী চায় না, চায় বালিকা, যার সঙ্গে সে কেলি করতে পারবে।”
দ্বিতীয়ত, নারীবাদী বিবর্তনের দ্বিতীয় ধারায় উনিশ শতকে নারীর বৌদ্ধিক ও আত্মিক উন্নয়নের ওপরই জোর দিয়েছিলেন নারীবাদীরা। নোরাও ঠিক এমনটাই ভেবেছে, কোনো কাজের যোগ্য নয় সে। কারো স্ত্রী হবার, সন্তানের মা হবার। নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে না পারলে আসলে নারীর মুক্তি নেই। আত্মোপলিব্ধর মুহূর্তে নোরা হেলমারকে সেকথাই জানাচ্ছেন, “…আর একটি কাজ আছে যেটা আমাকে সবার আগে শেষ করতে হবে– নিজেকে শিক্ষিত করা।” হারিয়েট মার্তিনিউ বলেছেন, “নারীকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে পুরুষের সহযাত্রী হবার জন্য, খেলা বা দাসী হবার জন্য নয়” (Rossi 1973:186)।
সবশেষে নোরা মনে করে “স্ত্রী ও মায়ের” চাইতেও তার উচ্চতর আরও একটা দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব হচ্ছে তার “নিজের প্রতি দায়িত্ব”। (১২১) নারীবাদী চিন্তার মূল কথা এটাই। নারী কোনো দিক থেকে– নৈতিক-বৌদ্ধিকভাবে পুরুষের তুলনায় ন্যূন নন। এসব ক্ষেত্রে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করা শুধু তার অধিকার নয়, দায়িত্বও বটে। এর উন্নয়নেও তাকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। উলস্টোনক্রাফ্টতো সেকথাই জানিয়ে গেছেন : “নারীর চূড়ান্ত কাজটা হবে তার নিজের বিকাশ সাধনে যা কিছু দরকার তা-ই করা।”

আইন ও ভালোবাসার মধ্যে দ্বন্দ্ব, এটাই হচ্ছে এই নাটকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ক্রোগস্টাডের সঙ্গে জালিয়াতি করে নোরা স্বামীর জীবন রক্ষার জন্য যে চুক্তি করে, সেটাই তার অপরাধ। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোনো স্ত্রীর কী অধিকার নেই স্বামীর জীবন বাঁচানোর? নোরা সেই প্রশ্নটাই করেছে এই নাটকে : “…স্বামীর জীবন রক্ষার অধিকার কি স্ত্রীর নেই? আইন সম্বন্ধে আমি তেমন কিছু জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আইনে এই ব্যাপারটিকে কোথাও-না-কোথাও বৈধ করা হয়েছেই।” নোরার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো তার প্রতি ডাক্তার র‌্যাঙ্কের দুর্বলতাকে নোরা প্রশ্রয় দিয়েছে, যা অনৈতিক। নোরা যেহেতু বিবাহিত এবং তার স্বামী-সন্তান রয়েছে, সুতরাং কোনো পুরুষকে তার প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। পারিবারিক যে-কোনো মানদ- অনুসারে এই অভিযোগও অযৌক্তিক। কেননা সংকটের মুহূর্তে নোরা যখন দিশেহারা, ডাক্তার র‌্যাঙ্ক তখন সাহায্যের উদার হাত বাড়িয়ে দিলেও নোরা সেই সাহায্য গ্রহণ করেননি। অথচ ডাক্তার র‌্যাঙ্ক তাকে সাহায্যের জন্যে একরকম মুখিয়েই ছিলেন। তবে নাটকের আভ্যন্তর সংলাপ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে এই পুরুষই যে তাকে নারী হিসেবে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছে, নোরার তা বুঝতে বাকি থাকেনি। ডাক্তার র‌্যাঙ্কের মাধ্যমেই নোরা উপলব্ধি করে যে তার স্বামী কতটা আলাদা ধরনের মানুষ।
নোরার চরিত্রকে তাই শুধু মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাটাই বড়ো কথা নয়। তাকে প্রথমে নারী, এরপর তার মানবিক অবস্থান বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করেছেন সমালোচকেরা। কেননা নোরাকে যদি শুধু মানবিক হয়ে ওঠার দিক থেকে দেখা হয়, তাহলে নারীর আবহমানকালের যে সংগ্রাম তার চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে, তা গৌণ হয়ে যায়। নোরার চরিত্রকে যেসব সমালোচক অসম্পূর্ণ বলে মনে করেন তাদেরও কীভাবে তার চরিত্রটি অবিনির্মিত (deconstruction) হতে পারে জোনাথন কালারের ব্যাখ্যা অনুসরণে তা বিনির্মাণ করে দেখানো প্রয়োজন (Culler 1982: 86)। কিন্তু কোনো সমালোচকই এখনও অবধি এই বিকল্প ব্যাখ্যা দেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। বরং গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, স্বামী টোরভাল্ড সব সময় এই নাটকে প্রাধান্যের জায়গায় থেকে কথা বলেছে। স্ত্রী নোরাকে সে অধস্তন মনে করেছে। নোরার চরিত্রকে যেসব সমালোচক স্বার্থপর আর নারীর মতো নয় বলে মনে করেছেন, তারা আসলে টোরভাল্ডের চোখ দিয়েই নোরাকে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাদের নোরা টোরভাল্ডেরই নোরা। এই সব সমালোচকের অধিকাংশই আবার পুরুষ। কিন্তু ইবসেন প্রকৃতপক্ষে কী চেয়েছিলেন? নোরা চরিত্র নির্মাণের পেছনে কী ছিল তাঁর লক্ষ্য? এই বিষয়টি, কোনো সন্দেহ নেই, গভীর অভিনিবেশ আর জেন্ডার সংবেদনশীল মুক্তদৃষ্টি দিয়ে দেখা উচিত।


Her home – out there
On liberty’s sea
Where the poet sets sail
Where his thoughts roam free.
Henrik Ibsen


ইবসেনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি আ ডলস্ হাউজ। এই নাটকের প্রধান চরিত্র নোরা হেলমার। ইবসেন গভীর মমত্ব আর অনুরাগ নিয়ে এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন। প্রশ্ন হলো ইবসেনের কোন মন্তব্যটি যথার্থ? নাটকটি রচনার কুড়ি বছর পর নওরোজিয়ান উইমেন রাইট্স লিগের ভোজসভায় ‘মানবতা’ই এর মূল বিষয়বস্তু বলে উল্লেখ করছিলেন সেই কথাগুলো, নাকি নাটকটি রচনার অব্যবহিত মুহূর্তে যা বলেছিলেন সেই কথাগুলো? প্রকৃতপক্ষে নাটকটি রচনার মুহূর্তে যে-কথাগুলো তাঁর মনে এসেছিল সেই কথাগুলোকেই আমরা অনেক বেশি আন্তরিক আর অকৃত্রিম বলে ধরে নিতে পারি। ইবসেন তখন বলেছিলেন :
A woman cannot be herself in contemporary society, it is an exclusively male society with laws drafted by men, and with counsel and judges who judge feminine conduct from the male point of view. (MacFarlane and Orton 1966: 436)
নোরার সংঘাত ও সংগ্রাম তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, কোনো নারী বা পুরুষের আত্মানুসন্ধানের কাহিনী নয়, নাট্যকার ইবসেনের মতে “প্রত্যেক পুরুষের সঙ্গে প্রত্যেক নারীর সংগ্রাম”ই এই নাটকের উপজীব্য বিষয় (Templeton 1997: 125)। ১৮৭৯ সালের বসন্তে নাটকটি লেখার পরিকল্পনা করার সময় ইবসেনের জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটে যা থেকে নারী আন্দোলনের প্রতি তাঁর যে সুস্পষ্ট সমর্থন ছিল তা বোঝা যায়। ইবসেন তখন রোমে। রোমের স্ক্যান্ডিনেভীয় ক্লাবের নির্বাচনে নারীরা যাতে ভোটদানের সুযোগ পান সেজন্য প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে এর সদস্যদেরকে তার প্রস্তাব সমর্থনের আহ্বান জানান। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি প্রশ্ন করেন :
Is there anyone in this assembly who dares to claim that our women are inferior to us in culture, intelligence, knowledge, or artistic talent? I don’t think many men would dare to suggest that. (Templeton 1997: 126)|
ইবসেনের জীবনীকার মেয়ার জানাচ্ছেন ঠিক এর দুমাস পরেই ইবসেন আ ডলস্ হাউজ লেখা শুরু করেন (Meyer 1971: 450)। সমকালের মানুষের কাছে এই নাটকটি ছিল সুস্পষ্টভাবে নারীপ্রসঙ্গ নিয়ে লেখা নাটক। ফলে ১৮৮০ দশকের পর থেকে এই প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে আ ডলস্ হাউজের অসংখ্য উচ্ছ্বসিত সমালোচনা প্রকাশিত হতে থাকে। সমালোচকেরাও ছিলেন সেকালের সব বিখ্যাত ব্যক্তি Ñ লুই আন্দ্রে-সালোমে, আল্লা নাজিমোভা, জর্জ ব্রান্ড, অগুস্ত স্ট্রিন্ডবার্গ প্রমুখ। তাঁরা সবাই এবং পত্রপত্রিকাতেও তখন লেখা হচ্ছিল যে এই নাটকের মূল বিষয় হচ্ছে পুরুষ কর্তৃক নারীর অধস্তনতা। এরই প্রতিক্রিয়ায় নরওয়েতে নারী-পুরুষের নতুন সামাজিক বিন্যাস আসন্ন হয়ে ওঠে। নাটকটি প্রকাশের পাঁচ বছর পর ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নওরোজিয়ান উইমেন্স রাইট্স্ লিগ। ইবসেন ওই সংগঠনের সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৮৯০ সালে (অর্থাৎ নাটকটি প্রকাশের ১১ বছর পর) বেটি হেনিংস লেখেন, “শিক্ষার অধিকার, কাজের স্বাধীনতা আর রাজনৈতিক ভোটাধিকার শুধু নয়, সভ্য সমাজে একজন সাধারণ বয়স্ক মানবপ্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার” নারীর যে থাকা দরকার, ইবসেনের নোরা তা দেখিয়ে দিয়েছে (Hennings 1890: 9)। ইবসেন এরকমও মত প্রকাশ করেন যে প্রগতিশীল দল গঠন করে আন্দোলন করা না হলে ইউরোপে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলন সফল হবে না। ফলে ইবসেন শুধু নারী অধিকার সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন না, তিনি সেই সংগ্রামের সঙ্গে যুক্তও ছিলেন। তবে সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে তিনি নিজের মতো করে সমাধানের কথা লিখেছিলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলন করা তাঁর স্বভাবে ছিল না। ইবসেনের জীবনীকারদের মতে তিনি শিল্পী হিসেবে ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ এবং জন্মগতভাবে তার্কিক। তবে তিনি শুধু মহৎ ভাবের দ্বারা জীবনকে চালিত করতে চাননি, আবার সমকাল সম্পর্কেও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। নারীবাদের প্রতি তাঁর যে অকুণ্ঠ অকৃত্রিম সমর্থন ছিল সমকালীন নওরোজীয় ঔপন্যাসিক, সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ক্যামিলা কোলেতকে লেখা চিঠি থেকেও তা বোঝা যায় (Templeton 1997: 128)।
প্রকৃতপক্ষে নোরার ভাবনা ইবসেনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিল। তাঁর প্রথম দিকের বিভিন্ন রচনায় নারীবাদী ভাবনাও অনেকটা জুড়ে ছিল। এই ভাবনার সূত্রপাত ঘটে লেডি ইঙ্গার অব ওস্ত্রাত রচনার মাধ্যমে। এই রচনায় মানবিক সম্পর্ক যে জেন্ডার পার্থক্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার উল্লেখ রয়েছে। এরপর দ্য ভাইকিংস অ্যাট হেলগিল্যান্ড, লাভস কমেডি, দ্য প্রিটেনডারস, ব্র্যান্ড, এমপেরর অ্যান্ড গ্যালিলিয়েন, দ্য পিলারস অব সোসাইটি শীর্ষক বিভিন্ন রচনাতেও নারী-পুরুষের সম্পর্ককে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। নাটকের ইতিহাসের দিক থেকে পিলারস অব দ্য সোসাইটি উনিশ শতকের একটা গুরুত্বপূর্ণ নাটক। আধুনিক জীবনের গদ্যনাট্যরূপ আর নাটকীয় বাস্তববাদের জন্য এই নাটকটি উল্লেখযোগ্য। এই নাটক রচনার জন্য ইবসেন ক্যামিলা কোলেতের সঙ্গে সমকালীন নারীবাদ সম্পর্কে কথা বলতেন। কোলেতও চাইতেন ইবসেন নারীবাদ নিয়ে নাটক লিখুন। নরওয়ের নারীবাদী নেত্রী ও বিদ্রোহী নারী আস্তা হানস্তিনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ইবসেন নির্মাণ করেন পিলারস অব সোসাইটি নাটকের লোনা হেসেল চরিত্রকে। এই নাটকে এরকম আরও একটি নারীচরিত্র আছে- ডিনা। লোনা ও ডিনা নতুন কালের নতুন দুই নারী, যারা স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে গুরুত্ব দেয়, নিজেরাই অর্থ উপার্জন করে জীবন নির্বাহ করে, প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, যাপন করে একক জীবন। ডিনাতো তাঁর হবু স্বামীকে বিয়ের আগেই স্পষ্ট করে জানায়, “প্রথমে আমি কাজ করতে চাই। তোমার মতো একটা কিছু হতে চাই। আমি এমন কিছু হতে চাই না যাকে অগ্রাহ্য করা যায়।” পিলার অব সোসাইটি নাটকটি খুবই স্বল্পপরিচিত নাটক। কিন্তু এটিই মূলত উনিশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারীবাদী নাটক। এই নাটকের দুটি সংলাপ এরকম : বার্ণিক নামের এক পুরুষ বলছে, “তোমরা, মানে নারীরাই সমাজের স্তম্ভ।” কিন্তু এক নারী প্রত্যুত্তরে বলে, “না প্রিয়, সত্য আর স্বাধীনতাই সমাজের স্তম্ভ।”


একজন গবেষক দেখিয়েছেন, নোরা কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়। ইবসেনের জীবনেই কন্যাতুল্য এরকম এক নারীর আবির্ভাব ঘটে যার নাম ছিল লরা পিটারসন কেইলার (১৮৪৯-১৯৩২)। ইবসেন পরিবারের সঙ্গে তার দারুণ সখ্যতা গড়ে ওঠে। উনিশ বছর বয়সে লরা ব্র্যান্ডের কন্যারা (ব্র্যান্ড নামে ইবসেনও একটি নাটক লেখেন) নামে একটি নাটক লিখে ইবসেনের কাছে পাঠিয়ে দেন প্রকাশের জন্য। লরা বিয়ে করেছিলেন ভিক্টর কেইলার নামের এক ডেনিশ নাগরিককে। কেইলার যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে টাকা ধার করে তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য লরা ইতালি নিয়ে যান। সুস্থ হওয়ার পর স্বামী যখন জানতে পারে লরা সেই ধার শোধ করার জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে, তখন সে এই বলে লরার বিরুদ্ধে বিচ্ছেদের মামলা করে যে লরা তার সন্তান পালনের উপযুক্ত মা নন। ভিক্টর এরপর আদালতের নির্দেশে তাদের দুই সন্তানকে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নেয় আর স্ত্রীকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেয়। পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভিক্টর স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়। লরা আবার দাম্পত্যজীবন শুরু করে। লরার এই কাহিনী ইবসেনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এরই প্রতিক্রিয়ায় তিনি লেখেন আ ডলস্ হাউজ নাটকটি। লক্ষণীয় লরার কাহিনীই হচ্ছে আ ডলস্ হাউজ-এর কাহিনী। তবে বাস্তবের এই কাহিনীকে শিল্পের প্রয়োজনে আর নিজের উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ রেখে ইবসেন অনেকটাই বদলে ফেলেন। লরা ছিলেন লেখক, নোরা গৃহবধূ। লরা লিখে ধার শোধ করতে চেয়েছেন, নোরা কপি করে স্বামীকে সাহায্য করেছেন। তবে লরার স্বামী তাকে মাতৃত্বের জন্য যে অনুপযুক্ত বলেছিলেন, ইবসেন সেই সূত্রটিকে নাটকে ঠিকই ব্যবহার করেছেন আর বদলে দিয়েছেন লরার পরিণামকে। লরা স্বামীর কাছে ফিরে আসে কিন্তু নোরা স্বামীকে ত্যাগ করে চলে যায়। ইবসেন ঠিকই বলেছিলেন যে এই শেষ দৃশ্যটির জন্যই নাটকটি লিখেছেন তিনি। এভাবেই এক মহান শিল্পী রচনা করেন চিরায়ত এক নাটক আ ডলস্ হাউজ। লরা যখন সংকটের মধ্য দিয়ে চলছিলেন ইবসেন সেই সময় একটা নোটে লেখেন :
She has committed a crime, and she is proud of it; because she did it for love for her husband and to save his life. But the husband, with his conventional view of honor, stands on the side of the law and looks at the affair with male eyes. (MacFarlane and Orton 1966: 437)
উল্লিখিত নোটে ইবসেন যে মন্তব্য করেন, পরবর্তীকালে আ ডলস্ হাউজে দেখা গেল সেই ভাবনারই প্রতিফলন। ইবসেন যে নারী-পুরুষের সম্পর্ক বা জেন্ডার কিংবা নারীবাদ নিয়ে কত গভীরভাবে ভেবেছিলেন, এই নোটের মন্তব্যগুলো লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়।


A breaker of the law? Perhaps –
Yet something shines above all laws,
Even as the crown of mist
Above the mountain-top.
Henrik Ibsen

নারী ও পুরুষ– দুই পৃথিবী তাদের। সভ্যতার শুরু থেকেই এই বিভাজন চলে আসছে। বিভাজনের সূত্রপাত করে পুরুষ। এরই প্রভাবে পুরুষতন্ত্র পৃথিবী জুড়ে সর্বজনীন হয়ে ওঠে। পুরুষ ভেবেছে সে-ই শ্রেষ্ঠ, নারী থাকবে তার অধস্তন হয়ে। সমস্ত কর্তৃত্ব তারই। পুরুষতন্ত্রেরই একটা প্রতীক হচ্ছে ঘর। পুরুষ মনে করে এটাই নারীর পৃথিবী। এই ঘরে পুতুলই মানায়। নারী হচ্ছে সেই পুতুল। পুরুষ একথাই ভেবেছে আর নারীর সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করেছে। এই আচরণের মধ্যে আছে তীব্র অহংবোধ, বীরত্বের ভাব (chivalry)। এ থেকেই পৌরুষের সৃষ্টি। আ ডলস্ হাউজের শুরু থেকেই এই পৌরুষ আর বীরত্বের ভাব দেখিয়ে চলে নোরার স্বামী টোরভাল্ড হেলমার আর পুতুল পুতুল আচরণ করে নোরা। নারী আর পুরুষের এই দুই পৃথিবীর কথা অন্য কোনো নাটকে এতটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি যতটা ধরা আছে এই নাটকে। নোরাকে কেন্দ্র করেই পুরুষতান্ত্রিক এই পৃথিবী যে কত করুণ আর অমানবিক হয়ে উঠতে পারে, পাঠকের চোখে সহজেই তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। নারী-পুরুষের এই বিভাজিত পৃথিবী, সাম্প্রতিক কালে নারীবাদীরা বলছেন যে এ হচ্ছে একধরনের মতাদর্শিক নির্মাণ। এই মতাদর্শের কারণেই নারী ও পুরুষের সম্পর্ক অসম হয়ে গেছে। কেবল নারী হয়ে জন্মাবার কারণে তার পৃথিবী আলাদা করে ফেলা হয়েছে (Kelly 1984: 52)। বিশ্বসাহিত্যে দ্বিতীয় এমন কোনো নাটক নেই যেখানে এরকমভাবে স্বামীর ভণ্ডামি, কূপমণ্ডুকতা, অহংবোধ, স্বামীকে পরিত্যাগ করে চলে যাওয়া, কাজের জগত থেকে নারীকে বাইরে রাখা কিংবা নারী কেন অধস্তন হয়ে পড়ে সে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

ইবসেনের স্বামী-স্ত্রী পুতুলের সংসার-এর দম্পতি মূলত স্ক্যান্ডেনেভীয় বিয়ের বুর্জোয়া ধারণাকেই প্রতিফলিত করে। এই ধারণা অনুসারে স্বামী শ্রেষ্ঠ আর যে-কোনো বিচারে স্ত্রীর স্থান তার নিচে। এই ধারণা অনুসারে স্ত্রী হবে স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, স্বামীর প্রতি অনুগত। নোরার প্রতি টোরভাল্ডের আচরণ আর উচ্চারণ থেকে বোঝা যায় যে সে নিজেকে নোরার অভিভাবক, পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করে। এমনকি টারান্টালা নাচটাও কিভাবে নাচতে হবে সে ব্যাপারেও সে খবরদারি করে। প্রথম থেকেই সে নোরাকে এমন ভাষায় সম্বোধন করে যা থেকে তার কাছে নোরার অবস্থান কী তা বোঝা যায়। প্রথম দৃশ্যের কথাই বিবেচনা করা যাক। এই দৃশ্যে নোরাকে টোরভাল্ড তিনবার লার্ক গানের পাখি, তিনবার কাঠবিড়ালি, একবার শূন্যমস্তিস্ক নারী এবং তিনবার অমিতব্যয়ী পাখি বলে সম্বোধন করেছে। প্রথম দৃশ্যেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী যে পুরুষের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল সে কথা বুঝিয়ে দেন ইবসেন। নোরাও স্বামীর কথা মেনে নেয়। কিন্তু টোরভাল্ড একথা শোনাতে ভোলে না যে, “এটা হল একটি ছোট্ট মিষ্টি পাখি। তবে এ পাখি পুষতে খরচ অনেক।” এভাবেই সামান্য খুনসুটির মধ্য দিয়ে স্বামী টোরভাল্ড তার ওপর যে নোরা নির্ভরশীল সে কথা বলে। নোরাও জানায়, “তুমি যা পছন্দ কর না আমি কখনো তা করি না।” এই দৃশ্যেই দেখা যায়, টোরভাল্ড নোরাকে একটু-আধটু আদর করে ঠিকই কিন্তু ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেয়। নোরা আটকে যায় গৃহের বৃত্তে, পুতুলের সংসারে। নোরাকে তাই বলা যায় সামান্য এক পোষা বউ (pet wife), স্বামী টোরভাল্ড তার দয়ালু রক্ষক। একসময় সংসারের প্রয়োজনে নোরাও কাজ করেছে, তবে সেই কাজ ছিল সূচির কাজ, ‘কুরুশ-কাঁটার কাজ, এমব্রয়ডারি’। শুরু থেকেই তার চরিত্রের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা, সাহস, আত্মগৌরবের অভাব দেখা যায়। একবার সে টোরভাল্ডের কাছে ভিক্ষে করার মতো করে টাকাও চেয়ে বসে। সংকীর্ণ এই ‘নারীর পৃথিবী’ আর সেই পৃথিবীতে ফিরে স্বামীরা কীরকম আচরণ করে, সে সম্পর্কে ইবসেনের ধারণা যে কতটা স্পষ্ট আর গভীর ছিল, নাটকটি রচনার কুড়ি বছর পর শার্লট পারকিন্স গিলমানের একটি লেখাতে তার উল্লেখ পাওয়া যায় :
The man, spreading and growing with the world’s great growth, comes home, and settles into the tiny talk and fret, or the alluring animal comfort of the place, with a distinct sense of coming down. It is pleasant, it is gratifying to every sense, it is kept warm and soft and pretty to suit the needs of the feebler and smaller creature who is forced to stay in it. (Gilman 1898: 263)

সামাজিক-পারিবারিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, নোরা একজন প্রান্তিক নারী। শুধুমাত্র নারী হবার কারণেই সে প্রান্তিকতার শিকার। অর্থ উপার্জন আর ব্যয়– এই একটি দিক থেকেই ইবসেন বুঝিয়ে দিয়েছেন যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী কতটা প্রান্তিক হয়ে পড়ে। উপার্জন তো দূরের কথা নারী হিসেবে নোরা স্বামীর অনুমতি ছাড়া টাকা ধারও করতে পারে না। তাকে অবৈধ পথের আশ্রয় নিতে হয়। অর্থনৈতিক কারণেই নারীর অবস্থা অধস্তন হয়ে পড়ে। অবৈধ পথে যদিওবা নোরা টাকা ধার করেছে, পরিশোধ করা হয়ে পড়েছে আরও দুরূহ। কিন্তু নোরা যে টাকা ধার করে, কিংবা খরচ করে, তার কোনোকিছুই নিজের জন্য নয়, স্বামী আর সন্তানদের জন্য। লিন্ডেকে সে বলে : “হ্যাঁ, এটা গর্বেরই বটে, তুমি তোমার মার জন্য করেছ, তোমার ভাইদের জন্য করেছ। আমি করেছি আমার স্বামীর জন্য। আমি টোরভাল্ডের জীবন রক্ষা করেছি। আমি তাকে বাঁচিয়েছি।” স্বামীর টাকা সে “কখনো অর্ধেকের বেশি খরচ” করেনি, “সব সময় শাদাসিধে কমদামি জিনিস” কিনেছে। স্বামী আর সন্তানদের সুখে রাখার জন্য কাজ খুঁজে পাওয়া, রাত জেগে কপি করে টাকা উপার্জন করার মধ্যে নোরা আনন্দ খুঁজে পায়, গর্ববোধ করে। এ প্রসঙ্গে লিন্ডেকে সে জানায় : “…আমি আরো উপার্জনের পথ খুঁজে বের করলাম। গত শীতে সৌভাগ্যক্রমে অনেকগুলো কপি করার কাজ জুটে গেল– একেবারে দরজা বন্ধ করে লিখতে লেগে গেলাম। কখনো কখনো মাঝরাত পার হয়ে যেত। ওহ্ দু-একসময় এত ক্লান্ত লাগত যে সে-কথা আর কী বলব। তবুও ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ মজার ছিল– বসে বসে কাজ করা আর টাকা উপার্জন করা। প্রায় পুরুষমানুষের মতো কাজ করেছি তখন।”

ইবসেন নোরার মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রের গতিপথ এভাবেই ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তাকে পুরুষালি বৈশিষ্ট্যে ধীরে ধীরে গড়ে তুলে নারী-পুরুষের পার্থক্যের যে বোধ সমকালীন সমাজে বিরাজ করছিল, পাথর্ক্যরে সেই বোধে আঘাত করেছেন। যে-কাজ মূলত পুরুষের সেই বড়ো কাজটিই নোরা করেছে– স্বামীর জীবন রক্ষা করেছে। অথচ এই স্বামীই সেরে ওঠার পর, আমরা নাটকে দেখতে পাই, পুরুষের সনাতন ভূমিকায় ফিরে গেছে। হয়ে উঠেছে নোরার রক্ষক, অর্থের যোগানদাতা, আচার-আচরণের (যেমন টাকা ব্যয় করা, নাচের খবরদারি করা) সতর্ক পর্যবেক্ষক। এখানেই শেষ নয়, নোরা যখন জানায় টোরভাল্ডের জীবন বাঁচানোর জন্যই ক্রোগস্টাডের কাছ থেকে বাবার সই জাল করে টাকা ধার করেছে, তখনই টোরভাল্ডের পুরুষতান্ত্রিক চেহারা দর্শকদের কাছে একেবারে নগ্ন হয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে নায়ক থেকে সে খলনায়কে পরিণত হয়। নোরাকে সে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে আক্রমণ করে বসে। তবে এই নাটকের বাঁকমুহূর্তটি আসে এর কিছু পরেই। ক্রোগস্টাড যখন নোরাকে তার জালিয়াতি থেকে মুক্তি দিয়ে চিঠির বাক্সে চিরকুট ফেলে যায়, তখন টোরভাল্ডের নারীরক্ষকের বীরত্বের (chivalry) মুখোশ একেবারে খসে পড়ে। তার অন্তঃসারশূন্য, স্বার্থপর, কপট রূপ দেখে ফেলার পরই নোরার সকল মোহভঙ্গ ঘটে যায়। নোরা অর্থ জালিয়াতি করেছিল স্বামীকে বাঁচানোর জন্য, সে ভেবেছিল ক্রোগস্টাডের সঙ্গে দ্বন্দ্বে টোরভাল্ড তার পাশে দাঁড়াবে, মুখোমুখি হবে সত্যের। কিন্তু এর পরিবর্তে নোরা দেখলো তার নীতিজ্ঞানশূন্য আত্মকেন্দ্রিক রূপ। হেলমারকে চেনার সেই মুহূর্তটি এরকম :
হেলমার : (বাতির কাছে গিয়ে) ওহ–সাহস হচ্ছে না–এ ক্ষুদ্র চিঠির মধ্যে হয়ত আমাদের সর্বনাশ লেখা আছে। নাহ্! আমাকে জানতেই হবে! (চিঠিটা ছিঁড়ে কয়েক লাইনের উপর গড়গড় করে চোখ বুলায়। উল্টিয়ে সংযুক্ত একটি কাগজ দেখে–তারপর আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।) নোরা! (নোরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।) নোরা–দাঁড়াও আমি আবার পড়ছি–হ্যাঁ, সত্যই। ওহ্ বেঁচে গেলাম। নোরা আমি বেঁচে গেছি, ওহ্–আমি বেঁচে গেছি।
নোরা : আর আমি?
টোরভাল্ডের উল্লিখিত সংলাপটি লক্ষণীয়। সর্বনাশের ক্ষেত্রে টোরভাল্ড উভয়ের (‘আমাদের’) সর্বনাশের কথা ভাবলেও রক্ষা পাওয়ার সময় ‘আমি’ সর্বনামটি দু-বার ব্যবহার করেছে। এই কথপোকথনের মধ্য দিয়ে নোরার কাছে টোরভাল্ডের নীতিশূন্য আত্মকেন্দ্রিক রূপটি স্পষ্ট হয়ে যায়। এ কারণেই প্রায় আর্তনাদের মতো নোরা উচ্চারণ করে, “আর আমি?” অর্থাৎ এতদিন ধরে স্বামীর যে আদর্শায়িত রূপটি সে নিজের মধ্যে লালন করে আসছিল, মুহূর্তের মধ্যে তা ধূলিস্মাৎ হয়ে যাওয়ায় নোরা মানসিকভাবে নিক্ষিপ্ত হয় অপার শূন্যতার গহ্বরে। অথচ একটু আগেই টোরভাল্ড নোরাকে একজন নীতিবাগীশের মতো কত বড়ো বড়ো কথাই না বলছিল :
তুমি আমার সব সুখ নষ্ট করেছ, শান্তি বিনাশ করেছ–সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছ আমার গোটা ভবিষ্যৎ। ওহ্–এটা চিন্তাই করা যায় না! আমি এখন নীতিজ্ঞানশূন্য একটা অবিবেচকের হাতের মুঠোয়। সে এখন আমাকে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করাতে পারে। তাকে জিজ্ঞাসা কর সে আমার কাছে কী চায়–তার ইচ্ছামতো আমাকে নির্দেশ দিতে বল–এখন তো আমার আর ‘না’ করার শক্তি নেই। তোমার মতো একজন অবিবেচক অপদার্থ মহিলার জন্য দেখ, কী করুণ অধঃপতন আমার!
নিজের আসন্ন সর্বনাশের ইঙ্গিত পেয়ে পুরুষের অহংবোধ ওই মুহূর্তে অবদমিত থাকলেও ক্রোগস্টাডের কাছ থেকে বন্ডটা ফেরত পাবার পরপরই আবার সেই বোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বীররক্ষকের ভূমিকায় (chivalrous protector) আবার অবতীর্ণ হয়। এবার তাঁর সংলাপের মধ্যে পাখি-প্রতিমার চমৎকার ব্যবহার করেছেন ইবসেন :
ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তুমি নিশ্চিন্তে আরাম কর আর আমি আমার পাখা দুটি দিয়ে তোমাকে আড়াল করব।…ক্ষিপ্র বাজের তীক্ষ্ম নখের কবল থেকে পালিয়ে আসা পাখির মতো তোমাকে আমি অভয়ারণ্য দেব।
কিন্তু একটু আগেই যে নোরা ছিল হেলমারের নাচের সঙ্গী, পুতুল, সে ইতিমধ্যে তার নাচের পোশাক বদলে ফেলেছে। পুতুল থেকে নোরা এভাবেই একজন আত্মসচেতন দৃঢ়চেতা নারীতে রূপান্তরিত হলো। কোনো কোনো সমালোচক বলেছেন, নোরার চরিত্রটি যেহেতু একজন একক নারীর আত্মসচেতন হয়ে ওঠার কাহিনী, ফলে তার চরিত্রটি কোনো নারীবাদী চরিত্র নয়। কিন্তু এই ধারণা যে কত ভ্রান্ত, সিমোঁ দ্য বোভেয়ারের নারীর ক্ষেত্রে “যা কিছু ব্যক্তিগত, তাই রাজনৈতিক” কথাটি স্মরণ করলেই বোঝা যায়! টোরভাল্ডের অন্তঃসারশূন্য, কপট রূপটিই নোরাকে তার বিবাহিত জীবনের অর্থ-অনর্থ, সন্তানদের সঙ্গে তার সম্পর্কের স্বরূপ প্রকৃতপক্ষে কী, সেই বোঝাপড়া বা নোরার ভাষায় “দেনাপাওনা-হিসেবনিকেশের” জায়গায় নিয়ে আসে। নোরার তখনি মনে হয়, আট বছর তাদের বিয়ে হয়েছে কিন্তু স্বামী-স্ত্রী কখনও কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেনি। নোরার বাবা ও স্বামী দু-জনই তাকে “ভুল বুঝেছে”। এমনকি জগত-জীবন সম্পর্কে নোরার নিজস্ব ধারণার কোনো গুরুত্ব ছিল না। নোরা এ প্রসঙ্গে এখন জানাচ্ছে, “…বাবার ধারণাটাই আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিল। কখনো যদি আলাদা করে ভেবেছি–সেটা তাকে বলতে পারি নি, বরং লুকিয়েছি। কারণ জানতাম সেটা সে পছন্দ করবে না। সে আমাকে তার ছোট্ট পুতুল বলে ডাকত–আমি যেমন আমার পুতুলের সঙ্গে খেলা করতাম আমার বাবা তেমনই আমার সঙ্গে খেলা করত। তারপর আমি তোমার ঘরে বসবাস করতে এলাম…আমি আমার বাবার হাত থেকে তোমার হাতে পাচার হলাম, তুমি সবকিছু তোমার পছন্দমতো সাজালে– তোমার পছন্দই আমার পছন্দ হয়ে গেল।” লক্ষণীয় ‘ধারণা’ শব্দটি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে পুরুষ যে জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে নারীকে অধস্তন করে রাখে, নোরা কথার মধ্যে তারই উল্লেখ রয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ বলেও কিছু থাকে না। তার নিজস্ব ঘর বলেও কোনো কিছুর অস্তিত্ব পুরুষতান্ত্রিক সমাজ স্বীকার করে না। অনেকটা পণ্যের মতো সে পিতার ঘর থেকে স্বামীর ঘরে “পাচার” হয় মাত্র। সে নিজে যেমন পুতুল, তেমনি তার ঘরও পুতুলের ঘর, খেলাঘর মাত্র। টোরভাল্ডকে উদ্দেশ্য করে এ প্রসঙ্গে নোরার উচ্চারণ : “যাকে তুমি সংসার বলো সে কেবল খেলাঘরই ছিল। আমি এখানে ছিলাম তোমার পুতুল-বৌ, যেমন বাবার বাড়িতে ছিলাম পুতুল-মেয়ে।” লক্ষণীয়, নোরা বা নারী কখনই বিষয় (subject) হয়ে উঠতে পারেনি, হয়ে উঠেছে বিষয়ী (object) আর যৌনসম্পত্তিবিশেষ।


নোরার এই কথাগুলোকে মেনে নিয়েছে টোরভাল্ড, কিন্তু এরপরও সে তার প্রাধান্যের জায়গা থেকে সরে আসেনি, নোরাকে ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছে। কিন্তু এতদিনে নারী জেনে গেছে, “সত্যিকারের বউ হওয়ার শিক্ষা দেয়ার মতো যোগ্যতা” পুরুষের নেই। এখন নারীই নারীশিক্ষার ভার বা নিজেকে আলোকিত করার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিতে চাইছে। নোরা টোলভাল্ডকে সেকথাই জানিয়ে দেয়, “…একটি কাজ আছে যেটা আমাকে সবার আগে শেষ করতে হবে–নিজেকে শিক্ষিত করা।” নোরার এই উচ্চারণ, বলা বাহুল্য, অদৃশ্য কোনো নওরোজীয় গৃহবধূর কথা নয়। এর রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে, সেই রাজনীতি হলো পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর ক্ষমতায়ন আর আত্মপ্রতিষ্ঠার রাজনীতি। নিজের প্রতি নারীর দায়বোধ এখন অনেক স্পষ্ট। এই দায়বোধ থেকেই মানবিকতায় উত্তীর্ণ হয় নারী :
নোরা : টোরভাল্ড, আমি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চাই।
হেলমার : সেজন্য তোমার বাড়ি ছাড়তে হবে–স্বামী-সন্তান ছাড়তে হবে–মানুষ কী বলবে তুমি ভেবে দেখবে না?
নোরা : সেটা ভাবা আমার কাজ নয়। এটা আমার প্রয়োজন–এটুকুই আমি জানি।
হেলমার : কিন্তু এটা অপমানকর, লজ্জাজনক! তুমি কি এভাবেই তোমার পবিত্র দায়িত্বকে অবজ্ঞা করবে–প্রত্যাখ্যান করবে?
নোরা : কোনটাকে আমার পবিত্র দায়িত্ব বলছ?
হেলমার : সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে? তোমার স্বামী-সন্তানের প্রতি কি তোমার কর্তব্য নেই?
নোরা : এরকম পবিত্র দায়িত্ব আমার আরো একটি আছে।
হেলমার : কোন দায়িত্বের কথা বলছ?
নোরা : আমার নিজের প্রতি দায়িত্ব।
হেলমার : সবকিছুর আগে তুমি স্ত্রী এবং মা।
নোরা : সেটা আমি এখন আর বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি সবকিছুর আগে আমি একজন মানুষ, যতটুকু তুমি, ততটুকু আমি।
ইবসেনের আ ডলস্ হাউজ নাটকের সর্বজনীনতা মূলত এখানেই। না, শুধু মানবিক সম্পর্ক উন্নয়নের দিক থেকে এই নাটকটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নারী-পুরুষের সম্পর্কের প্রশ্নে সমানাধিকার ও সমতার দাবি জোরালোভাবে উচ্চারিত হওয়ায়। নিজেকে চেনার ও বদলে ফেলার আত্মপ্রত্যয়ী ঘোষণা আর আত্মানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করায়। এজন্যই নোরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে পেরেছেন, ‘ধর্ম’ কী তা তিনি দেখতে চান। ‘আইন’ই যে সঠিক তাও তার যথার্থ মনে হয় না। শুধু তাই নয়, এই পৃথিবীটাই নারীর অনুকূল নয়। যে পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সম্পর্কই অসম হয়ে আছে, সেই পৃথিবীকেই নারী এখন ঠিক ঠিক চিনতে চায়। হেলমার তাই যখন বলে, “যে জগতে বাস কর সে জগৎই তুমি চেনো না”, উত্তরে নোরা জানায়, “সত্যি। আমি চিনি না। আমি এখন সেটাই চেনার চেষ্টা করব। পৃথিবী সঠিক না আমি সঠিক সেটা খুঁজে বের করতে হবে।”

নারীবাদী সমালোচক সান্ড্রা গিলবার্ট এবং সুসান গুবার বলেছেন, উনিশ শতকের ইউরোপীয় সাহিত্যে নারীর “নাটকীয়ভাবে গৃহবন্দিত্ব আর সেই গৃহ থেকে পালানোর ছবি পাওয়া যায়” (Gilbert and Susan 1979: 60)। সেকালের সাহিত্যের এটাই ছিল অভিনব বৈশিষ্ট্য। নারী লেখকেরা এভাবেই তখন নারীর জীবনচিত্র এঁকেছেন। এই প্রেক্ষাপটে দেখলে আ ডলস্ হাউজ নাটকে সমকালের পুরুষের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে বলা যায়। কেননা এই নাটকের নায়িকা নোরা ঘর ত্যাগ করে চলে যায়। কিন্তু লক্ষণীয়, সেকালের কোনো পুরুষই নোরার এই গৃহত্যাগকে মেনে নিতে পারেননি। কেবলমাত্র কোনো পুরুষের পক্ষেই এভাবে গৃহত্যাগ করা সম্ভব বলে তারা মনে করেছে। অন্যদিকে সন্তানের কারণে নোরার সংসার ত্যাগ করে যাওয়া ঠিক হয়নি বলে যারা মনে করেছেন, তারাও ইবসেনের শৈল্পিক সংবেদনাকে উপলব্ধি করতে পারেননি। টোরভাল্ড সবসময় মনে করেছে “স্বামী ও সন্তানদের” প্রতি নোরার কর্তব্যবোধ ও দায়িত্ববোধ নারীর সনাতন দায়িত্ব। কিন্তু ইবসেন নারীর এই সনাতন ভূমিকায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি একারণেই “মা নোরার সঙ্গে স্ত্রী নোরার” কোনো পার্থক্য করেননি। নারীর সত্তাকে একক অভিন্ন সত্তা হিসেবেই দেখেছেন। একারণেই তাঁর লক্ষ্য ছিল নারীর একক সমগ্র সত্তায় পুরুষতন্ত্র কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, নতুন কালের নারী তার বিরুদ্ধে কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেসব পর্যবেক্ষণ করা ও নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা। অর্থাৎ নারীসত্তা আর নারীঅধস্তনতার সমগ্র রূপই ছিল ইবসেনের শিল্পীসত্তার মূল মনোযোগের বিষয়। সনাতন প্রচলিত ধারণা অনুসারে গৃহবধূর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাতৃত্ব, যা সন্তান ধারণ আর লালন-পালনের মাধ্যমে পরিণতি খুঁজে পায়। কিন্তু নোরা আত্মোপলিব্ধর মুহূর্তে নারীর এই (সন্তান) উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনমূলক ভূমিকা আর সেবা দানের ভূমিকাকে অস্বীকার করেছেন। অ্যাড্রিয়ান রিখ এবং এলিজাবেথ ব্যাডিন্টার নারীর এই ভূমিকা নারীকে যে কীভাবে পুরুষের অধস্তন করে রাখে তার বর্ণনা দিয়েছেন যথাক্রমে অব উইমেন বোর্ন (Rich 1976) আর মাদার লাভ : মীথ অ্যান্ড রিয়্যালিটি (Badinter 1981) গ্রন্থে। কিন্তু এই দুটি গ্রন্থ প্রকাশের প্রায় একশো বছর আগে ইবসেন নোরার মধ্য দিয়েই মাতৃত্বের মীথকে একেবারে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। নারীর আত্মবোধের সঙ্গে সন্তান লালন-পালনকে আলাদা করে দেখেছেন। নারীর আত্মমুক্তির সঙ্গে সন্তানের যে কোনো সম্পর্ক নেই, ইবসেনের আগে সেকথা কেউ সাহিত্যে উল্লেখ করেননি। আ ডলস্ হাউজ নাটকে তাই দেখা যায় নোরা নিজেই টোরভাল্ডকে জানাচ্ছেন যে “বাচ্চাদের ব্যাপারে” তিনি আর যোগ্য নন। ইবসেনের নারীকে, বলা বাহুল্য, সংসারের কাজ আর সন্তান লালন-পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা সম্ভব নয়। নারী এখন বাইরের পৃথিবীতে পা দিয়েই মুক্তি খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু এই পৃথিবী, কোনো সন্দেহ নেই যে নতুন আত্মবোধে জাগ্রত নারীর জন্য একেবারেই সহজ হবে না। তবু এই পথেই নোরা পা বাড়ায়। নোরার এই গৃহত্যাগের মধ্যেই মূলত তার আত্মজাগরণ আর আত্মশক্তির বীজ লুকিয়ে আছে। পুতুল-পৃথিবী থেকে এভাবেই মুক্ত পৃথিবীতে গিয়ে নোরা অর্জন করে তার জ্ঞানতাত্ত্বিক, বৌদ্ধিক আর আত্মমুক্তি। নোরার এই ব্যক্তিক মুক্তির বোধ, বলা বাহুল্য যে পরবর্তী কালে দেশে দেশে নারীবাদীদের কণ্ঠে ও রচনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে নোরার চত্রিকে অনন্য হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। এই অনন্যতা, বলা বাহুল্য যে ঘটেছে নারীবাদের সূত্রেই। ইবসেন তাঁর সমস্ত রচনাকেই প্রতীকী অর্থে কবিতা বলে উল্লেখ করতে ভালোবাসতেন। সেদিক থেকে বললে তাঁর সৃষ্টি নোরাও একটি অনন্য কবিতা, আরও স্পষ্ট করে বললে একটি নারীবাদী প্রতীকী কবিতা।


টীকা


বাংলাদেশে ইবসেন রচিত আ ডলস্ হাউজ-এর বাংলায় অনূদিত দুটি সংস্করণ পাওয়া যায়। পুতুলের সংসার নামে প্রথমে এর অনুবাদ করেন আবদুল হক (ইবসেন ১৯৬৬); পরে নোরা নামে আরেকবার এর বাংলা ভাষান্তর করেন খায়রুল আলম সবুজ (ইবসেন ২০০০)। এই প্রবন্ধে খায়রুল আলম সবুজের নোরার বাংলা অনুবাদ গ্রহণ করা হয়েছে। বিস্তারিত তথ্যের জন্য তথ্যসূত্র দেখুন।

তথ্যসূত্র


ইবসেন, হেনরিক (১৯৬৬), পুতুলের সংসার (আ ডলস্ হাউজের অনুবাদ), অনুবাদক আবদুল হক, ঢাকা : বাংলা একাডেমী।


Ñ (২০০০), নোরা (আ ডলস্ হাউজের অনুবাদ), অনুবাদক খায়রুল আলম সবুজ, ঢাকা : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

Adams, R.M. (1957), The Fifty-First Anniversary,” Hudson Review 10.

Badinter, Elizabeth (1981), Mother Love: Myth and Reality, New York: Macmillan.

Code, Lorraine. (2000, edited), Encyclopedia of Feminist Theories, London: Routledge.
Culler, Jonathan (1982), On Deconstruction: Theory and Criticism After Structuralism, Ithaca: Cornell University Press.
Gilbert, Sandra and Susan Gubar (1979), The Madwoman in the Attic: The Woman Writer and the Nineteenth-Century Library Imagination, New Haven: Yale University Press.
Gilman, Charlotte Perkins (1898), Women and Economics, Ed. Carl Degler, New York: Harper.
Haugen, Einer (1979), Ibsen’s Drama: Author to Audience, Minneapolis: University of Minnesota Press.
Hennings, Betty (1890), The New Spirit, New York: Modern Library.
Ibsen, Henrik. (1964), Letters and Speeches, Ed. and trans. Evert Sprinchorn, New York: Hill.
Kelly, Joan (1984), Women, History, and Theory: The Essays of Joan Kelly, Chicago: University of Chicago Press.
MacFarlane, James Walter and Orton, Graham (1966 ed.),The Oxford Ibsen, Trans. MacFarlane et al., London: Oxford University Press.
Meyer, Michael (1971), Ibsen, Garden City: Doubleday.
Rich, Adrian (1976), Of Woman Born: Motherhood as Experience and Institution, New York: Norton.
Rogers, Katharine M. (1985), A Doll House in a Course on Women in Literature,” in Approaches to Teaching Ibsen’s A Doll House, Ed. by Yvonne Shafer, New York: The Modern Language Association of America.
Rossi, Alice (1973 ed.), The Feminist Papers: From Adams to De Beauvoir, New York: Columbia University Press.
Shafer, Yvonne (1985 ed.), Approaches to Teaching Ibsen’s A Doll House, New York: The Modern Language Association of America.
Templeton, Joan (1997), Ibsen’s Women, Cambridge: Cambridge University Press.


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন