মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়
জীবনানন্দতনয়া মঞ্জুশ্রী দাশকে জীবনে একবার-ই দেখেছিলাম। কথা হয়েছিল যৎসামান্য। কিন্তু সেই সামান্যই অসামান্য স্মৃতি, যা আমৃত্য লালন করে যাবো।
অকুস্থল মহাকরণ, কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংস নামে যা খ্যাত। সময় পেলে ওখানকার তথ্য ও সংস্কৃতিবিভাগে চলে যেতাম। আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ, গল্প ও উপন্যাসকার বিভূতিভূষণ-আত্মজ তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অনূনয়দা-অমিতাভদা-অংশুদা-দীপঙ্করদের সঙ্গে আড্ডা হতো খুব। একটা সারস্বত পরিবেশ ছিল সেখানে।
এরকম-ই একদিন গেছি। বৃষ্টির দিন ছিল সেটা। তথ্যসচিব অনুনয়দার নাতিবৃহৎ ঘরটিতে বসে গল্পগুজব করছি। এমন সময় বৃষ্টিস্নাত হয়ে নিরাবেগ নিরুদ্বিগ্ন এক ভদ্রমহিলা ঢুকলেন অনুনয়দার ঘরে। অনুনয়দা যথোচিত সম্মান দেখিয়ে তাঁকে চেয়ারে বসতে বললেন। একটু অন্যমনস্ক মহিলা, যেন অনুনয়দার কথা শুনেছেন কি শোনেননি। বৃষ্টির জল তাঁর শরীর থেকে গড়াচ্ছে। তিনি বসলেন অতঃপর।
মহিলা বসে পড়েই কোনো ভণিতা না করেই জানতে চাইলেন, হয়েছে কিছু? অনুনয়দা বললেন, 'না, হয়নি। কিছুদিন সময় লাগবে। 'বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'উনি মঞ্জশ্রী। মঞ্জুশ্রী দাশ।'
এইটকু বলতেই আমি বুঝে গেলাম, আমি বসে আছি জীবনানন্দতনয়ার পাশে ! শিহরিত, আপ্লুত, বিহ্বল, কর্তব্যবিমূঢ়, সেই মুহূর্তে আমি এ-সবের সমাহার। মনে পড়ে যাচ্ছিল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি এন. সি. সি.- র টাকা পেয়ে সিগনেট- প্রকাশিত জীবনানন্দের কবিতার বইগুলি ও প্রবন্ধগ্রন্থ 'কবিতার কথা' রাসবিহারী এভিন্যু-এর পিপলস বুক সেন্টার থেকে কিনে আনি। আর তার-ও আগে বিদ্যালয়জীবনে আমার স্কুলের বাংলা শিক্ষক নগেনস্যারের কাছে শুনি জীবনানন্দের নাম (1965/66 নাগাদ জীবনানন্দের নাম বহুশ্রুত ছিল না)। যাদবপুরে আবৃত্তি করেছি 'মৃত্যুর আগে'। সেই জীবনানন্দ দাশের কন্যা আমার পাশে ! আজ তো চারটে সূর্যের উদয় হওয়া লাগে! গীতায় বর্ণিত অর্জুনের দশা আমার, - 'বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে'।
নমস্কার করলাম। কিছু যে বলবো, ভাষাহারা হয়ে সব ভুলে গেছি। আসলে যৌবনে জীবনানন্দ এমন অভিঘাত তৈরি করেছিলেন, তাঁর সম্পর্কে নিতান্ত স্বল্পজানা আমি এতোটাই মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম জীবনানন্দের নামে যে মঞ্জুশ্রীকে সেদিন অবিশ্বাস্য বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল।
অনুনয়দা চা আর খাবার আনালেন আমাদের জন্য। উনি ওসবে মনোযোগ না দিয়ে বললেন, 'টাকাটা কবে--'। তাঁর অর্ধসমাপ্ত বাক্য শেষ না হতেই অনুনয়দা তাঁর মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে ওঁর হাতে দিলেন। উনি টাকাটা নিলেন। আর আমি বিস্ময়চকিত হয়ে ভাবতে লাগলাম, জীবনানন্দের মতো কবির মেয়ে আজ এরকম পরাশ্রয়ী! ভাবনাটা দূর করতে আমার প্রশ্ন তাঁকে, ' আপনিও কি কবিতা লেখেন?' যেন দূরভাষে শুনছি, এমন মৃদুতায় তিনি বললেন, 'এখন আর লিখি না।' এবার খানিকটা সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি পরে আছেন নিতান্তই আটপৌরে একটা শাড়ি। নিরাভরণ হাত। স্বল্প চুল, ভেজা।
অনুনয়দার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি কিছু খেলেন না। তাঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, না, কোনো জীবনানন্দীয় বোধ আসেনি, মনে হচ্ছিল, ঐ চোখ দিয়ে তিনি তাঁর পিতাকে দেখেছেন। আমি কি ঈর্ষান্বিত হতে পারি না চোখদুটির প্রতি?
'আপনার সঙ্গে একদিন দেখা করতে চাই' , বলতে তিনি আমার দিকে সামান্য মনোযোগী হয়ে তাকালেন। উত্তর দিলেন না কোনো। তাঁর চোখের বিচ্ছুরিত বিভা আমাকে কেন যেন শোকার্ত করে তুললো।
অনুনয়দা বললেন, ‘যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব টাকাটা স্যাংশন করছি। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।' দুশ্চিন্তা যে ছাড়বে না তাঁকে, তা ওঁর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। উনি উদাসীনের মতো রওনা হলেন। বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল।
মঞ্জুশ্রী চলে যেতে খুব বেদনার সঙ্গে অনুনয়দা বললেন, উনি নিজের লেখা একটা বইয়ের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যাপারে আসেন মাঝেমাঝে। হবে। কিন্তু অর্থের তাড়নায় অধৈর্য হয়ে বারবার আসেন। আর ওঁর আর্থিক অবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত শোচনীয়।' সেটা বুঝতেই পারছিলাম ওঁকে অনুনয়দার টাকা দেওয়া দেখে। আর ভাবছিলাম, কেন এমন হয়? কেন মধুসূদনের মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানদের অর্থসাহায্যের জন্য ফান্ড গড়তে হয়? কেন মানিক নজরল ঋত্বিক এমন দুর্গ্রহ নিয়ে জন্মান? উত্তর পাই না।
মনে হয়, মঞ্জশ্রীর সঙ্গে দেখা না হওয়াই ছিল যে ভালো। কখনো কখনো Yearrow Unvisited-ই রেখে দেওয়া উচিত।
মলয়চন্দ মুখোপাধ্যায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন