ভূমিকা ও অনুবাদ : মোজাফ্ফর হোসেন
[জেমস জয়েস (১৮৮৪-১৯৪১)-এর জন্ম আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ আয়ারল্যান্ডের বাইরে কাটলেও তাঁর প্রায় প্রতিটা লেখায় ডাবলিন শহরের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। লেখক হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে বেশ কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়েছে। শুরুর দিকে কোনো প্রকাশনীই তাঁর বই প্রকাশ করতে আগ্রহ দেখায়নি। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গল্প সংকলন ‘ডাবলিনার্স’।
‘এরাবি’(১৯০৫) এই সংকলনের উল্লেখযোগ্য একটি গল্প। বিশ্ব সাহিত্যে সর্বাধিক পঠিত গল্পগুলোর একটি। একজন তরুণের বেড়ে ওঠার গল্প এটি। এখানে একজন নিষ্পাপ তরুণের আপন সত্তা, স্বদেশ ও জীবনমূখী যে যাত্রা সেটা শেষ পর্যন্ত তিক্ত অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। আপাতদৃষ্টিতে গল্পটিকে সাধারণ রোমান্টিক গল্প বলে মনে হলেও এর গভীরতা অনেক। এরাবি এখানে শুধু একটি বাজার নয়, একটি তরুণের স্বদেশ এর প্রতিচ্ছবিও বটে, একইভাবে, মানগানের বোনও শুধু সাধারণ একজন মানবী নয়, বরং একজন বালকের কাছে তার অস্তিত্ব জন্মভূমি-তুল্য। গল্পে যে চাচার কথা বলা হয়েছে তাকে জয়েস-এর বাবা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে কেননা বাবার সাথে জয়েস-এর সুসম্পর্ক ছিল না মোটেও। কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন গল্পের ন্যারেটর হল ‘একজন তরুণ শিল্পীর প্রতিকৃতি’ ও ‘ইউলিসিস’ এর স্টিফেন ডেডালুসের প্রটোটাইপ।
জয়েস-এর আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস ‘একজন তরুণ শিল্পীর প্রতিকৃতি’ (১৯১৬) ও ‘ইউলিসিস’ (১৯২২) বিশ্বসাহিত্যে সর্বাধিক পঠিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম। জয়েসকে ধরে নেওয়া হয় বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক হিসেবে। এবং ‘ইউলিসিস’কে মনে করা হয় ঐ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। কবি হিসেবেও জয়েস-এর বেশ সুখ্যাতি আছে।
------------------------------------------------------------------------------------
নর্থ রিচমন্ড সড়কটি ছিল এক নিঝুম কানা গলি। খালি খ্রিস্টার্ন ব্রাদার্স স্কুলটি ছুটি হলে কয়েক মিনিটের জন্যে জেগে উঠতো গলিটা, তারপর আবার যা তাই। গলির শেষের এক ফালি চৌকো জমিতে একটা দোতলা বাড়ি ছিল। পরিত্যক্ত। বাদ বাকি বাড়িগুলো নিজ নিজ আভিজাত্যের গল্প আগলে বাদামি শীতল চোখে একে অন্যের মুখের দিকে চেয়ে থাকতো। আমাদের পেছনের দিকের বড় ঘরটায় ভাড়া থাকতেন এক পাদ্রি। ঐ কোঠাতেই মারা যান তিনি। মৃত্যুর কুয়াশায় ঐ কোঠার বন্ধ বাতাস ছিল ভারাক্রান্ত। রান্না ঘরের পেছনের ঘরটি ভর্তি অকাজের জিনিসে--পুরনো কাগজ, ছেঁড়া বই এইসবে। ঐ জঞ্জালের ভেতর আমি বাঁধানো অল্প পাতার কয়েকটা বই পেয়েছিলাম। বইগুলোর পাতা পুরনো হতে হতে ছিদলা ও ভাজ পড়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে হলুদ পৃষ্ঠার একটা বই১ ছিল। ঐ হলদেটে রঙের টানেই সেটি ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। বাড়ির পাশের বাগানটির অবস্থা তখন জঙ্গল হবার জোগাড়। মাঝখানে একটা আপেল গাছ ছিল এবং এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ঝোপ বেড়ে উঠেছিল। এমনি একটি ঝোপের আড়ালে পেয়েছিলাম আমাদের মৃত ভাড়াটের জং পড়া একটি সাইকেল-পাম্পার। মানুষটি ছিলেন বেশ পরোপকারী প্রকৃতির। মৃত্যুর আগে উইল করে সমস্ত টাকা পয়সা সেবা প্রতিষ্ঠানে দান করে গেছেন এবং ঘরের আসবাবপত্রগুলো দিয়ে গেছেন বোনকে।
শীতের ছোট দিনগুলোতে আমাদের সন্ধ্যার খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই ঘন ঘোর নেমে আসতো। পথে নেমে দেখতাম বাড়িগুলো মুখ গোমড়া করে কি যেন ভাবছে! মাথার উপরের আকাশ দ্রুত সন্ধ্যা-রঙে রাঙিয়ে উঠতো। রাস্তার বাতিগুলো মিটমিট করে তারার মতো জ্বলে উঠতো। শীতে বাতাসের ছোঁবলে আমাদের শরীর টাটিয়ে যেত। যতক্ষণ না আমাদের শরীর ঠা-ায় ঝলসে যেত আমরা খেলা বন্ধ করে বাড়ি ফিরতাম না। আমাদের হৈ-হুল্লড় নীরব রাস্তার চতুর্দিকে বাড়ি খেয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলতো। খেলতে খেলতে আমরা বাড়ির পাশের কাদা থকথকে অন্ধকার চোরা গলিতে ঢুকে পড়তাম। অন্ধকারে আচ্ছন্ন বাগানের ভেতর থেকে পোড়া কয়লার গন্ধ এসে নাকে বাড়ি মেরে আবার অন্ধকারে হারিয়ে যেত। আমরা যখন ফিরে আসতাম তখন রান্নাঘরের জানালা চুইয়ে আলোতে আলোতে রাস্তা ভিজে যেতো। যদি চাচাকে রাস্তার বাঁকে দেখতে পেতাম তাহলে তিনি বাড়িতে না ঢোকা পর্যন্ত অন্ধকারে গা ঢাকা দিতাম। অথবা যদি মানগানের বোন২ দরজার মুখে দাঁড়িয়ে মানগানকে চা পানের জন্যে ডাকতে আসতো, আমরা ছায়ার ভেতর থেকে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। অপেক্ষা করতাম সে ভেতরে যায় না দাঁড়িয়ে থাকে সেটা দেখার জন্যে; দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা ছায়ার ভেতর থেকে বের হয়ে মানগানের সঙ্গে হাঁটা শুরু করতাম। অর্ধ নগ্ন দরজায় তার দাঁড়িয়ে থাকা দেখলেই বোঝা যেত সে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। তার ভাই যখন তার সাথে এটাওটা নিয়ে খুনসুটি করতো, আমি তখন রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে দেখতাম। নড়ার সাথে সাথে তার পোশাকে ঢেউ খেলে যেতো এবং তার কোমল বেণি এদিক ওদিক দুলতে থাকতো।
প্রতি সকালবেলায় আমি সামনের মেঝেতে উপুড় হয়ে তার দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দরজা ইঞ্চি খানিক ফাঁক করে রাখতাম যাতে করে বিপরীত দিক থেকে আমাকে না দেখা যায়। যখন সে দরজার গোঁড়ায় পা রাখতো তখন আমার হৃদপি- কেঁপে উঠতো। আমি ভেতর থেকে দুই একটি বই যত্রতত্র হাতে তুলে ছুটে যেতাম রাস্তায়। তার বাদামী চেহারা আমার চোখের ভেতর গেঁথে যেতো এবং যখন আমরা পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে যেতাম, আমি গতি কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে দ্রুত সরে যেতাম। সকালের পর সকাল একই ঘটনা ঘটতো। দুই একটি সাধারণ কথাবাত্রা ছাড়া বিশেষ কোনো শব্দ বিনিময় হয়নি আমাদের মাঝে; অথচ তার নাম যেন আমার সমস্ত শরীরের রক্ত কণাকে আজ্ঞাবহ করে তুলেছিল।
যেখানে প্রেম ভালোবাসার কথা মাথায় থেকে ছুটে যাওয়ার কথা, সেখানেও তার উপস্থিতি আমি টের পেতাম। প্রতি শনিবার সন্ধ্যা বেলায় চাচী বাজারে যেতেন, আর তাঁকে সাহায্য করার জন্যে আমাকেও যেতে হতো। আমরা চওড়া রাস্তার ভেতর দিয়ে মাতাল আর বেশ্যাদের ঠেলে হেঁটে যেতাম। শ্রমিকরা খিস্তি দিয়ে এদিক-ওদিক অভিশাপ ছুড়ে মারতো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করতো একদল ভিখারি। তারা গান গেয়ে স্মরণ করতো আমাদের জন্মভূমির সমস্যাগুলো অথবা তারা গান গাইতো জনপ্রিয় হিরো ডাইনামিট রোসাকে নিয়েÑ আন্দোলনের জন্যে ব্রিট্রিশরা যাকে জেলে ঢুকিয়েছিল।
রাস্তার এই সমস্ত শব্দগুলো একটি সুর হয়ে আমার জীবনে অনুরণন সৃষ্টি করতো। আমি কল্পনা করতাম যে আমি নিরাপদে আমার পানপাত্র৩ বহন করে চলেছি একদল শত্রুর মধ্য দিয়ে। অদ্ভূত সব প্রার্থনায় তার নাম আমার ঠোঁটের ডগায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতো, যার অর্থ আমি নিজেই বুঝতে পারতাম না। মাঝে মধ্যে আমার চোখ জলে টলটল করতো, আমি বলতে পারবো না কেন। কখনো কখনো মনে হতো আমার হৃদয় নিজের খোঁড়া হৃদে নিজেই যেন হাবুডুবু খাচ্ছে। আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি ভাবতাম না। জানতাম না তার সাথে আদৌ কথা হবে কি না : যদি কথা হয়ও তবে কিভাবে তাকে আমি আমার এই গভীর অনুভূতির কথা জানাবো! আমার শরীর যেন একটি হার্প এবং তার কণ্ঠ ও অঙ্গভঙ্গি যেন রোজই সেটা বাজিয়ে যায়!
একদিন সন্ধ্যায় পেছনের ড্রয়িং রুমে গেলাম যেখানে পাদ্রি মারা গিয়েছিল। সেটা ছিল অন্ধকার বৃষ্টিস্নাত এক সন্ধ্যা এবং ভেতরটা ছিল শুনশান শব্দহীন। একটা ভাঙ্গা প্যানের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর বুকে আঁচড়ে পড়া বৃষ্টি ফোঁটার আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিছুদূরে একটি আলোকিত জানালা জ্বলজ্বল করছিল। আমি ওইটুকু দেখতে পেয়েই আবেগে আপ্লুত হলাম। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় পর্দার আড়ালে সরে যেতে চায়ছিল। মনে হচ্ছিল আমি খুব দ্রুত তাদের কাছ থেকে ছিটকে যাচ্ছি। আমি এক হাত আরেক হাতের তালুতে চেপে ধরে থাকলাম যতক্ষণ না তারা কেঁপে উঠলো। আমার ভেতর থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো : ‘আমার প্রেম! আমার ভালবাসা!’ অনেকবার।
অবশেষে একদিন সে আমার সাথে কথা বলল। যখন সে আমাকে ডাকলো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি বলে শুরু করবো। সে জানতে চাইলো আমি এরাবিতে যাচ্ছি কি না। মনে পড়ছে না সেদিন কি উত্তর দিয়েছিলাম।
‘এটা বিশাল একটা বাজার।’ সে বলেছিল। ‘যেতে পারলে খুব ভাল লাগতো।’
‘তাহলে যাও না কেন?’ আমি জানতে চেয়েছিলাম।
কথা বলার ফাঁকে সে তার হাতের সোনালী ব্রেসলেটটা ঠিক করে নিলো। কি সুন্দর মলিন মসৃণ গোলাকার তার কব্জি!
‘আমার যাওয়া হবে না।’ সে বলেছিল। কেননা ঐ সপ্তাহে তাদের আশ্রমে৪ একটা অনুষ্ঠান ছিল।
তার ভাই এবং আরও দুইজন ক্যাপ কাড়াকাড়ি করছিল এবং আমি রেলিং-এর ধারে একাকী দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে আমার দিকে হালকা ঝুকে একটা পেরেক ধরে নাড়াচাড়া করছিল। বিপরীত দিক থেকে আসা ল্যাম্পের আলোয় তার ফর্সা গলার প্রতিটা রেখা স্পস্ট হয়ে উঠেছিল। তার এলোমেলো চুল, স্কার্টের সাদা বর্ডার, রেলিং ধরে রাখা সুন্দর হাত সবকিছু যেন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
‘তুমি যাচ্ছ তাহলে! ভাল।’ সে বলল।
‘যদি যাই, তাহলে তোমার জন্যে কিছু একটা নিয়ে আসবো।’ বললাম আমি।
ঐ সন্ধ্যার পর থেকে কত রকম আজগুবি সব চিন্তা উঠতে বসতে আমাকে পাগল করে তুলেছিল। ঐ বাজে দিনগুলোকে জীবন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারলে বেশ ভাল হত। স্কুলের কথা মনে হতেই বিরক্ত লাগতো। রাতে শোবার ঘরে এবং দিনে শ্রেণিকক্ষে তার ছবি আমার বইয়ের প্রতিটা পৃষ্ঠায় অক্ষর হয়ে গেঁথে যেতো। এরাবি শব্দের প্রতিটা বর্ণ আমার স্বপ্ন বিলাসী মনের নির্জনতা ভেদ করে নাড়িয়ে যেতো। শনিবার রাতে বাজারে যাব বলে চাচীকে জানালাম। চাচী খুব বিস্মিত হলেন এবং ভাবলেন আমি যাতে প্রটেস্টট্যান্টদের চক্রান্তের স্বীকার না হয়। আমি ক্লাসে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। দেখলাম শিক্ষকের মুখ কেমন কোমল থেকে কঠিন রূপ নিলো। তিনি আশা করেছিলেন আমি অলস হয়ে যাচ্ছি না। আমি আমার ভবঘুরে চিন্তাগুলোকে লাইনে আনতে পারছিলাম না। সত্যি বলতে আমার ধৈর্য্যরে পাল্লা বেশ পাতলা ছিল, তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিলো এটা একটা বাচ্চাদের খেলনা, যেটা খুব কুৎসিত এবং কদাকার।
শনিবার সকালে চাচাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে সন্ধ্যায় আমি বাজারে যেতে চাচ্ছি। হলের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি কি যেন ভাবছিলেন। তিনি গা না করে বললেন--
‘হুম। জানি।’
যেহেতু তিনি হলের ভেতরে ছিলেন সেহেতু আমি ঐ সামনের জানালার পাশে তাকে দেখার জন্যে যেতে পারছিলাম না। বেশ নিরস মুডে বাসা ছেড়ে স্কুলের দিকে রওনা হলাম। বাতাস ছিল কর্কষ, দানা দানা। আমার ভেতরে ভেতরে একটা সঙ্কার দানা বেঁধে উঠছিল।
যখন আমি বিকালে বাড়ি ফিরলাম দেখলাম চাচা তখনো বাড়ি ফেরেননি। তখনো বেশ সময় ছিল। কিছুক্ষণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম এবং যখন এটার টিকটিক শব্দ ভেতরে জ্বালা ধরাতে শুরু করলো তখন ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপর তলায় উঠে গেলাম। খালি স্যাঁতসেঁতে রুমগুলো আমাকে মুক্তি দিলো। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সবগুলো রুম ঘুরে দেখলাম। সামনের জানালার ফাঁক গলিয়ে দেখলাম, সঙ্গীরা সব রাস্তায় খেলতে শুরু করেছে। তাদের হৈহুল্লোড় আমার ভেতরের ক্লান্তিকে ছুঁয়ে গেল। মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে শীতল গ্লাস ভেদ করে তাদের অন্ধকারের চাদড় মোড়ানো বাড়িটার দিকে তাকালাম। আমি বোধহয় ঘণ্টা খানেক ঐ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তেমন কিছুই দেখলাম না শুধু কল্পনার সাহায্যে সেই বাদামী চেহারার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকার ওই দৃশ্যটি ছাড়া।
যখন আমি আবার নিচে নেমে আসলাম, দেখলাম মিসেস মারসার চুলার আগুনের পাশে বসে আছেন। তিনি ছিলেন বয়স্ক বাগ্মী মহিলা; এক মহাজনের বিধবা স্ত্রী। তিনি পরিত্যক্ত স্ট্যাম্প গোছাতেন কি একটা ধর্মীয় উদ্দেহ্য হাসিলের জন্যে! আমাকে তাদের চায়ের টেবিলের গালগল্প সহ্য করতে হতো। খাবার দিতে আরো এক ঘণ্টার মতো দেরি হলো, চাচা তখন পর্যন্ত বাড়ি ফেরেননি। মিসেস মারসার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি দুঃখিত যে তিনি আর কিছুক্ষণ থাকতে পারছেন না। আটটা বেজে গেছে, কিন্তু তিনি বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকতে চান না কেননা রাতের হাওয়া তার সহ্য হয় না। যখন তিনি চলে গেলেন আমি আঙুল মটকাকে মটকাতে একবার ঘরের ভেতর যাই, একবার বাইরে আসি। চাচী বললেন--
‘আমার মনে হয় আজ তোমার বাজারে না যাওয়াই ভাল।’
রাত ন’টার সময় বাইরের দরজায় চাচার চাবির আওয়াজ পেলাম। শুনতে পেলাম তিনি নিজের সাথে কথা বলছেন। আমি ঐ শব্দকে ব্যাখ্যা করতে পারতাম। যখন তার খাওয়া মাঝ পর্যায়ে, আমি তখন বাজারে যাওয়ার টাকা চাইলাম। তিনি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।
‘লোকজন এখন বিছানাতে। একঘুম শেষ হল বলে।’ তিনি বললেন।
আমি হাসতে পারলাম না। চাচী জোর দিয়ে তাঁকে বললেন--
‘তুমি ওকে টাকাটা দিয়ে দিলেই তো পারো। তুমিই তো দেরি করালে।’
চাচা ভুলে যাওয়ার জন্যে খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন যে তিনি ঐ পুরানো প্রবাদে বিশ্বাস করেন--
‘অল ওয়ার্ক এন্ড নো প্লে মেকস জ্যাক এ ডাল বয়।’
তিনি জানতে চায়লেন কোথায় যাচ্ছি। আমি যখন দ্বিতীয় বারের মতো বললাম, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আরবের বিখ্যাত গীতি কবিতা ‘ঘোড়ার জন্যে বিদায়গীতি’৫ আমি জানি কি না। যখন আমি রান্নাঘর ছেড়ে আসলাম তখন তিনি ঐ গীতি কবিতার শুরুর লাইনগুলো চাচিকে শোনানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
আমি দুই শিলিং খুব শক্ত করে ধরেছিলাম যখন বাকিংহাম সড়ক থেকে স্টেশনের দিকে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তার চারিদিকে ক্রেতাদের জটলা ও চোখ ধাঁধানো আলো দেখে আমি আমার যাত্রার উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে আবারো অবগত হলাম। প্রায় ফাঁকা ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির বগিতে গিয়ে বসলাম। অসহনীয় দেরি করার পর ট্রেনটি খুব ধীরে ধীরে স্টেশন থেকে বের হয়ে যেতে শুরু করলো। ট্রেনটা ধ্বংশপ্রায় ঘর বাড়ি ও চকচকে নদীর উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ওয়েস্টল্যান্ড রো স্টেশনে একদল লোক বগির দরজা খোলার চেষ্টা করলে টিটি গিয়ে বললেন যে এটি শুধুমাত্র বাজারের যাত্রী বাহি ট্রেন। আমি একটি কামরায় একাকী বসে ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনটি কোনো মতে কাঠ দিয়ে তৈরি করা স্টেশনের পাশ কাটিয়ে চলতে শুরু করলো।
আমি রাস্তায় নেমে একটি বড় আলোকিত ঘড়িতে দেখতে পেলাম দশটা বাজতে তখন দশ মিনিট বাকি। সামনে দাঁড়িয়ে বিশাল একটি ভবন যার ফটকে ঐ বিস্ময়কর শব্দটি৬ লেখা ছিল।
আমি ছয় পেনির প্রবেশ দ্বার খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বাজার বন্ধ হয়ে যাবে এই ভয়ে একটি দরজায় ক্লান্ত চেহারার একজন লোকের হাতে এক শিলিং ধরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। বিশাল একটি হলের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। প্রায় সবগুলো দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং হলের বেশির ভাগ অংশ তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। প্রার্থনার পর চার্চে যেমন চারিদিক থেকে নীরবতা এসে পরিব্যাপ্ত করে রাখে তেমন শুনশান নীরবতার উপস্থিতি ওখানে টের পাচ্ছিলাম। ভয়ে ভয়ে বাজারের মাঝ বরাবর হেঁটে যাচ্ছিলাম। কিছু লোকজন এখনো খোলা একটি দোকানের সামনে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটি পর্দার ওপরে বিভিন্ন রঙের আলো দিয়ে লেখা ছিল ক্যাফে চ্যানট্যান৭, সেখানে দাঁড়িয়ে দুজন ব্যাক্তি একটি সালভারের৮ ওপর টাকা গুনছিল। কয়েন পতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। খুব কষ্ট করে আমাকে মনে করতো হলো আমি কেন এখানে এসেছি। একটি দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম এবং চিনা মাটির দানি ও ফুল আঁকা চায়ের কাপগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলাম। দোকানের মুখেই এক কম বয়সী মহিলা দু’জন ভদ্র-যুবার সাথে কি নিয়ে যেন মসকরা করছিল! আমি তাদের কথা বলার ভঙ্গিমা লক্ষ্য করলাম এবং কি নিয়ে আলোচনা করছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
‘না। কখনও এমন কথা বলিনি।’
‘না না, তুমি বলেছ।’
‘আমার মনে হয় না আমি বলেছি।’
‘সে (মেয়েটি) কি বলেনি?’
‘হ্যাঁ। আমি তাকে বলতে শুনেছি।’
‘হুম, গুল মারছেন আপনারা!’
আমাকে এটাওটা নাড়তে দেখে মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে এসে জানতে চাইলো আমি কিছু কিনতে চাই কি না। তার কথা শুনে আমার কাছে কিছু বিক্রি করার ব্যাপারে তাকে উৎসাহী বলে মনে হল না। দোকানের গেটের দুই দিকে অল্প আলোয় দণ্মাডায়মান দুটি বড় দানির দিকে একবার বিনম্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম--
‘না। ধন্যবাদ আপনাকে।’
মেয়েটি একটা দানির অবস্থান পরিবর্তন করে আবার ভদ্র-যুবা দ্বয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। তারা আবার ঐ পূর্বের বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করলো। কথা বলার ফাঁকে এক থেকে দুই বার মেয়েটি তার কাঁধের ওপর দিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকালো।
আমি তার দোকানের সামনে ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করলাম, যদিও জানতাম তার কোনো মানে হয় না। বোধহয় তার দোকানের ঐ পণ্যগুলোর প্রতি আমার আগ্রহটাই এর মূল কারণ। তারপর আমি ধীর পায়ে ওখান থেকে সরে আসলাম। হাতের দুই পেনিকে পকেটের ছয় পেনির মধ্য ছেড়ে দিলাম। হলের এক প্রান্ত থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল যে কিছুক্ষণের মধ্যে সব আলো নিভে যাবে। উপরের অংশ ইতোমধ্যে অন্ধকারে অস্ত গেছে।
অন্ধকারের সাথে চোখাচোখি হতেই আমি আত্মশ্লাঘা তাড়িত ও উপহাসমূলক জীব হিসেবে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করলাম-- নিদারুণ যন্ত্রণা ও ক্ষোভে আমার চোখ জোড়া ঝলসে গেলো।
টীকা :
১. দ্য এবোর্ট : ওয়াল্টার স্কট
২. মানগানের বোন : গল্পে প্রটাগনিস্ট-এর প্রতিবেশি তরুণী। কিন্তু এখানে স্মরণ করা হয়েছে আইরিশ কবি ক্লারেন্স মানগান (১৮০৩-৪৯) ও তাঁর জনপ্রিয় কবিতা ‘ডার্ক রোজালিন’, যেখানে আয়ারল্যান্ডকে রুপবান তরুণীর সাথে তুলনা করা হয়েছে যার প্রেমে কবি কাতর ছিলেন।
৩. পানপাত্র : এখানে সেই চ্যালিস বা পানপাত্রকে বোঝানো হয়েছে যেটা যিশু খ্রিস্ট তাঁর ‘লাস্ট সাফারে’ ব্যবহার করেছিলেন।
৪. মানগানের বোন যে আশ্রমের স্কুলে পড়তো, সপ্তাহের একটি বিশেষ দিনে সেখানে ধর্মীয় আচারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো।
৫. ঘোড়ার জন্যে বিদায়গীত’ : জনপ্রিয় কবি ক্যারোলিন নরটন (১৮০৮-৭৭)-এর একটি গীতিকবিতা, যেখানে একজন মরূভূমির যাযাবর লোভের বসে তার প্রিয় ঘোড়াটিকে বিক্রি করে দেয়। তারপর সে অনুশোচনায় ভোগে এবং তার স্বর্ণমুদ্রা ফেরত দিয়ে ঘোড়াটি ফিরিয়ে নেয়।
৬. এরাবি
৭. ক্যাফে চানটান্ট : প্যারিস-এ একধরনের দোকানকে বোঝানো হয় যেগুলো বিনোদনের জন্যে অনেক রাত অবদি খোলা থাকে।
৮. সালভার : ট্রে বা একটি বড় থালা, পবিত্র কোনো অনুষ্ঠানে পরিবেশনার কাজে ব্যবহার করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন