বদরুল হায়দার
জীবনানন্দ দাশ মূলত কবি। বাংলা আধুনিক কবিতার জনক হিসেবে তার কবিতা
যেভাবে মহীয়ান ও চিরভাস্বর, তেমনি গল্পও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
বাংলা কবিতায় তিনি সমকালীনদের অতিক্রম করে এক নিজস্ব কাব্যভুবন সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে বাংলা ছোট গল্পেও তিনি তার নিজস্বতাকে ধারণ করেছেন। অনিশ্চিত অনুভূতিময় স্বপি্নল মধ্যবিত্ত জীবনের অভিঘাত, জগৎ ও মানুষ সম্পর্কে সচেতনতা তার গল্পকে করেছে এক সুদূরপ্রসারী অভিযাত্রী। প্রেম, যৌনতা, মনস্তাত্তি্বক প্রতিফলন ও অনাবিষ্কৃত দিকের বিশ্লেষণ তার গল্প নতুন মাত্রা দান করেছে।
বাংলা ছোট গল্প কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু হলেও জন্মলগ্ন থেকেই বাংলা ছোট গল্প লাভ করে অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও অনন্ত যৌবন। জন্মলগ্ন থেকে বাংলা ছোট গল্প তার নিজস্ব আসন লাভ করেছে বিশ্বাতীত এক চিরন্তন আবহের পরিপুষ্টতাকে ধারণ করে। মূলত রবীন্দ্র বন্ধনযুক্ত গতিতে এই ছোট গল্প ত্রিশের দশক পর্যন্ত গতিমান ছিল। পরে রবীন্দ্র বন্ধনমুক্তি ও বিরোধিতার মধ্য দিয়ে বাংলা ছোট গল্প উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আবির্ভূত হয় একদল লেখকের হাতে। অন্যদিকে রুশ বিপ্লবের চেতনা জগৎ ও মানুষ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
গতানুগতিকতার বিরুদ্ধাচারিতার ফলে ছোট গল্পে রবীন্দ্র প্রবাহমুক্ত একটি আবহকে লালন করে। মধ্যবিত্ত মানসিকতা, প্রেম, যৌনতা, মনস্তাত্তি্বকতায় গল্পে বিষয় বদলাতে থাকে। আবিষ্কৃত হতে থাকে অনাবিষ্কৃত দিকের সন্ধান।
ত্রিশের কবিতার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জীবনানন্দ দাশও ছোট গল্প লিখতে শুরু করেন। মধ্যবিত্ত মানুষ ও সমাজের মধ্যে নেমে আসে ভাঙন। অবক্ষয়, পতন ও পচনের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ বাংলা ছোট গল্পে আবির্ভূত হন। অন্যদিকে জীবন সম্পর্কে প্রচলিত মূল্যবোধগুলো সম্মুখীন হয় হাজারো প্রশ্নের। বাংলা ছোট গল্পে বিষয় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় প্রচলিত ধ্যান-ধারণা। পরাধীন জীবনের অনিশ্চয়তা ও সহায়তা না থাকায় সমাজ মানুষের বিশ্লেষণে জীবনানন্দ দাশ ছোট গল্প আলাদা ভাষায় সৃষ্টিতে প্রয়াসী হয়ে ওঠেন।
জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ ও দ্বান্দ্বিকতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে বেদনাবোধের উল্লম্ফন, যা তার ছোট গল্পের বিষয়বৈচিত্র্যে অন্য একটি নতুন মাত্রা দান করে। মূলত জীবনানন্দ মানুষের জীবনের এপিঠ-ওপিঠ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আজীবন সাধারণ বিষয়কে বেছে নিয়েছেন। চলমান যান্ত্রিকতার ভেতর জেগে ওঠা সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতের অন্তঃধ্বনির বেদনা ও আনন্দকে চিত্রায়ন করতে গিয়ে বাংলা ছোট গল্পে আলাদা সঙ্গীতের জয়গান করছেন। অন্যদিকে বেকারত্বের ভয়াবহ রূপ, যুদ্ধোত্তর মুদ্রাস্ফীতি, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা এবং দাঙ্গার অস্থিরতা সময় শরীরে নৈরাশ্য ও দ্বন্দ্বকে চরমে নিয়ে যায়। ফলে দেশজুড়ে শুরু হয় দ্বান্দ্বিক বোধের টানাপড়েন যা জীবনানন্দ দাশকে কখনো কখনো প্ররোচিত করেছিল। তিনি সভ্যতার মৌলিক অন্তর্বিরোধকে দেখেছেন উচ্ছ্বাসী ও অস্থির মানুষের ভেতর। বাস্তবতাকে যাচাই ও শনাক্ত করার জন্য আয়ত্ত করেছেন নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতাকে।
রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পে প্রেমের দোলা দেয় বহুভাবে। যদিও তিনি ভাষার মাধুর্যতা, কাহিনী বিন্যাস, প্রকৃতির বর্ণনা সব মিলিয়ে একটি আলাদা ব্যঞ্জনা প্রকাশে আগ্রহী ছিলেন। রবীন্দ্র-পরবর্তী ত্রিশের আগ পর্যন্ত অনেক লেখকই এসেছেন ছোট গল্পে।
সমাজ সংস্কার অন্যদিকে কুসংস্কার, দরিদ্র মানুষের যন্ত্রণা এবং অসহায় মানুষের বিক্ষোভ, এমনকি নর-নারীকে নিয়ে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব। অন্যদিকে বুদ্ধি-আশ্রয়ী ঝাঁঝালো ব্যঙ্গাত্মক ধারার গল্প নিয়ে আসেন প্রমথ চৌধুরী, ধূর্জটি প্রসাদ, কিরণ শঙ্কর রায়সহ অনেকে। বস্তুত বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাণচাঞ্চল্য যুগ হচ্ছে কল্লোল যুগ। তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আর বাস্তবতাকে আত্মস্থ করার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলেন একদল লেখন। উপেক্ষিত সাধারণ জীবনাশ্রয়ী নির্মম, নিষ্ঠুর ভিত্তিভূমির চাষাবাদে তারা এগিয়ে এলেন। কল্লোলের অগ্রসরমান ছোট গল্পকারদের বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধকুমার স্যানাল আরো অনেকেই এসেছেন নিজস্বতাকে নিয়ে। এদের অনেকের ছোট গল্পে দেহভোগ, লালসা, যৌনতা এসেছে বিভিন্নভাবে। অন্যদিকে বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী হতাশা, ব্যর্থতা এমনকি রোমান্টিকতাও ছিল তাদের গল্পে। কিন্তু কবি জীবনানন্দ দাশ কল্লোলীয় সময়ের ভেতর ছোট গল্প শুরু করলেও কল্লোলীয় প্রভাব থেকে আলাদা ছিলেন।
নিম্ন শ্রেণির মানুষের জীবনের চিত্রায়ন ছিল তার গল্পের বৈশিষ্ট্য। তার ছোট গল্পে এসেছে দুর্ভেদ্য রহস্য যা অনাদি-অনন্তের মতো কখনো জটিল বলে মনে হয়। যা জীবনের সমুদয় সত্তাকে এক লহমায় গ্রাস করে আবার ছন্দোময় কিংবা বিদ্যুতের সুতীক্ষ্ন ভঙ্গিতে প্রাণময় করে তোলে। মূলত কবি জীবনানন্দ দাশ মধ্যবিত্তের জীবনের প্রাণকেন্দ্র থেকে অবক্ষয়ের মূল কারণগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন।
জীবনানন্দ দাশের গল্পে প্লটবিহীন ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। গল্পের পরিণতিতে এক দ্বিধাহীন স্বতঃস্ফূর্ততার প্রকাশ ঘটে। তার কবিতার উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। ছোট গল্পে তা অনেকটা অস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্গত কাব্যবিভায় উদ্ভাসিত আরেক অনুভূতির অনুভব অভিজ্ঞতাই তার গল্পের মূল সুর, যা বিষণ্নতায় ঘেরা, অস্পষ্ট ও ধূসর। তার ছোট গল্পে স্থান-কাল-পাত্র বর্ণনায় রহস্যময়তা দেখা যায়। যেখানে মানব-মানবীর প্রেমকে নিয়ে যায় সময়হীনতার কাছে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান ক্ষয়িষ্ণুতাকে গ্রহণ করেছেন গল্পে জোরালোভাবে, যা ছিল কবি হিসেবে তার একান্ত কাম্য।
জীবনানন্দ দাশ দেশজ ও প্রচলিত আঞ্চলিক শব্দকে নির্দ্বিধায় স্থান দেন গল্প প্রকাশের ক্ষেত্রে। যেমন দিয়েছেন তার কবিতায়। মূলত তিনি আবহমান বাংলার পল্লীপ্রকৃতিকে সূক্ষ্ম কাব্য শরীর অনুভূতি, অনুভব, অভিজ্ঞতার বিন্যাসে অর্থবহভাবে মিশিয়ে দেন গল্পে।
ইঙ্গিতধর্মিতা ছোট গল্পে অলঙ্কার বা আবরণ নয়। আর বহিরাঙ্গের কারুকাজ নয়। জীবনানন্দ দাশ তার গল্পকে নতুন অভিধায়, নতুন ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ করে সার্থক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। দক্ষ আলোর শিল্পীর মতো ঘুণেধরা মধ্যবিত্তের চরিত্র রূপায়ণে আগ্রহী হন বুনন জালের শরীরে। জীবনের শূন্যতা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি ব্যঙ্গ ও করুণার অভিব্যক্তি নিয়ে ফুটে উঠেছে গল্পে জীবনচরিত অভিধান।
মনস্তাত্তি্বক জটিলতার প্রতীক জীবনানন্দ দাশের গল্পকে আচ্ছন্ন করে তোলে, যা অনুভূতিপ্রধান ও প্রকৃতিমনস্ক।
প্রেমের বিচিত্র সম্পর্ক তিনি গল্পে নানাভাবে নিয়ে আসেন। মানুষের অন্তর্জীবনের অনুভূতিই এ যুগের মূল কৌতূহলের বিষয়। ব্যক্তি প্রেম তথা দাম্পত্য প্রেমের উন্মেষ ও বিরহরূপের চিত্রায়ন তার গল্পে দেখা যায়, যা সম্পূর্ণ প্রকৃতিনির্ভর। অন্যদিকে দুরন্ত অবাধ্যতা তার গল্পে রূপান্তরিত প্রাকৃত পরিবেশের হাতছানি হয়ে দেখা দেয়।
মানুষের স্বরূপ, সংকট, আনন্দ-বেদনা আবেগ-বিদ্রোহ প্রকাশ তার গল্পের আধুনিকতাকে স্পর্শ করে। প্রেমের ক্ষেত্রে বিষয়নির্ভর সরলতা ও অপ্রাপ্তির ব্যঞ্জনা তার গল্পে নির্মম সত্যের সন্ধানী হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ দাশ মূলত কবি। বাংলা আধুনিক কবিতার জনক হিসেবে তার কবিতা যেভাবে মহীয়ান ও চিরভাস্বর, তেমনি গল্পও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন