"হাংরি আন্দোলন" ও হাংরি আন্দোলনের কবি

 সোমনাথ দত্ত

পারমিতাদির প্রশ্নের অনুরোধে উত্তর দিতে পারাটা নিঃসন্দেহে দারুণ সৌভাগ্যের ব্যাপার, এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হচ্ছে না। কিন্তু ব্যাপারটা হল, এই উত্তরটা আমি একটু নিজস্ব ভঙ্গিতে দিতে চাই, মানে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, নিজের মতবাদ সব মিলিয়ে মিশিয়ে। আমার যেভাবে উচিত মনে হয়েছে, ঘটনাগুলোকেও সেভাবেই উপস্থাপিত করছি।এই মতামতের সাথে হয়তো অনেকে একমত নাও হতে পারেন, সেক্ষেত্রে সবার নিজস্ব ধারণা বা নিজস্ব তত্ত্ব সম্বন্ধে জানাতে অনুরোধও করছি, অবশ্যই যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে।

সময়টা ১৯৬৫। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কাঠগড়ায় উঠেছেন মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। পাবলিক প্রসেকিউটরের জিজ্ঞাসা -" 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটা পড়ে আপনার কি মনে হয়েছে?"

শক্তি: ভালো লাগেনি।

প্রসিকিউটর: অবসিন কি? ভালো লাগেনি বলতে আপনি কি বোঝাতে চেয়েছেন?

শক্তি: ভালো লাগেনি মানে জাস্ট ভালো লাগেনি। কোনো কবিতা পড়তে ভালো লাগে,আবার কোনোটা ভালো লাগে না।

হ্যাঁ, সেই মামলায় মলয়বাবুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন স্বয়ং শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ফলাফল-নিম্ন আদালতে সাজা ঘোষিত হয় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে। তারপরের ঘটনায় আসছি। তার আগে…..

ফ্ল্যাশব্যাক!

সালটা ১৯৬২ । কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে খালাসিটোলা, বারদুয়ারি অবধি সর্বত্র গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের ব্লু প্রিন্টের মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি ম্যানিফেস্টো।ভাষাটা অনেকটা এরকম-

মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়।……এখন কবিতা রচিত জয় অর্গ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।

২৬৯ নেতাজী সুভাষ রোড, হাওড়া থেকে প্রকাশিত এই ম্যানিফেস্টোর ওপরে লেখা - হাংরি জেনারেশন। নীচের লাইনে তিনটি নাম। স্রষ্টা: মলয় রায়চৌধুরী। নেতৃত্ব: শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদনা : দেবী রায়। তখনও কলেজ স্ট্রিটের বাতাসে আসেনি বারুদের গন্ধ, দেয়ালে লেখা হয়নি 'সত্তরের দশক মুক্তির দশক'। কিন্তু পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া এই ম্যানিফেস্টোর গুরুত্ব অন্যত্র। এর আগে 'কবিতা', 'ভারতী', কৃত্তিবাস, শতভিষা -অনেক কবিতার কাগজ ছিল, সেগুলি ঘিরে কবিরা সংঘবদ্ধও হতেন।কিন্তু এভাবে সাইক্লোস্টাইল করা ম্যানিফেস্টো আগে কখনো ছড়ায়নি বাংলা কবিতা।

তবে শুরুটা কিন্তু মোটেই এখানে নয়। ওটা ছিল হাংরি আন্দোলনের দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো।প্রথমটি বেরিয়েছিল কয়েকমাস আগে, ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে। ইংরেজিতে লেখা সেই ম্যানিফেস্টো জানান দেয় -

Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of bamboozled gardens.

অর্থাৎ কিনা, কবিতা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না, বিভ্রমের বাগানে পুনরায় বৃক্ষরোপণ করে না।

বিশ্বায়নের ঢের আগে ইংরেজি ভাষাতেই প্রথম ম্যানিফেস্টো লিখে ফেলেছিলেন হাংরি কবিরা। কারণ পাটনার বাসিন্দা মলয় রায়চৌধুরী ম্যানিফেস্টোটি লিখেছিলেন। পাটনায় কোনো বাংলা ছাপাখানা ছিল না, ফলে ইংরেজি।

দুটি ম্যানিফেস্টোতেই শেষ হল না ইতিহাস। আসলে হাংরি এমন একটা আন্দোলন, যার কোনো কেন্দ্র নেই, নেই কোনো সুষ্ঠু নেতৃত্ব। ফলে শহরে, মফস্বলে যেকোনো কবিরাই বের করতে পারেন তাদের নিজস্ব বুলেটিন। এই যেমন, ১৯৬৮ সালে শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর 'মুক্ত কবিতার ইস্তাহার' -এ ছাপিয়ে দিলেন ২৮ টি প্রতিজ্ঞা -

  • সমস্ত ভণ্ডামির চেহারা মেলে ধরা
  • শিল্প নামক তথাকথিত ভূষিমালে বিশ্বাস না করা
  • প্রতিষ্ঠানকে ঘৃনা করা
  • সভ্যতার নোনা পলেস্তারা মুখ থেকে তুলে ফেলা, ইত্যাদি।

এরপরের ঘটনা আরো চমৎকার। পরে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধে। মলয়বাবু অবশেষে ব্যাংকের চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যান। শৈলেশ্বর, সুবো আচার্য আর প্রদীপ চৌধুরীরা বলেন -' মলয় বুর্জোয়া সুখ আর সিকিউরিটির লোভে আন্দোলন ছেড়ে চলে গিয়েছে।' ভাবুন একবার তবে এই আন্দোলনের কি ছিরি আর আন্দোলনকারীদের ঐক্যবদ্ধতার দশাখানা কি।

চিত্র: হাংরি আন্দোলনের লেখকগণ। ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে: শৈলেশ্বর ঘোষমলয় রায়চৌধুরীসুভাষ ঘোষ বাসুদেব দাশগুপ্ত, ডেভিড গার্সিয়া এবং সুবিমল বসাক

আসলে এই আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি কিন্তু এতোটাও কমজোরি ছিল না। হাংরি নাম চয়ন করা হয় জিওফ্রে চসারের 'ইন দি সাওর হাংরি টাইম' বাক্যটি থেকে, এ কাজ করেন স্বয়ং মলয়বাবু। তাত্ত্বিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয় সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেঙলারের 'দ্য ডিক্লাইন অফ দ্য ওয়েস্ট ' গ্রন্থটির দর্শন থেকে। স্পেঙলার বলেছিলেন-

একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। তা হলো জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে, তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়। তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় , তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন।

ষাটের দশকের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু কলোনীতে মানুষের ভিড় আর সর্বোপরি স্বরাজের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিয়ে স্বার্থ আর নোংরা রাজনীতির নগ্ন খেলা - এসবকিছুর প্রেক্ষাপটে সরকার, কর্তৃপক্ষ আর প্রতিষ্ঠানের প্রতি স্বাভাবিক বিশ্বাসের ভিতটাই নড়ে যায় যুবসমাজের। তারা শরণাপন্ন হয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান বিরোধী, শাসকবিরোধী কাব্য আন্দোলনের।সে কারণেই দেখা যায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা যুবসমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে হাংরি আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব আর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। সুবিমল বসাকের আগে কেউ 'বাঙাল ভাষায়' কবিতা উপন্যাস লেখেননি, এই ব্যাপারটা বেশ লক্ষণীয়। পরবর্তী দশকের লিটল ম্যাগাজিনের রচনাগুলিতে এর প্রভাব কিন্তু স্পষ্ট।

শুধু কবিতা লিখে ক্ষান্ত হওয়ার ছিল না এই হাংরি গোষ্ঠী। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, এম এল এ, সচিব , লেখক- সবাইকে পাঠানো হল মুখোশ। প্রতিটি মুখোশে লেখা থাকে-

দয়া করে মুখোশটা খুলে ফেলুন।

এখানেই শেষ নয়। কবি সাহিত্যিকদের পাঠানো হল বিয়ের কার্ড। তাতে লেখা -

F*ck the Bastard of Gungshalik School of Poetry

শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে উদ্দেশ্য করে-

কবিতা ভাতের মতো কেন লোকে নিতেই পারছে না

যুদ্ধ বন্ধ হলে নেবে? ভিখারিও কবিতা বুঝেছে

তুমি কেন বুঝবে না হে অধ্যাপক মুখ্যমন্ত্রী সেন?

কিন্তু এত গেলো মুদ্রার একপিঠ। পেছনে আর গল্প নেই? হাংরিরা বরাবর চেয়েছিল শাসক আর ভন্ড লোকেদের প্রকৃত স্বরূপকে নগ্নরূপে তুলে ধরতে। আর শুধু তার জন্যেই কি সম্মুখ নগ্নতা আর যৌনতাকে এতটা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে কবিতার প্রত্যেকটি ছত্রে?

কথায় কথায় উইলিয়াম বারোজ এবং হেনরি মিলারের উদাহরণ বারে বারেই টেনেছেন হাংরিরা। কিন্তু আসল ঘটনা হলো, এরা যত না ভালো কবিতা লিখেছেন, তার চেয়ে বেশি করেছেন ঝগড়া। এবং তার চেয়েও বেশিবার গাঁজা, এল এস ডি, মেস্কালিন আর অ্যাম্ফেটামাইন ট্রিপে গিয়েছেন। আদতে কিরকম লিখতেন হাংরি কবিরা?

জেগে ওঠে পুরুষাঙ্গ নেশার জন্য হাড় মাংস রক্ত ঘিলু শুরু করে কান্নাকাটি

মনের বৃন্দাবনে পাড়াতুতো দিদি বোন বৌদিদের সঙ্গে শুরু হয় পরকীয়া প্রেম

লিখেছিলেন অকালপ্রয়াত ফাল্গুনী রায়। কি? গা রী রী করে উঠলো না? এর চেয়েও মারাত্মক মাপের লাইন আছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও দেখে নিজেরই এতটা বিবমিষা হচ্ছিল, যে এই উত্তরে উল্লেখ করার মতো সাহস বা রুচিবোধ কোনোটাই দেখাতে পারলাম না। আপনি বলতেই পারেন, শ্লীলতা-অশ্লীলতার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়ে সমাজের সত্যতাকেই নিংড়ে বের করতে চেয়েছিলেন তাঁরা।কি দরকার এভাবে শুধু ভদ্রতা আর ভাবব্যাকুলতার মধ্যে কাব্যকে আটকে রাখার? ওটা তো ভণ্ডামি। উত্তরে আমি বলব, যদি সমাজে বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে শ্লীলতা অশ্লীলতার পার্থক্যই ঘুচিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হয়, তবে দিন না, কিন্তু নিজের মূল্যবোধের পতন ঘটিয়ে? পার্থক্য ঘোচাতে গিয়ে তো শুধু অশ্লীলতাকেই মূর্ত করে তোলা হল। ক্ষুধার্ত, জেব্রা, ফুঃ এর মত পত্রিকায় যেভাবে ইটালিক্স আর বোল্ড ব্যবহার করে কিছু শব্দ আর বাক্যকে ফুটিয়ে তোলা হত, তাকে আর যাই হোক, ওই পার্থক্য ঘোচানো বলা যায় না, বরং অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া আর মূল্যবোধ বিকিয়ে দেওয়া। বস্তুত, আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে এটাই ছিল হাংরি গোষ্ঠীর মূল ইউ এস পি। উন্মুক্ত যৌনতাকে বাজারে সস্তায় বেচে কিনতে চেয়েছিলেন খ্যাতি আর সম্মান।যার জন্য বাংলা কবিতার মর্মকে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর দেরাজ থেকে সোজা নামিয়ে আনেন রাস্তায়। বুঝতে পারছেন না এখনও আসল ভন্ড মানে হিপোক্রিট কারা ? বেশ, তবে আবার চলে যাই সেখানে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম।

হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এই মোকদ্দমা দায়ের করা হয় ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে আই পি সি ১২০বি, ২৯২, ২৯৪ ধারায়, ১১ জনের বিরুদ্ধে। কিন্তু মলয়বাবু বাদে বাকি সবাইকে রেহাই দেওয়া হয়। ১২০ বি এবং ২৯৪ ধারা তুলে ২৯২ পাতার চার্জশিট দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ' কবিতাটির জন্যে। এক এক করে সবার আসল চেহারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল। বহু আন্দোলনকারীই রাজসাক্ষী দেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা শুরুতেই বলেছি। নিম্ন আদালতে সাজা তো ঘোষিত হল। এরপর মামলা গেল উচ্চ আদালতের দ্বারে। এই মামলাটি কিন্তু এক অর্থে শাপে বর হয়ে দাঁড়ালো হাংরি গোষ্ঠীর জন্য। সারা ভারতজুড়ে একের পর এক পত্র পত্রিকায় তাদেরকে নিয়ে প্রতিবেদন বের হলো। এমনকি টাইমস পত্রিকাতেও মলয়বাবুর ছবি ছেপে খবর বেরোলো। বিদেশ থেকেও বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিনিধিরা এলেন এই মামলার খবর নিতে। দেশের সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের বড় একটা অংশ তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখালো। আর এটাই বোধ হয় চাইছিলেন হাংরি গোষ্ঠীর কবিরা।

শক্তির কয়েকমাস পর উচ্চ আদালতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এলেন মলয়ের সমর্থনে -

প্রসিকিউটর: কবিতাটা কি অশ্লীল মনে হচ্ছে?

সুনীল: কই না তো। আমার তো বেশ ভালো লাগছে। বেশ ভালো লিখেছে।

প্রসিকিউটর: আপনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে?

সুনীল: না, তা কেন হবে? কবিতা পড়লে সেসব কিছু হয় না।

ছাড়া পেয়ে গেলেন মলয় রায়চৌধুরী। একই মামলায় শক্তি ও সুনীল পরস্পরের বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় কথা, '৬৫ সালের এই সাক্ষ্য দেওয়ার আগেই সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে বেশ কড়া একখানা চিঠি দিয়েছিলেন -

লেখার বদলে আন্দোলন ও হাঙ্গামা করার দিকেই তোমার ঝোঁক বেশি। রাত্রে তোমার ঘুম হয়তো? মনে হয়, খুব শর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার।

ব্যক্তিগত চিঠিতে অনুজপ্রতিম মলয়কে ধমকাচ্ছেন, কিন্তু আদালতে তার পাশে গিয়েই দাঁড়াচ্ছেন। সম্ভবত বন্ধু শত্রু নির্বিশেষে অনুজ কবিদের কাছে সুনীলের 'সুনীলদা' হয়ে ওঠা হাংরি মামলা থেকেই।প্রবাদপ্রতিম কৃত্তিবাসী বন্ধুত্বের নীচে যে কত চোরাবালি ছিল, তা বোঝা যায় উৎপলকুমার বসুকে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি চিঠি থেকে,

‘প্রিয় উৎপল, একদিন আসুন।...আপনি তো আর শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না।’

তা হলে কি হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে প্রভাবহীন, শুধুই কেচ্ছাদার জমজমাট এক পাদটীকা? দুটি কথা।

  • হাংরিদের প্রভাবেই কবিতা-সংক্রান্ত লিট্ল ম্যাগগুলির ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ গোছের নাম বদলে যায়।আসে ‘ক্ষুধার্ত’, ‘জেব্রা’, ‘ফুঃ’-এর মতো কাগজ।
  • পরবর্তী কালে সুবিমল মিশ্রের মতো অনেকেই নিজেকে হাংরি বলবেন না, বলবেন ‘শুধুই ছোট কাগজের লেখক’। কিন্তু তাঁদের গল্প, উপন্যাসেও আসবে সেই টাইপোগ্রাফিক বিভিন্নতা। তৈরি হবে শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। হাংরিরা না এলে কি নব্বইয়ের দশকেও হানা দিতেন পুরন্দর ভাট?

আসলে, ম্যানিফেস্টোর মধ্যেই ছিল মৃত্যুঘণ্টা। হাংরিরা নিজেদের যত না সাহিত্যবিপ্লবী মনে করেছেন, তার চেয়েও বেশি যৌনবিপ্লবী। সুনীল, শক্তিরা পরে হাংরিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। কিন্তু ১৯৮১ সালে ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকার হয়ে শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন অরুণেশ ঘোষ...

অরুণেশ: অনেক সমালোচক বলেন, হাংরি সাহিত্য ভারতবর্ষে যৌন বিপ্লবের প্রেরণা দিয়েছে...

শঙ্খ: এ হল আবার সেই বাড়িয়ে ভাবার প্রবণতা। হাংরি সাহিত্য কি সত্যি সত্যি এত দূর বিস্তারিত যে গোটা ভারতবর্ষের যৌন বিপ্লবের প্রেরণা হতে পারবে সে?

তাই, দেখতে পাই, সত্তরের দশকে কিছু কবি এলোপাতাড়ি রকমের প্রচেষ্টা চালালেও হাংরি আন্দোলন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, আসল তত্ত্বটিই তাঁরা জানতেন না বলে। ১৯৬৭ সাল যেমন মামলার শেষ, তেমনি একইসাথে এই প্রথাবিরোধী আন্দোলনেরও সমাপ্তি। এখনো পর্যন্ত হাংরি অধ্যায়ের সুদূরপ্রসারী একটা প্রভাব উপলব্ধি করছি আর করে চলেছি আমরা।তবে সত্যি বলতে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র হয়েছে মেনে নিলেও এর ব্যর্থতা একপ্রকার অবশ্যম্ভাবীই মনে হয়েছে আমার। কারণ,

১. হাংরি গোষ্ঠী নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় একপ্রকার মরিয়াই ছিল। সেই কারণেই তারা তাদের পূর্ববর্তী সমস্ত প্রজন্মের কবিতা, সাহিত্যকে মিথ্যা আর মূল্যহীন প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল। কোনো জাতিই যখন তার অতীত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে এগোতে পারে না, তখন সাহিত্য কি করে পারবে?

২.মুখে বড় বড় কথা বললেও আদতে হাংরিরা নির্দিষ্ট কোনো তত্ত্ব বা ism অনুসরণ করতেন না। না ছিল কোনো উপযুক্ত সংগঠন, না নেতৃত্ব।

৩.প্রত্যেকে ছিলেন একেকজন ভন্ড। মামলার সময় আসল চেহারা বেরিয়ে এল তো? সব ছিল খ্যাতি পাওয়ার লোভ। বোধহয় সে উদ্দেশ্য কিছুটা সফলও হয়েছিল মলয়বাবুর।

৪.আর ছিল, অশ্লীলতার অস্ত্রকে কাজে লাগিয়ে, খ্যাতির লোভে 'সমাজ চুলোয় যাক' মার্কা একটা মনোভাব। মনস্তাত্ত্বিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা কোনো সুস্থ সমাজ গঠনের মানসিকতা হতে পারে না।

পুনশ্চ- কিছু অতিরিক্ত কথা: পরিশেষে এটাই বলবো, আমি বা আমার প্রজন্মের কেউ সেই যুগটাকে প্রত্যক্ষ করিনি। যা জানতে পেরেছি, সবই পত্র পত্রিকা বা লোকের মুখে শুনে। কিন্তু এ যুগেও এমন কিছু জিনিস আমাদের চোখে পড়ে, যার ভিত্তিতে এই আন্দোলন সম্বন্ধেও একটা 'অনুরূপ' ধারণা পোষণ করতে পারি। উদাহরণ হিসেবে আমি বলি, আজকের দিনে আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ভোজপুরী গান শোনেন? আপনার মাথায় কতগুলো এমন গানের কথা আসবে, যে আপনি আমার রুচিবোধ নিয়ে রীতিমতো সন্দিহান হয়ে পড়বেন। অথচ আপনার মাথায় একবারও আসবে না যে, আমি অজস্র শ্রুতিমধুর ভোজপুরী ভজনগীতি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এমনকি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারজয়ী কাল্ট সঙ্গীতের প্রসঙ্গও তুলতে পারি।

সত্যি বলতে কি, আমাদের মনের গঠনটাই এমন করে ফেলেছি, যে সরল স্বাভাবিক কৃষ্টির থেকে তথাকথিত 'ভালগার' বিষয়বস্তু আমাদেরকে বেশি নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আর এই লোভটা দেখিয়েই অনেকে আমাদের প্রথাগত সংস্কৃতিকে লুটে নিতে আসে। অনেকটা 'মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভান্ডার' গোছের ফর্মুলায়।আপনি অতি বুদ্ধিমান হলে তাদের অভীষ্টকে ঘৃণাপূর্ণ ভঙ্গিতে দেখতে পারেন, অবজ্ঞা করতে পারেন, কিন্তু উপেক্ষা করতে পারেন না।তাই উচ্চাঙ্গের সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিতেও পরিবর্তন আনতে হবে আরো আমাদের মূল্যবোধে, আমাদের নীতিবোধে।ধারালো চিন্তাভাবনা মানেই অন্য কাউকে অযথা অসম্মান করা নয়, অশ্লীলতা তো নয়ই, যদিও এই ভাবনাটা আমার, একান্ত ব্যক্তিগত।

ধন্যবাদ:)

তথ্যসূত্র :

হাংরি প্রজন্ম - উইকিপিডিয়া

বাংলা সাহিত্যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রভাব : অভিজিৎ পাল

আনন্দবাজার পত্রিকা - রবিবাসরীয় গল্প

হাংরি আন্দোলন :: Hungryalist Movement :: MILANSAGAR ::

হাংরি আন্দোলন ও বালি উত্তরপাড়ার ঐতিহ্যের সাবর্ণভিলা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন