রবীন্দ্র কবিতায় বৈশাখ

পৃথিবীর কলেবরে প্রকৃতি আর মানুষের কলরব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার অন্যতম দিক। কবি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি এবং প্রকৃতির অংশ হিসেবে নিজেকে ভাবতেই ভালোবেসেছেন। পৃথিবীর রঙ-রূপ-ঋতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আলোড়িত করেছে সারাজীবন। তাই কবির দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ_'আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত ওঠে ধ্বনি আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার লাগিবে তখনি,...'(ঐকতান/জন্মদিনে)

প্রকৃতির পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্যগুলো সহসা কবির উপলব্ধিতে সাড়া জাগিয়েছে। আর সে কারণে রবীন্দ্র কবিতায় আমাদের ভূগোল, আমাদের পঞ্জিকার মাসগুলো অনায়াসে স্থান করে নেয়। সেই সব মাসের উচ্চারণ যেমন প্রকৃতি দর্শন তেমনি প্রকৃতি কখনো অনুসঙ্গ, কখনো প্রসঙ্গ, কখনো তত্ত্ব-তথ্যের প্রতীকী ছোঁয়ায় নতুন ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। 

বাঙালির পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখ। বাঙালি জাতি পৃথিবীর অন্যান্য জাতি থেকে স্বতন্ত্র হয়ে যায় তাদের নিজস্ব পঞ্জিকার জন্য। রবীন্দ্র কবিতায় বাঙালি ঐতিহ্য-বোধ আর শিকড়স্পর্শী অনুভূতি রবীন্দ্র চেতনার উল্লেখযোগ্য দিক। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে কবি বাঙালির মর্মে-ধর্মে-কর্মের বিষয়াদিসহ প্রতিবেশ আর পরিবেশের সঙ্গে আমাদের বাঙালির যে সম্পর্ক সে সমস্ত কিছুকে কবিতায় ধারণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে বাঙালির নববর্ষের সূচনা মাস বৈশাখ রবীন্দ্র কবিতায় যথেষ্ট গুরুত্বসহ উপস্থাপিত হয়।

বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। এই জন্ম মাসের সঙ্গে কবির জন্মসূত্রেই নাড়ির টান। যদিও বর্ষা অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের প্রসঙ্গ রবীন্দ্র কবিতায় এসেছে বিস্তৃত পরিসর জুড়ে, যেমন- 'কড়ি ও কোমল' (১২৯৩) কাব্যগ্রন্থের 'বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর'; 'মানসী' (১২৯৭) কাব্যগ্রন্থের 'বর্ষার দিনে', 'মেঘদূত'; 'সোনার তরী' (১২৯৮-১৩০০) কাব্যগ্রন্থের 'সোনার তরী'; 'কল্পনা' (১৩০৪-১৩০৮) কাব্যগ্রন্থের 'বর্ষামঙ্গল'; 'ক্ষণিকা' (১৩০৭) কাব্যগ্রন্থে 'আষাঢ়', 'নববর্ষা'; 'গীতাঞ্জলি'র (১৩১৩-১৩১৭) 'আষাঢ়সন্ধ্যা', 'বর্ষার রূপ' প্রভৃতি। তবে একজন যথার্থ কবি নির্দিষ্ট ঋতুর কিংবা সময়ের হয়ে ওঠেন না, হতে পারেন না। বিশেষ করে রবীন্দ্র-প্রতিভা সংকীর্ণ পরিসরে ক্ষুদ্র পৃথিবীকে দেখেনি। রবীন্দ্র-পৃথিবীর পটভূমি বিশাল। সে পৃথিবীতে রয়েছে জীবনদেবতা, মানুষ, প্রকৃতি আর সবকিছুর সঙ্গে রয়েছে কবির নিবিড় প্রেমের সম্পর্ক। আর সে প্রেমের কারণে রবীন্দ্র কবিতার কোনো কিছুই তুচ্ছ হয়ে যায় না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু কবিতায় বৈশাখের উল্লেখ রয়েছে। কবি বৈশাখের প্রকৃতির বিশিষ্টতাকে অনুধাবন করতে চেয়েছেন, দেখেছেন প্রকৃতির রুদ্র-বিষণ্ন রূপ। বৈশাখ কবির কাছে কখনো বার্তা বয়ে এনেছে, কখনো প্রতীক হয়ে ধরা দিয়েছে। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী একজন সার্থক কবির পক্ষেই এক বিষয়কে একাধিক চিত্রকল্প হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছে। রবীন্দ্র-কবিতায় বৈশাখ একাধিক বোধের উপস্থাপক। 'কল্পনা' কাব্যগ্রন্থে 'বৈশাখ' কবিতায় কবি বলেন_
'হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,
ধূলায় ধূসর রুক্ষ্ম উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপ্তঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক_হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?...' ( বৈশাখ/কল্পনা )

বৈশাখের শুষ্ক-রুক্ষ্ম প্রকৃতি আমাদের চিন্তা-চেতনায় ব্যক্তি ইমেজ হয়ে ধরা দেয়। সেই ব্যক্তি ইমেজ নিয়ে যায় আমাদের ভারতীয় পৌরাণিক ইমেজ ভৈরব অর্থাৎ শিব চরিত্রের কাছে। কবি দীপ্তচক্ষু শীর্ণ সন্ন্যাসী বৈশাখকে তার উগ্র ভয়াল রূপ ত্যাগ করে পদ্মাসনে বসতে বলেন। বিগত বছরের অবস্থা কবির কাছে অস্পষ্ট থাকে না। কবি জানেন নতুন বছরের সূচনায় পৃথিবীর পরিত্যক্ত গত বছর ভস্মীভূত মৃত বছরে পরিণত হয়। কবি বৈশাখকে আহ্বান করেন শান্তিময় মন্ত্র উচ্চারণের জন্য। রবীন্দ্রনাথ ভৈরব-রূপ সেই প্রকৃতিকে নিয়ে যান বিশ্ব প্রকৃতির কাছে, বিশ্ব সংসারের কাছে। যে সংসারের লক্ষ-কোটি নারী-পুরুষের হৃদয় ক্ষুধা-তৃষ্ণা-জরা-মৃত্যুর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। গেরুয়া যে বসন বৈরাগ্যের প্রতীক কবি শিব রূপ বৈশাখকে সে আবরণের দ্বারা এসব কাতর-হৃদয় মানবের উত্তরণের অনুরোধ জানান।

কবিতার শেষ চরণগুলোতে কবি বৈশাখকে শিবের রুদ্রমূর্তির ভয়াল গর্জনের আহ্বান জানান তাতে কবির মধ্যাহ্ন-তন্দ্রায় অলস সময়-যাপন থেকে নিজে উদ্ধার পাবেন, বেরিয়ে আসবেন খোলা স্থানে, দরজার বাইরে। চেয়ে দেখবেন বৈশাখের  নীরব-নিস্তব্ধ-নির্বাক দুপুর। 

'বৈশাখ' কবিতায় এক দিকে সমগ্র মানবের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা অন্যদিকে কবির আপন সংকটের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসবার তাড়না স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রাণহীন শুষ্ক প্রান্তর এড়িয়ে কিংবা না দেখে মধ্যাহ্ন তন্দ্রায় কিংবা নিদ্রায় নিজেকে আড়ালে নিরাপদে রাখার মতো ভীরুতা কবির কাম্য নয়। কখনো ভেতরের তাগিদ সৃষ্টি না হলে প্রয়োজন হয় বাইরের উদাত্ত আহ্বান, হোক তা ভৈরব গর্জনের মতন_ কবি তাকেই কামনা করেন।

'বলাকা' কাব্যগ্রন্থের 'ছবি' কবিতাটির মাঝে বৈশাখের প্রসঙ্গ এসেছে। পটে লিখা স্থির ছবির বিপরীত চিত্র হিসেবে এসেছে বৈশাখ। কবিতার ভাষায়_ 
'...এই ধূলি
ধূসর অঞ্চল তুলি 
বায়ুভরে ধায় দিকে দিকে,
বৈশাখে সে বিধবার আভরণ খুলি
তপস্বিনী ধরণীরে সাজায় গৈরিকে,...' (ছবি/বলাকা)

কবি বৈশাখে চঞ্চলতা দেখেছেন_ যে চঞ্চলতা জীবনের আরেক নাম। বিধবা নারীর রূপ ছেড়ে বৈশাখে প্রকৃতি প্রাণময় হয়ে ওঠে। 

বৈশাখের প্রকৃতির রঙে কবি রবীন্দ্রনাথ গেরুয়া রঙ দেখেছেন। গেরুয়া রঙ বৈরাগ্যের প্রতীক। বৈশাখ তেজোদ্বীপ্ত, শিবের মতোন ভয়াল রূপ ধারণক্ষম, আবার বিধবার বেশ ছিন্নকারী সাহসীর মতো। রবীন্দ্রনাথ বৈশাখের তুমুল বেগের মাঝে দেখেছেন ক্ষিপ্রতা আর সাহসিকতা, গেরুয়া রঙের মাঝে দেখেছেন পৃথিবীর বৈরাগ্য। প্রসঙ্গ ক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন রবীন্দ্র কবিতায় ঋতু পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনেক সময় শিবের রুদ্রমূর্তির তুলনা এনেছেন। বর্ষার আগমন বার্তায়ও কবি ভৈরব প্রসঙ্গ এনেছেন_
'ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রসে...' ( বর্ষামঙ্গল/কল্পনা )

ভারতীয় পূরাণ আর ঐতিহ্য রবীন্দ্র কবিতার অনন্য দিক। এই কবিতায় কবি বর্ষার আগমনেও দেখছেন ভৈরবরূপী দাপট। 

'বলাকা' কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা 'বলাকা'য় জড়ের মাঝে জীবনের যে স্পন্দন কবি অনুভব করেছেন সেখানে নিশ্চল পর্বত বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ হতে চেয়েছে _
'...পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;...' (বলাকা/ বলাকা)

অসাধারণ চিত্রকল্পে গতির যে শিল্পিত প্রকাশ তা আমাদের চির পরিচিত জড়ত্বে জীবনমুখীন উপলব্ধির সন্ধান দেয়। 'বলাকা' কাব্য প্রসঙ্গে নীহারঞ্জন রায় বলেন-'কিন্তু তত্ত্ব কাব্য নয়, এবং তত্ত্ব হিসেবে বলাকা বিচার্যও নয়।... রসাশ্রিত সত্য কাব্য হয়ে দেখা দেয়।' _ (রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা) বলাকা কবিতায় সেই রসাশ্রিত সত্য অসাধারণ ভঙ্গিমায় উপস্থাপিত হয়েছে। বৈশাখের মেঘের নিরুদ্দেশ যাত্রা দেখে অচল পর্বত বৈশাখের মেঘ হতে চাওয়ায় স্থিতির গতিপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। বৈশাখের মেঘ এখানে গতির প্রতীক।
নাহিদ হক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন