নারীর রবীন্দ্রনাথ – শ্রেণীর রবীন্দ্রনাথ – সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ

rabindranath-tagore-1নারীর রবীন্দ্রনাথ” প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদের “নারী” গ্রন্থের ‘নারীর শত্রু মিত্র রুশো-রাসকিণ- রবীন্দ্রনাথ- স্টুয়ার্ড মিল’ অধ্যায়টির কথা মনে পড়লো। বাস্তবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টির ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম হন নাই। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ, রুশো-রাসকিনের মতোই, পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষ; এবং প্রভাবিত ছিলেন ঐ দুজন, ও আরো অনেককে দিয়ে। রোমান্টিক ছিলেন তিনি এবং ছিলেন ভিক্টোরীয়; নারী, প্রেম, কবিতা, সমাজ সংসার, রাজনীতি, জীবন, এবং আর সমস্ত কিছু সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন তিনি পশ্চিমের রোমান্টিকদের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে; এবং সে সবের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় ভাববাদ বা ভেজাল। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় মৌলিকতা খুবই কম; তাঁর সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য।” (হুমায়ুন আজাদ, নারী ১১৪ পৃষ্ঠা)

রবীন্দ্রনাথের নারী ধারণা রোমান্টিকতার আচ্ছাদনে আবৃত। বাস্তব নারীর চেয়ে তিনি অনেক বেশি দেখেছেন স্বপ্নের নারীকে, কল্পনার নারীকে। এহেন রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথের চোখে নারী মাত্রই তরুণী, রূপসী, মানস সুন্দরী, দেবী; আর রবীন্দ্রনাথরা অর্থাৎ পুরুষেরা তাদের দেবতা। রবীন্দ্রনাথ অবাস্তব নারীর উপাসক, হাজার স্তব রচনা করেন লোকোত্তর নারীর; কিন্তু বাস্তবে নারী তাদের কাছে গৃহিণী, আদরে নামে যাকে বলা হয়, ‘গৃহলক্ষ্মী’। রবীন্দ্রনাথের নারী হয় স্বপ্নে অথবা গৃহে অবস্থান করে, বাস্তবে অন্যত্র সে থাকতে পারে না। নারীর অস্তিত্ব অনেক সময় স্বীকার করেন নি। ‘দুই বোন’ উপন্যাসের শুরুতে তিনি মন্তব্য করেছেন, “মেয়েরা দুই জাতের, কোন এক পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি। এক জাত প্রধানত মা, আর এক জাত প্রিয়া”। এটা কোন পণ্ডিতি কথা নয়। এটা পুরুষতন্ত্রের কথা, বা বলা যায় পুরুষতন্ত্রের ধারক রবি বাবুর নিজের কথা। পুরো উপন্যাসে রবি বাবু তার এই নিজের কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। নারী মুক্তিতে তার কোন আস্থা বা বিশ্বাস ছিল না। যদিও তার কোন কোন পঙক্তি শুনে মনে হতে পারে তিনি মহান নারীবাদী! হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলতে হয়, “ভিক্টোরীয় ঘরে বাইরে তত্বে তার আস্থা ছিল দৃঢ়, এ নামে একটি উপন্যাস লিখে তিনি তা দেখিয়েছেন; এবং নারীপ্রকৃতি বলে পুরুষতন্ত্র যে উপকথা তৈরি করেছিলো, তিনি ছিলেন তাতে অন্ধ বিশ্বাসী। রবীন্দ্রনাথের নারী ধারণা রুশো- রাসকিন-টেনিসনের নারী ধারণারই বাঙ্গালী রূপ; তাদের মতোই তিনি ভিন্ন ভাষায় কিছুটা ভারতীয় ভাবাবেগ মিশিয়ে প্রকাশ করেছেন।” (হুমায়ুন আজাদ, নারী-পৃষ্ঠা ১১৫)
রবি বাবু ছিলেন কথার যাদুকর! ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নারী নিয়ে অনেক সুন্দর কথা বলেন; কিন্তু একটু খেয়াল করলেই রবি বাবুর নারীচিন্তার নগ্নতা ধরা খেয়ে যায়। তিনি চাননি নারীর কোন বিকাশ ঘটুক। তিনি চেয়েছেন নারী থাকুক আদিমতমা চিরন্তনী; থাকুক ঘরের কোণে পুরুষের কল্যাণী হয়ে। পুরানো ভারতের ঋষিদের মতো আধুনিক এ ঋষি কবি নারীর নামে কুৎসা রটাননি, প্রতিবাদ করেছেন ঐসব কুৎসার, কিন্তু পুরানো ঋষিরা নারীকে যে অবস্থানে যে ভূমিকায় দেখতে পছন্দ করত, তিনিও তাই পছন্দ করতেন। বাস্তবের নারী তার কাছে গৃহিণী, কল্যাণী আর অবাস্তব নারী মানস সুন্দরী, এমন কি জীবন দেবতা! পুরানো ঋষিদের মানস সুন্দরীর মোহ ছিল না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সে মোহ ছিল প্রবল। সে মোহটুকু বাদ দিলে নারী গৃহিণী - জায়া ও জননী। নারী যে খাঁচায় বন্দী, রবি বাবুর চোখে যে এটা বাধেনি তা নয়, কিন্তু তিনি খাঁচার রূপেই মুগ্ধ হয়ে ভেবেছেন নারী আছে ‘সোনার খাঁচায়’! নারী যে শিকলে বন্দী রবি বাবুর কাছে তা মনে হয়েছে ‘সোনার শিকল’। এ শিকল যেন শিকল নয় বরং সোনার শিকলের রূপে তিনি মুগ্ধ!
মানসী’ কবিতার নারীকে এ ক্ষেত্রে উদহারন রূপে সামনে নিয়ে আসা যায়।
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারী
আপন অন্তর হতে। বসি কবি গন
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
…………………………
…………………………
লজ্জা দিয়ে সজ্জা দিয়ে দিয়ে আবরণ
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন
পড়েছে তোমার ’পরে প্রদীপ্ত বাসনা
অর্ধেক মানবি তুমি অর্ধেক কল্পনা।।”
এ কবিতায় পুরুষ নারীর ২য় বিধাতা। যে পুরুষ অনেক বেশি শক্তিশালী প্রথম বিধাতা থেকে। ১ম টি নারী সৃষ্টির কারণ ২য় টি নারীর বন্দিত্বের কারণ। কবিতায় পুরুষ সক্রিয় নারী নিষ্ক্রিয়, নারী পুরুষের তৈরি মূর্তি সম্ভোগ সামগ্রী! শেষে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্র চিন্তার নগ্নতা, যেখানে নারীর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হলো ‘অর্ধেক মানবি তুমি অর্ধেক কল্পনা’ য়।
আবার শ্রেণীর জায়গা থেকে যদি মার্ক্সবাদী দৃষ্টি নিয়ে দেখি তবে সেই একই ফলাফল, অর্থাৎ শ্রেণীর ঊর্ধ্বে তিনি নন। এখানেই আমার কাছে রবি বাবু অনেক দুরের, সে তুলনায় নজরুল অনেক কাছের। ‘কালচার’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ রূপে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি চালু করার জন্য রবীন্দ্রনাথ রীতিমত কুস্তী লড়েছিলেন। কালচার শব্দের প্রতিশব্দ রূপে কৃষ্টিকে তিনি বর্জন করেছেন। কারণ কৃষ্টি মানে কর্ষণ যা কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, জমিদার নন্দন সাহিত্যিক রবি বাবুর এটা ভাল লাগেনি। তাই সংস্কৃতি অর্থে জীবনের, চিন্তার বা মনের কর্ষণ নয়, জীবনের, চিন্তার বা মনের সৃজন অর্থে ‘সংস্কার’ই তিনি গ্রহণ করেছেন, শিল্প সাহিত্যের সৃজনশীলতার এক ‘খাটো ও বাধা’ নিয়মে। এ থেকে তাঁর মনোজগতের কাঠামোটিও খানিকটা বুঝা যায়। বিশেষ করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা ব্যক্তিগত ও সামাজিক চিন্তা, কর্মকাণ্ড, বিনোদন, দুঃখ-সুখের সাধারণ অনুভূতিকে অর্থাৎ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সংস্কৃতি সংস্কৃতির মর্যাদা দিতে রবি বাবু চাননি, স্থূল চিন্তা রূপেই দেখেছেন।
. আহমদ শরীফ, তার প্রবন্ধ ‘ইতিহাসের নিরপেক্ষ আয়নায় বাংলাদেশ’ এ উল্লেখ করেন - ‘‘অতএব রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ থেকে আজকের সমাজবাদ-বিরোধী গণমানুষের-বিরোধী যে কোনো মনস্বী-মনীষা বা সাধারণ বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোক মাত্রেই পরোক্ষ গণশত্রু।’’ (পৃ ১৭৮)। ‘‘অতএব রেনেসাঁন্সের জন্যে গৌরববোধ করা, সগর্বে রেনেঁসাসের মহিমাকীর্তন করা, রেনেসাঁসওয়ালাদের প্রশংসা করা প্রকারন্তরে গণমানবে দুর্ভোগ-দুর্দশাকে অস্বীকার করার এবং মুৎসুদ্দি কমপ্রেডরের তারিফ করার শামিল।’’ ()
স্যারের এই গণমানবের কথার মাধ্যমেই মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি দেশের সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির প্রতি স্যারের ভালোবাসা যেমন ছিল তেমনি এক শ্রেণীর সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীর প্রতি তীব্র ঘৃণা। রবীন্দ্র প্রতিভাকে যদি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা হয়, তবে দেখা যাবে যে তাঁর কাজেরও একটা গণ্ডি রয়েছে। সেই গণ্ডির কারণে, ‘সমাজ পরিবর্তন যাদের লক্ষ্য, যারা গণমানবের আর্থসামাজিক মুক্তি অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ’ তারা দেখতে পান যে, রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে সাহায্য করছেন না। (‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মের রবীন্দ্রমূল্যায়ন’)। অন্যত্র, ‘‘শ্রেণীস্বার্থের অচেতন কিংবা সচেতন বাধাই সাহিত্যে রবীন্দ্রভূমিকা সীমিত রেখেছিল।’’ (‘‘রবীন্দ্রসাহিত্য ও গণমানব’’)
উপনিবেশিকতার সময়ে সাম্রাজ্যবাদী সমাজব্যবস্থার বাস্তবতায় ১৯৩৬ সালের এপ্রিলে মুন্সি প্রেম চাঁদের নেতৃত্বে ভারতীয় লেখকদের সংগঠন প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন (পিডব্লিউএ) বা প্রগতিশীল লেখক সংঘ (পিডব্লিউএ) জন্ম লাভ করে। যদিও রবি বাবু সেই লেখক সঙ্ঘের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন এমনটি শোনা যায়, কিন্তু এর সাথে তাঁর শ্রেণীগত কারণেই নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। যাইহোক সাহিত্যিক রবিবাবু ও তাঁর সাহিত্যকে তুলনা করতে হলে মুন্সি প্রেমচাঁদের একটি মন্তব্যই যথেষ্ট! প্রগতিশীল লেখক সংঘের (পিডব্লিউএ) উদ্বোধনী বক্তৃতায় প্রেম চাঁদ বলেন - “যে সাহিত্য আমাদের মনে অনুসন্ধিৎসা জাগায় না কিংবা আমাদের আত্মিক প্রয়োজন মেটায় না, যা শক্তিসঞ্চারী এবং গতিশীল নয়, যা আমাদের হৃদয়ে সৌন্দর্যের ফুল ফোটায় না, অন্তরে অঙ্গীকারের শক্তি জাগিয়ে যা আমাদের করালদর্শন বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে শেখায় না- আজকের দিনে সে সাহিত্যের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এমনকি এগুলো সাহিত্য পদবাচ্যও নয়”।।

লিখেছেনবন্ধু বাংলা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন