দর্শন ও কবিতার মেলবন্ধন

আমিনুল ইসলাম



দর্শনের স্বরূপ সম্পর্কে যেমন, দার্শনিকদের সামাজিক ভূমিকা নিয়েও তেমনি বিতৃষ্ণা-বিতর্কের অন্ত নেই। বাস্তবমুখী শিক্ষার এই যে দাবি, তা ষোল আনা যথার্থ। কারণ অর্থনীতি-প্রযুক্তির প্রসার ছাড়া অগ্রসরমান জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, দর্শন কি সত্যিই জীবনবিমুখ?

এখন আসা যাক দর্শন ও সাহিত্যের, বিশেষ করে দর্শন ও কবিতার সম্পর্কের ব্যাপারে। দর্শন যেমন জীবনের মৌলিক প্রশ্নাবলির সদুত্তর অনুসন্ধানে নিয়োজিত, কাব্য-সাহিত্যের লক্ষ্যও তাই। দর্শন তার বিষয়বস্তুকে পরিমাপ করে যুক্তির নিরিখে, আর কাব্য-সাহিত্যের আবেদন থাকে ভাবাবেগ আপ্লুত হৃদয়তন্ত্রীর দরবারে। দার্শনিকের চিন্তার বাহন মস্তিষ্ক, আর কবির মূল অবলম্বন হৃদয়।

পৃথিবীর আদি রচনাবলির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যুগপৎ স্বীকৃতি পেয়েছে সাহিত্য ও দর্শন হিসেবে, বেশকিছু লেখক নন্দিত হয়েছেন একাধারে কবি ও দার্শনিক হিসেবে। যেমন_ মূলত ধর্মকথা হয়েও উপনিষদের শ্লোকগুলো স্মরণীয় হয়ে আছে সার্থক কাব্য হিসেবে। একই কথা বলা যায়, বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ সম্পর্কে। দার্শনিক রীতিতে এবং বিস্তৃত যুক্তির আঙ্গিকে পরিবেশিত না হলেও এসব গীতি রচনায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় জগৎ ও জীবনের এমন কিছু তত্ত্বের, যেগুলো সমান গুরুত্ব পেয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আধুনিক দার্শনিক সাহিত্যে।
যিনি শুধু কবি, দার্শনিক নন_ তিনি তার কাব্যে জগৎ ও জীবনের কিছু বিবরণ দেন মাত্র। আর যিনি একাধারে কবি ও দার্শনিক, তিনি তার কাব্যে জগৎ ও জীবনের নিছক বর্ণনাই দেন না, ছন্দ-যুক্তির সমন্বয়ে হাজির করেন এক চমৎকার ব্যাখ্যা। লুক্রেটিয়াস, ওমর খৈয়াম, দান্তে, গ্যেটে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল_ এসব খ্যাতিমান কবির সবাই ছিলেন দার্শনিক-কবি।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা বলা যায় এক্ষেত্রে। নিছক একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, দর্শনের জীবনকেন্দ্রিক অর্থ ও আবেদনের নিরিখেই আমরা বিচার করতে চাই তার চিন্তার মানবিক দিকটি। মানবকল্যাণে আত্মনিবেদিত দার্শনিক মাত্রই যেমন দর্শনকে রস-কষহীন বিশুদ্ধ তত্ত্বের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে যুক্ত করতে চান সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও হাসি-কান্নার বাস্তব জীবনের সঙ্গে, নজরুলও ঠিক তেমনি কাব্যসাহিত্যকে বিশুদ্ধতার সংরক্ষিত এলাকা থেকে মুক্ত করে পেঁৗছে দিয়েছেন নিপীড়িত মানুষের ঘরে। তার প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের প্রেরণা প্রথম সুস্পষ্টভাবে অভিব্যক্ত হয় বিদ্রোহী কবিতায়। অনেকটা পারস্য দেশীয় ধর্মবেত্তা আল-গাজালি এবং ফরাসি দার্শনিক দেকার্তের মতো তিনি নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রথমেই গ্রহণ করলেন প্রতিবাদ, সংশয় ও ধ্বংসকে এবং স্বাগত জানালেন সর্বাত্মক বিক্ষোভকে।

এ নেতিবাচক মনোভাব অবশ্য নজরুলের শেষ কথা নয়। এটি তার ইতিবাচক দর্শনের প্রারম্ভিক পর্ব মাত্র। নজরুল নিশ্চিত যে, নিজের ওপর নিজের যখন বিশ্বাস আসে, যখন মানুষ আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়, তখন সে অনুধাবন করে পরম স্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হিসেবে সে তুচ্ছ নয়, হেয় নয়, বরং শ্রদ্ধেয় ও মহান। মানুষের অন্তরে যেহেতু স্রষ্টার অধিষ্ঠান, সুতরাং মানুষকে কখনও কোনো প্রয়োজনে পূর্বানুমতি নিয়ে স্রষ্টার কাছে যেতে হয় না, স্বয়ং স্রষ্টাই এসে ধরা দেন মানুষের কাছে।

এবার আসি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে। তিনি ছিলেন বৈশ্বিক মাপের একজন দার্শনিক-কবি। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে তিনি বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো দার্শনিক মত গড়ে তুলেছেন_ এ কথা অবশ্য হলফ করে বলা যাবে না। কারণ তিনি মূলত একজন কবি, আর কবি হিসেবে তার রচনার মূল উপাদান ও আলোচনার পদ্ধতি দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণ নয়, অনাবিল হৃদয়াবেগ, অপরোক্ষ অনুভূতি। রবীন্দ্রনাথ প্লেটো-এরিস্টটল কিংবা স্পিনোজা-রাসেলের মতো যৌক্তিক প্রয়োগ পদ্ধতির আশ্রয় নেননি। তার কবি-হৃদয়ে ভেদবুদ্ধি বা যুক্তি-বিচারের চেয়ে অনুভূতিই ছিল প্রবল। তাই বলে হৃদয়াবেগের চাপে কবিগুরু দার্শনিক যুক্তির পথ পরিহার করেননি। যেমন_ সসীম-অসীমের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি যে কবিতার অবতারণা করেছেন, তা যুগপৎ স্বীকৃত অনবদ্য কাব্য ও যথার্থ দর্শন হিসেবে। উপনিষদের ব্রহ্মের কথাই বলি, ভক্তের ভগবানের কথাই বলি কিংবা তার নিজের জীবন দেবতার কথাই বলি, তাদের সবাইকেই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের মনে ও প্রকৃতিতে অনুসূ্যত সত্তারূপে। কবির ভাষায়--
 'জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে/তুমি বিচিত্র রূপিণী।'
 
আদর্শবাদী জীবন দর্শনের রূপ-স্বরূপ ও অন্তঃসারের অনুভূতিকেই কবি দার্শনিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন 'জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ' শীর্ষক তার সুপ্রসিদ্ধ হিবার্ট বক্তব্যে। এ একই বক্তব্যের ভাব তিনি প্রকাশ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত 'মানুষের ধর্ম'-এর বক্তব্যে। এখানে সহানুভূতি ও একাত্মবোধের প্রেরণায়ই কবি নিজেকে সব মানুষের 'সমান বয়সী' বলে দাবি করেছেন। যে যুগে জাতীয় চেতনাই ছিল উপমহাদেশের পরাধীন মানুষের সবচেয়ে বড় প্রেরণা, তখনও তিনি সব মানুষের স্বজাতি হয়ে থাকার গভীর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এ অনুভূতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েই। সেদিনের হিন্দু ধর্মের অতি-আধুনিক সংস্করণ ব্রাহ্ম ধর্মের সঙ্গে ইসলামের একেশ্বরবাদের যে নিকট যোগ, তার প্রভাবও তার ওপর পড়েছিল। কারণ এ একেশ্বরবাদ জীবনের প্রতি কর্মে, প্রতি চেষ্টায় এক বিশ্ব চেতনার কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুই নয়। আধ্যাত্ম চেতনা তার কাছে শুধু পরের কাছ থেকে পাওয়া একটি সংস্করণ মাত্রই ছিল না। তার নিজের সাধনার দ্বারা তিনি সে সংস্কারকে অনুভূতিতে রূপায়িত করতে পেরেছিলেন। এখানেই তার দার্শনিক চিন্তার স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য।

দর্শনের পথ যুক্তির_ সন্দেহ নেই। কিন্তু কেবল যুক্তি দিয়ে মনকে নিঃসংশয়, দ্বিধামুক্ত ও পরিতৃপ্ত করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন অখণ্ড অনুভূতি ও অনাবিল হৃদয়াবেগ, যা কি-না কাব্যসাহিত্যের মূল অবলম্বন। যে রচনায় একদিকে সাহিত্যিক আনন্দ-অনুভূতি এবং অন্যদিকে দার্শনিক যুক্তি-বিচারের সার্থক সমন্বয় ঘটে, সে রচনাই মর্যাদা পায় সুসাহিত্য ও প্রকৃত দর্শনের এবং সেই কাব্যসাহিত্যের রচয়িতাই লাভ করেন দার্শনিক-কবির মর্যাদা। এ মর্যাদাসম্পন্ন দার্শনিক-কবি কেবল বিশুদ্ধ তত্ত্ব রোমন্থনই করেন না, জগৎ-জীবন ও মানুষকে নিয়েই কথা বলেন, মানবকল্যাণেই নিবেদিত থাকেন। বর্তমান ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ পৃথিবীতে এ ধরনের মানব দরদি দার্শনিকের শিক্ষা মানুষের দুঃখ-কষ্ট মোচনে সহায়ক হোক, বিশ্বশান্তি ও প্রগতির পথ সুগম করুক-- এ আশাই করছি আন্তরিকভাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন