মৃণাল বসু চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ
কোন শব্দে বাঁধি তাকে ? ‘শ্রুতি’ আন্দোলনের কবি ? বিশিষ্ট অনুভবী গল্পকার ? প্রাজ্ঞ প্রাবন্ধিক ? একটি অনুকরণীয় মানুষ? একটি উদার ব্যক্তিত্ব? একটি ছাতার মত আশ্রয় ? একটি বাতাসের মত সহজ প্রশ্রয় ? মৃণাল বসু চৌধুরী আসলে একাধারে সবকটিই । ‘শব্দের মিছিল’ এর ‘একমুঠো প্রলাপ’ তাঁর কাছে গিয়েছিল একটি কথোপকথনের আর্জি নিয়ে, তিনি এক কথায় তা পূরণই শুধু করলেন না, আমার প্রতিটি প্রশ্নে যত্ন সহ উন্মোচিত করলেন তাঁর কথনবিশ্ব, যাপন বিশ্বাস, অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত মধুর স্মৃতি । আভূমি কৃতজ্ঞতা, অঞ্জলিভরা আর আন্তরিক শুভকামনা , দাদা, খুব ভালো থাকুন, আরো অনেক লিখে চলুন আমাদের জন্য , শুধু আমাদের জন্য ।


আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে’ দু’ একটি কথা বলে নিই... আমরা যখন কবিতা লিখতে শুরু করি ,আমাদের সামনে ছিল বাংলা কবিতার দিকপালদের অসাধারণ সব সৃষ্টি ।তিরিশের কবিরা তখন স্বমহিমায়,চল্লিশের কবিরা তখন নিয়মিত লিখছেন,পঞ্চাশের কবিরা তারুণ্যের ছোঁয়ায় বদলে দিতে শুরু করেছেন কবিতার ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি ।
আমার প্রথম কবিতার বই’ মগ্ন বেলাভূমি ‘প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে।তার আগের বছর ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে আমার প্রথম কবিতা । প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পাবার পর মনে হয়েছিল যদি অন্যরকম কবিতা না লিখতে পারি, যদি না অর্জন করতে পারি নিজস্ব ভঙ্গি বা কণ্ঠস্বর , কবিতার জগতে স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারব না, ভিড়ের মধ্যেই হারিয়ে যেতে হবে।
সমমনস্ক কয়েকজন মিলে আমরা ‘শ্রুতি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করি ১৯৬৫ সালে। ১৪টি সংখ্যা বেরোনোর পর ১৯৭১ সালে তা বন্ধ হয়ে যায় । শ্রুতি আন্দোলন এখন ইতিহাস । শ্রুতির বিভিন্ন ইস্তেহারে যে সব কথা আমরা বলেছিলাম তার মধ্যে কয়েকটি এই প্রসঙ্গে বলা দরকার.।।
(ক) ... কোন রকম ব্যাখ্যা , বিধান বা তত্ত্ব প্রচারের দায়িত্ব কবিতার নেই
(খ) ব্যক্তির কল্পনাময় আন্তরিক আভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির প্রকাশে ব্যক্তিত্বের পরিমণ্ডল রচনাই কবিতা । তাই কবিতা হবে ব্যক্তিগত , মগ্ন , ও একান্তই অন্তর্মুখী ।
(গ) চিৎকার বা বিবৃতি কোনটাই কবিতা নয় । প্রচারসর্বস্ব রাজনীতি , অন্ধ সামাজিকতা ক্ষুৎকাতর জৈব আর্তনাদের কোন স্থান কবিতায় নেই..
৫১ বছর আগের এই বিশ্বাস থেকে অনেকটাই সরে এসেছি আমরা । এই প্রসঙ্গেই লিখেছিলাম, মনে আছে...
কবিতার আঙ্গিক নিয়ে ভাবতে ভাবতে
হঠাৎ কখন
ভাবনারই আঙ্গিক বদলে যায়
শব্দদূষণ আস্তে আস্তে সরিয়ে দেয় শব্দচয়নের প্রয়াস
প্রতিবন্ধীদের ভিড়ে ক্রমশ হারিয়ে যায় প্রতিবাদী হাত ...
ফিরে আসি আপনার প্রশ্নে । আপনার উদ্ধৃত কবিতার শেষ তিনটি পংক্তি দেখুন ...
সংঘবদ্ধ হবার জন্য
ভিড়ের মধ্যে একলা মানুষ
হাঁটছে কেবল হাঁটছে কেবল হাঁটছে......।
নিজস্ব চিন্তাভাবনা , যন্ত্রণা নিয়েও সংঘবদ্ধ হবার জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারে একজন মানুষ ।অন্তর্মুখী মানুষেরাও কিন্তু নিঃশব্দে বাড়িয়ে দেয় হাত প্রয়োজনে পাশেও দাঁড়ায় । এমন বিশ্বাস থেকেই আমার উচ্চারণ...
মুক্তির উপায় আর স্বাধীনতা নিয়ে
যত খুশি গবেষণা হোক
মানুষের পাশে এসে শেষ অবধি মানুষই দাঁড়ায় ...।


কবির অন্তর্জগতে দিনরাত যে অনুভবী ভাঙাগড়া , জটিল আবহ , তার মধ্যেই হয়ত লুকিয়ে থাকে কবিতার বীজ । আমাদের দিনযাপনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, প্রেম-প্রত্যাখান, রাজনীতি , সমাজ , নারী , ঈশ্বর , সুখ-দুঃখ , আনন্দ-বিষাদ, ঈর্ষা-লোভ, সততা-দুর্নীতি, সারল্য-চাতু্র্য, সাফল্য-ব্যর্থতা, বঞ্চনা-অবহেলা সমস্ত কিছুই আমাদের অন্তর্জগতে জায়গা করে নেয়। তারপর সেই সব আবেগ বা অভিজ্ঞতা অনন্ত মন্থনে পরিশুদ্ধ হয়ে অনিবার্যভাবে বেরিয়ে আসে কবিতায়। জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, সমস্ত আবেগই কবিতার অনুষঙ্গ। শুধুমাত্র অন্তরঙ্গ উপলব্ধি ও অন্তর্জগতের অভিজ্ঞতাই কবিকে দায়বদ্ধ রাখে কবিতার কাছে। চেতন ও অবচেতনের জটিল খেলায় নিজেরই অজান্তে তৈরি হয় এক মায়ার জগত। এই মায়াপৃথিবীর কথাই বিভিন্ন সময়ে উন্মোচিত হয় কবিতায়...।। এমনই বিশ্বাস আমার...। এই মন্থন প্রক্রিয়া সকলের এক নয়। আর তাই কবিতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ ভিন্ন ভিন্ন ভাষা...। বৈচিত্র্য ।




‘ তিন পা যাবার পর সব নাকি ভুলে যায় চতুর বেড়াল / এই সুখ মানুষের নেই’...।। এমন অনেক প্রসঙ্গে বেড়ালেরা আমার কবিতায়...
গত ৪৭ বছর ধরে আমার সব অক্ষমতাকে আনন্দে পরিণত করেছেন আমার স্ত্রী, ...আমার প্রায় সমস্ত উচ্চারণ তাকে ঘিরে...যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষায় এম,এ করেছিল তপতী...। শিক্ষক হিসেবে শঙ্খবাবু, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ,পবিত্র সরকার এবং আরও কিছু গুণী মানুষের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল তার ... বাড়িতে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো প্রায়ই...। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা আমার প্রায় প্রতিটি কবিতার প্রথম পাঠিকা ছিল তপতী । এখনও নতুন কবিতা লিখে ওকেই শোনাই...।
স্বীকার করতে লজ্জা নেই কবিতার বিষয় , ভাষা ছন্দ নিয়ে আমাদের আলোচনা বা তর্ক থেকে আমি শিখেছি অনেক কিছু । যা আমার কাব্যজীবনের সম্পদ......
প্রসঙ্গত বলে রাখি ,এ বছর একুশে বইমেলায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত আমার শেষ গ্রন্থ ‘নিজের সঙ্গে নির্বাসনে’ । আত্মজীবনীমূলক এই গ্রন্থটি তপতীকে উৎসর্গ করা । এর আগে কিছু কবিতার বই ওকে উৎসর্গ করলেও গদ্যের বই এই প্রথম ওকে দিলাম ...হাতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল।। শিশুদের মত যত্ন করে রেখে দিয়েছিল বালিশের নীচে….


জন্মমুহূর্ত থেকে আজ পর্যন্ত যা শিখেছি তা শিখিয়েছে জীবনই ।। শিখিয়েছে বেঁচে থাকার আসল কৌশল...অলৌকিক সৎ উচ্চারণ , দ্বিধাহীন স্পষ্ট অঙ্গীকার । সমস্ত জীবন ধরে যে বঞ্চনার ইতিহাস এবং ধারাবাহিক অবহেলা ক্রমশ মলিন করে তুলতে চেয়েছিল আমার চরাচর, আমি তাকে প্রশ্রয় দিই নি । খুঁজিনি কোন অমরাবতী, সোনালি আশ্রয় । জীবন যেভাবে চায়, তেমন আসুক , কখনো জটিল, কখনো বা সহজ সরল... প্রখর উত্তাপ আর অনাবিল ভালবাসা দিয়ে ভেঙে ভেঙে আমি তাকে আশ্চর্য সুন্দর করে নেবো ... নিরন্তর এই প্রয়াসের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমার আনন্দ ...আমার বেঁচে থাকার কবিতা ।
যাপিতজীবন আর তার স্বপ্নময় অলিগলির মধ্যে পাওয়া সমস্ত কিছুই আমি ভালবাসার মোড়কে মুড়ে রেখে দিই আমার চারপাশে। এই ভালবাসাই আমায় চিনিয়ে দেয় মুক্তির পথ । জন্ম দেয় নতুন কবিতার । আরোপিত দর্শন কবিতার ক্ষতি করে বলেই আমার বিশ্বাস । আমার কবিতায় যদি কোন দর্শন থাকে তা হয়ত জীবন থেকেই উপলব্ধ ... । অনুশীলনে হয়ত খড়,মাটি রঙ দিয়ে প্রতিমার রূপ দেওয়া যায়... প্রাণের ছোঁয়ায় তাকে অপরূপ করে দিতে বোধহয় মায়াবী রহস্যময় কিছুর প্রয়োজন হয় যা শুধুমাত্র অনুশীলনে আয়ত্ত্ব করা সম্ভব নয় ।


নিজস্ব বিশ্বাস , অভিজ্ঞতা, অনুভব থেকে কবিতার সংজ্ঞা নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন অনেকেই । সেই সমস্ত প্রয়াসের কথাই উল্লেখ করেছিলাম প্রবন্ধটিতে...। মনে হয়েছিল , কবিতার স্বরুপ নির্ণয়ের বিভিন্ন প্রচেষ্টার মধ্য থেকে একজন কবি বেছে নেবেন তার পথ...। নিজস্ব ভাষা ও আঙ্গিক ...।
কবিতার সঠিক কোন সংজ্ঞা হয় বলে আমি বিশ্বাস করি না...। কবির সত্য তার বোধ ও মননের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের ভাবনা মিশিয়ে উপভোগ করেন আনন্দ বা দুঃখ...। সেই কারনেই একই বিষয়ে বিভিন্ন কবির কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন সত্যের প্রকাশ ঘটে... । আপনি আপনার বিশ্বাস থেকে কবিতা লেখেন... ভাষা , আঙ্গিক , নিয়ে আপনার ভাবনা আপনার ই...। আমি আমার মত করে লিখি যা আনেকের ভাবনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে ।
যেমন , ১৯৭০ সাল থেকে আমি কবিতায় যতিচিহ্ন ব্যাবহার করি না... শব্দের সমস্ত সম্ভাবনা যাচাই করে গুরুত্ব অনুযায়ী তাকে কখনো অন্য শব্দের সঙ্গে জুড়ি কখনো বেশি স্পেস দিয়ে তাকে একদম আলাদা করে দিই... কখনো বা বিশেষ কোন শব্দের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাকে আলাদা পঙতিতে বসাই।।
আমরা শ্রুতির কবিরা সামান্য দুএকজন বাঙালি কবি এবং বিদেশী কবিদের কথা মাথায় রেখে, অক্ষরবৃত্তের , ১৪ , ১৮ , ২২ অক্ষরের ঠাসবুনন থেকে কবিতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম ... আজ যে কোন কবির কবিতার বহিরঙ্গে যে দৃষ্টিনন্দন চেহারা এসেছে তার জন্য শ্রুতির কবিদের অবদান স্বীকার করতেই হবে...। ১৯৬৫ সালের আগের কবিতার চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই পরিস্কার হবে ব্যাপারটা ... একটা কথা আমরা জানি... পথের সন্ধান দেয় কেউ কেউ ... আর তাকে রাজপথ বানায় অন্যরা...। এটাই নিয়ম ।।
আপনার প্রশ্নটির প্রসঙ্গে আমার শেষ কথাটি বলি...। অর্জিত জ্ঞান পণ্ডিত তৈরি করে আর উপলব্ধ জ্ঞান থেকে জন্ম নেয় কবিতা । যে যেভাবেই লিখুন না কেন... কবিতার হয়ে ওঠাই মূল কথা...। বিখ্যাত সেই উক্তিটি দিয়েই শেষ করি.... A poem should not mean / but be .
উত্তরাধুনিক কবিতাকে গিমিক বলতে চাই না...। ওঁরা ওঁদের বিশ্বাস নিয়ে কবিতাকে পাল্টাবার চেষ্টা করছেন ... ভবিষ্যৎ তো ইতিহাস বলবে ...


মূলত ঐ দেশের বিভিন্ন শহর থেকে আমন্ত্রণ ও লেখালিখির সুত্রেই যাওয়া... ।




২০১৩ সালে প্রকাশিত কবিতার বই ‘ তবে কি ফিরেই যাবো ’ নামটি কোন ইঙ্গিত বহন করছে কিনা জানতে চেয়েছেন । প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মগ্ন বেলাভুমি ’ বেরোবার পর ৫১ বছর কেটে গেল... তবু যে কবিতা লিখতে চাই লেখা হল না... তাই প্রশ্ন করি নিজেকেই , তবে কি ফিরেই যাবো , সমস্ত ব্যর্থতা নিয়ে অস্থির আড়ালে ? তারপর ডান হাত বাঁ কাঁধে রেখে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি – যাও ,প্রতিবেশ তুচ্ছ করে ,অলৌকিক অনন্তের খোঁজে যাও , যাও স্বপ্ননদীতীরে... হয়ত পেতেও পারো মায়াবিনী অক্ষরপ্রতিমা । আবার শুরু করি নতুন উদ্যমে...


বইমেলা জানুয়ারী মাসে ... ততদিনে অবস্থা আরও একটু স্বাভাবিক হবে মনে হয়... টাকার যোগানও বাড়া উচিত । তবু কিছু প্রভাব তো পড়বেই...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন