সমাজের মতো সামাজিক ইতিহাসের সমীক্ষাও গতিশীল। পরিবর্তনশীল অর্থে গতিশীল। সমীক্ষার বিভিন্ন পর্বে ইতিহাসের গতিশক্তির উৎসসন্ধানী দৃষ্টি যত গভীরে প্রসারিত হতে থাকে, ক্রমে তত সমাজের আলো-অন্ধকারের কানাচ ও কক্ষগুলি গোচরে আসে, তত তার কাজ চালানো রাং-ঝালাইয়ের জোড়াতালিগুলি ধরা পড়ে, পলেস্তারার ফাঁক দিয়ে রং-চটা ফাটলগুলি উঁকি মারে এবং আমাদের অনেক মনগড়া ও বইপড়া ভাবপ্রতিমার সমেমাহনী রূপ তার ভিতরের ও পেছনের বাঁশ-খড়ের কঙ্কালটির রূঢ় প্রকাশে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলার নবজাগরণের যে ভাবপ্রতিমা, ঊনিশ শতকের পশ্চাদ্পটে, নানারঙের প্রলেপ দিয়ে আমরা নির্মাণ করেছি, তার অনেক রঙ আজ সামাজিক গতির তরঙ্গে ধূয়েমুছে মাটি হয়ে গিয়েছে, অনেক রঙের বাহ্য ঔজ্জ্বল্য ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। তার কারণ, প্রলেপগুলি বেশির ভাগই কাঁচা রঙের। তা থেকে বোঝা যায়, আমাদের ইতিহাসের ধারা বিশ্লেষণে, বিশেষ করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারা, মূলে কোথাও গলদ আছে, ভয়ঙ্কর একটা ফাঁক ও ফাঁকি আছে, যে ফাঁক ও ফাঁকি কেবল তারিখ ও তথ্যের সমারোহে পূরণ করা যায় না। কারণ প্রাণহীন নীরেট তথ্য, মহাফেজখানা বা গ্রন্থাগার যেখান থেকেই আবিষকৃত হোক, ঐতিহাসিক ও অনুসন্ধানীর হাতে তা খেলার পুতুল মাত্র। তিনি তাঁর দৃষ্টি, বুদ্ধি ও বিচারভঙ্গি অনুযায়ী সেগুলি নির্বাচন করেন, সাজিয়ে-গুছিয়ে সামনে উপস্থিত করেন এবং তার ভিতর দিয়ে ইতিহাসের পালাগান শোনান। সেটা কেবল তথ্যের পুতুলনাচের ইতিকথা, সমাজের ও মানুষের ইতিকথা নয়। একই তথ্যের কত বিচিত্র প্রকাশ ও ব্যাখ্যা আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্রে সাময়িকপত্রে দেখতে পাই। কাজেই কেবল তথ্য নয়, তথ্যানতর্গত সত্যটিকে বুঝতে হলে ইতিহাসের গতিবোধ তো বটেই, সেই গতির ছন্দ ও তাল-মাত্রা সম্বন্ধেও বোধ সজাগ থাকা প্রয়োজন। এই বোধ থাকলে ঐতিহাসিক তথ্যবিচার বিজ্ঞানসমমত হতে পারে, ইতিহাস বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে, এবং তা যদি হয় তা হলে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বিভেদরেখা লুপ্ত হয়ে যায়। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের এই মিলনসীমানেত দাঁড়িয়ে আজ আমরা ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের গতিধারার বিচার বিশ্লেষণ করব এবং চেষ্টা করব তার অসঙ্গতি অসমগতি ও অপূর্ণতার কারণগুলি নির্দেশ করতে।
পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের অর্থ ও গুরুত্বের দিক থেকে আমাদের ঐতিহাসিকরা সাধারণত ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের বিচার করে থাকেন। ইতিহাসে কখনও দেখা যায় না যে দুই দেশের বা দুই পরিবেশের এক-ধরনের ঘটনার মধ্যে ঠিক একই কারণের সমাবেশ অথবা একই প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। কিন্তু কারণ ও তার ফলাফলের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, কতকগুলি মৌল বিষয়ের বা ঘটনার অনতর্নিহিত তাৎপর্যের সাদৃশ্যের জন্য আমরা ‘রেনেসাঁসে’র মতো ঐতিহাসিক শব্দ ব্যবহার করতে পারি। ইতিহাসের দিক থেকে ‘রেনেসাঁস’ কথায় ‘ typological’ গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য কি? জার্মান সমাজবিজ্ঞানী আলফ্রেদ ফন্ মার্টিন তাঁর Sociology of the Renaissance গ্রন্থে রেনেসাঁসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্দেশ করে বলেছেন - ‘ the typological importance of the Renaissance is that it marks the first cultural and social breach between the Middle Ages and modern times : it is a typical early stage of modern age.’ মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিচ্ছেদ ঘটে রেনেসাঁসের যুগে এবং সেইদিক থেকে রেনেসাঁসকে আধুনিক যুগের প্রথম উদয়পর্ব বলা যায়। যুগ থেকে যুগানতরে যাত্রার পথে কখনও অতীত যুগের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামাজিক সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদ ঘটে না, বিচ্ছেদের শক্তিগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে - সমাজের মূল গঠন-বিন্যাসের পরিবর্তনের ফলে। এই মূল গঠন-বিন্যাস অর্থনৈতিক, যার ভিতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সমাজের গোষ্ঠীবিন্যাস ও শ্রেণীবিন্যাস গড়ে ওঠে এবং তার উপর ভিত্তি করে সমাজের ধ্যানধারণা ভালমন্দ-বিচারবোধ সবকিছুর বিকাশ হয়। মূল অর্থনৈতিক ভিত্তির যদি বিশেষ পরিবর্তন না হয়, তাহলে সেই পুরাতন ভিত্তির উপরে গঠিত সামাজিক সংস্থা বা ইন্স্টিটিউশনগুলির অথবা সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণাগুলির স্থায়ী পরিবর্তন হয় না, বহিরাগত ভাবসংঘাতের ফলে একটা সঞ্চরণশীল পরিবর্তন হতে পারে মাত্র। এইদিক থেকে বিচার করলে, typologically ঊনিশ শতকের বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক আলোড়নকে ‘রেনেসাঁস’ বললে ভুল হয় না, কিন্তু বৈদেশিক শাসনাধীনে সংঘটিত এই জারজ রেনেসাঁস-এর সঙ্গে পাশ্চাত্ত্য রেনেসাঁর-এর প্রকৃতিগত বৈসাদৃশ্য তো আছেই, উপরন্তু তার বাস্তব পশ্চাদ্ভূমি না থাকার জন্য শেষপর্যনত তার সামাজিক ফলাফলও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষময় হয়েছে। ’রেনেসাঁস’ বা নবজাগরণের ঐতিহাসিক লক্ষণগুলি বিচার করে বাংলার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে আমরা তার অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতা আরও ভাল করে বুঝতে পারব।
মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের যে সামাজিক ‘breach’ বা বিচ্ছেদ রেনেসাঁসের অন্যতম ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য বলে আগে উল্লেখ করেছি, তার প্রথম প্রকাশ হবে সামাজিক অঙ্গবিন্যাসের (social structure -এর) পরিবর্তনে। মধ্যযুগের সমাজ ছিল একটা ‘rigidly graduated system’ এবং সেই কঠোর প্রায়-অচল স্তরবিন্যস্ত সমাজের চেহারা ছিল পিরামিডের মতো, অপরিবর্তনীয় - ‘pyramid of Estates’ -এর পাশে অচল-অনড় ’pyramid of values’। অর্থাৎ স্থাবর ধনসম্পত্তির পিরামিডের পাশে স্থাবর ভালমন্দবোধ ও অটল ধ্যানধারণার পিরামিড - যেমন ‘base’ বা বনিয়াদ, তেমনি তার উপরের ‘superstructure’ বা সৌধ। ধনতন্ত্রের উন্মেষপর্বে, রেনেসাঁসের যুগে, এই পিরামিডে আঘাত হানল প্রথমত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের অবাধ প্রতিযোগিতার নীতি, দ্বিতীয়ত নবযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যমান সচল ’টাকা’ ( money )। আঘাতের ফলে মধ্যযুগের সামাজিক পিরামিডে ভাঙন ধরল, অচল স্তরিত সমাজের ভিতরে দেখা গেল নতুন এক সচল স্তরায়ন (flexible social stratification) আরম্ভ হয়েছে সমাজে। সমাজে মানুষকে স্তরিত করার শক্তি হল অবাধ প্রতিযোগিতায় অর্জিত টাকা। টাকা সচল গতিশীল, কাজেই সামাজিক স্তরগুলিও, গতিশীল, rigid বা অচল নয়। আগে সমাজে কোনো ঊর্ধ্বাধঃ গতি (vertical mobility) ছিল না, এখন সেই গতি সঞ্চারিত হল অবাধগতি টাকার দৌলতে এবং টাকা সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যমানে পরিণত হওয়ার ফলে - সামাজিক মর্যাদার মান, প্রভাব-প্রতিপত্তির মান। ইটালীয় রেনেসাঁসের কালে সমাজের এই গতিশীলতা দেখে আক্ষেপ করে Aeneas Sylvius বলেছিলেন : ‘Italy... has lost all stability... a servant may easily become a King’ এবং Lujo Brentano দুঃখ করে বলেছিলেন যে টাকার জোরে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য অত্যধিক বাড়ছে। শুধু তাই নয়, তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন দেখে যে ‘Cash payments are now the tie between people.’ ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে কার্ল মার্কস ‘cash nexus’ বলেছিলেন, তার প্রায় চারশ বছর আগে ব্রেনতানো এবং আরও অনেকে সেই ’cash tie’ -এর চেহারা দেখে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
বাণিজ্যের স্বাধীনতা ও টাকার সচলতার দিক থেকে বিচার করলে ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে, প্রধানত নতুন মহানগর কলকাতা কেন্দ্রে, আঠার শতক থেকে এই ধরনের পরিবেশ রচিত হয়েছিল। কলকাতা শহরে যে নতুন নাগরিক অভিজাত ধনিকগোষ্ঠী (urban aristocracy) গড়ে উঠেছিল, তার পরিবার-প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অধিকাংশেরই টাকার ধান্দায় নগরে আগমন এবং যে-কোনো কৌশলে যে-কোনো গম্য-অগম্য পথে-বিপথে-কুপথে টাকার সন্ধানে বেপরোয়া অভিযান আঠার শতকের বিভিন্ন পর্বে আরম্ভ হয়েছিল। বাণিজ্যের স্বাধীনতা ছিল ইংরেজদের, এদেশীয় বা বাঙালীদের সম্পূর্ণ নয়। করিতকর্মা বাঙালীদের স্বাধীনতা ছিল ইংরেজদের অধীনে ও সাহচর্যে যে-কোনো কর্মে নিযুক্ত হবার, অবশ্য কোনো আধ্যাত্মিক কর্মে নয়, অর্থকরী কর্মে। আর একটি স্বাধীনতাও তাঁরা এই সময় প্রদর্শন করেছিলেন, সেটি হল মধ্যযুগীয় কুলবৃত্তিগত বন্ধন ছিন্ন করে যে-কোনো অর্থকরী কর্ম করার স্বাধীনতা। ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ বণিকদের মধ্যে অনেকেই কুলবৃত্তি ও কুল-মর্যাদা ত্যাগ করে, নতুন টাকার মর্যাদায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ইটালীয় সমাজপ্রসঙ্গে সিলভিয়াসের কথার -‘servants may easily become a King’ - প্রায় প্রতিধ্বনি করেছেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ’নববাবুবিলাস’ গ্রন্থেঃ
ইংরাজ কোম্পানি বাহাদুর অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন এই কলিকাতা নামক মহানগর আধুনিক কাল্পনিক বাবুদিগের পিতা কিম্বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসিয়া স্বর্ণকার কর্মকার চর্মকার চটকার মঠকার বেতনোপভুক হইয়া কিম্বা রাজের সাজের কাঠের খাটের ঘাটের মঠের ইটের সরদারি চৌকিদারী জুয়াচূরি পোদ্দারী করিয়া অথবা অগম্যাগমন মিথ্যাবচন পরকীয় রমণী সংঘটনকামি ভাড়ামি রাস্তাবন্দ দাস্য দৌত্য গীতবাদ্যতৎপর হইয়া কিম্বা পৌরোহিত্য ভিক্ষাপুত্র গুরুশিষ্যভাবে কিঞ্চিৎ অর্থসঙ্গতি করিয়া কোম্পানির কাগজ কিম্বা জমিদারি ক্রয়াধীন... অধিকতর ধনাঢ্য হইয়াছেন।
ভবানীচরণ অর্থনীতিবিদ না হলেও এখানে একটি বিরামচিহ্নহীন বাক্যের মধ্যে সম্পূর্ণ আঠার শতক ও ঊনিশ শতকের প্রায় প্রথমার্ধ পর্যনত বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের মর্ম প্রকাশ করেছেন। ভবানীচরণের কথা যে কতখানি সত্য তা কলকাতার প্রাচীন ধনিক পরিবারগুলির আদিপুরুষদের কর্মজীবনের কাহিনী বিচার করলে বোঝা যায়। আঠার শতকে কলকাতার বহিরাঙ্গিক বিন্যাস অনেকটা মধ্যযুগীয় নগর ও গণ্ডগ্রামের মতো ছিল - বিভিন্ন কুলবৃত্তিজীবীদের বাস ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে। আঞ্চলিক পুরনো নামগুলি থেকে তা বোঝা যায়, যেমন কুমোরটুলি কলুটোলা জেলিয়াটোলা ডোমটুলি গোয়ালটুলি পটুয়াটোলা শাঁখারীটোলা ইত্যাদি। এই মধ্যযুগীয় নাগরিক পরিবেশে শোভাবাজারের দেব-পরিবার, সিমলের দে-সরকার পরিবার, জোড়াসাঁকো পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার, মল্লিক পরিবার এবং আরও অনেক প্রাচীন ব্রাহ্মণ-কায়স্থ- বণিক পরিবার, যাঁরা সে সময় কলতাকার নতুন ধনিকসমাজ গড়ে তুলেছিলেন, তাঁরা মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কবিগান তর্জাগান আখড়াইগান পাঁচালি কথকতা ইত্যাদির সঙ্গে ঘৌড়দৌড়, বুলবুলির লড়াই, পোষা বাঁদরের বিয়ে, মাতৃপিতৃশ্রাদ্ধ, পুত্রকন্যার বিবাহ, সাহেবদের খানা পিনা, গঙ্গার ঘাটনির্মাণ, দেবালয় নির্মাণ, তীর্থস্থানে ধর্মশালা নির্মাণ প্রভৃতির কল্যাণে বাঙালী Comprador-শ্রেণীর নব্যধনিকরা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। আঠার শতকের মাত্র দশ-বারজন কলকাতার বিখ্যাত বাঙালী ধনিক পরিবারের বিচিত্র ভোগবিলাসের (যাকে conspicuous consumption বলা হয়) ব্যয়ের পরিমাণ যদি হিসেব করা যায়, তাহলে মোট অংক অনতত কয়েক কোটি টাকায় দাঁড়াবে। এই মূলধন জমা করা থাকলে ঊনিশ-শতকে এই সমস্ত পরিবারের বংশধররা স্বাধীন শিল্পবাণিজ্যক্ষেত্রে উদযোগী হয়ে অনতত কিছুটা অগ্রসর হতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তা করেন নি।
তার উপর আঠার শতকের শেষে, ১৭৯৩ সালে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে যখন নতুন জমিদারশ্রেণীতে রূপানতরিত হবার পথ নব্যধনিকের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন তাঁরা ভোগবিলাসের পর উদ্বৃত্ত টাকা প্রধানত জমিদারী কিনতে ব্যয় করেন। কার্ল মার্কস তাঁর Notes on Indian History গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল প্রসঙ্গে লিখেছেন ‘greater part of the province’s landholdings fell rapidly into the hands of a few city-capitalists who had spare capital and readily invested it in land’. স্বাধীন শিল্পবাণিজ্যক্ষেত্রে যাঁরা কিছুটা সেই সময় উদযোগী হন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রামদুলাল দে ও দ্বারকানাথ ঠাকুর, কিন্তু উভয়েই শেষ পর্যনত বিশাল স্থাবর সম্পত্তির মালিকে পরিণত হন। শহর থেকে উপার্জিত অর্থে আরও কতজন যে খুদে-মাঝারি জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীতে পরিণত হয়েছিলেন তার ঠিক নেই। ১৮৭২-৭৩ সালের প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে মধ্যস্বত্বের বিস্তারের ফলে জমিদারীর সংখ্যা বাংলাদেশে দেড় লক্ষের বেশি হয়েছে, বিশ হাজার একরের উপরে বড় জমিদারীর সংখ্যা পাঁচশ’র কিছু বেশি, বিশ হাজার থেকে পাঁচশ একরের মধ্যে মাঝারি জমিদারী প্রায় ষোল হাজার, এবং পাঁচশ একর ও তার কম ছোট জমিদারীর সংখ্যা দেড় লক্ষের কিছু কম। এর সঙ্গে যদি জমিদার-পত্তনিদার-জোতদারদের গোমস্তা নায়ের তহশীলদার পাইক দফাদার প্রভৃতি কর্মচারী ও ভৃত্যদের সংখ্যা যোগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে ঊনিশ শতকের শেষ পর্বে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্বনীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রাম্যসমাজে কমপক্ষে সাত-আট লক্ষ লোকের এমন একটি ‘শ্রেণী’ (সামাজিক ‘স্তরায়ন’) তৈরি হয়েছে, যে শ্রেণী ব্রিটিশ শাসকদের সুদৃঢ় স্তম্ভস্বরূপ। অবশ্য সামাজিক শ্রেণী হিসেবে বলতে গেলে ‘একটি’ শ্রেণী বলা যায় না, দু’টি শ্রেণী বলতে হয় - একটি নতুন জমিদারশ্রেণী, আর একটি নতুন মধ্যস্বত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্যশ্রেণী। নামে দুই শ্রেণী হলেও, কাজ ও স্বার্থের দিক থেকে এদের চিনতাভাবনা ও আচরণ একশ্রেণীর মতো।
এর পাশে নাগরিক সমাজে, যেমন কলকাতা শহরে, ব্রিটিশ শাসকরা তাঁদের বিশ্বাসভাজন আরও দু’টি শ্রেণী তৈরি করেছিলেন - একটি নতুন নাগরিক ধনিকশ্রেণী, আর-একটি নতুন নাগরিক মধ্যশ্রেণী। এই মধ্যশ্রেণীর মধ্যে ছোট ছোট ব্যবসায়ী, দোকানদার, দালাল প্রভৃতির সংখ্যা অনেক, বাকি নানারকমের চাকরিজীবী। নাগরিক মধ্যশ্রেণীর একটি বিশেষ স্তর হিসেবে গড়ে উঠেছিল বাঙালি ইংরেজিশিক্ষিত এলিট্শ্রেণী। ব্রিটিশ আমলে বাঙালী সমাজের এই নতুন শ্রেণীরূপায়ণ নিশ্চয় একটা বড় রকমের পরিবর্তন এবং আগেকার পিরামিডের মতো স্তরিত সমাজের সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। আগে বলেছি, নবযুগের নতুন শ্রেণীবিন্যাস অচল নয়, সচল, উর্ধ্বাধঃ গতিশীল, এবং সেই গতির প্রধান চালকশক্তি ‘টাকা’। টাকা সচল, শ্রেণীও তার ছন্দে সচল। বাঙালী সমাজে আঠার-ঊনিশ শতকে এ-সত্যও নির্মম বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার জন্যই কি তাকে ’রেনেসাঁস’ বলা যায়? বিশেষ করে যে-সমাজে পরিষকার দেখা যাচ্ছে, আধুনিক ধনতন্ত্রের ‘typical early stage’-এর কোনো আভাস পাওয়া যায় না? বিশেষ করে শ্রমশিল্পের বিস্তারে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষকারের অগ্রগতিতে? যে-সমাজে কোনো ‘entrepreneur’-এর সুদূর পদধ্বনিও শোনা যায় না অর্থনীতিক্ষেত্রে? কেবল টাকার ধান্দা, টাকা সম্পর্কে মুনাফালোভী মনোভাব যদি typical early stage of capitalism হয় (অবশ্য এটা capitalist mentality নিশ্চয় ) তাহলে বাংলাদেশে ঊনিশ শতকে নিশ্চয় তার বিকাশ হয়েছিল বলতে হয়, এবং সেটা যে রেনেসাঁসের যুগের একটা ঐতিহাসিক লক্ষণ তাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমরা জানি প্রকৃত ‘রেনেসাঁস’ তা নয়।
আরও আশ্চর্য হতে হয় এই কথা ভেবে যে ইয়োরোপীয় ‘রেনেসাঁসের’ ঐতিহাসিক পথে আমাদের দেশে প্রকৃত নবজাগরণের যাঁরা অগ্রদূত হতে পারতেন, ব্রিটিশ আমলের নতুন সামাজিক প্রতিবেশে সেই বাঙালী বণিক-শ্রেণী (merchants) আদৌ সচল ও সজাগ হলেন না। কেন হলেন না, সে-প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে বাংলার, তথা ভারতের সমাজেতিহাসের অনুসন্ধানীদের। দুঃখের বিষয়, গতানুগতিক ইতিহাসের পাতায় বহুজনচর্বিত পর্বতপ্রমাণ তথ্যস্তূপের মধ্যেও এরকম কোনো প্রশ্নেরই আভাস পাওয়া যায় না, উত্তর তো দূরের কথা। প্রাচীন হিন্দুযুগ থেকে মধ্যযুগ ও আধুনিক ব্রিটিশ শাসনের যুগ পর্যনত বাংলাদেশের (এবং ভারতবর্ষের) বণিকজাতি বংশধরপম্পরায় দেশ-বিদেশে বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। মনসামঙ্গল চণ্ডীমঙ্গল প্রভৃতি মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যে বাঙালী বণিকদের সমৃদ্ধির বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ধনপতি সদাগর আমি বসি হে উজানী, গন্ধবণিক জাতি বিদিত অবনী’। ধনপতি সাগরের পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে ‘সাত শত বেনে আইসে ধনপতি ধাম’ - তাঁদের মধ্যে চম্পকনগরের চাঁদ সদাগরও ছিলেন। এ রকম আরও অনেক বিবরণ থেকে বাংলাদেশের গন্ধবণিক তাম্বুলিবণিক সুবর্ণবণিক প্রভৃতি বণিক-জাতির বাণিজ্যলব্ধ ধনৈশ্বর্যের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা থেকে একথা অনতত ভাবা যেতে পারে যে এদেশে Mercantile Capitalism -এর বিকাশ স্বচ্ছন্দে হতে পারত এবং তার ক্রমিক পরিণতি, ঐতিহাসিক অবস্থার আনুকূল্যে, ইয়োরোপের মতো Industrial Capitalism-এ হওয়াও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তা হল না কেন? তা ছাড়া, যে ভারতবর্ষে প্রাচীন হিন্দুযুগ থেকে বিজ্ঞান (Science) অনুীশীলনের (গণিত, জ্যোতিষ, রসায়ন প্রভৃতি) ধারা বেশ পরিস্ফুট ছিল (মধ্যযুগে অবশ্য শীর্ণ হয়েছিল), সেই দেশে সর্বত্র বিজ্ঞানের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গেল কেন, তাও ভাবা দরকার। যদি ‘মার্কাণ্টাইল ক্যাপিটালিজম্’- এর স্বাভাবিক বিকাশ হত এদেশে এবং তার পরিণতি হত ’ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজম্’-এ, তাহলে বিজ্ঞান অনুশীলনের ধারা অনেক বেশি পরিপুষ্ট হত এবং তার প্রবাহ বিচ্ছিন্ন হত না। তা যদি হত, তাহলে ইয়োরোপের মতো কি আমাদের দেশেও ’রেনেসাঁস’ বা নবজাগরণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক লক্ষণ স্বভাবতঃই দেখা দিত না? ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ প্রসঙ্গে এরকম কতকগুলি অত্যনত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো চেষ্টাই আজ পর্যনত হয় নি এবং তা না হবার ফলে নবজাগরণ-বিষয়ে সমস্ত আলোচনা ও গবেষণা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে বলতে হয়। আমরা শুধু গতানুগতিক ইতিহাস চর্চার অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে বাইরের খোলটির গায়ে আঁচড় কেটেছি, অনেক হিজিবিজি আঁচড়, কিন্তু ভিতরের বস্তুটিকে সন্ধান করি নি। বাস্তব সমাজ, বাস্তব জীবনের কথা ভুলে গিয়ে আমরা শুধু এদেশের মুষ্টিমেয় মানুষের মানসলোকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান দর্শনের বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়ার বিচার-বিশ্লেষণ করেছি, অথচ দেশের বাকি পঁচানব্বই জন মানুষের মনের সুদূর প্রানেত পর্যনত তার কোনো সপর্শ লাগল কিনা, অথবা আদৌ লাগতে পারে এরকম কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কিনা, সে-বিষয় চিনতা করার অবকাশ পাই নি।
আমাদের প্রশ্ন, কেন এদেশের বণিকশ্রেণী আধুনিক ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থা বিকাশে সহায় হলেন না, কেন ধনপতি সদাগররা এ যুগের কোটিপতি ক্যাপিটালিস্ট হতে পারলেন না? এ প্রশ্নে সদুত্তরের জন্য নতুন দৃষ্টিতে পর্যাপ্ত গবেষণা ও তথ্যানুশীলন প্রয়োজন। আপাতত আমাদের মনে হয়, বাঙালী তথা ভারতীয় সমাজে, বিশেষ করে বাঙালী সমাজে বণিকশ্রেণীর প্রতি সামাজিক উপেক্ষা ও অবজ্ঞাই হল এই স্বাভাবিক ঐতিহাসিক গতি ব্যাহত হবার অন্যতম কারণ। এদিক থেকে চীনের সমাজের সঙ্গে আমাদের ভারতীয় সমাজের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। জোসেফ নীডহাম চৈনিক সমাজের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন -‘The despising of the merchant was a very old characteristic in Chinese thought…’ আমাদের দেশেও একথা সত্য। কিন্তু চৈনিক সমাজে জাতিবর্ণভেদ (caste) বলে কিছু ছিল না, বর্ণবৈষম্য ভারতীয় বৈশিষ্ট্য। এই বর্ণবৈষম্যজনিত সামাজিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষা আমাদের দেশে বণিকশ্রেণীকে শক্তিশালী আধুনিক পুঁজিপতিশ্রেণীতে পরিণত হতে দেয় নি, উদ্যম উদযোগ ও অর্থনৈতিক অভিযানের দুঃসাহসিক পথ থেকে তাদের উৎখাত করেছে। যে কর্ম ও কৃতিতের জন্য কোনো সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা লভ্য নয়, তা করার জন্য কোনো প্রেরণা এদেশের বণিকরা পান নি। কাজেই এদেশের বাণিজ্যলব্ধ মূলধনের ঐতিহাসিক বিকাশ হয় নি আধুনিক শিল্পগত মূলধনে, এবং তা না হওয়ার ফলে যেমন বিজ্ঞানচর্চার ধারাবাহিক অবনতি হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক উৎপাদনব্যবস্থার দীর্ঘস্থিতি ও গতানুগতিকতা এদেশের মানুষকে কর্মবমিুখ ও আলস্যের উপাসক করেছে, এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয়েছে ধর্মচর্চার চূড়ানত বিকৃতিতে, নৈষকর্ম্যের সাধনায়।
ব্রিটিশ শাসকরা আমাদের দেশের পুরাতন সমাজব্যবস্থার অনেক কিছু ওলটপালট করেছেন বটে, কিন্তু তার মূল গড়নটিকে অর্থাৎ বর্ণবৈষম্যের ভিত্তিকে একেবারেই আঘাত করতে পারেন নি। ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্যরা টাকার ধান্দায় খানিকটা ব্যবসাবাণিজ্যের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁদের কাছেও বাণিজ্যলব্ধ টাকার আকর্ষণের চাইতে শিক্ষা ও চাকুরীলব্ধ টাকার আকর্ষণ ছিল অনেক বেশি, সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে। আর তার চাইতেও বড় সত্য হল, বাঙালী বণিকরা (গন্ধবণিক, তাম্বুলিবণিক প্রভৃতি) ব্রিটিশ আমলেও কেউ আধুনিক শিল্পপতি হবার জন্য উদ্যোগী হলেন না, তাঁদের বংশগত বাণিজ্যের গণ্ডির মধ্যে বন্দী হয়ে রইলেন। এমন কি ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হবার পরেও আজও তাঁদের মধ্যে সেরকম কোনো উদ্যোগের লক্ষণ দেখা যায় না, তার কারণ সমাজের মূল বর্ণভিত্তিক গড়ন আজও অটুট আছে, বদলায় নি এবং সেই সমাজবিন্যাসে বণিকরা নিম্নস্তরের উপেক্ষার পাত্র হয়ে আছেন।
একথা সহজ সত্য যে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে আমাদের দেশে ধনতান্ত্রিক বিকাশের পথ আদৌ সহজগম্য ছিল না এবং পদে পদে তার বাধা ছিল অনেক। কিন্তু বাংলার অর্থনীতিক্ষেত্রে অনতত শিল্পবাণিজ্যের মধ্যবর্তী স্তরে যেটুকু সক্রিয় হওয়ার সুযোগ ছিল, যথেষ্ট মূলধন সঞ্চয় করা সত্ত্বেও বাঙালীরা তা হন নি নিষিক্রয়তার প্রতিমূর্তিরূপে গ্রামের জমিদারী, শহরের গৃহসম্পত্তি. কোম্পানির কাগজ, স্বর্ণপিণ্ড ইত্যাদিতে নিশ্চিনত ও নিরাপদ আয়ের সুযোগ খুঁজেছেন, আর যাঁরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত মধ্যশ্রেণী, তাঁরা চাকরি, বিশেষ করে সরকারী চাকরিকেই মানবজীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেছেন। ছেলে দারোগা হোক, ডেপুটি হোক, সরকারী কেরানী হোক, নিদেনপক্ষে জমিদারের গোমস্তা বা নায়েব হোক, এই ছিল বাঙালী মায়েদের প্রার্থনা দেবতার কাছে, এবং বিবাহের বাজারে এই সব পাত্রের মূল্য ছিল অত্যধিক, যেমন বর্তমানে ’ইঞ্জিনিয়ার’ নামক জীবদের। পরিবার থেকে সমাজ পর্যনত এমনই একটা পরিবেশ রচিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে যে বাঙালীর মন ‘achievement-oriented’ বা ব্যক্তিকৃতিমুখী হয়ে গড়ে উঠবার সুযোগ পায় নি তার মধ্যে, ‘slavery-oriented’ বা দাসত্বভাবাপন্ন হয়ে গড়ে উঠেছে। এই দাসত্বপ্রবণ দারোগা-কেরানী-গোমস্তা-নির্ভর, গ্রাম্য নব্য জমিদার-পত্তনিদার ও নাগরিক নব্যধনিক খুদে-ব্যবসায়ী-মুখাপেক্ষী যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ, দেশের বড়জোর শতকরা দশজনের গণ্ডি পর্যনত যার আলোক বিচ্ছুরিত, বাকি নব্বুইজনের সুবিস্তীর্ণ রাজ্যে শুধু অজ্ঞান ও সুপ্তির ঘোর অন্ধাকার, সেই নবজাগরণের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে মনে হয়।
ব্রিটিশ আমলে ঊনিশ শতকের মধ্যেই আমাদের দেশে রেলপথ, পোস্ট অফিস, টেলিগ্রাফ, পাটকল, কাপড়ের কল এবং অন্যান্য কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে, তার জন্য যথেষ্ট মূলধন, উদ্যম ও সুদক্ষ কারিগরির প্রয়োজন হয়েছে, কিন্তু বিদেশীর শাসনশোষণাধীনে থাকার ফলে স্বভাবতই সেগুলি enclave-এর (আংক্লাভ্) রূপ নিয়েছে যে ‘আংক্লাভ’-গুলি ‘cut out and isolated from the surrounding economy, but tied to the economy of the home country.’ গুনার মীরডাল তাঁর Economic Theory and Under Developed Regionsগ্রন্থে, এবং পরবর্তী Asian Drama গ্রন্থে, এ বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। মীরডাল নতুন কথা কিছু বলেন নি, বৈজ্ঞানিক অর্থনীতিবিদ, বিশেষ করে মার্কসবাদীরা, একথা অনেক আগেই বলেছেন। রেলওয়ে, তৎসংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ারিং-শিল্প পাটকল, প্ল্যানটেশন সবই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো গড়ে উঠেছে এদেশে, পরিপার্শ্বের দেশীয় অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন, বিদেশী শাসকদের নিজেদের দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমাদের দেশের, অনতত বাংলাদেশের surrounding economy’-র সামনততান্ত্রিক রূপের বিশেষ পরিবর্তন হয় নি, বরং ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থে নবরূপে তাকে রূপায়িত করা হয়েছিল। পরিপার্শ্বের এই সামনততান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন যে নতুন অর্থনীতির বিকাশ বাংলাদেশে হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ ইংলণ্ডের দেশীয় অর্থনীতির স্বার্থে, মূলধন উদ্যম কারিগরি সবই প্রায় ইংলণ্ডের। আমাদের দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল ‘plentiful labour supply and low wages’-এর দিক থেকে, অর্থাৎ যথাসম্ভব অল্প মজুরিতে প্রচুর পরিমাণে মজুর সরবরাহের দিক থেকে। তাই আমরা করেছি, মূলধন উদ্যম কারিগরি-কুশলতা কিছুই নিজেরা তেমন নিয়োগ বা প্রয়োগ করতে পারি নি।
ব্রিটিশের প্রধান লক্ষ্য ছিল, নিরাপদ-নিশ্চিনত শাসন-শোষণের উদ্দেশ্যে এ দেশের আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক স্থিতি (social stability) যে-কোনো উপায়ে বজায় রাখা। ‘সামাজিক স্থিতি’ কথাটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশের সমাজের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তিতে অথবা সামাজিক অঙ্গবিন্যাসে এমন কোনো দূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটাতে চান নি, যাতে সামাজিক স্থিতি নষ্ট হতে পারে। আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুগের অভ্যুদয় হলে যে সামাজিক সচলতা ও পরিবর্তনের সূচনা হত, তার মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নির্বিঘ্নে শোষণ-শাসনের সুবিধা হত না। দেশী-বিদেশী লুণ্ঠনস্বার্থে সংঘাত হত। কাজেই তাঁদের কোনো স্বার্থ ছিল না রেনেসাঁসের অর্থনৈতিক ভিত্তি এদেশে গড়ে তোলার। তাঁরা এমনভাবে সমাজের শ্রেণীবিন্যাসটিকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন যাতে তার অতীতে সামনততান্ত্রিক বনেদটি মূলত বজায় থাকে। যেমন আমরা আগে বলেছি - গ্রাম্য সমাজে নতুন জমিদারশ্রেণী, বৃহৎ একটি জমিদারী-নির্ভর মধ্যস্বত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্যশ্রেণী, এবং নাগরিক সমাজে নতুন অর্বাচীন অভিজাত-ধনিকশ্রেণী, খুদে-ব্যবসায়ী দোকানদার চাকরিজীবী প্রভৃতিদের নিয়ে বড় একটি নাগরিক মধ্যশ্রেণী এবং তার মধ্যে সোনার চাঁদের মতো একদল ইংরেজিশিক্ষিত ‘elite’। সাম্রাজ্যবাদীর অধীন দেশে, যেমন আমাদের বাংলাদেশে, এই শিক্ষিত ’এলিট’-গোষ্ঠী সম্বন্ধে জ্যঁ পল্ সার্ত্র যে উক্তি করেছেন তা নির্মম হলেও সত্য :
‘The European elite undertook to manufacture a native elite. They picked out promising adolescents: they branded them, as with a redhot iron, with the principles of western culture; they stuffed their mouths full with high sounding phrases, grand glutinous words that stuck to the teeth… These walking lies had nothing left to say to their brothers; they only echoed’. (Preface, Fanon: The Wretched of the Earth).
বাংলাদেশের পাশ্চাত্যবিদ্যা শিক্ষিত ’এলিট’ প্রসঙ্গেও সার্ত্রের এই উক্তি প্রযোজ্য। পাশ্চাত্য ভাবদর্শের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে এই এলিটের কথা আসবে।
যে-ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গড়নের পরিবর্তন ব্রিটিশ আমলে দেখা গেল, তাতে সমাজের যে‘institutional power-structures’, যেমন আমাদের জাতিবর্ণভেদ, ধর্মসম্প্রদায়ের বৈষম্য ইত্যাদি - তার কোনো উন্নতিশীল পরিবর্তন কিছু হল না। যে-কোনো সমাজের স্থায়িত্ব ও শক্তির প্রধান উৎস হল institutionsএবং আমাদের দেশের সামনততান্ত্রিক সমাজের power-structure যে-সমস্ত ইন্স্টিটিউশনের উপর প্রতিষ্ঠিত, তার মধ্যে অন্যতম হল যৌথ পরিবার (joint family), জাতিভেদপ্রথা (caste system), বিবাহপ্রথা, ধর্ম ইত্যাদি । ঊনিশ শতকের সমাজসংস্কারকদের যথেষ্ট প্রচেষ্টা সত্ত্বেও (গাছের গোড়ায় জল দিয়ে ডাল কাটার মতো) এবং সংস্কার-আন্দোলন মধ্যে মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, শেষ পর্যনত পূর্বোক্ত কোনো সামাজিক ইনস্টিটিউশনের পরিবর্তন হয়নি, এমন কি ঊনিশ শতকের শেষ পর্বে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের সদলবলে ও সশব্দে বাংলার নবজাগরণের রঙ্গমঞ্চ দখল করা থেকে বোঝা যায় যে এগুলির দৃঢ়ভিত্তিতে কোনো আঁচড় পর্যনত লাগেনি। লাগবার কথা নয়, কারণ মূল অর্থনৈতিক গড়নের পরিবর্তন ছাড়া সমাজেরinstitutional power-structure -এর কোনো পরিবর্তন হতে পারে না, বাংলাদেশেও সেই কারণে হয় নি। এবং তা হয় নি বলেই বাংলাদেশের রেনেসাঁস-আন্দোলন শেষ পর্যনত অনেক বাষ্প বিদ্যুৎ ও বুদবুদ উদগার করে কোনরকমে নিভ-নিভ সল্তেটি জ্বালিয়ে রেখেছিল মাত্র। ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অনেকাংশে ব্যর্থতা ও ট্র্যাজিক পরিণতি, অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতার এইটাই প্রধান কারণ বলে মনে হয়। জাতিভেদপ্রথা, ধর্মসম্প্রদায়-বৈষম্য ইত্যাদি ‘hardened institutions of inequality’ যেমন দেশের ভিতরের উন্নত ভাবাদর্শের সম্প্রসারণে অনতরায় সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি উন্নত ও অগ্রগামী দেশ থেকে আগত কোনো উন্নতিশীল শক্তির বিস্তারকেও সঙ্কুচিত করতে পারে। ‘If they hamper the spread effects within those countries, they inhibit at the same time, the spread of expansionary momentum from the advanced countries abroad’ (Myrdal). এই কারণে মধ্যযুগে যেমন রামানন্দ কবীর দাদূ নানক নামদেব প্রমুখ সাধক-সংস্কারকদের জাতিবৈষম্য ও ধর্মভেদের বিরুদ্ধে সমস্ত আবেদন আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে, অর্থাৎ তাঁদের ভাবাদর্শের কোনো প্রসার হয়নি, তেমনি ঊনিশ শতকে বাংলাদেশে রামমোহন বিদ্যাসাগর ইয়ংবেঙ্গল দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ সংস্কারকদের পাশ্চাত্ত্য ভাবসংঘাতজাত উন্নতিশীল সংস্কার-আদর্শের বিস্তারও অনেকটা সংকুচিত হয়েছে। নতুন ভাবাদর্শের ‘spread effect’ যেমন ব্যাহত হয়েছে, তেমনি ঊনিশ শতকে পাশ্চাত্য ভাবসংঘাতের‘expansionary momentum’I ‘inhibited’ হয়েছে, পুরাতন institutional power-structure-এর প্রতিঘাতে। তাই দেখা যায়, বাংলার নবজাগরণ মূলত নগরকেন্দ্রিক পাশ্চাত্য বিদ্যাশিক্ষিত মুষ্টিমেয় এলিটের মস্তিষেকর আন্দোলন, দেশের মানুষের আন্দোলন নয়। আমাদের দেশের মতো ঐতিহ্যানুগামী সমাজে (tradition-bound society) পুরাতন সামাজিক ইনস্টিটিউশনের শক্তি যে কত সংহত ও সুদৃঢ়, তা ব্রিটিশ শাসনমুক্তির প্রায় পঁচিশ বছর পরেও, আধুনিক যন্ত্রোন্নত শিল্পায়নের সামাজিক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও, আজও আমরা ধর্মবৈষম্য জাতিভেদ প্রভৃতির সদম্ভ আত্মপ্রকাশে বুঝতে পারছি। কাজেই ঊনিশ শতকে এই সমস্ত ইনস্টিটিউশনের লৌহপ্রাচীরে প্রতিহত হয়ে বাংলার নবজাগরণের আদর্শ কিভাবে খণ্ডিত ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
অনুমান না করে কয়েকটি দৃষ্টানত উল্লেখ করছি। ‘ধর্ম’ যখন সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী ইনস্টিটিউশন, বিশেষ করে আমাদের মতো ঐতিহ্যমুখী (‘tradition-oriented’) সমাজে, তখন ধর্মসংস্কারের কথাই প্রথম বলি। অজস্র ধর্র্মীয় কুসংস্কার, আচার-বিচার বাহ্য অনুষ্ঠান, পৌত্তলিকতা ও বহু-দেবতাবাদ, হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সমাজমানসকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে দেখে রামমোহন গভীর বেদনাবোধ করেছিলেন এবং পাশাপাশি খ্রীস্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারও মিশনারীদের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন। হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজের সঙ্কট তিনি তাঁর দূরদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন বলেই প্রাচীন উপনিষদ ও তন্ত্রশাস্ত্র থেকে বাহ্যানুষ্ঠানবর্জিত একেশ্বর ব্রহ্মের উপাসনা প্রবর্তন ও প্রচার করে এই কথাই বলতে বা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন যে হিন্দুধর্মের উৎসমুখে সন্ধান করলে সেখানেও সহজ সরল অকৃত্রিম একদেবতা নিরাকার ব্রহ্মের স্বরূপ ছাড়া অন্য কিছু উপলব্ধি করা যায় না। তিনি ’ব্রাহ্মসমাজ’ স্থাপন করেছিলেন হিন্দুধর্মের এই প্রকৃত রূপ, শুধু খ্রীস্টান মিশনারীদের কাছে নয়, সমগ্র দেশবাসীর কাছে উদঘাটিত করার জন্য। যুগে যুগে ঐতিহাসিক সঙ্কট- কালে শ্রেষ্ঠ ধর্মসংস্কারকেদের পথই অনুগমন করেছিলেন রামমোহন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছিল - যদিও সেই ব্যর্থতা বিদেশে তাঁর অকালমৃত্যুর জন্য তিনি নিজে বিশেষ অনুভব করেন নি। দুটি কারণে ব্যর্থ হয়েছিল , প্রথম কারণ, ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা গৃহের ভিতরের স্থাপত্য থেকে আরম্ভ করে সাপ্তাহিক উপাসনা, উপাসনা-পদ্ধতি প্রভৃতি সবকিছুর উপর খ্রীস্টান গির্জা ও ধর্মের প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ। দেবদেবীর দেবালয় যে-দেশের গ্রামে গ্রামে, গৃহে গৃহে যেখানে গৃহদেবতা অতিদরিদ্রের অতিসরল অনাড়ম্বর পদ্ধতিতে উপাস্য, সেখানে দেবতা ও তাঁর উপাসনার প্রতি এই ‘intellectual’ বা বুদ্ধিযুক্তিসর্বস্ব মনোভঙ্গি কখনই সমাজে সাধারণজনগ্রাহ্য হতে পারে না। দ্বিতীয় কারণ, এরই অনুসিদ্ধানত - গজদনতমিনার বা প্রাসাদশীর্ষ থেকে কেবল নিরপেক্ষ বুদ্ধি ও যুক্তির সুতীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করে, অথবা বিমুর্ত মানবতা-বোধসম্ভূত হৃদয়াবেগের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে কোনো জনসমাজে কখনও ধর্মসংস্কার করা যায় না। তা যদি করা যেত তাহলে রাজপুত্র গৌতম বুদ্ধ থেকে কবীর দাদূ নানক শ্রীচৈতন্য সকলেই হিন্দুসমাজের ও হিন্দুধর্মের কাঠাম পাল্টে ফেলতে পারতেন। তা যদি করা যেত, তাহলে বিংশ শতাব্দীর প্রায় চতুর্থ পাদে পৌঁছেও আমরা হিন্দুধর্মের এরকম মধ্যযুগীয় উৎকট স্বরূপপ্রকাশে স্তম্ভিত হতাম না।
রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজ তাঁর ব্যক্তিত্বমুগ্ধ কয়েকজনমাত্র সহগামীর সংকীর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নব্যধনিক জমিদার ও শহরের নতুন রাজা-মহারাজা। যেমন টাকীর জমিদার, তেলিনীপাড়ার জমিদার, ভূকৈলাস-খিদিরপুরের রাজা প্রভৃতি। এঁদের পক্ষে ব্রহ্মোপাসনার মর্ম বোঝা দূরে থাক, হিন্দুধর্ম ও সমাজের সাংস্থানিক গঠনে আঘাত করা প্রত্যক্ষভাবে তাঁদের শ্রেণীস্বার্থ ও স্থিতস্বার্থের বিরোধী ছিল। তাই রামমোহনের অনুপস্থিতিতে ও অবর্তমানে তাঁরা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে প্রায় গোঁড়া হিন্দু হয়ে ওঠেন। দ্বারকানাথের বদান্যতায় ব্রাহ্মসমাজের অস্তিত্ব বজায় থাকে বটে, কিন্তু তার আদর্শ নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক দীক্ষার ব্যবস্থা করে এবং নিজে দীক্ষা নিয়ে ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ’ব্রাহ্মসমাজ’ থেকে ’ব্রাহ্মধর্মে’র রূপ দেন। তিনি বলেন ’পূর্বে ব্রাহ্মসমাজ ছিল, এখন ব্রাহ্মধর্ম হইল।’ কিন্তু হিন্দুধর্মেরই বিশাল পরিধির মধ্যে যখন নতুন ’ব্রাহ্মধর্ম’ হল তখন চিরাগত নীতি অনুযায়ী অন্যান্য বহু উপাসক-সম্প্রাদায়ের মতো ব্রাহ্মদের আর-একটি সম্প্রদায়-রূপে হিন্দুসমাজ ধীরে ধীরে নির্বিবাদে আত্মসাৎ করে নিল। তারপর শুধু অতিনির্দিষ্ট সঙ্কীর্ণ সীমানার মধ্যে ‘peaceful coexistence’ ছাড়া তার আর কিছুই করণীয় রইল না।
ঊনিশ শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে একথা ঠিক যে কেশবচন্দ্র সেন বলিষ্ঠ প্রগতিশীল আদর্শে - যেমন স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রীস্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ প্রভৃতি - ব্রাহ্মসমাজকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন - কিন্তু যে বিস্তৃত চোরাবালির ভূমি আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, অবশেষে কেশবচন্দ্র নিজেই তাতে প্রোথিত হলেন। হিন্দুধর্মের সনাতন ইনস্টিটিউশন গুরুবাদ অবতারবাদ তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এই সময় আদিব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনও ‘Brahmoism is Hinduism’ কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং তার অন্যতম প্রবক্তা হন রাজনারায়ণ বসু। ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ ও নীতির এই করুণ পরিণতির পর ঊনিশ শতকের চতুর্থ পাদে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের বিজয় অভিযান স্বাভাবিক। প্রধানত শহরবাসী শিক্ষিত এলিটের ideologicalআন্দোলন - যার ‘spread effect’ I ‘expansionary momentum’ প্রায় ছিল না বলা চলে, তা আতসবাজির মতো চমক সৃষ্টি করতে পারে - যেমন প্রায় বছর দশেকের জন্য ঊনিশ শতকের তিরিশের দশকে করেছিলেন ডিরোজীয়ান ইয়ং বেঙ্গল দল - কিন্তু তার স্থায়ী দান বিশেষ থাকে না। কতকগুলি প্রগতিশীল ‘values’ I‘ideas’-এর যে ‘সেডিমেণ্ট’ বা তলানি পড়ে থাকে সমাজমনের উচ্চস্তরে, পরে নতুন অবস্থানতরে নতুন নিরিখে তার পুনর্মূল্যায়ন হয়। যেমন বর্তমানে হচ্ছে। সে যাই হোক, ঊনিশ শতকের ধর্মসংস্কার প্রসঙ্গে আরও একটু বলা যায় এই যে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরাও ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের প্রতিপাদ্য ছিল এই যে প্রাচীন হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সমাজ-রাষ্ট্রের মধ্যে আধুনিক যুগের সমস্ত প্রগতিশীল ভাবাদর্শ নিহিত আছে - সাম্য গণতন্ত্র স্ত্রীশিক্ষা স্বাধীনতা, পুরুষ-নারীর সামাজিক সমান অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি - তার জন্য নতুন কোনো আদর্শ বাইরে থেকে আমদানি করা অর্থহীন। ঊনিশ শতকের প্রথম পর্বের‘ওরিয়েণ্টালিস্ট’ - যাঁরা প্রাচীন সংস্কৃতবিদ্যা শিক্ষার প্রচলন করতে চেয়েছিলেন - এবং শেষ পর্বের ’রিভাইভালিস্ট’দের মনোভঙ্গি ও যুক্তির মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নেই। উভয়েরই বক্তব্য হল সবই প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে ও হিন্দু ধর্মে আছে, গীতায় সাম্যবাদ পর্যনত। এইটাই হল সবচেয়ে মারাত্মক বিপজ্জনক চিনতাধারা, যার প্রভাব থেকে আজ পর্যনত আমাদের দেশের অনেক ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানী, সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতা মুক্ত হতে পারেন নি। আমাদের দেশের এই চিনতাধারা ও ধারণা সম্বন্ধে মীরডাল তাঁর Asian Drama গ্রন্থে সুন্দর একটি মনতব্য করেছেন। তিনি বলেছেন ‘this may be good tactics, but it is bad sociology’। বাস্তবিকই তাই। দেশের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত জনসমাজকে বিভ্রানত করার দিক থেকে এবং তাদের অসাড় নিসপন্দ করে রাখার দিক থেকে এ কৌশল খুব ভাল , কিন্তু সামাজিক বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে সনাতন হিন্দুধর্মের মতো একটি অটল ’ইনস্টিটিউশন’ কতকগুলি সামাজিক ইনস্টিটিউশনের শক্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সব কয়টি হল জাতিভেদ বর্ণবৈষম্য গুরুবাদ প্রভৃতি সামাজিক অসাম্য এবং মুল অর্থনৈতিক অসাম্যের ‘hardened institutions of inequality’ কাজেই সবই যে বেদ-উপনিষদ-গীতায় আছে, সনাতন হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতশাস্ত্রে আছে, একথা বলা ‘good tactics’, কিন্তু ‘bad sociology’. এই চিনতাধারা আজও আমাদের সমাজে বেশ সক্রিয় থাকার ফলে এবং যন্ত্রোন্নয়ন-শিল্পোন্নয়নের সংঘাত সামনততান্ত্রিক ভিত্তির শিথিলতার মধ্যে অর্থনৈতিক অসাম্য-বৈষম্য অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, বর্তমানে তাই দেখা যায় ধর্মের পুরাতন institutional power-structures যেন ক্রমে আরও শক্তিশালী হচ্ছে - গুরুবাদ পৌত্তলিকতা অবতারবাদ জাতিভেদ ধর্মানুষ্ঠান অত্যধিক মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে - বিশেষ করে বাংলাদেশের শহরে-নগরে ও তার উপকণ্ঠে। শুধু এই বিষয়টি সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের একটি চমৎকার ক্ষেত্র হতে পারে, অত্যনতinteresting - কেবল মধ্যবিত্তদের নানারকমের নৈরাশ্য ও ব্যর্থতা বিচারের দিক থেকে নয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পাশ্চাত্ত্যবিদ্যার পলেস্তারার উপর প্রাচীন ধর্মীয় ইনস্টিটিউশনের আঘাত লাগলে কিভাবে যে তা এখনও সহজে খসে যেতে পারে সেই দিক থেকে, এবং millenarianism বা স্বপ্নস্বর্গ কামনা ও পরিত্রাতাmessiah-র প্রভাব যে মধ্যবিত্তের মানস-স্তরের কত গভীরে পর্যনত প্রবেশ করতে পারে, সেই বিষয় অনুশীলনের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম বিশেষ ঘটে নি। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন বোধহয় ঊনিশ শতকের সবচেয়ে বড় সমাজসংস্কার আন্দোলন, যা শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রাম্যসমাজে পর্যনত খানিকটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, এবং বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সর্বভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হবার পর ঊনিশ শতকের শেষ পর্যনত কয়েকটিমাত্র বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তার অধিকাংশই বিদ্যাসাগরের নিজের উদ্যম ও অর্থব্যয়ে অথবা তাঁর একানত ভক্তদের প্রচেষ্টায়। তাও দেখা গেছে বিধবাবিবাহ যাঁরা করতে অগ্রণী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে সাময়িক অর্থলোভে শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, কোনো আদর্শপ্রীতির জন্য বিবাহ করেন নি। বিদ্যাসাগর নিজেও তা বুঝতে পেরে শেষজীবনে হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন। বিধবাবিবাহ হিন্দুসমাজ গ্রহণ তো করেই নি, শিক্ষিত উচ্চসমাজে যাঁরা আদর্শের দিক থেকে একদা তা সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারেন নি। বিধবাবিবাহের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সামাজিক প্রথা, যেমন নারীর অর্থনৈতিক পরাধীনতা, যৌথপরিবার, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি - যেমন ছিল ঠিক তেমনি রেখে শুধু প্রথা হিসেবে বিধবাবিবাহ সমাজে প্রচলিত হতে পারে না। আর যে প্রথাগুলির কথা উল্লেখ করলাম সেগুলিও সমাজের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তির আধুনিক রূপানতর ছাড়া পরিবর্তিত হতে পারে না। তাই বিধবাবিবাহ ব্যর্থ হয়েছে, নারীর পরাধীনতা, যৌথপরিবার সবই বজায় থেকেছে, এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিবারণের জন্য শেষ পর্যনত ইংরেজরাই কোনো আইন পাস করতে চান নি। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো পাশ্চাত্ত্যবিদ্যায় শিক্ষিত শ্রেষ্ঠও আইন প্রয়োগ করে এই ধরনের সমাজসংস্কারের বিরোধী ছিলেন। শিক্ষিত বাঙালী এলিটের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চয় গণ্য হতে পারেন এবং সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রেও শিক্ষিত এলিটের মন যে চিরায়ত সামাজিক প্রথা ও ইনস্টিটিউশনের কতদূর আবদ্ধ হয়ে ছিল, তা এই দৃষ্টানত থেকে বোঝা যায়।
ইয়োরোপীয়ান এলিটের আদর্শপুষ্ট হয়ে এদেশের শিক্ষিত এলিট গড়ে উঠেছিল। সেই আদর্শের বীজ থেকে অঙ্কুর, এবং অঙ্কুর থেকে গাছ ফল ফুল হবার মতো দেশের মানুষের মনের মাটি তৈরি হয় নি, তার কারণ তার উপযুক্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ রচিত হয় নি। তার উপর এই শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর সামাজিক উৎপত্তিও বাংলার নবজাগরণের প্রবাহকে কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে নিয়ন্ত্রিত করেছে। প্রধানত হিন্দুসমাজের উচ্চস্তর থেকে, অর্থাৎ উচ্চবর্ণের ধনিক ও সচ্ছল মধ্যবিত্তের স্তর থেকে আধুনিক বাঙালী এলিটের উদ্ভব হয়েছে। এক কথায় ঊনিশ শতকের বাঙালী এলিটকে উচ্চবর্ণের সঙ্গতিপন্ন হিন্দু মধ্যবিত্ত ‘এলিট’ বলা যায়। তার ফলে এই এলিটগোষ্ঠী-অনুপ্রাণিত ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন হিন্দুসমাজ কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। প্রায় ঊনিশ শতকের শেষ পর্যনত বাংলাদেশে শিক্ষিত মুসলমান এলিটগোষ্ঠীর বিকাশ হয় নি বলা চলে। ব্রিটিশের ক্রমবর্ধমান প্রশাসন-যন্ত্রের নানা শ্রেণীর চালক ও কর্মচারী সরবরাহের জন্য যে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা হিন্দুরাই বেশি আয়ত্ত করেছিলেন বলে এই স্তরের চাকরিজীবীদের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালী হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল। ধনিক ও মধ্যবিত্তের স্তরে বাঙালী হিন্দুদের সঙ্গে বাঙালী মুসলমানদের বিচ্ছেদ তো হয়েছিলই, শিক্ষিত এলিটের স্তরেও হয়েছিল। এই কারণে বাংলাদেশে যে সামাজিক রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ট্রাজিডি ঘটেছে, তাও ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে অস্বীকার করা যায় না। যদি ঐতিহাসিক সত্য বিকৃত না করে বাংলাদেশ থেকে আধুনিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও ক্রমবিকাশের ইতিবৃত্ত রচনা করতে হয় তাহলে তা মূলত হিন্দু জাতীয়তাবোধের বিকাশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এইভাবে বাঙালী মুসলমানসমাজ ঊনিশ শতকের শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে, পরবর্তীকালে নতুন উদীয়মান বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত এলিটশ্রেণী স্বভাবতই অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে জাতীয় আন্দোলনের ধারার সঙ্গে একাত্মীয়তা স্থাপন করতে পারেন নি। তার আগেই উভয় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক সামাজিক দূরত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল খণ্ডিত বাংলাদেশ এবং খণ্ডিত ভারত।
ঊনিশ শতকের নবজাগরণের অনুপ্রেরণার মূলে যে প্রগতির ধ্যানধারণা - ‘idea of progress’ সক্রিয় ছিল, তারই বা স্বরূপ কি? ফরাসী বিপ্লব ও ইংলণ্ডের শিল্পবিপ্লব, বাষ্পীয় শক্তি, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ , ইলেকট্রিসিটি, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রচালিত শিল্পোৎপাদনের প্রসার ইত্যাদির জন্য যে বাস্তব সামাজিক পরিবেশ ইংলণ্ডে গড়ে উঠেছিল, পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক দার্শনিক মনীষী ও শিল্পী-কবিদের প্রগতির চিনতাধারায় তারই প্রতিফলন হয়েছিল। প্রত্যক্ষ ‘material progress’-এর উপর ideas of progress’ রচিত হয়েছিল। তার চারিদিকে ছিল মানুষের দুঃসাহসিক অভিযান ও অগ্রতি - অর্থনীতি ও বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে। যদিও এই উন্নতি ও প্রগতি প্রধানত বর্ধিষ্ণু বুর্জোয়াশ্রেণী ও নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণীর জন্য নির্ধারিত, তাহলেও তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। রেলপথ ও রেলগাড়ির গতির মতো প্রগতির ধারণাও হল সরল ও যান্ত্রিক। কবি টেনিসন যখন লিভারপুল থেকে ম্যাঞ্চেস্টারের রেলপথে প্রথম যাত্রা করেন, তখন ১৮৩০ সালে, তিনি লেখেন!
Let the great world spin forever down the ringing grooves of change.
১৮৫১ সালে লণ্ডনের বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রদর্শনীতে বাস্তব অগ্রগতির নিদর্শন সকলকে দেখানো হয়েছিলEdinburgh Review (October 1851)তখন প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য জানিয়ে লেখেন যে এই বিরাট মেলার লক্ষ্য ‘to seize the living scroll of human progress, inscribed with every successive conquest of man’s intellect.’ ইংলণ্ডের বাস্তব পরিবেশ থেকে উদ্ভূত এই প্রগতির ধ্যানধারণা ইংরেজ শাসক ও এলিটগোষ্ঠী আমাদের দেশের এলিটগোষ্ঠীর মস্তিষেক রোপণ করেছিলেন, সম্পূর্ণ অবাস্তব পরিবেশে। ভৌগোলিক ও সামাজিক নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে তার ফলে বাংলাদেশে কিছুটা আদর্শগত আলোড়ন হয়েছিল এবং যতটা হয়েছিল সেই অনুপাতে সামাজিক সুফল ফলে নি। পুরাতন মধ্যযুগীয় সামাজিক ইনস্টিটিউশনের লৌহপ্রাচীরে প্রতিহত হয়ে প্রগতির ভাবধারা প্রতিক্রিয়ার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রায় চতুর্থ পাদে পৌঁছেও আমরা তাই আজ বাংলার সমাজে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার বিচিত্র সহাবস্থান দেখতে পাই - ধর্মীয় গুরুবাদ থেকে রাজনৈতিক মার্কস্বাদ, সর্বক্ষেত্রে। জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন সেই ঊনিশ-শতকীয় সঙ্কীর্ণ মধ্যবিত্ত-মানস আজও আমাদের বুদ্ধি ও চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বাংলাদেশে তাই আজ অলিগলিতে, পাড়ায় পাড়ায় ধর্মীয় গুরু, Messiah ও অবতারের প্রাদুর্ভাব, প্রত্যেক মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে অনতত একজন করে তরুণ আধুনিক কবি ও কমিউনিস্টের আবির্ভাব, প্রত্যেক অঞ্চলে মহকুমায় ও থানায় একটি করে মার্কসবাদী ও সোশ্যালিস্ট দল - একজন ব্যক্তি বা‘গুরু’- কেন্দ্রিক - প্রত্যেক মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক মার্কসবাদী - শুধু বিশেষত্ব এই যে তিনি কমিউনিস্ট-বিরোধী, বিশেষ করে যে কমিউনিস্টরা বড্ড বেশি masses-এর মুখ চেয়ে শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলে এবং বিশিষ্ট সভ্য ভদ্রলোকের মতো পার্লিয়ামেণ্টারি কায়দায় মার্কসবাদী আন্দোলনের কথা বলে না, আধুনিক শিক্ষায়তনের পাশাপাশি পেশাদার অ্যাস্ট্রলজারের চেম্বার, ভীড়ের চাপ দু’জায়গাতেই সমান, কোনোরকমে লিখতে-পড়তে শিখেছেন এরকম বাঙালীর মধ্যে অনতত শতকরা কুড়িজন ‘ক্রিয়েটিভ’ সাহিত্যিক অর্থাৎ অরিজিন্যাল গল্প উপন্যাস কবিতা লেখেন এবং তাঁদের সৃজনীপ্রতিভার স্ফুরণ অশিক্ষিত অমার্জিত শিশ্নপরায়ণতার(‘genitality’) মধ্যে, ফ্রয়েডীয়ান অর্থে eroticism-এ নয়, কিঞ্চিৎ অর্থের মালিক এ রকম বহু বাঙালী নামে গালভরা ’ব্যবসায়ী’ আসলে নেপোশ্রেণীর নিকৃষ্ট দালাল এবং অবাঙালী মোনোপলিস্ট পুঁজিপতির আজ্ঞাবহ মাল-যোগানদার দাসানুদাস - এ রকম সব বিচিত্র সামাজিক উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত অদ্ভুত মধ্যবিত্ত হবুচন্দ্রের রাজ্য বাংলাদেশের মতো দেশ কোথাও আছে কি না সন্দেহ। এও অনেকটা আমাদের ঊনিশ শতকের মধ্যবিত্ত এলিটগোষ্ঠী অনুপ্রাণিত নবজাগরণের উত্তরাধিকার, কেবল আকারে ও বিকারে অনেক পরিবর্ধিত। কার্ল মার্ক্সের ‘alienation’ এবং এমিল ডুর্কহাইমের ‘anomie’-র সামাজিক অনুসন্ধানের আদর্শক্ষেত্র আজ বাংলাদেশ। কিন্তু সেটা আলোচনার যোগ্য বিষয়, আপাতত আমাদের আলোচনা নয়।*আমাদের কথা হল, বাংলাদেশের বিশাল বর্ধিষ্ণু জনসমাজে কিছুদিন আগে পর্যনত যারা মার্ক্সের ভাষায়‘submen’ ছিল, অর্থাৎ যারা তাদের শক্তি ও শোষিত সত্তা সম্বন্ধে সচেতন ছিল না, তারা আজ তাদের ‘sub-humanity’ সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠছে এবং সেই মানবেতর অস্তিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। প্রাথমিক রাষ্ট্রিক ও নাগরিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে এই বিদ্রোহ তাদের সার্থক হলে, ভবিষ্যতে তারা আমাদের লিখিত ইতিহাস-সাহিত্য-সংস্কৃতির পুনর্মূল্যায়ন করবে এবং তখন অনেক অধুনা প্রচলিত মূল্যায়নের মানদণ্ড আবর্জনাস্তূপে নিক্ষিপ্ত হবে। বইপত্র তো হবেই । তখন অনেক রূঢ় মানসিক আঘাতের হাত থেকেও আমরা নিষকৃতি পাব না। বিশিষ্ট বাঙালী মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকরা হয়ত তখন বর্তমানের ক্লাব হোটেল আড্ডাখানা ও ’সুইট হোম’ ছেড়ে অরণ্যবাসী হতে চাইবেন। কিন্তু বর্তমানের মিলেনারিয়ানিজম্, অ্যানোমি, অ্যালিয়েনেশন ও মার্কসইজম্-এর সমন্বয়, ঊনিশ শতকের ‘ব্রাহ্মইজম্’ ও ‘হিন্দুইজম’-এর মতো অথবা ইয়ং বেঙ্গলের‘রেডিকালিজম্’ ও আশী-নব্বই-এর দশকের হিন্দু ‘রিভাইভ্যালিজম্’-এর সমন্বয়ের মতো, অরণ্যেও সম্ভব হবে না, অনতত বাংলাদেশের সীমাবদ্ধ জনারণ্যে তো নয়ই।
*আমার নতুন বই ‘মেট্রোপলিটন মন, মধ্যবিত্ত, বিদ্রোহ’-এর মধ্যে এবিষয়ে একাধিক প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। (১৯৭৮) - লেখক
[সৌজন্যে : বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, প্রকাশক : ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ ::১৯৯৩,
উপরের প্রবন্ধটি লেখকের বাংলার নবজাগৃতি গ্রন্থের ১৯৭০ সালের সংযোজন হিসাবে প্রকাশিত হয়। - বঙ্গরাষ্ট্র]
অনলাইন : ১০ জুলাই, ২০০৮
গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলার নবজাগরণের যে ভাবপ্রতিমা, ঊনিশ শতকের পশ্চাদ্পটে, নানারঙের প্রলেপ দিয়ে আমরা নির্মাণ করেছি, তার অনেক রঙ আজ সামাজিক গতির তরঙ্গে ধূয়েমুছে মাটি হয়ে গিয়েছে, অনেক রঙের বাহ্য ঔজ্জ্বল্য ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। তার কারণ, প্রলেপগুলি বেশির ভাগই কাঁচা রঙের। তা থেকে বোঝা যায়, আমাদের ইতিহাসের ধারা বিশ্লেষণে, বিশেষ করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারা, মূলে কোথাও গলদ আছে, ভয়ঙ্কর একটা ফাঁক ও ফাঁকি আছে, যে ফাঁক ও ফাঁকি কেবল তারিখ ও তথ্যের সমারোহে পূরণ করা যায় না। কারণ প্রাণহীন নীরেট তথ্য, মহাফেজখানা বা গ্রন্থাগার যেখান থেকেই আবিষকৃত হোক, ঐতিহাসিক ও অনুসন্ধানীর হাতে তা খেলার পুতুল মাত্র। তিনি তাঁর দৃষ্টি, বুদ্ধি ও বিচারভঙ্গি অনুযায়ী সেগুলি নির্বাচন করেন, সাজিয়ে-গুছিয়ে সামনে উপস্থিত করেন এবং তার ভিতর দিয়ে ইতিহাসের পালাগান শোনান। সেটা কেবল তথ্যের পুতুলনাচের ইতিকথা, সমাজের ও মানুষের ইতিকথা নয়। একই তথ্যের কত বিচিত্র প্রকাশ ও ব্যাখ্যা আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্রে সাময়িকপত্রে দেখতে পাই। কাজেই কেবল তথ্য নয়, তথ্যানতর্গত সত্যটিকে বুঝতে হলে ইতিহাসের গতিবোধ তো বটেই, সেই গতির ছন্দ ও তাল-মাত্রা সম্বন্ধেও বোধ সজাগ থাকা প্রয়োজন। এই বোধ থাকলে ঐতিহাসিক তথ্যবিচার বিজ্ঞানসমমত হতে পারে, ইতিহাস বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে, এবং তা যদি হয় তা হলে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বিভেদরেখা লুপ্ত হয়ে যায়। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের এই মিলনসীমানেত দাঁড়িয়ে আজ আমরা ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের গতিধারার বিচার বিশ্লেষণ করব এবং চেষ্টা করব তার অসঙ্গতি অসমগতি ও অপূর্ণতার কারণগুলি নির্দেশ করতে।
পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের অর্থ ও গুরুত্বের দিক থেকে আমাদের ঐতিহাসিকরা সাধারণত ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের বিচার করে থাকেন। ইতিহাসে কখনও দেখা যায় না যে দুই দেশের বা দুই পরিবেশের এক-ধরনের ঘটনার মধ্যে ঠিক একই কারণের সমাবেশ অথবা একই প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। কিন্তু কারণ ও তার ফলাফলের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, কতকগুলি মৌল বিষয়ের বা ঘটনার অনতর্নিহিত তাৎপর্যের সাদৃশ্যের জন্য আমরা ‘রেনেসাঁসে’র মতো ঐতিহাসিক শব্দ ব্যবহার করতে পারি। ইতিহাসের দিক থেকে ‘রেনেসাঁস’ কথায় ‘ typological’ গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য কি? জার্মান সমাজবিজ্ঞানী আলফ্রেদ ফন্ মার্টিন তাঁর Sociology of the Renaissance গ্রন্থে রেনেসাঁসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্দেশ করে বলেছেন - ‘ the typological importance of the Renaissance is that it marks the first cultural and social breach between the Middle Ages and modern times : it is a typical early stage of modern age.’ মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিচ্ছেদ ঘটে রেনেসাঁসের যুগে এবং সেইদিক থেকে রেনেসাঁসকে আধুনিক যুগের প্রথম উদয়পর্ব বলা যায়। যুগ থেকে যুগানতরে যাত্রার পথে কখনও অতীত যুগের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামাজিক সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদ ঘটে না, বিচ্ছেদের শক্তিগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে - সমাজের মূল গঠন-বিন্যাসের পরিবর্তনের ফলে। এই মূল গঠন-বিন্যাস অর্থনৈতিক, যার ভিতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সমাজের গোষ্ঠীবিন্যাস ও শ্রেণীবিন্যাস গড়ে ওঠে এবং তার উপর ভিত্তি করে সমাজের ধ্যানধারণা ভালমন্দ-বিচারবোধ সবকিছুর বিকাশ হয়। মূল অর্থনৈতিক ভিত্তির যদি বিশেষ পরিবর্তন না হয়, তাহলে সেই পুরাতন ভিত্তির উপরে গঠিত সামাজিক সংস্থা বা ইন্স্টিটিউশনগুলির অথবা সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণাগুলির স্থায়ী পরিবর্তন হয় না, বহিরাগত ভাবসংঘাতের ফলে একটা সঞ্চরণশীল পরিবর্তন হতে পারে মাত্র। এইদিক থেকে বিচার করলে, typologically ঊনিশ শতকের বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক আলোড়নকে ‘রেনেসাঁস’ বললে ভুল হয় না, কিন্তু বৈদেশিক শাসনাধীনে সংঘটিত এই জারজ রেনেসাঁস-এর সঙ্গে পাশ্চাত্ত্য রেনেসাঁর-এর প্রকৃতিগত বৈসাদৃশ্য তো আছেই, উপরন্তু তার বাস্তব পশ্চাদ্ভূমি না থাকার জন্য শেষপর্যনত তার সামাজিক ফলাফলও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষময় হয়েছে। ’রেনেসাঁস’ বা নবজাগরণের ঐতিহাসিক লক্ষণগুলি বিচার করে বাংলার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে আমরা তার অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতা আরও ভাল করে বুঝতে পারব।
মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের যে সামাজিক ‘breach’ বা বিচ্ছেদ রেনেসাঁসের অন্যতম ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য বলে আগে উল্লেখ করেছি, তার প্রথম প্রকাশ হবে সামাজিক অঙ্গবিন্যাসের (social structure -এর) পরিবর্তনে। মধ্যযুগের সমাজ ছিল একটা ‘rigidly graduated system’ এবং সেই কঠোর প্রায়-অচল স্তরবিন্যস্ত সমাজের চেহারা ছিল পিরামিডের মতো, অপরিবর্তনীয় - ‘pyramid of Estates’ -এর পাশে অচল-অনড় ’pyramid of values’। অর্থাৎ স্থাবর ধনসম্পত্তির পিরামিডের পাশে স্থাবর ভালমন্দবোধ ও অটল ধ্যানধারণার পিরামিড - যেমন ‘base’ বা বনিয়াদ, তেমনি তার উপরের ‘superstructure’ বা সৌধ। ধনতন্ত্রের উন্মেষপর্বে, রেনেসাঁসের যুগে, এই পিরামিডে আঘাত হানল প্রথমত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের অবাধ প্রতিযোগিতার নীতি, দ্বিতীয়ত নবযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যমান সচল ’টাকা’ ( money )। আঘাতের ফলে মধ্যযুগের সামাজিক পিরামিডে ভাঙন ধরল, অচল স্তরিত সমাজের ভিতরে দেখা গেল নতুন এক সচল স্তরায়ন (flexible social stratification) আরম্ভ হয়েছে সমাজে। সমাজে মানুষকে স্তরিত করার শক্তি হল অবাধ প্রতিযোগিতায় অর্জিত টাকা। টাকা সচল গতিশীল, কাজেই সামাজিক স্তরগুলিও, গতিশীল, rigid বা অচল নয়। আগে সমাজে কোনো ঊর্ধ্বাধঃ গতি (vertical mobility) ছিল না, এখন সেই গতি সঞ্চারিত হল অবাধগতি টাকার দৌলতে এবং টাকা সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যমানে পরিণত হওয়ার ফলে - সামাজিক মর্যাদার মান, প্রভাব-প্রতিপত্তির মান। ইটালীয় রেনেসাঁসের কালে সমাজের এই গতিশীলতা দেখে আক্ষেপ করে Aeneas Sylvius বলেছিলেন : ‘Italy... has lost all stability... a servant may easily become a King’ এবং Lujo Brentano দুঃখ করে বলেছিলেন যে টাকার জোরে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য অত্যধিক বাড়ছে। শুধু তাই নয়, তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন দেখে যে ‘Cash payments are now the tie between people.’ ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে কার্ল মার্কস ‘cash nexus’ বলেছিলেন, তার প্রায় চারশ বছর আগে ব্রেনতানো এবং আরও অনেকে সেই ’cash tie’ -এর চেহারা দেখে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
বাণিজ্যের স্বাধীনতা ও টাকার সচলতার দিক থেকে বিচার করলে ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে, প্রধানত নতুন মহানগর কলকাতা কেন্দ্রে, আঠার শতক থেকে এই ধরনের পরিবেশ রচিত হয়েছিল। কলকাতা শহরে যে নতুন নাগরিক অভিজাত ধনিকগোষ্ঠী (urban aristocracy) গড়ে উঠেছিল, তার পরিবার-প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অধিকাংশেরই টাকার ধান্দায় নগরে আগমন এবং যে-কোনো কৌশলে যে-কোনো গম্য-অগম্য পথে-বিপথে-কুপথে টাকার সন্ধানে বেপরোয়া অভিযান আঠার শতকের বিভিন্ন পর্বে আরম্ভ হয়েছিল। বাণিজ্যের স্বাধীনতা ছিল ইংরেজদের, এদেশীয় বা বাঙালীদের সম্পূর্ণ নয়। করিতকর্মা বাঙালীদের স্বাধীনতা ছিল ইংরেজদের অধীনে ও সাহচর্যে যে-কোনো কর্মে নিযুক্ত হবার, অবশ্য কোনো আধ্যাত্মিক কর্মে নয়, অর্থকরী কর্মে। আর একটি স্বাধীনতাও তাঁরা এই সময় প্রদর্শন করেছিলেন, সেটি হল মধ্যযুগীয় কুলবৃত্তিগত বন্ধন ছিন্ন করে যে-কোনো অর্থকরী কর্ম করার স্বাধীনতা। ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ বণিকদের মধ্যে অনেকেই কুলবৃত্তি ও কুল-মর্যাদা ত্যাগ করে, নতুন টাকার মর্যাদায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ইটালীয় সমাজপ্রসঙ্গে সিলভিয়াসের কথার -‘servants may easily become a King’ - প্রায় প্রতিধ্বনি করেছেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ’নববাবুবিলাস’ গ্রন্থেঃ
ইংরাজ কোম্পানি বাহাদুর অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন এই কলিকাতা নামক মহানগর আধুনিক কাল্পনিক বাবুদিগের পিতা কিম্বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসিয়া স্বর্ণকার কর্মকার চর্মকার চটকার মঠকার বেতনোপভুক হইয়া কিম্বা রাজের সাজের কাঠের খাটের ঘাটের মঠের ইটের সরদারি চৌকিদারী জুয়াচূরি পোদ্দারী করিয়া অথবা অগম্যাগমন মিথ্যাবচন পরকীয় রমণী সংঘটনকামি ভাড়ামি রাস্তাবন্দ দাস্য দৌত্য গীতবাদ্যতৎপর হইয়া কিম্বা পৌরোহিত্য ভিক্ষাপুত্র গুরুশিষ্যভাবে কিঞ্চিৎ অর্থসঙ্গতি করিয়া কোম্পানির কাগজ কিম্বা জমিদারি ক্রয়াধীন... অধিকতর ধনাঢ্য হইয়াছেন।
ভবানীচরণ অর্থনীতিবিদ না হলেও এখানে একটি বিরামচিহ্নহীন বাক্যের মধ্যে সম্পূর্ণ আঠার শতক ও ঊনিশ শতকের প্রায় প্রথমার্ধ পর্যনত বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের মর্ম প্রকাশ করেছেন। ভবানীচরণের কথা যে কতখানি সত্য তা কলকাতার প্রাচীন ধনিক পরিবারগুলির আদিপুরুষদের কর্মজীবনের কাহিনী বিচার করলে বোঝা যায়। আঠার শতকে কলকাতার বহিরাঙ্গিক বিন্যাস অনেকটা মধ্যযুগীয় নগর ও গণ্ডগ্রামের মতো ছিল - বিভিন্ন কুলবৃত্তিজীবীদের বাস ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে। আঞ্চলিক পুরনো নামগুলি থেকে তা বোঝা যায়, যেমন কুমোরটুলি কলুটোলা জেলিয়াটোলা ডোমটুলি গোয়ালটুলি পটুয়াটোলা শাঁখারীটোলা ইত্যাদি। এই মধ্যযুগীয় নাগরিক পরিবেশে শোভাবাজারের দেব-পরিবার, সিমলের দে-সরকার পরিবার, জোড়াসাঁকো পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার, মল্লিক পরিবার এবং আরও অনেক প্রাচীন ব্রাহ্মণ-কায়স্থ- বণিক পরিবার, যাঁরা সে সময় কলতাকার নতুন ধনিকসমাজ গড়ে তুলেছিলেন, তাঁরা মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কবিগান তর্জাগান আখড়াইগান পাঁচালি কথকতা ইত্যাদির সঙ্গে ঘৌড়দৌড়, বুলবুলির লড়াই, পোষা বাঁদরের বিয়ে, মাতৃপিতৃশ্রাদ্ধ, পুত্রকন্যার বিবাহ, সাহেবদের খানা পিনা, গঙ্গার ঘাটনির্মাণ, দেবালয় নির্মাণ, তীর্থস্থানে ধর্মশালা নির্মাণ প্রভৃতির কল্যাণে বাঙালী Comprador-শ্রেণীর নব্যধনিকরা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। আঠার শতকের মাত্র দশ-বারজন কলকাতার বিখ্যাত বাঙালী ধনিক পরিবারের বিচিত্র ভোগবিলাসের (যাকে conspicuous consumption বলা হয়) ব্যয়ের পরিমাণ যদি হিসেব করা যায়, তাহলে মোট অংক অনতত কয়েক কোটি টাকায় দাঁড়াবে। এই মূলধন জমা করা থাকলে ঊনিশ-শতকে এই সমস্ত পরিবারের বংশধররা স্বাধীন শিল্পবাণিজ্যক্ষেত্রে উদযোগী হয়ে অনতত কিছুটা অগ্রসর হতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তা করেন নি।
তার উপর আঠার শতকের শেষে, ১৭৯৩ সালে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে যখন নতুন জমিদারশ্রেণীতে রূপানতরিত হবার পথ নব্যধনিকের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন তাঁরা ভোগবিলাসের পর উদ্বৃত্ত টাকা প্রধানত জমিদারী কিনতে ব্যয় করেন। কার্ল মার্কস তাঁর Notes on Indian History গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল প্রসঙ্গে লিখেছেন ‘greater part of the province’s landholdings fell rapidly into the hands of a few city-capitalists who had spare capital and readily invested it in land’. স্বাধীন শিল্পবাণিজ্যক্ষেত্রে যাঁরা কিছুটা সেই সময় উদযোগী হন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রামদুলাল দে ও দ্বারকানাথ ঠাকুর, কিন্তু উভয়েই শেষ পর্যনত বিশাল স্থাবর সম্পত্তির মালিকে পরিণত হন। শহর থেকে উপার্জিত অর্থে আরও কতজন যে খুদে-মাঝারি জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীতে পরিণত হয়েছিলেন তার ঠিক নেই। ১৮৭২-৭৩ সালের প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে মধ্যস্বত্বের বিস্তারের ফলে জমিদারীর সংখ্যা বাংলাদেশে দেড় লক্ষের বেশি হয়েছে, বিশ হাজার একরের উপরে বড় জমিদারীর সংখ্যা পাঁচশ’র কিছু বেশি, বিশ হাজার থেকে পাঁচশ একরের মধ্যে মাঝারি জমিদারী প্রায় ষোল হাজার, এবং পাঁচশ একর ও তার কম ছোট জমিদারীর সংখ্যা দেড় লক্ষের কিছু কম। এর সঙ্গে যদি জমিদার-পত্তনিদার-জোতদারদের গোমস্তা নায়ের তহশীলদার পাইক দফাদার প্রভৃতি কর্মচারী ও ভৃত্যদের সংখ্যা যোগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে ঊনিশ শতকের শেষ পর্বে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্বনীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রাম্যসমাজে কমপক্ষে সাত-আট লক্ষ লোকের এমন একটি ‘শ্রেণী’ (সামাজিক ‘স্তরায়ন’) তৈরি হয়েছে, যে শ্রেণী ব্রিটিশ শাসকদের সুদৃঢ় স্তম্ভস্বরূপ। অবশ্য সামাজিক শ্রেণী হিসেবে বলতে গেলে ‘একটি’ শ্রেণী বলা যায় না, দু’টি শ্রেণী বলতে হয় - একটি নতুন জমিদারশ্রেণী, আর একটি নতুন মধ্যস্বত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্যশ্রেণী। নামে দুই শ্রেণী হলেও, কাজ ও স্বার্থের দিক থেকে এদের চিনতাভাবনা ও আচরণ একশ্রেণীর মতো।
এর পাশে নাগরিক সমাজে, যেমন কলকাতা শহরে, ব্রিটিশ শাসকরা তাঁদের বিশ্বাসভাজন আরও দু’টি শ্রেণী তৈরি করেছিলেন - একটি নতুন নাগরিক ধনিকশ্রেণী, আর-একটি নতুন নাগরিক মধ্যশ্রেণী। এই মধ্যশ্রেণীর মধ্যে ছোট ছোট ব্যবসায়ী, দোকানদার, দালাল প্রভৃতির সংখ্যা অনেক, বাকি নানারকমের চাকরিজীবী। নাগরিক মধ্যশ্রেণীর একটি বিশেষ স্তর হিসেবে গড়ে উঠেছিল বাঙালি ইংরেজিশিক্ষিত এলিট্শ্রেণী। ব্রিটিশ আমলে বাঙালী সমাজের এই নতুন শ্রেণীরূপায়ণ নিশ্চয় একটা বড় রকমের পরিবর্তন এবং আগেকার পিরামিডের মতো স্তরিত সমাজের সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। আগে বলেছি, নবযুগের নতুন শ্রেণীবিন্যাস অচল নয়, সচল, উর্ধ্বাধঃ গতিশীল, এবং সেই গতির প্রধান চালকশক্তি ‘টাকা’। টাকা সচল, শ্রেণীও তার ছন্দে সচল। বাঙালী সমাজে আঠার-ঊনিশ শতকে এ-সত্যও নির্মম বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার জন্যই কি তাকে ’রেনেসাঁস’ বলা যায়? বিশেষ করে যে-সমাজে পরিষকার দেখা যাচ্ছে, আধুনিক ধনতন্ত্রের ‘typical early stage’-এর কোনো আভাস পাওয়া যায় না? বিশেষ করে শ্রমশিল্পের বিস্তারে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষকারের অগ্রগতিতে? যে-সমাজে কোনো ‘entrepreneur’-এর সুদূর পদধ্বনিও শোনা যায় না অর্থনীতিক্ষেত্রে? কেবল টাকার ধান্দা, টাকা সম্পর্কে মুনাফালোভী মনোভাব যদি typical early stage of capitalism হয় (অবশ্য এটা capitalist mentality নিশ্চয় ) তাহলে বাংলাদেশে ঊনিশ শতকে নিশ্চয় তার বিকাশ হয়েছিল বলতে হয়, এবং সেটা যে রেনেসাঁসের যুগের একটা ঐতিহাসিক লক্ষণ তাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমরা জানি প্রকৃত ‘রেনেসাঁস’ তা নয়।
আরও আশ্চর্য হতে হয় এই কথা ভেবে যে ইয়োরোপীয় ‘রেনেসাঁসের’ ঐতিহাসিক পথে আমাদের দেশে প্রকৃত নবজাগরণের যাঁরা অগ্রদূত হতে পারতেন, ব্রিটিশ আমলের নতুন সামাজিক প্রতিবেশে সেই বাঙালী বণিক-শ্রেণী (merchants) আদৌ সচল ও সজাগ হলেন না। কেন হলেন না, সে-প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে বাংলার, তথা ভারতের সমাজেতিহাসের অনুসন্ধানীদের। দুঃখের বিষয়, গতানুগতিক ইতিহাসের পাতায় বহুজনচর্বিত পর্বতপ্রমাণ তথ্যস্তূপের মধ্যেও এরকম কোনো প্রশ্নেরই আভাস পাওয়া যায় না, উত্তর তো দূরের কথা। প্রাচীন হিন্দুযুগ থেকে মধ্যযুগ ও আধুনিক ব্রিটিশ শাসনের যুগ পর্যনত বাংলাদেশের (এবং ভারতবর্ষের) বণিকজাতি বংশধরপম্পরায় দেশ-বিদেশে বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। মনসামঙ্গল চণ্ডীমঙ্গল প্রভৃতি মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যে বাঙালী বণিকদের সমৃদ্ধির বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ধনপতি সদাগর আমি বসি হে উজানী, গন্ধবণিক জাতি বিদিত অবনী’। ধনপতি সাগরের পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে ‘সাত শত বেনে আইসে ধনপতি ধাম’ - তাঁদের মধ্যে চম্পকনগরের চাঁদ সদাগরও ছিলেন। এ রকম আরও অনেক বিবরণ থেকে বাংলাদেশের গন্ধবণিক তাম্বুলিবণিক সুবর্ণবণিক প্রভৃতি বণিক-জাতির বাণিজ্যলব্ধ ধনৈশ্বর্যের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা থেকে একথা অনতত ভাবা যেতে পারে যে এদেশে Mercantile Capitalism -এর বিকাশ স্বচ্ছন্দে হতে পারত এবং তার ক্রমিক পরিণতি, ঐতিহাসিক অবস্থার আনুকূল্যে, ইয়োরোপের মতো Industrial Capitalism-এ হওয়াও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তা হল না কেন? তা ছাড়া, যে ভারতবর্ষে প্রাচীন হিন্দুযুগ থেকে বিজ্ঞান (Science) অনুীশীলনের (গণিত, জ্যোতিষ, রসায়ন প্রভৃতি) ধারা বেশ পরিস্ফুট ছিল (মধ্যযুগে অবশ্য শীর্ণ হয়েছিল), সেই দেশে সর্বত্র বিজ্ঞানের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গেল কেন, তাও ভাবা দরকার। যদি ‘মার্কাণ্টাইল ক্যাপিটালিজম্’- এর স্বাভাবিক বিকাশ হত এদেশে এবং তার পরিণতি হত ’ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজম্’-এ, তাহলে বিজ্ঞান অনুশীলনের ধারা অনেক বেশি পরিপুষ্ট হত এবং তার প্রবাহ বিচ্ছিন্ন হত না। তা যদি হত, তাহলে ইয়োরোপের মতো কি আমাদের দেশেও ’রেনেসাঁস’ বা নবজাগরণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক লক্ষণ স্বভাবতঃই দেখা দিত না? ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ প্রসঙ্গে এরকম কতকগুলি অত্যনত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো চেষ্টাই আজ পর্যনত হয় নি এবং তা না হবার ফলে নবজাগরণ-বিষয়ে সমস্ত আলোচনা ও গবেষণা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে বলতে হয়। আমরা শুধু গতানুগতিক ইতিহাস চর্চার অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে বাইরের খোলটির গায়ে আঁচড় কেটেছি, অনেক হিজিবিজি আঁচড়, কিন্তু ভিতরের বস্তুটিকে সন্ধান করি নি। বাস্তব সমাজ, বাস্তব জীবনের কথা ভুলে গিয়ে আমরা শুধু এদেশের মুষ্টিমেয় মানুষের মানসলোকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান দর্শনের বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়ার বিচার-বিশ্লেষণ করেছি, অথচ দেশের বাকি পঁচানব্বই জন মানুষের মনের সুদূর প্রানেত পর্যনত তার কোনো সপর্শ লাগল কিনা, অথবা আদৌ লাগতে পারে এরকম কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কিনা, সে-বিষয় চিনতা করার অবকাশ পাই নি।
আমাদের প্রশ্ন, কেন এদেশের বণিকশ্রেণী আধুনিক ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থা বিকাশে সহায় হলেন না, কেন ধনপতি সদাগররা এ যুগের কোটিপতি ক্যাপিটালিস্ট হতে পারলেন না? এ প্রশ্নে সদুত্তরের জন্য নতুন দৃষ্টিতে পর্যাপ্ত গবেষণা ও তথ্যানুশীলন প্রয়োজন। আপাতত আমাদের মনে হয়, বাঙালী তথা ভারতীয় সমাজে, বিশেষ করে বাঙালী সমাজে বণিকশ্রেণীর প্রতি সামাজিক উপেক্ষা ও অবজ্ঞাই হল এই স্বাভাবিক ঐতিহাসিক গতি ব্যাহত হবার অন্যতম কারণ। এদিক থেকে চীনের সমাজের সঙ্গে আমাদের ভারতীয় সমাজের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। জোসেফ নীডহাম চৈনিক সমাজের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন -‘The despising of the merchant was a very old characteristic in Chinese thought…’ আমাদের দেশেও একথা সত্য। কিন্তু চৈনিক সমাজে জাতিবর্ণভেদ (caste) বলে কিছু ছিল না, বর্ণবৈষম্য ভারতীয় বৈশিষ্ট্য। এই বর্ণবৈষম্যজনিত সামাজিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষা আমাদের দেশে বণিকশ্রেণীকে শক্তিশালী আধুনিক পুঁজিপতিশ্রেণীতে পরিণত হতে দেয় নি, উদ্যম উদযোগ ও অর্থনৈতিক অভিযানের দুঃসাহসিক পথ থেকে তাদের উৎখাত করেছে। যে কর্ম ও কৃতিতের জন্য কোনো সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা লভ্য নয়, তা করার জন্য কোনো প্রেরণা এদেশের বণিকরা পান নি। কাজেই এদেশের বাণিজ্যলব্ধ মূলধনের ঐতিহাসিক বিকাশ হয় নি আধুনিক শিল্পগত মূলধনে, এবং তা না হওয়ার ফলে যেমন বিজ্ঞানচর্চার ধারাবাহিক অবনতি হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক উৎপাদনব্যবস্থার দীর্ঘস্থিতি ও গতানুগতিকতা এদেশের মানুষকে কর্মবমিুখ ও আলস্যের উপাসক করেছে, এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয়েছে ধর্মচর্চার চূড়ানত বিকৃতিতে, নৈষকর্ম্যের সাধনায়।
ব্রিটিশ শাসকরা আমাদের দেশের পুরাতন সমাজব্যবস্থার অনেক কিছু ওলটপালট করেছেন বটে, কিন্তু তার মূল গড়নটিকে অর্থাৎ বর্ণবৈষম্যের ভিত্তিকে একেবারেই আঘাত করতে পারেন নি। ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্যরা টাকার ধান্দায় খানিকটা ব্যবসাবাণিজ্যের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁদের কাছেও বাণিজ্যলব্ধ টাকার আকর্ষণের চাইতে শিক্ষা ও চাকুরীলব্ধ টাকার আকর্ষণ ছিল অনেক বেশি, সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে। আর তার চাইতেও বড় সত্য হল, বাঙালী বণিকরা (গন্ধবণিক, তাম্বুলিবণিক প্রভৃতি) ব্রিটিশ আমলেও কেউ আধুনিক শিল্পপতি হবার জন্য উদ্যোগী হলেন না, তাঁদের বংশগত বাণিজ্যের গণ্ডির মধ্যে বন্দী হয়ে রইলেন। এমন কি ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হবার পরেও আজও তাঁদের মধ্যে সেরকম কোনো উদ্যোগের লক্ষণ দেখা যায় না, তার কারণ সমাজের মূল বর্ণভিত্তিক গড়ন আজও অটুট আছে, বদলায় নি এবং সেই সমাজবিন্যাসে বণিকরা নিম্নস্তরের উপেক্ষার পাত্র হয়ে আছেন।
একথা সহজ সত্য যে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে আমাদের দেশে ধনতান্ত্রিক বিকাশের পথ আদৌ সহজগম্য ছিল না এবং পদে পদে তার বাধা ছিল অনেক। কিন্তু বাংলার অর্থনীতিক্ষেত্রে অনতত শিল্পবাণিজ্যের মধ্যবর্তী স্তরে যেটুকু সক্রিয় হওয়ার সুযোগ ছিল, যথেষ্ট মূলধন সঞ্চয় করা সত্ত্বেও বাঙালীরা তা হন নি নিষিক্রয়তার প্রতিমূর্তিরূপে গ্রামের জমিদারী, শহরের গৃহসম্পত্তি. কোম্পানির কাগজ, স্বর্ণপিণ্ড ইত্যাদিতে নিশ্চিনত ও নিরাপদ আয়ের সুযোগ খুঁজেছেন, আর যাঁরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত মধ্যশ্রেণী, তাঁরা চাকরি, বিশেষ করে সরকারী চাকরিকেই মানবজীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেছেন। ছেলে দারোগা হোক, ডেপুটি হোক, সরকারী কেরানী হোক, নিদেনপক্ষে জমিদারের গোমস্তা বা নায়েব হোক, এই ছিল বাঙালী মায়েদের প্রার্থনা দেবতার কাছে, এবং বিবাহের বাজারে এই সব পাত্রের মূল্য ছিল অত্যধিক, যেমন বর্তমানে ’ইঞ্জিনিয়ার’ নামক জীবদের। পরিবার থেকে সমাজ পর্যনত এমনই একটা পরিবেশ রচিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে যে বাঙালীর মন ‘achievement-oriented’ বা ব্যক্তিকৃতিমুখী হয়ে গড়ে উঠবার সুযোগ পায় নি তার মধ্যে, ‘slavery-oriented’ বা দাসত্বভাবাপন্ন হয়ে গড়ে উঠেছে। এই দাসত্বপ্রবণ দারোগা-কেরানী-গোমস্তা-নির্ভর, গ্রাম্য নব্য জমিদার-পত্তনিদার ও নাগরিক নব্যধনিক খুদে-ব্যবসায়ী-মুখাপেক্ষী যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ, দেশের বড়জোর শতকরা দশজনের গণ্ডি পর্যনত যার আলোক বিচ্ছুরিত, বাকি নব্বুইজনের সুবিস্তীর্ণ রাজ্যে শুধু অজ্ঞান ও সুপ্তির ঘোর অন্ধাকার, সেই নবজাগরণের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে মনে হয়।
ব্রিটিশ আমলে ঊনিশ শতকের মধ্যেই আমাদের দেশে রেলপথ, পোস্ট অফিস, টেলিগ্রাফ, পাটকল, কাপড়ের কল এবং অন্যান্য কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে, তার জন্য যথেষ্ট মূলধন, উদ্যম ও সুদক্ষ কারিগরির প্রয়োজন হয়েছে, কিন্তু বিদেশীর শাসনশোষণাধীনে থাকার ফলে স্বভাবতই সেগুলি enclave-এর (আংক্লাভ্) রূপ নিয়েছে যে ‘আংক্লাভ’-গুলি ‘cut out and isolated from the surrounding economy, but tied to the economy of the home country.’ গুনার মীরডাল তাঁর Economic Theory and Under Developed Regionsগ্রন্থে, এবং পরবর্তী Asian Drama গ্রন্থে, এ বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। মীরডাল নতুন কথা কিছু বলেন নি, বৈজ্ঞানিক অর্থনীতিবিদ, বিশেষ করে মার্কসবাদীরা, একথা অনেক আগেই বলেছেন। রেলওয়ে, তৎসংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ারিং-শিল্প পাটকল, প্ল্যানটেশন সবই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো গড়ে উঠেছে এদেশে, পরিপার্শ্বের দেশীয় অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন, বিদেশী শাসকদের নিজেদের দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমাদের দেশের, অনতত বাংলাদেশের surrounding economy’-র সামনততান্ত্রিক রূপের বিশেষ পরিবর্তন হয় নি, বরং ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থে নবরূপে তাকে রূপায়িত করা হয়েছিল। পরিপার্শ্বের এই সামনততান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন যে নতুন অর্থনীতির বিকাশ বাংলাদেশে হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ ইংলণ্ডের দেশীয় অর্থনীতির স্বার্থে, মূলধন উদ্যম কারিগরি সবই প্রায় ইংলণ্ডের। আমাদের দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল ‘plentiful labour supply and low wages’-এর দিক থেকে, অর্থাৎ যথাসম্ভব অল্প মজুরিতে প্রচুর পরিমাণে মজুর সরবরাহের দিক থেকে। তাই আমরা করেছি, মূলধন উদ্যম কারিগরি-কুশলতা কিছুই নিজেরা তেমন নিয়োগ বা প্রয়োগ করতে পারি নি।
ব্রিটিশের প্রধান লক্ষ্য ছিল, নিরাপদ-নিশ্চিনত শাসন-শোষণের উদ্দেশ্যে এ দেশের আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক স্থিতি (social stability) যে-কোনো উপায়ে বজায় রাখা। ‘সামাজিক স্থিতি’ কথাটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশের সমাজের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তিতে অথবা সামাজিক অঙ্গবিন্যাসে এমন কোনো দূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটাতে চান নি, যাতে সামাজিক স্থিতি নষ্ট হতে পারে। আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুগের অভ্যুদয় হলে যে সামাজিক সচলতা ও পরিবর্তনের সূচনা হত, তার মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নির্বিঘ্নে শোষণ-শাসনের সুবিধা হত না। দেশী-বিদেশী লুণ্ঠনস্বার্থে সংঘাত হত। কাজেই তাঁদের কোনো স্বার্থ ছিল না রেনেসাঁসের অর্থনৈতিক ভিত্তি এদেশে গড়ে তোলার। তাঁরা এমনভাবে সমাজের শ্রেণীবিন্যাসটিকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন যাতে তার অতীতে সামনততান্ত্রিক বনেদটি মূলত বজায় থাকে। যেমন আমরা আগে বলেছি - গ্রাম্য সমাজে নতুন জমিদারশ্রেণী, বৃহৎ একটি জমিদারী-নির্ভর মধ্যস্বত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্যশ্রেণী, এবং নাগরিক সমাজে নতুন অর্বাচীন অভিজাত-ধনিকশ্রেণী, খুদে-ব্যবসায়ী দোকানদার চাকরিজীবী প্রভৃতিদের নিয়ে বড় একটি নাগরিক মধ্যশ্রেণী এবং তার মধ্যে সোনার চাঁদের মতো একদল ইংরেজিশিক্ষিত ‘elite’। সাম্রাজ্যবাদীর অধীন দেশে, যেমন আমাদের বাংলাদেশে, এই শিক্ষিত ’এলিট’-গোষ্ঠী সম্বন্ধে জ্যঁ পল্ সার্ত্র যে উক্তি করেছেন তা নির্মম হলেও সত্য :
‘The European elite undertook to manufacture a native elite. They picked out promising adolescents: they branded them, as with a redhot iron, with the principles of western culture; they stuffed their mouths full with high sounding phrases, grand glutinous words that stuck to the teeth… These walking lies had nothing left to say to their brothers; they only echoed’. (Preface, Fanon: The Wretched of the Earth).
বাংলাদেশের পাশ্চাত্যবিদ্যা শিক্ষিত ’এলিট’ প্রসঙ্গেও সার্ত্রের এই উক্তি প্রযোজ্য। পাশ্চাত্য ভাবদর্শের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে এই এলিটের কথা আসবে।
যে-ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গড়নের পরিবর্তন ব্রিটিশ আমলে দেখা গেল, তাতে সমাজের যে‘institutional power-structures’, যেমন আমাদের জাতিবর্ণভেদ, ধর্মসম্প্রদায়ের বৈষম্য ইত্যাদি - তার কোনো উন্নতিশীল পরিবর্তন কিছু হল না। যে-কোনো সমাজের স্থায়িত্ব ও শক্তির প্রধান উৎস হল institutionsএবং আমাদের দেশের সামনততান্ত্রিক সমাজের power-structure যে-সমস্ত ইন্স্টিটিউশনের উপর প্রতিষ্ঠিত, তার মধ্যে অন্যতম হল যৌথ পরিবার (joint family), জাতিভেদপ্রথা (caste system), বিবাহপ্রথা, ধর্ম ইত্যাদি । ঊনিশ শতকের সমাজসংস্কারকদের যথেষ্ট প্রচেষ্টা সত্ত্বেও (গাছের গোড়ায় জল দিয়ে ডাল কাটার মতো) এবং সংস্কার-আন্দোলন মধ্যে মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, শেষ পর্যনত পূর্বোক্ত কোনো সামাজিক ইনস্টিটিউশনের পরিবর্তন হয়নি, এমন কি ঊনিশ শতকের শেষ পর্বে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের সদলবলে ও সশব্দে বাংলার নবজাগরণের রঙ্গমঞ্চ দখল করা থেকে বোঝা যায় যে এগুলির দৃঢ়ভিত্তিতে কোনো আঁচড় পর্যনত লাগেনি। লাগবার কথা নয়, কারণ মূল অর্থনৈতিক গড়নের পরিবর্তন ছাড়া সমাজেরinstitutional power-structure -এর কোনো পরিবর্তন হতে পারে না, বাংলাদেশেও সেই কারণে হয় নি। এবং তা হয় নি বলেই বাংলাদেশের রেনেসাঁস-আন্দোলন শেষ পর্যনত অনেক বাষ্প বিদ্যুৎ ও বুদবুদ উদগার করে কোনরকমে নিভ-নিভ সল্তেটি জ্বালিয়ে রেখেছিল মাত্র। ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অনেকাংশে ব্যর্থতা ও ট্র্যাজিক পরিণতি, অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতার এইটাই প্রধান কারণ বলে মনে হয়। জাতিভেদপ্রথা, ধর্মসম্প্রদায়-বৈষম্য ইত্যাদি ‘hardened institutions of inequality’ যেমন দেশের ভিতরের উন্নত ভাবাদর্শের সম্প্রসারণে অনতরায় সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি উন্নত ও অগ্রগামী দেশ থেকে আগত কোনো উন্নতিশীল শক্তির বিস্তারকেও সঙ্কুচিত করতে পারে। ‘If they hamper the spread effects within those countries, they inhibit at the same time, the spread of expansionary momentum from the advanced countries abroad’ (Myrdal). এই কারণে মধ্যযুগে যেমন রামানন্দ কবীর দাদূ নানক নামদেব প্রমুখ সাধক-সংস্কারকদের জাতিবৈষম্য ও ধর্মভেদের বিরুদ্ধে সমস্ত আবেদন আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে, অর্থাৎ তাঁদের ভাবাদর্শের কোনো প্রসার হয়নি, তেমনি ঊনিশ শতকে বাংলাদেশে রামমোহন বিদ্যাসাগর ইয়ংবেঙ্গল দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ সংস্কারকদের পাশ্চাত্ত্য ভাবসংঘাতজাত উন্নতিশীল সংস্কার-আদর্শের বিস্তারও অনেকটা সংকুচিত হয়েছে। নতুন ভাবাদর্শের ‘spread effect’ যেমন ব্যাহত হয়েছে, তেমনি ঊনিশ শতকে পাশ্চাত্য ভাবসংঘাতের‘expansionary momentum’I ‘inhibited’ হয়েছে, পুরাতন institutional power-structure-এর প্রতিঘাতে। তাই দেখা যায়, বাংলার নবজাগরণ মূলত নগরকেন্দ্রিক পাশ্চাত্য বিদ্যাশিক্ষিত মুষ্টিমেয় এলিটের মস্তিষেকর আন্দোলন, দেশের মানুষের আন্দোলন নয়। আমাদের দেশের মতো ঐতিহ্যানুগামী সমাজে (tradition-bound society) পুরাতন সামাজিক ইনস্টিটিউশনের শক্তি যে কত সংহত ও সুদৃঢ়, তা ব্রিটিশ শাসনমুক্তির প্রায় পঁচিশ বছর পরেও, আধুনিক যন্ত্রোন্নত শিল্পায়নের সামাজিক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও, আজও আমরা ধর্মবৈষম্য জাতিভেদ প্রভৃতির সদম্ভ আত্মপ্রকাশে বুঝতে পারছি। কাজেই ঊনিশ শতকে এই সমস্ত ইনস্টিটিউশনের লৌহপ্রাচীরে প্রতিহত হয়ে বাংলার নবজাগরণের আদর্শ কিভাবে খণ্ডিত ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
অনুমান না করে কয়েকটি দৃষ্টানত উল্লেখ করছি। ‘ধর্ম’ যখন সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী ইনস্টিটিউশন, বিশেষ করে আমাদের মতো ঐতিহ্যমুখী (‘tradition-oriented’) সমাজে, তখন ধর্মসংস্কারের কথাই প্রথম বলি। অজস্র ধর্র্মীয় কুসংস্কার, আচার-বিচার বাহ্য অনুষ্ঠান, পৌত্তলিকতা ও বহু-দেবতাবাদ, হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সমাজমানসকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে দেখে রামমোহন গভীর বেদনাবোধ করেছিলেন এবং পাশাপাশি খ্রীস্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারও মিশনারীদের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন। হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজের সঙ্কট তিনি তাঁর দূরদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন বলেই প্রাচীন উপনিষদ ও তন্ত্রশাস্ত্র থেকে বাহ্যানুষ্ঠানবর্জিত একেশ্বর ব্রহ্মের উপাসনা প্রবর্তন ও প্রচার করে এই কথাই বলতে বা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন যে হিন্দুধর্মের উৎসমুখে সন্ধান করলে সেখানেও সহজ সরল অকৃত্রিম একদেবতা নিরাকার ব্রহ্মের স্বরূপ ছাড়া অন্য কিছু উপলব্ধি করা যায় না। তিনি ’ব্রাহ্মসমাজ’ স্থাপন করেছিলেন হিন্দুধর্মের এই প্রকৃত রূপ, শুধু খ্রীস্টান মিশনারীদের কাছে নয়, সমগ্র দেশবাসীর কাছে উদঘাটিত করার জন্য। যুগে যুগে ঐতিহাসিক সঙ্কট- কালে শ্রেষ্ঠ ধর্মসংস্কারকেদের পথই অনুগমন করেছিলেন রামমোহন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছিল - যদিও সেই ব্যর্থতা বিদেশে তাঁর অকালমৃত্যুর জন্য তিনি নিজে বিশেষ অনুভব করেন নি। দুটি কারণে ব্যর্থ হয়েছিল , প্রথম কারণ, ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা গৃহের ভিতরের স্থাপত্য থেকে আরম্ভ করে সাপ্তাহিক উপাসনা, উপাসনা-পদ্ধতি প্রভৃতি সবকিছুর উপর খ্রীস্টান গির্জা ও ধর্মের প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ। দেবদেবীর দেবালয় যে-দেশের গ্রামে গ্রামে, গৃহে গৃহে যেখানে গৃহদেবতা অতিদরিদ্রের অতিসরল অনাড়ম্বর পদ্ধতিতে উপাস্য, সেখানে দেবতা ও তাঁর উপাসনার প্রতি এই ‘intellectual’ বা বুদ্ধিযুক্তিসর্বস্ব মনোভঙ্গি কখনই সমাজে সাধারণজনগ্রাহ্য হতে পারে না। দ্বিতীয় কারণ, এরই অনুসিদ্ধানত - গজদনতমিনার বা প্রাসাদশীর্ষ থেকে কেবল নিরপেক্ষ বুদ্ধি ও যুক্তির সুতীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করে, অথবা বিমুর্ত মানবতা-বোধসম্ভূত হৃদয়াবেগের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে কোনো জনসমাজে কখনও ধর্মসংস্কার করা যায় না। তা যদি করা যেত তাহলে রাজপুত্র গৌতম বুদ্ধ থেকে কবীর দাদূ নানক শ্রীচৈতন্য সকলেই হিন্দুসমাজের ও হিন্দুধর্মের কাঠাম পাল্টে ফেলতে পারতেন। তা যদি করা যেত, তাহলে বিংশ শতাব্দীর প্রায় চতুর্থ পাদে পৌঁছেও আমরা হিন্দুধর্মের এরকম মধ্যযুগীয় উৎকট স্বরূপপ্রকাশে স্তম্ভিত হতাম না।
রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজ তাঁর ব্যক্তিত্বমুগ্ধ কয়েকজনমাত্র সহগামীর সংকীর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নব্যধনিক জমিদার ও শহরের নতুন রাজা-মহারাজা। যেমন টাকীর জমিদার, তেলিনীপাড়ার জমিদার, ভূকৈলাস-খিদিরপুরের রাজা প্রভৃতি। এঁদের পক্ষে ব্রহ্মোপাসনার মর্ম বোঝা দূরে থাক, হিন্দুধর্ম ও সমাজের সাংস্থানিক গঠনে আঘাত করা প্রত্যক্ষভাবে তাঁদের শ্রেণীস্বার্থ ও স্থিতস্বার্থের বিরোধী ছিল। তাই রামমোহনের অনুপস্থিতিতে ও অবর্তমানে তাঁরা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে প্রায় গোঁড়া হিন্দু হয়ে ওঠেন। দ্বারকানাথের বদান্যতায় ব্রাহ্মসমাজের অস্তিত্ব বজায় থাকে বটে, কিন্তু তার আদর্শ নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক দীক্ষার ব্যবস্থা করে এবং নিজে দীক্ষা নিয়ে ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ’ব্রাহ্মসমাজ’ থেকে ’ব্রাহ্মধর্মে’র রূপ দেন। তিনি বলেন ’পূর্বে ব্রাহ্মসমাজ ছিল, এখন ব্রাহ্মধর্ম হইল।’ কিন্তু হিন্দুধর্মেরই বিশাল পরিধির মধ্যে যখন নতুন ’ব্রাহ্মধর্ম’ হল তখন চিরাগত নীতি অনুযায়ী অন্যান্য বহু উপাসক-সম্প্রাদায়ের মতো ব্রাহ্মদের আর-একটি সম্প্রদায়-রূপে হিন্দুসমাজ ধীরে ধীরে নির্বিবাদে আত্মসাৎ করে নিল। তারপর শুধু অতিনির্দিষ্ট সঙ্কীর্ণ সীমানার মধ্যে ‘peaceful coexistence’ ছাড়া তার আর কিছুই করণীয় রইল না।
ঊনিশ শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে একথা ঠিক যে কেশবচন্দ্র সেন বলিষ্ঠ প্রগতিশীল আদর্শে - যেমন স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রীস্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ প্রভৃতি - ব্রাহ্মসমাজকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন - কিন্তু যে বিস্তৃত চোরাবালির ভূমি আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, অবশেষে কেশবচন্দ্র নিজেই তাতে প্রোথিত হলেন। হিন্দুধর্মের সনাতন ইনস্টিটিউশন গুরুবাদ অবতারবাদ তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এই সময় আদিব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনও ‘Brahmoism is Hinduism’ কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং তার অন্যতম প্রবক্তা হন রাজনারায়ণ বসু। ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ ও নীতির এই করুণ পরিণতির পর ঊনিশ শতকের চতুর্থ পাদে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের বিজয় অভিযান স্বাভাবিক। প্রধানত শহরবাসী শিক্ষিত এলিটের ideologicalআন্দোলন - যার ‘spread effect’ I ‘expansionary momentum’ প্রায় ছিল না বলা চলে, তা আতসবাজির মতো চমক সৃষ্টি করতে পারে - যেমন প্রায় বছর দশেকের জন্য ঊনিশ শতকের তিরিশের দশকে করেছিলেন ডিরোজীয়ান ইয়ং বেঙ্গল দল - কিন্তু তার স্থায়ী দান বিশেষ থাকে না। কতকগুলি প্রগতিশীল ‘values’ I‘ideas’-এর যে ‘সেডিমেণ্ট’ বা তলানি পড়ে থাকে সমাজমনের উচ্চস্তরে, পরে নতুন অবস্থানতরে নতুন নিরিখে তার পুনর্মূল্যায়ন হয়। যেমন বর্তমানে হচ্ছে। সে যাই হোক, ঊনিশ শতকের ধর্মসংস্কার প্রসঙ্গে আরও একটু বলা যায় এই যে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরাও ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের প্রতিপাদ্য ছিল এই যে প্রাচীন হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সমাজ-রাষ্ট্রের মধ্যে আধুনিক যুগের সমস্ত প্রগতিশীল ভাবাদর্শ নিহিত আছে - সাম্য গণতন্ত্র স্ত্রীশিক্ষা স্বাধীনতা, পুরুষ-নারীর সামাজিক সমান অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি - তার জন্য নতুন কোনো আদর্শ বাইরে থেকে আমদানি করা অর্থহীন। ঊনিশ শতকের প্রথম পর্বের‘ওরিয়েণ্টালিস্ট’ - যাঁরা প্রাচীন সংস্কৃতবিদ্যা শিক্ষার প্রচলন করতে চেয়েছিলেন - এবং শেষ পর্বের ’রিভাইভালিস্ট’দের মনোভঙ্গি ও যুক্তির মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নেই। উভয়েরই বক্তব্য হল সবই প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে ও হিন্দু ধর্মে আছে, গীতায় সাম্যবাদ পর্যনত। এইটাই হল সবচেয়ে মারাত্মক বিপজ্জনক চিনতাধারা, যার প্রভাব থেকে আজ পর্যনত আমাদের দেশের অনেক ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানী, সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতা মুক্ত হতে পারেন নি। আমাদের দেশের এই চিনতাধারা ও ধারণা সম্বন্ধে মীরডাল তাঁর Asian Drama গ্রন্থে সুন্দর একটি মনতব্য করেছেন। তিনি বলেছেন ‘this may be good tactics, but it is bad sociology’। বাস্তবিকই তাই। দেশের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত জনসমাজকে বিভ্রানত করার দিক থেকে এবং তাদের অসাড় নিসপন্দ করে রাখার দিক থেকে এ কৌশল খুব ভাল , কিন্তু সামাজিক বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে সনাতন হিন্দুধর্মের মতো একটি অটল ’ইনস্টিটিউশন’ কতকগুলি সামাজিক ইনস্টিটিউশনের শক্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সব কয়টি হল জাতিভেদ বর্ণবৈষম্য গুরুবাদ প্রভৃতি সামাজিক অসাম্য এবং মুল অর্থনৈতিক অসাম্যের ‘hardened institutions of inequality’ কাজেই সবই যে বেদ-উপনিষদ-গীতায় আছে, সনাতন হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতশাস্ত্রে আছে, একথা বলা ‘good tactics’, কিন্তু ‘bad sociology’. এই চিনতাধারা আজও আমাদের সমাজে বেশ সক্রিয় থাকার ফলে এবং যন্ত্রোন্নয়ন-শিল্পোন্নয়নের সংঘাত সামনততান্ত্রিক ভিত্তির শিথিলতার মধ্যে অর্থনৈতিক অসাম্য-বৈষম্য অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, বর্তমানে তাই দেখা যায় ধর্মের পুরাতন institutional power-structures যেন ক্রমে আরও শক্তিশালী হচ্ছে - গুরুবাদ পৌত্তলিকতা অবতারবাদ জাতিভেদ ধর্মানুষ্ঠান অত্যধিক মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে - বিশেষ করে বাংলাদেশের শহরে-নগরে ও তার উপকণ্ঠে। শুধু এই বিষয়টি সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের একটি চমৎকার ক্ষেত্র হতে পারে, অত্যনতinteresting - কেবল মধ্যবিত্তদের নানারকমের নৈরাশ্য ও ব্যর্থতা বিচারের দিক থেকে নয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পাশ্চাত্ত্যবিদ্যার পলেস্তারার উপর প্রাচীন ধর্মীয় ইনস্টিটিউশনের আঘাত লাগলে কিভাবে যে তা এখনও সহজে খসে যেতে পারে সেই দিক থেকে, এবং millenarianism বা স্বপ্নস্বর্গ কামনা ও পরিত্রাতাmessiah-র প্রভাব যে মধ্যবিত্তের মানস-স্তরের কত গভীরে পর্যনত প্রবেশ করতে পারে, সেই বিষয় অনুশীলনের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম বিশেষ ঘটে নি। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন বোধহয় ঊনিশ শতকের সবচেয়ে বড় সমাজসংস্কার আন্দোলন, যা শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রাম্যসমাজে পর্যনত খানিকটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, এবং বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সর্বভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হবার পর ঊনিশ শতকের শেষ পর্যনত কয়েকটিমাত্র বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তার অধিকাংশই বিদ্যাসাগরের নিজের উদ্যম ও অর্থব্যয়ে অথবা তাঁর একানত ভক্তদের প্রচেষ্টায়। তাও দেখা গেছে বিধবাবিবাহ যাঁরা করতে অগ্রণী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে সাময়িক অর্থলোভে শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, কোনো আদর্শপ্রীতির জন্য বিবাহ করেন নি। বিদ্যাসাগর নিজেও তা বুঝতে পেরে শেষজীবনে হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন। বিধবাবিবাহ হিন্দুসমাজ গ্রহণ তো করেই নি, শিক্ষিত উচ্চসমাজে যাঁরা আদর্শের দিক থেকে একদা তা সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারেন নি। বিধবাবিবাহের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সামাজিক প্রথা, যেমন নারীর অর্থনৈতিক পরাধীনতা, যৌথপরিবার, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি - যেমন ছিল ঠিক তেমনি রেখে শুধু প্রথা হিসেবে বিধবাবিবাহ সমাজে প্রচলিত হতে পারে না। আর যে প্রথাগুলির কথা উল্লেখ করলাম সেগুলিও সমাজের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তির আধুনিক রূপানতর ছাড়া পরিবর্তিত হতে পারে না। তাই বিধবাবিবাহ ব্যর্থ হয়েছে, নারীর পরাধীনতা, যৌথপরিবার সবই বজায় থেকেছে, এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিবারণের জন্য শেষ পর্যনত ইংরেজরাই কোনো আইন পাস করতে চান নি। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো পাশ্চাত্ত্যবিদ্যায় শিক্ষিত শ্রেষ্ঠও আইন প্রয়োগ করে এই ধরনের সমাজসংস্কারের বিরোধী ছিলেন। শিক্ষিত বাঙালী এলিটের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চয় গণ্য হতে পারেন এবং সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রেও শিক্ষিত এলিটের মন যে চিরায়ত সামাজিক প্রথা ও ইনস্টিটিউশনের কতদূর আবদ্ধ হয়ে ছিল, তা এই দৃষ্টানত থেকে বোঝা যায়।
ইয়োরোপীয়ান এলিটের আদর্শপুষ্ট হয়ে এদেশের শিক্ষিত এলিট গড়ে উঠেছিল। সেই আদর্শের বীজ থেকে অঙ্কুর, এবং অঙ্কুর থেকে গাছ ফল ফুল হবার মতো দেশের মানুষের মনের মাটি তৈরি হয় নি, তার কারণ তার উপযুক্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ রচিত হয় নি। তার উপর এই শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর সামাজিক উৎপত্তিও বাংলার নবজাগরণের প্রবাহকে কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে নিয়ন্ত্রিত করেছে। প্রধানত হিন্দুসমাজের উচ্চস্তর থেকে, অর্থাৎ উচ্চবর্ণের ধনিক ও সচ্ছল মধ্যবিত্তের স্তর থেকে আধুনিক বাঙালী এলিটের উদ্ভব হয়েছে। এক কথায় ঊনিশ শতকের বাঙালী এলিটকে উচ্চবর্ণের সঙ্গতিপন্ন হিন্দু মধ্যবিত্ত ‘এলিট’ বলা যায়। তার ফলে এই এলিটগোষ্ঠী-অনুপ্রাণিত ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন হিন্দুসমাজ কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। প্রায় ঊনিশ শতকের শেষ পর্যনত বাংলাদেশে শিক্ষিত মুসলমান এলিটগোষ্ঠীর বিকাশ হয় নি বলা চলে। ব্রিটিশের ক্রমবর্ধমান প্রশাসন-যন্ত্রের নানা শ্রেণীর চালক ও কর্মচারী সরবরাহের জন্য যে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা হিন্দুরাই বেশি আয়ত্ত করেছিলেন বলে এই স্তরের চাকরিজীবীদের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালী হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল। ধনিক ও মধ্যবিত্তের স্তরে বাঙালী হিন্দুদের সঙ্গে বাঙালী মুসলমানদের বিচ্ছেদ তো হয়েছিলই, শিক্ষিত এলিটের স্তরেও হয়েছিল। এই কারণে বাংলাদেশে যে সামাজিক রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ট্রাজিডি ঘটেছে, তাও ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে অস্বীকার করা যায় না। যদি ঐতিহাসিক সত্য বিকৃত না করে বাংলাদেশ থেকে আধুনিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও ক্রমবিকাশের ইতিবৃত্ত রচনা করতে হয় তাহলে তা মূলত হিন্দু জাতীয়তাবোধের বিকাশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এইভাবে বাঙালী মুসলমানসমাজ ঊনিশ শতকের শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে, পরবর্তীকালে নতুন উদীয়মান বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত এলিটশ্রেণী স্বভাবতই অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে জাতীয় আন্দোলনের ধারার সঙ্গে একাত্মীয়তা স্থাপন করতে পারেন নি। তার আগেই উভয় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক সামাজিক দূরত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল খণ্ডিত বাংলাদেশ এবং খণ্ডিত ভারত।
ঊনিশ শতকের নবজাগরণের অনুপ্রেরণার মূলে যে প্রগতির ধ্যানধারণা - ‘idea of progress’ সক্রিয় ছিল, তারই বা স্বরূপ কি? ফরাসী বিপ্লব ও ইংলণ্ডের শিল্পবিপ্লব, বাষ্পীয় শক্তি, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ , ইলেকট্রিসিটি, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রচালিত শিল্পোৎপাদনের প্রসার ইত্যাদির জন্য যে বাস্তব সামাজিক পরিবেশ ইংলণ্ডে গড়ে উঠেছিল, পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক দার্শনিক মনীষী ও শিল্পী-কবিদের প্রগতির চিনতাধারায় তারই প্রতিফলন হয়েছিল। প্রত্যক্ষ ‘material progress’-এর উপর ideas of progress’ রচিত হয়েছিল। তার চারিদিকে ছিল মানুষের দুঃসাহসিক অভিযান ও অগ্রতি - অর্থনীতি ও বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে। যদিও এই উন্নতি ও প্রগতি প্রধানত বর্ধিষ্ণু বুর্জোয়াশ্রেণী ও নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণীর জন্য নির্ধারিত, তাহলেও তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। রেলপথ ও রেলগাড়ির গতির মতো প্রগতির ধারণাও হল সরল ও যান্ত্রিক। কবি টেনিসন যখন লিভারপুল থেকে ম্যাঞ্চেস্টারের রেলপথে প্রথম যাত্রা করেন, তখন ১৮৩০ সালে, তিনি লেখেন!
Let the great world spin forever down the ringing grooves of change.
১৮৫১ সালে লণ্ডনের বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রদর্শনীতে বাস্তব অগ্রগতির নিদর্শন সকলকে দেখানো হয়েছিলEdinburgh Review (October 1851)তখন প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য জানিয়ে লেখেন যে এই বিরাট মেলার লক্ষ্য ‘to seize the living scroll of human progress, inscribed with every successive conquest of man’s intellect.’ ইংলণ্ডের বাস্তব পরিবেশ থেকে উদ্ভূত এই প্রগতির ধ্যানধারণা ইংরেজ শাসক ও এলিটগোষ্ঠী আমাদের দেশের এলিটগোষ্ঠীর মস্তিষেক রোপণ করেছিলেন, সম্পূর্ণ অবাস্তব পরিবেশে। ভৌগোলিক ও সামাজিক নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে তার ফলে বাংলাদেশে কিছুটা আদর্শগত আলোড়ন হয়েছিল এবং যতটা হয়েছিল সেই অনুপাতে সামাজিক সুফল ফলে নি। পুরাতন মধ্যযুগীয় সামাজিক ইনস্টিটিউশনের লৌহপ্রাচীরে প্রতিহত হয়ে প্রগতির ভাবধারা প্রতিক্রিয়ার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রায় চতুর্থ পাদে পৌঁছেও আমরা তাই আজ বাংলার সমাজে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার বিচিত্র সহাবস্থান দেখতে পাই - ধর্মীয় গুরুবাদ থেকে রাজনৈতিক মার্কস্বাদ, সর্বক্ষেত্রে। জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন সেই ঊনিশ-শতকীয় সঙ্কীর্ণ মধ্যবিত্ত-মানস আজও আমাদের বুদ্ধি ও চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বাংলাদেশে তাই আজ অলিগলিতে, পাড়ায় পাড়ায় ধর্মীয় গুরু, Messiah ও অবতারের প্রাদুর্ভাব, প্রত্যেক মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে অনতত একজন করে তরুণ আধুনিক কবি ও কমিউনিস্টের আবির্ভাব, প্রত্যেক অঞ্চলে মহকুমায় ও থানায় একটি করে মার্কসবাদী ও সোশ্যালিস্ট দল - একজন ব্যক্তি বা‘গুরু’- কেন্দ্রিক - প্রত্যেক মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক মার্কসবাদী - শুধু বিশেষত্ব এই যে তিনি কমিউনিস্ট-বিরোধী, বিশেষ করে যে কমিউনিস্টরা বড্ড বেশি masses-এর মুখ চেয়ে শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলে এবং বিশিষ্ট সভ্য ভদ্রলোকের মতো পার্লিয়ামেণ্টারি কায়দায় মার্কসবাদী আন্দোলনের কথা বলে না, আধুনিক শিক্ষায়তনের পাশাপাশি পেশাদার অ্যাস্ট্রলজারের চেম্বার, ভীড়ের চাপ দু’জায়গাতেই সমান, কোনোরকমে লিখতে-পড়তে শিখেছেন এরকম বাঙালীর মধ্যে অনতত শতকরা কুড়িজন ‘ক্রিয়েটিভ’ সাহিত্যিক অর্থাৎ অরিজিন্যাল গল্প উপন্যাস কবিতা লেখেন এবং তাঁদের সৃজনীপ্রতিভার স্ফুরণ অশিক্ষিত অমার্জিত শিশ্নপরায়ণতার(‘genitality’) মধ্যে, ফ্রয়েডীয়ান অর্থে eroticism-এ নয়, কিঞ্চিৎ অর্থের মালিক এ রকম বহু বাঙালী নামে গালভরা ’ব্যবসায়ী’ আসলে নেপোশ্রেণীর নিকৃষ্ট দালাল এবং অবাঙালী মোনোপলিস্ট পুঁজিপতির আজ্ঞাবহ মাল-যোগানদার দাসানুদাস - এ রকম সব বিচিত্র সামাজিক উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত অদ্ভুত মধ্যবিত্ত হবুচন্দ্রের রাজ্য বাংলাদেশের মতো দেশ কোথাও আছে কি না সন্দেহ। এও অনেকটা আমাদের ঊনিশ শতকের মধ্যবিত্ত এলিটগোষ্ঠী অনুপ্রাণিত নবজাগরণের উত্তরাধিকার, কেবল আকারে ও বিকারে অনেক পরিবর্ধিত। কার্ল মার্ক্সের ‘alienation’ এবং এমিল ডুর্কহাইমের ‘anomie’-র সামাজিক অনুসন্ধানের আদর্শক্ষেত্র আজ বাংলাদেশ। কিন্তু সেটা আলোচনার যোগ্য বিষয়, আপাতত আমাদের আলোচনা নয়।*আমাদের কথা হল, বাংলাদেশের বিশাল বর্ধিষ্ণু জনসমাজে কিছুদিন আগে পর্যনত যারা মার্ক্সের ভাষায়‘submen’ ছিল, অর্থাৎ যারা তাদের শক্তি ও শোষিত সত্তা সম্বন্ধে সচেতন ছিল না, তারা আজ তাদের ‘sub-humanity’ সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠছে এবং সেই মানবেতর অস্তিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। প্রাথমিক রাষ্ট্রিক ও নাগরিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে এই বিদ্রোহ তাদের সার্থক হলে, ভবিষ্যতে তারা আমাদের লিখিত ইতিহাস-সাহিত্য-সংস্কৃতির পুনর্মূল্যায়ন করবে এবং তখন অনেক অধুনা প্রচলিত মূল্যায়নের মানদণ্ড আবর্জনাস্তূপে নিক্ষিপ্ত হবে। বইপত্র তো হবেই । তখন অনেক রূঢ় মানসিক আঘাতের হাত থেকেও আমরা নিষকৃতি পাব না। বিশিষ্ট বাঙালী মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকরা হয়ত তখন বর্তমানের ক্লাব হোটেল আড্ডাখানা ও ’সুইট হোম’ ছেড়ে অরণ্যবাসী হতে চাইবেন। কিন্তু বর্তমানের মিলেনারিয়ানিজম্, অ্যানোমি, অ্যালিয়েনেশন ও মার্কসইজম্-এর সমন্বয়, ঊনিশ শতকের ‘ব্রাহ্মইজম্’ ও ‘হিন্দুইজম’-এর মতো অথবা ইয়ং বেঙ্গলের‘রেডিকালিজম্’ ও আশী-নব্বই-এর দশকের হিন্দু ‘রিভাইভ্যালিজম্’-এর সমন্বয়ের মতো, অরণ্যেও সম্ভব হবে না, অনতত বাংলাদেশের সীমাবদ্ধ জনারণ্যে তো নয়ই।
*আমার নতুন বই ‘মেট্রোপলিটন মন, মধ্যবিত্ত, বিদ্রোহ’-এর মধ্যে এবিষয়ে একাধিক প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। (১৯৭৮) - লেখক
[সৌজন্যে : বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, প্রকাশক : ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ ::১৯৯৩,
উপরের প্রবন্ধটি লেখকের বাংলার নবজাগৃতি গ্রন্থের ১৯৭০ সালের সংযোজন হিসাবে প্রকাশিত হয়। - বঙ্গরাষ্ট্র]
অনলাইন : ১০ জুলাই, ২০০৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন