সমুদ্র কন্যা

খোরশেদ আলম
সমুদ্রের বিশালতা, গোপন অনুভবের কথা কে অস্বীকার করবে? অন্ততঃ একবারও সমুদ্রের সঙ্গে যার কথোপকথন হয়েছে তিনি এর মূল্য বুঝতে সক্ষম। সমুদ্রে বেড়াতে গিয়ে নিশাচরের মত অন্ধকারের রাজ্য-ভ্রমণে কারো কোন বাধা নেই। নিশুতি রাতে সাগর পারে বসে জীবনের গভীর স্পর্শ যিনি পেয়েছেন তিনি ধন্য হয়েছেন। নিঃসঙ্গ মানুষের জীবনে নৈসর্গিক একাকিত্ব কল্পনার এক অন্যরকম ঘোর তৈরি করে। বাস্তবতার জটিল-কুটিল রূপ মানুষকে মুহ্যমান করে। সমুদ্রের নৈকট্য এমন মানুষের জন্য বেদনার অবলোপন ঘটাতে বাধ্য।
সমুদ্রের কাছে এলে মানুষের মনের আঁচড় কাটা ক্ষত স্থানে রক্তিম আলোক-রেখা জাগে। সমুদ্রের গর্জন মানুষের নৈঃসঙ্গ্যকে করে সুদূরপ্লাবী। নিশুতি রাতের সমুদ্র চাঁদের রজতস্নানে থাকে আবিষ্ট। তখন নৈঃশব্দিক অনুভব একটি দীর্ঘ লয়ের সঙ্গীত রচনা করে। মনের একটি গহন অনুভবের কথা তখন সমুদ্রের বুকে আঁছড়ে পড়া ঢেউয়ের মত শ্রবণযন্ত্রে ধ্বনিত হয়।

সংসারের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে নিত্যদিনের হিসেব-নিকেশ বন্দি করে মানুষের মন। তখন তার পরিতৃপ্তি কেবল সচ্ছন্দ্য বেঁচে থাকবার সীমিত প্রয়াসে মলিন। বাস্তব-সংসারে কড়ি ও গোণ্ডার হিসেব তাকে করে রাখে ব্যতিব্যস্ত। ব্যস্ততা আর আয়োজনের নানা ভারে নিমজ্জিত হতে হতে সে সত্যি হারায় একাকী হবার স্বাদ। উল্টো সে বরণ করে নেয় যান্ত্রিক কোলাহল কিংবা বিচ্ছিন্নতার আত্মরতি। কিন্তু একাকিত্ব কিংবা বিচ্ছিন্নতা শব্দ দুটোর কিছু আলাদা মানে থাকা দরকার। 

একাকিত্ব ব্যক্তি মানুষের একান্ত অনুভবের ফসল। বিচ্ছিন্নতা আধুনিক পৃথিবীর মানুষের পারস্পরিক বিযুক্তি। কিন্তু একাকিত্ব নৈঃসঙ্গ্য আর বিচ্ছিন্নতা এখন সমার্থক। তাই আমাদের মন আর মেঘের সঙ্গী হয় না। সমুদ্র পাড়ে বেড়াতে গেলে পর্যটনের সজ্জিত সৌন্দর্যে আসলটি হারিয়ে হৃদয় টানে না। কিংবা হরণ করে না সমুদ্রের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে নির্মিলিত সূর্যের লুকোচুরি। তার চেয়ে এখন এই ভালো মণিহারী দ্রব্যের সুচতুর ঝলকানি। তাই লাশ কাটা ঘরের মত আমাদের আজ স্বস্তি নেই। আমাদের ক্লান্ত ক্লান্ত করে। জীবনানন্দ দাশ মানব-জীবনের যে জটিলতাকে আবিষ্কার করেছিলেন তার মধ্যে আমরা এখন অবচেতনে ভ্রমণ করি। অথচ তিনি ঐতিহাসিক বিরাটত্বের এক সুবিস্তৃত মহাপৃথিবীর দিকে ইঙ্গিত করে নিরাসক্ত মনেও এনেছিলেন আসক্তি।
রবীন্দ্রনাথ কান পাতলেই সমুদ্রের প্রতিধ্বনি শুনতে পেতেন। তিনি মনের চরাচরে পেতেন গূঢ়সঞ্চারী এক অনির্বচনীয় অনুভব। কারণ তাঁর কাছে সমুদ্রের মতোই বিশালত্বের মহিমায় মানব-জীবনও উচ্চকিত। তাই তিনি শঙ্খের মধ্যে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা তানের সাদৃশ্য খুঁজে পান। এমনকি দিগন্তহীন সমুদ্রের কাছে দাঁড়ালে সাধারণ মানুষও তার সুতীব্র কষ্টের অনুভবকে পরাহত করার মন্ত্রণা খুঁজে পায়।
সমুদ্র নিরবধি কেঁদে চলে। কাঁদে মানুষী অনুভবের সঙ্গে একাত্ম হবার জন্যে। মানুষের জীবনের বেদনাদীর্ণ কান্নার মত সমুদ্র মানুষকে বিহ্বল করে। কান্নার পর হৃদয়াবেগের প্রাবল্য কমে আসে প্রশান্তি। সমুদ্রের গর্জন সে প্রশান্তিকে আরেকবার স্বাগত জানায়। সমুদ্র মানুষের আহত মনের আকুতিকে ধরে না শুধু; তার সঙ্গে যুক্ত থাকে মানবিক যন্ত্রণার কৈফিয়তি আবেগ। রাবণ তার পুত্রশোকের অবসান চেয়েছিল সমুদ্রের প্রতি বিষোদ্গার করে। রাম সৈন্যরা সমুদ্রের সঙ্গে করেছিল আঁতাত। যার পরিণতি শৈল-শৃঙ্খলে রাবণের প্রতি বিরুদ্ধতা ও রামের জয়মাল্য।
সমুদ্রের প্রচণ্ডতা ভয়াবহ, কখনো ভাসিয়ে নিয়ে যায় এর জনারণ্য। সমুদ্র দ্বীপ জাগায়। জন্ম দেয় কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ণ। সত্যবতী তাই মৎস্যগন্ধা হয়, পিতৃপাপে নিমগ্ন হয় সন্তান-সন্তুতি। সমুদ্রের বিভঙ্গ বাস্তবতা জন্ম দেয় কৃষ্ণবর্ণের। শুরু হয় দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ আদি-পৃথিবী ও বর্তমান পৃথিবীর; সাদা ও কালোর। সমুদ্র দূরত্বগামী, রচনা করে প্রণালী। ওডিসিয়াস হারায় স্বদেশ, ফেরায়ও সমুদ্র। সভ্যতা সূচনা করে সমুদ্র কিংবা রক্তাক্ত করে স্বচ্ছ নীল। রামচন্দ্রের শৈলজ-অস্ত্র আর মুসার লাঠি বিভঙ্গ করে সমুদ্রের সহজতা। পজেইডন সমুদ্রে ঝড় তোলে, দেবী এথেনাও রাজত্ব করে এখানেই। শিল্প এভাবেই সমুদ্রকে ধারণ করেছে। ক্লাসিক্যাল সাহিত্যও সমুদ্রের নানামাত্রিক বৈচিত্র্যে মুগ্ধ। 

পৃথিবীর বিশালতার অনেকটুকুই সমুদ্রের অধিকারে। তাই সমুদ্র আমাদের চৈতন্যে এক বিপুল পৃথিবীর সুর তোলে। সমুদ্র আমাদের জীবনে এনে দেয় নতুন ভাববার মত অনেক উপকরণ। সমুদ্র যেমন অকাতরে দেয় তেমনি নিঃশব্দে কেড়েও নেয়। কখনো সে ভাসিয়ে নিয়ে যায় জনজীবন। মানুষ আক্রান্ত হয়, মানুষ ব্যথিত হয় সমুদ্রের আচরণে। একটি আইলা ভাসিয়ে নিয়ে যায় নিযুত মানুষের জীবন, সম্পদ কিংবা আরো বেশি কিছু। মানুষ তখন রাবণের মতই সমুদ্রের প্রতি অভিযোগের সুর তোলে। প্রতাপান্বিত সমুদ্র তখন আর মানুষকে দানের মন্ত্রে সাজায় না; তার কাছ থেকে গ্রহণ করে, তাকেই আমরা কেড়ে নেয়া বলি।
সমুদ্র নিয়ে সমুদ্র-গভীর দার্শনিকতার কচকচি দিয়ে লাভ কী হবে? আসলে সমুদ্র দেখতে হয় নিজের চোখে; স্পর্শ করতে হয় নিজের হৃদয়ের আলোকে। যে খোঁজে মহৎ, সে পায় মহত্ত্ব। যে অন্বেষণ করে ভালবাসা, প্রেম তার হাতের নাগালে। আবার দুঃখ আসে ধেয়ে ঠিক সাগরের উত্তাল তরঙ্গে মানুষি বিপন্নতার সঙ্গী হবার জন্য।
-তুমি কে গো?
-ঐ যে দেখা যায় সবুজ, ঘন গাছগাছালি, ঐখানে আমরা থাকি।
এইখানে সাবধানে চলিবেন। আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। একদিকে হেলান দিবেন না। পানিতে পড়ে যেতে পারেন। এর আগে এ-রকম ঘটনা ঘটিয়াছিল; আটকাইতে পারি নাই। ঐ যে দূরে দেখা যায় দারুচিনি দ্বীপের দেশ। 
সাধু-চলিতের মিশেলে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয় কেয়ারী-সিন্দবাদ জাহাজের প্রচার বিভাগ থেকে। কবে কোন এককালে জাভা নাকি সুমাত্রা থেকে বিরাট মশলার এক জাহাজ সমুদ্রের ঝড়ের তা-বে পড়ে। জেগে ওঠা বালুচরে আটকে পড়ে অসংখ্য মানুষ। কোন এক হালভাঙা নাবিকের কথা মনে পড়ে। মন চলে যায় জীবনানন্দের সৌন্দর্যময় দারুচিনি দ্বীপের ভেতরে। ঘোর কেটে সম্বিত ফিরে আসে। যার পরিচয় জানতে চাইলাম তার কথাগুলো আবার উচ্চারিত হতে থাকে।
-ওই যে ঐখানে আমরা থাকি। কোনো স্কুল নাই। আমি টেকনাফ থেকে স্কুল সেরে এইখানে আসি। আরো দূরে কক্সবাজারে ইংরেজি স্কুলে পড়া যায়। আমি বাংলা স্কুলে পড়ি।
-তোমার বাবা কি করে?
-আমাদের অনেকগুলা নারকেল গাছ আছে। ডাব বিক্রি করি। ঐ যে তাকান গাছের মাথাগুলান দেখা যায়। একটা নৌকাও আছে মাছ ধরার। আমার বাবা এইগুলা করে।
-আর কি কি পেশা আছে তোমাদের ওখানে।

-গেলেই দেখতে পাবেন। অনেকগুলা দোকান, লাল-নীল কাপড় লাগান গদি অলা ভ্যানগাড়ি, টলার, নৌকা, স্পিডবোড, লম্বা লম্বা জাল, শুটকির মাচা, হোটেল আরো কত কী।
কেয়ারী সিন্দবাদ তীরের যত কাছে আসা শুরু করে সমুদ্রের বুকে উঁচু হয়ে দাঁড়ান সবুজ আর নারিকেল গাছ ঘেরা দ্বীপের অপূর্ব সৌন্দর্যে মন মাতাল হয়। সমুদ্র যাত্রীদের চোখে অপরিসীম কৌতূহল। এখানে অবশ্য কারো কৌতূহলী না হয়ে উপায় নেই। যাদের মন কখনো কোথাও মজে না তারাও এখানে হয় উচ্ছ্বসিত। কেয়ারী থেকে জেটি নজরে আসে। তীরে নামে অসংখ্য মানুষ। দূরের সমুদ্র-স্নাত সৌন্দর্য আর কাছের দ্বীপের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। আরো গভীরে গেলে বোঝা যায় আলোর নিচের অন্ধকার। মানুষের দৈন্য এখানে নিত্যদিনের গাটছড়ার বাধন। সারি সারি গোলপাতা আর নারকেল শাখা দিয়ে ঘেরা বাড়িগুলোর জীর্ণতা নজরে আসে। সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বাস এখানে। সময় এখানে থমকে দাঁড়ানো। ভেতরে গলির মতো ধূলো রাস্তায় তাদের নিত্যদিনের আসা-যাওয়া।
সমুদ্র এখানে আছড়ে পড়ে সুদৃশ্য প্রবালে। শ্বেতশুভ্র প্রবাল, চকচক করে সমুদ্রের অগভীর পানিতে। ঢেউ খেলে নূড়ি-পাথরে টক্কর খায় নীলাভ পানির অগ্রভাগ। অদূরেই তাজা মাছ ভাজার স্যানস্যান শব্দ। বার্মিজ সস্তা মসলায় মাখিয়ে পামওয়েলে চলছে ফ্লায়িং ফিশ, লবস্টার কিংবা কাঁকড়া ভাজা। দোকানি পসরা সাজিয়ে বসে আছে। বার্মিজ স্যান্ডেল, লুঙ্গি কিংবা রঙিন ব্যাগের বাহারি রকমের সজ্জা। এসবের মধ্যেও একবার দোকানীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। 

দোকানি আলফাজের পূর্বপুরুষ কবে থেকে এখানে আছে কেউ জানে না। কেউ না জানলেও আলফাজ জানে তাদের বাড়ির মতোই এখানকার অনেক বাড়িতে পর্দা প্রথার আধিপত্য। অন্দরের মেয়ে মানুষকে দেখার ক্ষমতা খুব কম লোকেরই হয়। ধর্ম তাদের জীবনের সঙ্গে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাধা। অভাব আর দরিদ্রতার মধ্যেও তারা খোদার নাম নিতে ভোলে না। দ্বীপ জেগে ওঠা তাদের কাছে আল্লার মহিমা; পর্যটকের আগমন ব্যবসা-সিদ্ধির পথে সৃষ্টিকর্তার ছায়া।
তবুও এ-অঞ্চল অবহেলিত। কেন্দ্রের সুনজর পড়ে না বলে মানুষের ভাগ্য আজ অনিশ্চিত। ইট ও কাঠ আমদানীর ওপর নিষেধাজ্ঞা নতুন স্থাপনা তৈরিতে বাধা প্রদান করছে। দ্বীপের এক ইঞ্চি জায়গার মূল্য টাকার অঙ্কে কোটী হলেও নারিকেল আর গোলপাতার ছাউনি সাধারণ মানুষের বাড়ির ম্লান সৌন্দর্যের পেছনে কার্যকর। অর্থনৈতিক দৈন্য তাদেরকে বানায় সিজনাল ভ্যান চালক, মাছের ছোট জেলে, শুটকি বেচনেঅলা ইত্যাদি। সমুদ্রের প্রবল ঝড় পাতার ছাউনি উড়িয়ে নিয়ে যায়। সুপেয় পানির অভাব তাদেরকে নোংরা কুপের পানি পান করাতে বাধ্য করে। সন্ধ্যার পরেই থাকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। চারিদিকে অথৈ জলের তলায় বিস্ময়কর মানবিক এক দুরবস্থা।
চাঁদনী রাতের আলো সমুদ্রের জলে ঝিকমিক করে। উঁচু উঁচু ঢেউকে উপেক্ষা করেও জেলেদের ডিঙ্গি নৌকা ভাসে মাছ ধরবার অপেক্ষায়। ট্রলারের যারা মালিক নয় তারা ভাসে সমুদ্রে। রাতের আলো সেখানে সমুদ্রের সঙ্গে মিতালী ঘোষণা করে। দিনের সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দেয় পর্যটকের দল। গভীর রাতে সমুদ্র এখানে বাণ ডাকে। দিনের বালুচরে যেখানে আঁক কাটা যায় রাতেই সেখানে জমে গভীর নোনা জল। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরের সন্নিকটে। সে শব্দে কান পেতে হোটেলের লবিতেও বসে থাকা যায় না। ছুটে আসতে হয় জলকন্যার কাছে। পা দিয়ে ছুঁয়ে দিতে হয় স্বচ্ছ জলের ঢেউ। চাঁদ সেখানে রূপালী অলোক তরঙ্গের মত।
বালুময় তীরে চর জাগে সকাল বেলা। আবার বহুদূরের পথে নেমে যায় নোনাজল। নৌকা সে জলের দূরত্ব ঘোচায়। সমুদ্র পরীরা নেমে আসে। যেন শীর্ণকায় চুলে চিরুনী পড়েনি বহুদিন। হাতে শুভ্র প্রবাল হাতে হাক ছাড়ে, নিবেন একটা প্রবাল, সাদা প্রবাল, বিশ টাকা দাম। সমুদ্রের সৌন্দর্য কুড়ি টাকায় বিক্রি হয়। মানুষের দারিদ্র্য বিক্রি হয় আরো কম দামে।
-তোমার বাড়ি কোথায়?
-ঐ যে পাট করা কলা পাতার কেওড়া জঙ্গলের পুরনো প্রাচীর। তার ভিতরে ঘর। আমরা থাকি।
এখানে সভ্যতা প্রবেশ করে না। সমুদ্রের বুকে আঁচড়ে পড়া চাঁদনী আলোও মলিন। উঁচু হোটেলের বারান্দা চোখে পড়ে। ওখানে বিদেশী মানুষ থাকে। আসলে থাকে দেশের মানুষ। টুপি পড়া ছোট ছেলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। দুধারে কলমীর জঙ্গল। নোনা মাটিতে জন্মানো অচেনা গুল্মলতা।
-তুমি কোথায় পড়ো? কী পড়ো?
-মাদ্রাসায় পড়ি। আলিফ, বা, তা, ছা।
আল্লার মহিমায় দুনিয়ার সৃজন। সমুদ্র আরো বেশী মহিমাময়। ক্ষুধা লাগা শীর্ণমুখ, জীর্ণ পরিচ্ছদ, বুকের ভেতরে ঢুকে যাওয়া পেটে খোদার কালাম ফুটে ওঠে।
-তোমার বাবা কি করে?
-নারকোলের ছোবড়া দিয়া আগুন জ্বালানের মশলা তৈয়ার করে। আল্লায় দিছিল নারকোল গাছ। ঐখান থেকে নারকোলের নিজ্জাস আসে। তিনমাস ভ্যান চালন। তিন মাস ডাব বিক্রি, মিষ্টি পানীয় আল্লার দান। ছয়মাস ফুটপাতের দোকানদারী। 
-সমুদ্র বিলাস চেনো?
বালকের হা করে দাঁড়িয়ে থাকা। হাত নড়ে, মুখখানা কিছু ঠাহর করতে চায়।
--হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি চেনো না!
-হ চিনি। এইখানে ইদানিং আর বেশী আসে না। এলাকার মানুষ পছন্দ করে না। সে নাকি সিনেমা বানায়। এলাকার মানুষ তারে এইখানে আসা বন্দ করেছিল। এখন বাড়ির কাজ চলতেছে।
হালকা জঙ্গলের পথ ধরে ভেতরের দিকে প্রবেশ করা যায়। আগেই নজরে পড়ে কাঠের দোতলা ঘরটি। কাজ চলছে। ওপরে রেস্টুরেন্টের মত বসার ব্যবস্থা। গোল গোল কাঠের চাকতি দিয়ে বানানো টেবিল, কাঠের চেয়ার। ভেতরে কাঠের সিড়ি দোতলায় ওঠার। নিচের তলায় গাছের গুড়ি আর প্রায় অক্ষত কাঠে সামান্য আঁচড় দিয়ে বানানো বসবার ও বিশ্রাম নেবার স্থান। ভেতরে বেশ কটি তাবু ঘর। প্রত্যেকটি তাবু ঘরের ভেতরে অত্যাধুনিক থাকার ব্যবস্থা। প্রত্যেকটি ঘরের সাহিত্যিক নাম আছে। প্রত্যেকটি নামের এক একটি বিশেষত্ব আছে। দুসারি তাবুর মাঝখান দিয়ে একটি পথ গিয়ে মিশেছে সমুদ্রের দিকে। যেখানে সমুদ্রের চাঁদপড়া ঢেউ রূপালী আলোর শব্দে রিনিঝিনি আওয়াজ তোলে।
ন্যাংটা ছেলের দল চমক ভাঙায়। সমুদ্র পরীর হাতের শুষ্ক প্রবাল কালো ও সাদা। কালো প্রবাল দশ টাকা, সাদা প্রবাল বিশ টাকা, নূড়ি পাথর রঙিন শামুক পনের টাকা।
-এই যে মাছ খান, ভাজা মাছ, বার্মিজ মশলায় মাখানো মাছ, লবস্টার, ফ্লায়িং ফিশ বিশ টাকা। শুটকি নেন সামুদ্রিক শুটকির প্যাকেট পঞ্চাশ টাকা একশ টাকা। আসেন বাড়ির ভেতরে হোটেল, থাকবেন তিনশ টাকা। পানি লন বিশুদ্ধ খাবার পানি বোতল চল্লিশ টাকা লিটার।
অকস্মাৎ শ্রবণযন্ত্রে শ্রুত হয় 
এইহানে আল্লার রহমত আছিল। তাই হোটেল হইছে। হোটেলের মালিকগো বাড়ি ঢাকা, চট্টগ্রাম শহর। মেলা ট্যাকার মালিক তারা। মানুষগো খাওয়া-পড়ার ব্যবস্থা অইছে। আল্লাতালা সমুন্দ্রের মদ্যে মাটি ফালাইছে। এইহানকার স্তানীয়ো মানুষগোর উন্নেতি অয় নাই। হ্যারা নোক-ঠকায়া খায়। ভ্যানের বাড়া ন্যায় বেশী। হেল্লাই আল্লাতালা বেজার।
দুজন পর্যটকের পারস্পরিক আলাপচারিতা চলে। যার মর্মার্থ উদ্ধার করা যায় এই যে- তারা যে হোটেলগুলোতে ভাড়া থাকে সেগুলোর আসল মালিক খোদার রহমত নিয়ে এসেছে এই সমুদ্র ঘেরা দ্বীপের মধ্যে। অবস্থা বিবেচনায় স্থানীয় মানুষরা কেবল লোক ঠকিয়ে উপার্জন করে।
রাম-লক্ষণ এ দ্বীপে না থাকলেও রামের সুদৃশ্য প্রস্তর মাল্য এখানে ছেড়া দ্বীপ নামের দ্বীপটিকে পরস্পরের সঙ্গে জোড়া দিয়েছে যেন। তারই মাঝে ট্রলার ব্যবসায়ীদের হাকাহাকি ডাকাডাকি। ওপারের দ্বীপে সমুদ্র যাত্রায় অনেক ঝকমারি। তাই প্রবল রোদের তাপে মুখের-গায়ের চামড়া ঝলসিয়ে মানুষগুলো অন্যের নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের মনের তৃষ্ণা মেটায়। একখানা ছোট নৌকা সমুদ্রে ভেড়ার জন্য অপেক্ষাকৃত বড় ট্রলারের সামনে দাঁড়ায়। প্রবালের গায়ে গায়ে লাগানো সাদা-কালো রঙের সমুদ্র-স্নাত পাথরগুলো চকচক করে ওঠে। 

একদিকে কেওড়া বন, তিন দিকের সমুদ্রের পাহাড়ায় অসম্ভব সৌন্দর্যের লীলাভূমি। কেওড়া পাতায় ছাওয়া ঘরের ভেতরে সমুদ্র-পিয়াসী মানুষের বিশ্রামাগার। রাত্রে থাকবার সুব্যবস্থা। ধূলি ওড়ানো বিছানায় রাত্রির আধভাঙা চাঁদ। সমুদ্রের মাতানো আওয়াজ, জাহাজের সাইরেন, বাতি ঘরের আলোক রেখা, ছলাৎ ছলাৎ নোনা পানিতে ঢেউয়ের আছড়ে পড়া শব্দ। কিন্তু এখানকার মানুষের নিত্যদিনের কোলাহল শুরু হয় জীবিকা উপার্জনের তাগিদ নিয়ে। তাই সমুদ্রের বাতাস ঠেকিয়ে চুলায় আগুন ধরানো, মাছ ভাজা, একই কড়ইয়ে লবস্টার, কাঁকড়া কিংবা সাপ ভাজার দৃশ্যে অবাক হবার কিছু নেই। সংস্কারের বিধি-নিষেধের দেয়াল থাকলেও শুধুই জীবিকার তাগিদে পর্যটকের সাপ ভাজা খাবার স্বাদ তারা মেটায়- একই কড়ইয়ে সস্তা বার্মিজ মশলায় মাখানো সস্তা দামের তেল ফুটিয়ে। 

ওদিকে সমুদ্রকন্যারা একবার না একবার ঝিনুকের অন্তরে মুক্তো পেলেও তাকে বিলিয়ে দিয়ে নিজেরা উপভোগ করে রুক্ষ চুলের বেণী। সমুদ্রের বাতাস সেখানে কল্লোল তোলে কিন্তু বেশি ওপরে ওড়াতে পারে না। প্রশান্ত সমুদ্রের নিবিড় অনুভব সেখানে চুপিসারে ক্রন্দন তোলে।

----------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি 
খোরশেদ আলম
গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
পেশা : শিক্ষকতা
বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন