রবিউল হুসাইন
প্রথাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের ধারে কাছে না গিয়ে ঠিক সেই সময় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু কাজী সাহিদ হাসান ফরিদ, তাজু চৌধুরী, সায়ীদ মোস্তাফা কামাল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মাহবুব হোসেন খান ঠিক করলাম যে একটি নতুন ধরনের পত্রিকা বের করবো, নাম হবে ‘না’।
প্রথম সংখ্যায় কবি রফিক আজাদও ছিলেন, তখন ‘স্বাক্ষর’ পত্রিকায় কবিকুল লিখে চলেছেন। প্রথম সংখ্যা ‘না’-তে আমাদের আরেক বন্ধু ইনামুল কবীর ব্রক্ষ্মা লিখেছিলেন। এখন তিনি অকালপ্রয়াত। প্রথম সংখ্যাটি ছিল সাধারণ মানের, বিশেষ করে আঙ্গিকের ক্ষেত্রে এবং বিষয়ে। তবে প্রথম থেকেই মেকী প্রেমের আহাজারি আমরা বাদ দিতে চেষ্টা করি জেনেশুনেই এবং এক ধরনের নির্লিপ্ততা প্রাপ্ত হই। আর তাই অন্যান্য অনেক পত্রিকার সঙ্গে আমাদের ‘না’-এর এই দিকটির পার্থক্য উল্লেখযোগ্য ছিল, হয়তো এ কারণেই একটু আলাদা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছিল।
এই সময়ে শিল্পী রশীদ চৌধুরী প্যারিস থেকে ফিরে একটি প্রদর্শনী করেছিলেন। সেখানেই আমাদের সঙ্গে আলাপ এবং পরে আমাদের স্থাপত্য বিভাগের শিল্পবিষয়ক খণ্ডকালীন শিক্ষকও হয়েছিলেন। প্রয়াত শিল্পী রশীদ চৌধুরী, আমাদের প্রিয় রশীদ ভাই, একজন অবিষ্কারকের ভূমিকা পালন করে গেছেন সারা জীবন। আমাদের সঙ্গে ভীষণ ঘনিষ্ঠ হয়ে ‘না’-এর যাবতীয় আঙ্গিকের ভার নিলেন, লাল খেরো খাতার মতো হবে, তবে তা কালোর আধিক্যে চটের আবরণে এবং যৌথ সম্পাদনায়। প্রকাশিত হয়েছিল মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক মীজান ভাইয়ের ‘গাংচিল’ প্রেস থেকে। ‘না’-এর সেটাই ছিল দ্বিতীয় সংখ্যা। ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হক (বটু ভাই), তখন থেকেই ঘনিষ্ঠ।
রশীদ ভাইয়ের স্কেচ-চুম্বন, প্রচ্ছদ, অঙ্গসজ্জা এবং এ দেশের বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ মুহম্মদ খসরুর নিরীক্ষাধর্মী আলোকচিত্রাবলী তখনকার প্রকাশনায় এক বিশেষ নতুনত্ব নিয়ে আসে এবং বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই হৈচৈ, সমালোচনা-পর্যালোচনা। মূল জার্মান থেকে ফ্রিডেমান ব্যার্গরের কবিতা সায়ীদ মোস্তফা কামাল এবং মূল ফরাশি থেকে রবার দেনোর কবিতা রশীদ চৌধুরী অনুবাদ করেন। আঙ্গিক ও উপস্থাপনা ছাড়া এই পত্রিকাটির বৈশিষ্ট্য ছিল লেখার অভিনবত্ব, বিশেষ করে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। তাজু চৌধুরীর আমগ্ন রোমান্টিক মনের লিরিক্যাল উচ্ছ্বাস এবং শিল্পিত শব্দ বিন্যাস, ছন্দজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত প্রথাগত কবিতা হয়েও এক অনন্য আবিষ্কারের ঠিকানা দিয়েছিল।
এছাড়া ভীষণ আকর্ষণ করেছিল কাজী সাহিদ হাসান, তার প্রথাবিরোধী একটানা বিভিন্ন বক্তব্য-ঠাসা গদ্যভঙ্গির লাইন দিয়ে। কাজি সাহিদ হাসান স্পষ্ট করে কথা বলতেন কবিতায়, ছন্দে অবিশ্বাস করতেন ঘোরতর, চৈতন্যপ্রবাহী বক্তব্যপ্রধান একটানা গদ্যভঙ্গি ছিল তার স্বতঃস্ফূর্তমান বাস্তবতা। কবিতা আর গল্প এবং প্রবন্ধ এসবের ভাষা সব এক রকম হবে, কোন পার্থক্য থাকবে না। পড়ার পর শুধু বক্তব্য এবং বিষয়ে, সঙ্গে সঙ্গে মননের ও বোধে পার্থক্যটা ধরা পড়বে। পাঠক নিজেই ঠিক করবেন কোনটা কবিতা, কোনটা গল্প, কোনটা কি। মাহবুব হোসেন খান একটা জটিল প্রবন্ধ লিখেছিলেন বিজ্ঞানের, তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। আইসোমর্ষিক জগৎসমূহের প্রাথমিক ধারা বিশ্লেষণ ও আলোচনা। তিনি ইংরেজি অক্ষরের বদলে বাংলা ক খ গ দিয়ে আইনস্টাইন আর মিনকোস্কীর চতুর্মাত্রিক জগতের গাণিতিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছিলেন। এটা সে সময়ে নতুন ছিল।
এরপর আমার লেখা ছবিতা অর্থাৎ ছবির রেখা দিয়ে এ্যাপেলোনিয়ার-প্রভাবিত কবিতা, তবে পার্থক্য ছিল ছবির রেখা যেখানে যেখানে স্পর্শ করে যায়, ঠিক সেই জায়গায় কবিতার লাইনের অর্থের সম্পূরক হতে হবে। এই রকম দুটো কবিতা এঁকে লিখেছিলাম, মাতাল এবং সাপ। এ ছাড়া লম্বিত খাড়া এবং আনুভূমিক লাইনের আঁটসাঁটবদ্ধতাধর্মী কবিতাও ছিল। বক্তব্য, বিষয় ও ছবি মিলে এই প্রয়াস খুব দুরূহ আর ছাপাছাপিও বিশেষ মনোযোগ এবং কষ্টের। এ রকম কংক্রিটধর্মী কবিতার বোধহয় এখানে সেবারই প্রথম সূচনা হয়। যতিচিহ্নহীন, ঠাসবুনুনি, লাইনবন্দি, জগদ্দল শব্দমালা দিয়ে কবিতা, অঙ্কের যোগ, গুণ, ব্র্যাকেট দিয়ে এবং সর্বোপরি প্রেমহীন যৌনতার বাড়াবাড়ি, যৌনহিংসা অথবা যৌনক্ষুধাসংবলিত প্রগলভতাপূর্ণ যৌনপলায়নী মনে বৃত্তিমূলক সাবলীল উচ্চারণে পঙ্ক্তিমালা রচিত হয়েছিল।
সব কিছু প্রাতিষ্ঠানিক প্রসঙ্গকে পাশ কাটিয়ে অন্যপথে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমরা নতুন আঙ্গিকে, প্রয়াসে ও উদ্যমে এবং সাহিত্যের দাদাগিরিত্ব সম্পূর্ণ পরিহার করে। এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে বহু মানুষকে কৌতূহলী, উৎসাহী আবার কখনো রাগান্বিত এবং কখনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে হাস্যকর বলেও মত দিতে হয়েছে। খবরের কাগজে উপসম্পাদকীয় লেখা, সমাজের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাতসহ বহু নিন্দা-প্রশংসা কুড়িয়েছিলাম আমরা। ‘না’ বোধহয় সেদিক থেকে এ দেশে প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড-গন্ধী সাহিত্য পত্রিকা ছিল।
তবে ‘না’-এর প্রয়োজন ফুরোয় না। যখন প্রয়োজন পড়বে তখন এমনিতেই মাটি খুঁড়ে বেরুবে, আমাদের দ্বারা হয়ত নয়, অন্য কেউ তখন সেই দায়িত্ব নেবে। সাহিত্যাঙ্গনে ‘না’-এর দাবী কখনো ফুরোবার নয়। ভিন্ন কণ্ঠ, ভিন্ন আঙ্গিক, নতুনত্বের প্রয়াস সব-সময়ই অভিনন্দিত, বিশেষ করে সাহিত্য ও সৃষ্টিশীল শিল্পক্ষেত্রে। কিন্তু লক্ষ করা যায়, ‘না’-এর কথা আজকাল খুদে পত্রিকার আলোচনাতে আসে না, অবাক লাগে একথা ভেবে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিহীন এই সমাজের বৃহৎ অংশের মানুষের মতো তারাও ভুলে যান যে নিরপেক্ষ দৃষ্টিই হচ্ছে মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রধান দৃষ্টি লাভের কৌশল ও উপায়। এ ব্যতীত সে চোখ থেকেও অন্ধ। একমাত্র দেখি কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক-সমালোচক বন্ধুবর আবদুল মান্নান সৈয়দ ব্যতিক্রম। তার খুদে পত্রিকাবিষয়ক বেশ কয়েকটি লেখায় ‘না’- এর উল্লেখ দেখতে পাই। আমরা মনে করি, ‘না’-এর সক্রিয় সদস্য বলেই নয়, এ দেশের খুদে পত্রিকার কথা উঠলে কান টানলে মাথা আসার মতোই ‘না’-এর প্রসঙ্গ আসা উচিত।
মান্নান সৈয়দ ছাড়াও আরেক জনকে দেখেছিলাম, তিনি হচ্ছেন শহীদ মুনীর চৌধুরী। আমাদের কাছে অবাক লেগেছিল সে সময় তার এক বক্তৃতায়, এমন কি টেলিভিশনেও সাম্প্রতিক সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিষয় বলতে গিয়ে তিনি ‘না’-এর ভূমিকার কথা অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছিলেন। উত্তাল ষাটের দশকে ‘না’ ছিল সেই সময়ের প্রচল নান্দনিকতার বিরুদ্ধে এবং স্যাড জেনারেশনের প্রতিনিধিত্বকারী। বিদ্রোহ জ্ঞাপনসহ সাহিত্য বা কবিতায় নিরীক্ষাময় এক সৃষ্টিশীল, অবাধ, আন্তর্জাতিক ধীমান ও মননের বিপুল এবং প্রধান পরিচয়চিহ্ন-এই সাহিত্য-সন্দেশ বর্তমানে জানা থাকলে কালের যাত্রা উপভোগ্য না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন