মাহমুদ কামাল
মাত্র ৮টি পৃষ্ঠা। বুলেটিনের সংখ্যা সাকুল্যে এক। সাল ১৯৬৪। মূল্য ১৩ পয়সা। ক্ষীণকায় এই বুলেটিন যার নাম আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ দিয়েছেন প্যাম্পলেটÑ বাংলা সাহিত্যেরÑ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্যাম্পলেট ইতিহাস হয়ে আছে। ইতিহাসের নাম দ্য স্যাড জেনারেশন। প্রথম, দ্বিতীয় ও শেষ পৃষ্ঠায় যথাক্রমে ইংরেজিতে রফিক আজাদের ঘোষণাপত্র ও প্রশান্ত ঘোষালের চম্পাবতী বিষয়ক লেখাসহ ৬টি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিক্রম যথাক্রমেÑ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ইউসুফ পাশা, আসাদ চৌধুরী, শহীদুর রহমান, বুলবুল খান মাহবুব ও ফারুক আলমগীর। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে স্যাড জেনারেশন এবং রফিক আজাদ ছিল একে অপরের পরিপূরক। উত্তরকালে যদিও রফিক আজাদসহ স্যাড জেনারেশনের সদস্যরা ঘোষণাপত্র অনুযায়ী তাদের কবিতায় সেই ধারাটি আর অব্যাহত রাখেননি। কিন্তু রফিক আজাদের প্রথম দিককার কবিতা পর্যালোচনা করলে তারই লেখা ঘোষণাপত্রের ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেসব কবিতায়। দশক বিচারে তিনি গেল শতকের ষাট দশকের অন্যতম প্রধান কবি।
ষাটের কবিদের উত্থান ঘটেছে লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে। এস্টাবলিস্টমেন্টের বিরুদ্ধে ষাটের কবিরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন লিটল ম্যাগাজিন এবং ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে। সেই সময়ে কবিতা সম্পর্কে তাদের যে বক্তব্য তা কোনোভাবেই প্রকাশ সম্ভব ছিল না ব্যবসায়ী পত্রিকার ভিতরে। কবিতাকে পণ্য হিসেবে দেখতে নারাজ বলেই ষাটের দশকে কবিতাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আন্দোলন সংগঠিত হয় বাংলাদেশ এবং ভারতে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যে গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে ইতিহাসে তা ‘হাংরি জেনারেশন’ নামে পরিচিত। যদিও এর আগে আমেরিকাতে বীট জেনারেশনের উদ্ভব ঘটে গেছে এবং বিটনীকরা তুমুল আলোড়ন তুলেছে সে দেশে। বীট জেনারেশনের হাওয়া পশ্চিমবঙ্গে এসে স্পর্শ করে একদল ক্ষুৎকাতর কবিদের এবং এরাই সংগঠিত হন ‘হাংরি জেনারেশন’ তত্তে¡র ছায়ায়। যদিও হাংরি আন্দোলনের মূল স্থপতি মলয় রায়চৌধুরী এই পারম্পর্য অস্বীকার করেছেন তার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ রচনায়। বীটদের ‘এ্যাংরি’ পশ্চিমবঙ্গে এসে রূপান্তরিত হয় ‘হাংরি’ নামে এবং বাংলাদেশে ‘স্যাড জেনারেশন’। কেরুয়াকের কবিতা ভাবনা কিংবা গিনস্বার্গের ‘চিৎকার’ অথবা মলয় রায় চৌধুরীর ‘প্রচÐ বৈদ্যুতিক ছুতার’ কিংবা ‘স্যাড জেনারেশনের’ ইশতেহার ইত্যাদিকে একটু মিলিয়ে দেখলে এই পারম্পর্য অবশ্যই চোখে পড়ে।
গিনস্বার্গের ‘হাউল’ অর্থাৎ লক্ষ শূকরছানার জন্মের তীব্র চিৎকার আমেরিকাতে অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং পরবর্তী সময়ে আদালতের মাধ্যমে অশ্লীলতার অভিযোগ থেকে কবিতাটি মুক্ত হয়। পাটনার কবি মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচÐ বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটিকে অশ্লীলতার অভিযোগ এনে আদালতে মামলা ঠোকা হয়। নিম্ন আদালতে দুইশ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদÐ ঘোষিত হয়। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতে কবিতাটি অশ্লীলতার অভিযোগ থেকে যথারীতি মুক্ত হয়। ঢাকায় ‘স্যাড জেনারেশনের’ কবিরাও অশ্লীলতার অভিযোগ থেকে দূরে থাকেননি। স্যাড জেনারেশনের কবিরা ছিলেন ঢাকা বিশ^^বিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই সময় তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়াও চলছিল। এ প্রসঙ্গে স্যাড জেনারেশনের প্রকাশক বুলবুল খান মাহবুব তার ‘মধুর ক্যান্টিন’ গ্রন্থে লিখেছেন, “মধুর ক্যান্টিনে বসে আছি আমরা। আমি, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী আর শহীদুর রহমান। আসাদ চৌধুরী চলে গেল একটু পরই। আমরা তিনজন বেশ উত্তেজিত। আগামীকাল বের হবে আমাদের বহুপ্রার্থিত কবিতা সংকলন ‘দ্যা স্যাড জেনারেশন।’ গতানুগতিক কাব্যধারার বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহের ফসল স্যাড জেনারেশন বের হলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবেÑ এ নিয়ে আমাদের আলোচনার অন্ত নেই। আমার ভাবনাটা একটু বেশি, কারণ আমি এর প্রকাশক। এসএম হলের ৩৪ নম্বর রূম থেকে প্রকাশিত হচ্ছে সংকলনটি। রফিক আমাকে সাহস যোগাচ্ছে, দেখিস তোর কোনও অসুবিধা তো হবেই না বরং প্রকাশক হিসেবে ভবিষ্যতে গর্ববোধ করবি। বললাম, আমি অন্য কিছু ভাবছি না। রাজনৈতিক কারণে আমার ৩৪ নম্বর রূম এমনিতেই হল কর্তৃপক্ষের বিষদৃষ্টিতে পড়েছে। এবার ব্যতিক্রমধর্মী সংকলন স্যাড জেনারেশন বের হলে হয়তো তাদের দৃষ্টিটা একটু তীক্ষè হবে।” তো যাই হোক সেই সময়ে স্যাড জেনারেশনের কার্যকলাপে বাংলাদেশে তুমুল কাÐ ঘটে যায়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতার পারম্পর্য খুঁজে পাওয়া গেলেও তিন দেশের এই তিন আন্দোলন স্বদেশে ভিন্ন মাত্রা জুগিয়েছে।
স্যাড জেনারেশনের ম্যানিফেস্টো বাংলা কবিতাকে কতটুকু বর্ধিত ও পরিপুষ্ট করেছে সেদিকে না গিয়ে বলা যায়, পঞ্চাশ কর্তৃক কবিতার যে আঙ্গিক, ছন্দ কিংবা কবিতার যে নান্দনিকতা তখন প্রচল ছিল তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই ষাটের কবিরা নতুন পথ খুঁজছিলেন।
মূলত রফিক আজাদকে কেন্দ্র করেই স্যাড জেনারেশনের আবির্ভাব। আট পৃষ্ঠার এই কাগজের তিনটি পৃষ্ঠা খরচ হয়েছে রফিক আজাদের লেখা ঘোষণাপত্র এবং প্রশান্ত ঘোষালের চম্পাবতী বিষয়ক লেখায় যেখানে রফিক আজাদের বিষণœতার জবাব রয়েছে। বাকি পাঁচ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে ছয়টি কবিতা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘নির্বাচিত দূরে থেকে’ কবিতাটি রফিক আজাদকে উৎসর্গ করা। সেখানেও রফিক আজাদ। যেমনÑ রফিক,/ তোমার শরীরে, হাড়ে, অবিশ্রান্ত করাত কলের/ অমোঘ দুঃস্বপ্ন ঘোরে।
রফিক, আমি সব করাত কলের/ নির্বাচিত দূরে থেকে অসংখ্য কাঠের কান্না শুনে/ চলে যাব।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ পরবর্তী সময়ে স্যাড জেনারেশন ভাবনা থেকে দূরেই থেকেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘যুগপৎ’ ও ‘স্যাড জেনারেশন’Ñ দুটো প্যাম্পলেটÑ বেরোয় এগুলোর সমসময়ে। প্যাম্পলেটগুলোর মধ্যে কিছু অসাহিত্যিক উপাদানের সন্নিবেশ ছিলÑ কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা ছিলÑ যা সাধারণ পাঠকদের কাছে, বিশেষ করে পবিত্র-আক্রান্তদের মনে যুগপৎ উষ্মা ও হতাশার বেহালা শুনিয়েছিল। যে আচমকা আঘাতের, যে বিক্ষোভের দরকার ছিল প্রতিষ্ঠিতদের শান্ত, নিরুপদ্রব উৎকণ্ঠাহীনতার ভারী থাম ধরে জোরে নাড়া দেওয়ার জন্য, এগুলো তা করেছিল। এগুলোর মধ্যে নির্ভেজাল সাহিত্যলক্ষ্য হয়ত ছিল না, কিন্তু এই তরুণ গোষ্ঠীর শোভাযাত্রীর অন্বেষায় এগুলোও একদিন শরিক হাত মিলিয়েছিল, এজন্যই এদের স্মরণ করছি। (আগন্তুক ঋতু : উত্তর প্রজন্মÑ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, পৃষ্ঠা ৬৮-৬৯)
বুলেটিনে প্রকাশিত শহীদুর রহমানের ‘গন্ধ থেকে দূরে’ কবিতার কয়েকটি পঙ্্ক্তি এ রকম : তা হলে চলিরে আজাদ/ তোর ঘরের দেয়ালের গায়/ বিষ্টিরা থুতনি ঠ্যাঙ্গায়/ এবং কজন মেয়ের স্তন আর পাছা থেকে ঝরে
/ আচ্ছা চলিরে আজাদ।
ইউসুফ পাশা, আসাদ চৌধুরী, বুলবুল খান মাহবুব এবং ফারুক আলমগীরের কবিতাও রফিক আজাদের ঘোষণাপত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
উপর্যুক্ত কবিতা ও ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরপরই নিস্তরঙ্গ সাহিত্য ভুবনে ঘূর্ণি হাওয়া বইতে শুরু করে। লেখা হতে থাকে এর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক নানা প্রবন্ধ। আবদুল হাফিজ লিখলেন, ‘সাম্প্রতিক কবিতার আময় : অন্ধকার ও অপরাপর তৎপরতা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ। সেখানে স্যাড জেনারেশন সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ এ রকম : “দি স্যাড জেনারেশন বেরিয়েছিল ১৯৬৪-তে প্রায় আজাদময় রফিকময় হয়ে। রফিকময়তার অপর নাম অসহায় বিষাক্ত অপরাধী, তার রক্তে আত্মধ্বংসের লীলা, মৃত্যু তার সুপ্রিয়া, লেডি বা ভদ্র মহিলার প্রতি অননুরক্ত (অবশ্য মেয়েমানুষে দোষ নেই!), প্রথাবদ্ধ জীবনে অনীহা ও অনাসক্তি, সিগারেট তার মধুসঙ্গী, চিরকেলে বিবর্ণ মরালিটিতে তার অনাস্থা, জীবন অর্থহীন, অস্তিত্ব বর্তমান তবে দুঃসহ দুশ্চিন্তার শিকার, সুখ (প্রথাসিদ্ধ অর্থে) তার অজানা, বিশেষতঃ মানসিক ও শারীরিক বিপর্যয়ের মুখে, সে ‘বিপন্ন’, কিন্তু বীটনিক কিংবা অ্যাংরি নয়, রাজনীতি বা সংবাদপত্রে সে নিস্পৃহ, সে কিচ্ছু চায় না, কিচ্ছু-না কিচ্ছু-না, সে শুধু ক্লান্ত, বিবিক্ত, শ্রান্ত আর বিষাদমগ্ন, হেন অবস্থায় প্রশান্ত ঘোষাল নিয়ে এলেন চম্পাবতীকে।”
স্যাড জেনারেশনের একটিমাত্র বুলেটিন নিয়ে এত যে হৈ চৈ পরবর্তী সময়ে ওই ভাবনা থেকে রফিক আজাদসহ সবাই সরে এসেছেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তো বুলেটিনের কবিতাতেই সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। আসাদ চৌধুরী, ফারুক আলমগীর প্রথার মধ্যেই ফিরে এসেছেন। শহীদুর রহমান ‘বিড়াল’ নামে আলোচিত একটি গল্প লিখে পরিচিত হতে না হতেই মৃত্যুবরণ করলেন। প্রয়াত হয়েছেন ইউসুফ পাশা। অপার সম্ভামনাময় কবি! বুলবুল খান মাহবুব সাহিত্য থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত। কিন্তু রফিক আজাদ চুটিয়ে লিখে গেছেন। নিজের ভাবনা থেকে সরে এলেও এই বিষণœ দেবদূত এই ধারার বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। বিখ্যাত ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় ‘বেশ্যার বেড়াল’ নামে তার একটি আলোচিত কবিতা ছাপা হয়েছিল। কবিতাটির কয়েকটি পঙ্ক্তি এখানে উদ্ধৃত করি :
‘আলস্যে নেশায় বুঁদÑ আমি এক বেশ্যার বেড়াল;
সারারাত শুয়ে থাকি অনাবৃত উষ্ণ তলপেটে
বিছিয়ে কোমল থাবা।Ñ রিরংসায় কেঁপে ওঠে নারী
Ñআমি তার সর্বগ্রাসী উন্মুখর ঊরুর আস্বাদে।’
পরবর্তী সময়ে তিনি এই কবিতাটি তার কোনো কাব্যগ্রন্থে স্থান দেননি।
যৌবনে তিনি যে ভাবনায় আবিষ্ট ছিলেন তা কখনও পরোক্ষ কখনও প্রত্যক্ষভাবে তার কিছু কবিতায় উঠে এসেছে। তার প্রথম কবিতার বই ‘অসম্ভবের পায়ে’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। কবিতাগুলোর রচনাকাল ১৯৬৪-১৯৭২। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোর মধ্যে হে দরোজা, জ্যোৎস্না আর নেই, কবি, জন্মদিনের জর্নাল, আলোকিত অন্তর্ধানে এক উন্মাদ, শরীরী পুতুল এবং স্বগত মৃত্যুর পটভ‚মি কবিতায় তিনি দগ্ধ হয়েছেন, গোপন আগুনে জ্বলে পুড়ে গেছেন, নিঃসঙ্গতায় বিষণœ থেকেছেন। নিজেই নিজেকে বলেছেন, ‘গণিকার মতো গ্রাস করো এই আমÐু আমাকে।’
আবদুল হাফিজ স্যাড জেনারেশনকে বলেছিলেন আজাদময় রফিকময়। এই মন্তব্যের যথার্থতাই হচ্ছে অসম্ভবের পায়ে কাব্যের উপর্যুক্ত কবিতাগুলো।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন