প্রতিদিন
যাত্রীর হাঁকাহাঁকি চিৎকার আর চেঁচামেচিতে পূর্ণ হোসেনপুর স্টেশন। পূব-পশ্চিমমুখো রেললাইনের
একপাশে স্টেশনের অফিস ঘর ও যাত্রীদের অপেক্ষা করবার স্থান। এর উল্টোদিকে স্টেশনের পুরোনো
কিছু জীর্ণ ঘর। মালগাড়ির পুরোনো বগিসহ কয়েকটি গুদামঘরের অস্তিত্ব এখানে টের পাওয়া যায়।
দুপাশের দুটো রাস্তা শহরের দিকে প্রবেশ করেছে।
শহরের
মাঝখান থেকে যে রাস্তাটা স্টেশনে এসে মিশেছে সেটা দিয়ে অসংখ্য যাত্রী দিনে-রাতে প্রবেশ
করে, বের হয়। তারই পাশে কয়েকটি স্টেশনারি দোকান। সিগারেট ও খিলিপানের দোকানিরা চট কিংবা
ছালা বিছিয়ে বাণিজ্য করতে বসেছে।
নিশুতি
রাতের স্টেশনে দু একটি দোকান খোলা। আধ খোলা আধ বন্ধ দোকানের একপাশে কয়েকজন উদ্বাস্তু
মাঘ মাসের শীত উপেক্ষা করবার জন্য চট দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছে। দিনের আলোয় যে ভিক্ষুকের
দল স্টেশনের এ-মাথা ও-মাথা সুর করে ভিক্ষে করে বেড়ায় তারাও আশ্রয় নিয়ে আছে এক কোনায়।
এদের সবার অদূরে কিঞ্চিৎ আলাদা হয়ে এক পাগলী শীতে কোঁকাচ্ছে। সারাদিন শহরে ও স্টেশনে
মানুষের কাছে এটা-সেটা চেয়ে-খুঁজে খেয়ে-দেয়ে স্টেশনের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনাটিকে সে
বেছে নিয়েছে।
হোসেনপুর
স্টেশনে বেশ কয়েক বছর থেকেই এই পাগলীকে দেখা যায়। কবে সে এখানে এসেছে তার খবর অবশ্য
কেউ রাখার প্রয়োজন মনে করে না। আর রাখলেই বা চলবে কেন। এরকম কতো মানুষই তো স্টেশনে
রাস্তার ধারে রাত কাটায়। স্টেশনে বৃদ্ধ টুনু মিয়াই কেবল পাগলীর খোঁজ খবর রাখে। টুনু
মিয়া বহু বছর ধরে এখানকার স্টেশনেÑ কখনো রাস্তার পাশে চট করে বসা যায় আবার গুটানো যায়
এমন দোকান দিয়ে ছাতা মেরামত করে থাকে।
টুনু
মিয়া ডাক দিলে পাগলী তার কথা খুব মনোযোগের সাথে শোনে। তারপর অকস্মাৎ একদিকে ছুটে যায়।
টুনু মিয়ার কথা শুনলে পাগলী আপনি একটু হেসে আবার চিৎকার করতে করতে স্টেশনের অন্যপ্রান্তে
চলে যায়।
‘তোর বাড়ি কই? কোত্থেকে এসেছিস?’ এসব প্রশ্নের জবাবে পাগলী প্রথমে
হাসে, তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদে, আবার হেসে একদিকে চলে যায়। নিজের মনে বিড়বিড় করে
সে কি ভাষা উচ্চারণ করে তা কারো বোঝার সাধ্য নেই।
হোসেনপুর
স্টেশন। কতো অপরিচিত মানুষের আনাগোনা এখানে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কতো নাম না জানা মানুষের
ভিড় তারও কোনো সীমারেখা নেই। তার মধ্যে নগণ্য পাগলী আপন খেয়ালে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।
কারো সঙ্গে ঝগড়া করছে। অকারণেই কাউকে গালি দিচ্ছে। লোকজন ক্ষেপে গেলে কিছুক্ষণ পরই
হয়তো বুঝতে পেরেছে আসলে পাগলী। প্রতিদিন কুড়িয়ে পাওয়া ছেঁড়া ন্যাকড়া, কাপড়ের টুকরোসহ
আরো নানা রকমের সামগ্রী এনে স্টেশনের ঐ কোনাটিতে জড়ো করছে।
টুনু
মিয়া পাগলীর দিনের বেলার অভিভাবক হলেও সন্ধ্যার আগেই তার অভিভাবকত্ব শেষ হয়। সে শুধু
জানে ময়লা ছেঁড়াখোড়া কাপড়ে ভরা স্টেশনের এক নির্দিষ্ট কোনায় পাগলী ঘুমায়। রাতের বেলা
পাগলী কী করে তা কারো দেখার মনোযোগ নেই। রাত্রের ট্রেন এলে সে একবার এদিক একবার ওদিক
যাতায়াত করে। যাত্রীদেরকে নানা কথা বলে। কেউ তার দিকে ফিরে চায় কেউ আবার বিরক্ত হয়ে
তাকায়। কেউ দয়া করে একটা বা দুটো টাকা পাগলীর হাতে দেয়। সে আবার এসে শুয়ে পড়ে তার আস্তানায়।
সব রাত সে আবার ঘুমায়ও না।
স্টেশনের
যে দিকটায় সে আস্তানা করেছে তার কিঞ্চিৎ পাশের ভাঙা ঘরে নেশাখোরদের আশ্রয়স্থল। সন্ধ্যা
থেকেই সেখানে তাদের আড্ডা বাড়তে থাকে। রাত যতো গভীর হয় তাদের পাশবিক উৎসবও ততো বেশি
মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যেন। স্টেশনের গার্ড পুলিশ সবাই তাদের ব্যাপারে জানে যদিও নিবৃত্ত
করার উপায় খুঁজে পায় না। বরং পুলিশদের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব অনেকের নজর এড়ায় না।
রাত্রের
স্টেশনের নারকীয় দৃশ্য যারা চোখে দেখেনি তাদের জন্য হোসেনপুর স্টেশন উল্লেখযোগ্য জায়গা।
এখানে নরক গুলজার করতে আসা নানা লোকের মিশ্রণ মনের কোনায় একধরনের ভীতি জাগিয়ে তোলে।
স্টেশনে ট্রেন থেকে কোনো যাত্রী একা নেমে পড়লে তার চোখে সে দৃশ্য চরমভাবে ফুটে ওঠে।
এক ধরনের গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে তাকে স্টেশনের পরিবেশ পাড়ি দিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরতে
হয়। তার মধ্যে দু একটি চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
নিত্যদিনকার
স্টেশনের পরিবেশে অভ্যস্ত উদ্বাস্তু মানুষদের কিন্তু এ ধরনের কোনো ভীতি নেই। এর মধ্যেই
ছালার ডেরা বেঁধে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ছালার ওপর কিছু মানুষ নির্বিঘেœ রাত্রি যাপন করে।
কোনো নারকীয় পরিবেশই তাদের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। একটুখানি মাথা গুঁজতে পেলেই হলো।
কিন্তু তাদের নির্বিকার জীবনেও পাগলী একটি আসন্ন আশঙ্কা ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা
পাগলীর পাগলামো দিন দিন বাড়তে থাকে।
এই
পাগলামোর পেছনে তার মানসিক পীড়ার কথা জানলেও শারীরিক কোনো কারণকে সহসা আবিষ্কার করা
যায় না। পাগলী আগেও দু বার অনন্ত এ ধরনের প্রচ- আচরণ করেছিল। টুনু মিয়া ছাড়া অন্য কেউ
সে ইতিহাস মনে রাখে না। বিশেষত স্টেশনে যারা আসে কয়েকটি নেশাখোর ছাড়া তেমন কেউ দীর্ঘসময়
এখানে থাকে না। এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশন ঘুরে বেড়ায়। কয়েকটি দোকান থাকলেও নিজেদের
বেচাবিক্রি নিয়ে তারা মশগুল থাকে।
ছাতা
মেরামতকারী টুনু মিয়ার ভাবান্তর লক্ষ করা যায়। কতো লোকেরই তো সে ছাতা মেরামত করে। কোনো
বাছবিচার নাই। শ্রেণিবিশেষ নাই। পুলিশ থেকে শুরু করে স্টেশন মাস্টার কুলি গার্ড গাড়ির
স্বল্পবিরতির প্যাসেঞ্জার আরো কতো জনের। একেকটি ছাতা মানুষকে রোদ বৃষ্টিকে উপেক্ষা
করে নির্বিঘœ পথ চলার উপায় খুঁজে দেয়। পয়সার বিনিময়ে হলেও এতো লোকের উপকার করতে পেরে
তার মনে নিজের কর্ম সম্পর্কে একটি সমীহের ভাব আসে। শুধু একটি বিষয়ে তার মন সান্ত¦না
পায় না তা পাগলীর বিষয়ে।
অন্তঃসত্ত্বা
পাগলীর পেট বড় হতে থাকে। একেক দিন বমি করে ভাসায় স্টেশনের প্লাটফর্ম। গার্ড এসে তাকে
দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। পাগলী পড়ে থাকে স্টেশনের একপাশে তার কুড়ানো সামগ্রীর মাঝখানে।
কেউ একজন হয়তো রাতের অন্ধকারে জোর করে পাগলীকে ধর্ষণ করে। প্রবল ঝড়ের এক রাতে ঝড় থেমে
গেলে সুনসান নীরবতার মধ্যে ঘুমন্ত পাগলীর মুখ চেপে ধরে স্টেশনের নিরাপত্তারক্ষী পুলিশ।
ন
মাস পরÑ পাগলীকে কয়েকদিনের জন্য খুঁজে পাওয়া যায় না। পাগলীকে প্রতিদিন দেখতে অভ্যস্ত
চোখগুলো তাকে খুঁজে ফেরে কিছুক্ষণ। তারপর যে যার কাজে মন দেয় আবার। টুনু মিয়া আশপাশের
কয়েকটি স্টেশনে ট্রেনে চেপে তাকে খুঁজে আসে। কোথাও না পেয়ে হতাশ হয়। ছাতা মেরামত করতে
আসে নিরাপত্তা পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করে টুনু মিয়া কই। আশপাশ থেকে খবর আসে ‘বেটিক খুঁজব্যার গেইচে মনে হয়।’
‘আদিখ্যেতা’।
টুনু
মিয়া এলে নিরাপত্তা পুলিশ ধমকায়, ‘ঐ মিয়া গেছিল্যা কই? পেটওয়ালী পাগলীর জন্যে এত্ত দরদ ক্যান
তোমার।’
টুনু
মিয়া কিছু না বলে নীরবে চেয়ে থাকে তার দিকে।
আবার
ধমক, ‘স্টেশনে কাম করব্যার চাইলে আমার
কামটা আগে করা লাগবে। বুঝলা বুড়া। নাইলে এ জাগায় থাকব্যার পারবা না। কাম গুটায়্যা নিয়্যা
ভাগা লাগবে। ম্যালা লোক আছে, কাম করব্যার জন্যে জায়গা চায়।’
কয়েকদিন
পর পাগলী আবার ফিরে আসে। সেই আগের মতো স্টেশনে হইচই হাঙ্গামা আর কথার তুবড়ি ছোটায়।
কিন্তু তার পেটের শিশুটি কোথায় সে প্রশ্ন সবার চোখে লেগে থাকে। টুনু মিয়া তাকে জিজ্ঞেস
করে। কোনো সদুত্তর পায় না। পাগলীর কাছে আবার সদুত্তর কি? অন্যান্য অনেক কিছু ভোলার
মতো পাগলী তার সন্তানের কথা বেমালুম ভুলে যায়। এই ইতিহাস একবার নয় কয়েকবার ঘটে। শুধু
পুলিশ নয়, স্টেশনে আসা নানা বখাটে আর অজানা মানুষের শিকার হয় পাগলী।
কয়েকদিন
পরের ঘটনাÑ কেউ একজন পাগলীকে নদীর ঘাটে জঙ্গলের কাছে দেখে। তার কথা শুনে সবাই অনুমান
করে জঙ্গলের শেয়াল কিংবা গাড়োয়া জাতীয় কোনো প্রাণি বাচ্চাটাকে সাবাড় করেছে।
কিছুক্ষণ
পর একটি কুকুরের মুখে হাড্ডি নিয়ে দৌড়াতে দেখে নিরাপত্তা পুলিশসহ স্টেশনের গার্ড। পুলিশের
চোখে পড়তেই সে কুকুরটির দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে। আরেক দিন জঙ্গলের ভেতর থেকে বের হচ্ছে
কুকুরটি। পুলিশ তা চেয়ে দেখে সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে আসার পথে। তখনি সাইকেল ফেলে কুকুরের
পেছনে সেও কুকুরের মতো দৌড়াতে থাকে। কুকুর হাড্ডি ফেলে দিয়ে ঘেউ ঘেউ করে তার দিকে তেড়ে
আসতে গিয়ে আবার পালাতে শুরু করে। সেও কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।
তার
সমস্ত আত্মার শক্তি নিঃশেষিত হতে থাকে তবু সে হাল ছাড়ে না। বাইরের লোক দেখতে থাকে নিরাপত্তা
পুলিশ একটি কুকুরে পরিণত হয়েছে। ঘেউ ঘেউ করে স্টেশনের দিকে সে আসতে থাকে। সেও অনুভব
করতে থাকে ভেতরের কুকুরটা তার বাইরে এসেছে। সে এসে পাগলীর পায়ের কাছে অচেতন পড়ে থাকে।
অন্যদিকে পুলিশের দৃষ্টিপথ অনুসরণকারী ঐ কুকুরটিও দৌড়ে আসে। তারপর প্রভুভক্তের মতো
পাগলীর নিত্যসঙ্গী হয়। পুলিশ-রূপী কুকুরটাকে সে অস্বাভাবিক ঘেউ ঘেউ শব্দে বিতাড়িত করে।
সে-বিতাড়নে আরো কয়েকটি জন্তুর গায়ে আঁচড় পড়ে; তাদের কারোরই চার পা নেই। হাতিয়ার হাতে
থাকলেও মানুষরূপী দু পা বিশিষ্ট জানোয়ারগুলো কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়। এ-ঘটনায় উপস্থিত
সকলেই যার পর নাই অবাক হয়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধ টুনু মিয়া।
হোসেনপুর
স্টেশনে এ-রকম আশ্চর্য ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। প্রতিদিন
যাত্রীর হাঁকাহাঁকি চিৎকার আর চেঁচামেচিতে পূর্ণ হোসেনপুর স্টেশন। পূব-পশ্চিমমুখো রেললাইনের
একপাশে স্টেশনের অফিস ঘর ও যাত্রীদের অপেক্ষা করবার স্থান। এর উল্টোদিকে স্টেশনের পুরোনো
কিছু জীর্ণ ঘর। মালগাড়ির পুরোনো বগিসহ কয়েকটি গুদামঘরের অস্তিত্ব এখানে টের পাওয়া যায়।
দুপাশের দুটো রাস্তা শহরের দিকে প্রবেশ করেছে।
শহরের
মাঝখান থেকে যে রাস্তাটা স্টেশনে এসে মিশেছে সেটা দিয়ে অসংখ্য যাত্রী দিনে-রাতে প্রবেশ
করে, বের হয়। তারই পাশে কয়েকটি স্টেশনারি দোকান। সিগারেট ও খিলিপানের দোকানিরা চট কিংবা
ছালা বিছিয়ে বাণিজ্য করতে বসেছে।
নিশুতি
রাতের স্টেশনে দু একটি দোকান খোলা। আধ খোলা আধ বন্ধ দোকানের একপাশে কয়েকজন উদ্বাস্তু
মাঘ মাসের শীত উপেক্ষা করবার জন্য চট দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছে। দিনের আলোয় যে ভিক্ষুকের
দল স্টেশনের এ-মাথা ও-মাথা সুর করে ভিক্ষে করে বেড়ায় তারাও আশ্রয় নিয়ে আছে এক কোনায়।
এদের সবার অদূরে কিঞ্চিৎ আলাদা হয়ে এক পাগলী শীতে কোঁকাচ্ছে। সারাদিন শহরে ও স্টেশনে
মানুষের কাছে এটা-সেটা চেয়ে-খুঁজে খেয়ে-দেয়ে স্টেশনের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনাটিকে সে
বেছে নিয়েছে।
হোসেনপুর
স্টেশনে বেশ কয়েক বছর থেকেই এই পাগলীকে দেখা যায়। কবে সে এখানে এসেছে তার খবর অবশ্য
কেউ রাখার প্রয়োজন মনে করে না। আর রাখলেই বা চলবে কেন। এরকম কতো মানুষই তো স্টেশনে
রাস্তার ধারে রাত কাটায়। স্টেশনে বৃদ্ধ টুনু মিয়াই কেবল পাগলীর খোঁজ খবর রাখে। টুনু
মিয়া বহু বছর ধরে এখানকার স্টেশনেÑ কখনো রাস্তার পাশে চট করে বসা যায় আবার গুটানো যায়
এমন দোকান দিয়ে ছাতা মেরামত করে থাকে।
টুনু
মিয়া ডাক দিলে পাগলী তার কথা খুব মনোযোগের সাথে শোনে। তারপর অকস্মাৎ একদিকে ছুটে যায়।
টুনু মিয়ার কথা শুনলে পাগলী আপনি একটু হেসে আবার চিৎকার করতে করতে স্টেশনের অন্যপ্রান্তে
চলে যায়।
‘তোর বাড়ি কই? কোত্থেকে এসেছিস?’ এসব প্রশ্নের জবাবে পাগলী প্রথমে
হাসে, তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদে, আবার হেসে একদিকে চলে যায়। নিজের মনে বিড়বিড় করে
সে কি ভাষা উচ্চারণ করে তা কারো বোঝার সাধ্য নেই।
হোসেনপুর
স্টেশন। কতো অপরিচিত মানুষের আনাগোনা এখানে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কতো নাম না জানা মানুষের
ভিড় তারও কোনো সীমারেখা নেই। তার মধ্যে নগণ্য পাগলী আপন খেয়ালে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।
কারো সঙ্গে ঝগড়া করছে। অকারণেই কাউকে গালি দিচ্ছে। লোকজন ক্ষেপে গেলে কিছুক্ষণ পরই
হয়তো বুঝতে পেরেছে আসলে পাগলী। প্রতিদিন কুড়িয়ে পাওয়া ছেঁড়া ন্যাকড়া, কাপড়ের টুকরোসহ
আরো নানা রকমের সামগ্রী এনে স্টেশনের ঐ কোনাটিতে জড়ো করছে।
টুনু
মিয়া পাগলীর দিনের বেলার অভিভাবক হলেও সন্ধ্যার আগেই তার অভিভাবকত্ব শেষ হয়। সে শুধু
জানে ময়লা ছেঁড়াখোড়া কাপড়ে ভরা স্টেশনের এক নির্দিষ্ট কোনায় পাগলী ঘুমায়। রাতের বেলা
পাগলী কী করে তা কারো দেখার মনোযোগ নেই। রাত্রের ট্রেন এলে সে একবার এদিক একবার ওদিক
যাতায়াত করে। যাত্রীদেরকে নানা কথা বলে। কেউ তার দিকে ফিরে চায় কেউ আবার বিরক্ত হয়ে
তাকায়। কেউ দয়া করে একটা বা দুটো টাকা পাগলীর হাতে দেয়। সে আবার এসে শুয়ে পড়ে তার আস্তানায়।
সব রাত সে আবার ঘুমায়ও না।
স্টেশনের
যে দিকটায় সে আস্তানা করেছে তার কিঞ্চিৎ পাশের ভাঙা ঘরে নেশাখোরদের আশ্রয়স্থল। সন্ধ্যা
থেকেই সেখানে তাদের আড্ডা বাড়তে থাকে। রাত যতো গভীর হয় তাদের পাশবিক উৎসবও ততো বেশি
মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যেন। স্টেশনের গার্ড পুলিশ সবাই তাদের ব্যাপারে জানে যদিও নিবৃত্ত
করার উপায় খুঁজে পায় না। বরং পুলিশদের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব অনেকের নজর এড়ায় না।
রাত্রের
স্টেশনের নারকীয় দৃশ্য যারা চোখে দেখেনি তাদের জন্য হোসেনপুর স্টেশন উল্লেখযোগ্য জায়গা।
এখানে নরক গুলজার করতে আসা নানা লোকের মিশ্রণ মনের কোনায় একধরনের ভীতি জাগিয়ে তোলে।
স্টেশনে ট্রেন থেকে কোনো যাত্রী একা নেমে পড়লে তার চোখে সে দৃশ্য চরমভাবে ফুটে ওঠে।
এক ধরনের গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে তাকে স্টেশনের পরিবেশ পাড়ি দিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরতে
হয়। তার মধ্যে দু একটি চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
নিত্যদিনকার
স্টেশনের পরিবেশে অভ্যস্ত উদ্বাস্তু মানুষদের কিন্তু এ ধরনের কোনো ভীতি নেই। এর মধ্যেই
ছালার ডেরা বেঁধে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ছালার ওপর কিছু মানুষ নির্বিঘেœ রাত্রি যাপন করে।
কোনো নারকীয় পরিবেশই তাদের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। একটুখানি মাথা গুঁজতে পেলেই হলো।
কিন্তু তাদের নির্বিকার জীবনেও পাগলী একটি আসন্ন আশঙ্কা ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা
পাগলীর পাগলামো দিন দিন বাড়তে থাকে।
এই
পাগলামোর পেছনে তার মানসিক পীড়ার কথা জানলেও শারীরিক কোনো কারণকে সহসা আবিষ্কার করা
যায় না। পাগলী আগেও দু বার অনন্ত এ ধরনের প্রচ- আচরণ করেছিল। টুনু মিয়া ছাড়া অন্য কেউ
সে ইতিহাস মনে রাখে না। বিশেষত স্টেশনে যারা আসে কয়েকটি নেশাখোর ছাড়া তেমন কেউ দীর্ঘসময়
এখানে থাকে না। এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশন ঘুরে বেড়ায়। কয়েকটি দোকান থাকলেও নিজেদের
বেচাবিক্রি নিয়ে তারা মশগুল থাকে।
ছাতা
মেরামতকারী টুনু মিয়ার ভাবান্তর লক্ষ করা যায়। কতো লোকেরই তো সে ছাতা মেরামত করে। কোনো
বাছবিচার নাই। শ্রেণিবিশেষ নাই। পুলিশ থেকে শুরু করে স্টেশন মাস্টার কুলি গার্ড গাড়ির
স্বল্পবিরতির প্যাসেঞ্জার আরো কতো জনের। একেকটি ছাতা মানুষকে রোদ বৃষ্টিকে উপেক্ষা
করে নির্বিঘœ পথ চলার উপায় খুঁজে দেয়। পয়সার বিনিময়ে হলেও এতো লোকের উপকার করতে পেরে
তার মনে নিজের কর্ম সম্পর্কে একটি সমীহের ভাব আসে। শুধু একটি বিষয়ে তার মন সান্ত¦না
পায় না তা পাগলীর বিষয়ে।
অন্তঃসত্ত্বা
পাগলীর পেট বড় হতে থাকে। একেক দিন বমি করে ভাসায় স্টেশনের প্লাটফর্ম। গার্ড এসে তাকে
দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। পাগলী পড়ে থাকে স্টেশনের একপাশে তার কুড়ানো সামগ্রীর মাঝখানে।
কেউ একজন হয়তো রাতের অন্ধকারে জোর করে পাগলীকে ধর্ষণ করে। প্রবল ঝড়ের এক রাতে ঝড় থেমে
গেলে সুনসান নীরবতার মধ্যে ঘুমন্ত পাগলীর মুখ চেপে ধরে স্টেশনের নিরাপত্তারক্ষী পুলিশ।
ন
মাস পরÑ পাগলীকে কয়েকদিনের জন্য খুঁজে পাওয়া যায় না। পাগলীকে প্রতিদিন দেখতে অভ্যস্ত
চোখগুলো তাকে খুঁজে ফেরে কিছুক্ষণ। তারপর যে যার কাজে মন দেয় আবার। টুনু মিয়া আশপাশের
কয়েকটি স্টেশনে ট্রেনে চেপে তাকে খুঁজে আসে। কোথাও না পেয়ে হতাশ হয়। ছাতা মেরামত করতে
আসে নিরাপত্তা পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করে টুনু মিয়া কই। আশপাশ থেকে খবর আসে ‘বেটিক খুঁজব্যার গেইচে মনে হয়।’
‘আদিখ্যেতা’।
টুনু
মিয়া এলে নিরাপত্তা পুলিশ ধমকায়, ‘ঐ মিয়া গেছিল্যা কই? পেটওয়ালী পাগলীর জন্যে এত্ত দরদ ক্যান
তোমার।’
টুনু
মিয়া কিছু না বলে নীরবে চেয়ে থাকে তার দিকে।
আবার
ধমক, ‘স্টেশনে কাম করব্যার চাইলে আমার
কামটা আগে করা লাগবে। বুঝলা বুড়া। নাইলে এ জাগায় থাকব্যার পারবা না। কাম গুটায়্যা নিয়্যা
ভাগা লাগবে। ম্যালা লোক আছে, কাম করব্যার জন্যে জায়গা চায়।’
কয়েকদিন
পর পাগলী আবার ফিরে আসে। সেই আগের মতো স্টেশনে হইচই হাঙ্গামা আর কথার তুবড়ি ছোটায়।
কিন্তু তার পেটের শিশুটি কোথায় সে প্রশ্ন সবার চোখে লেগে থাকে। টুনু মিয়া তাকে জিজ্ঞেস
করে। কোনো সদুত্তর পায় না। পাগলীর কাছে আবার সদুত্তর কি? অন্যান্য অনেক কিছু ভোলার
মতো পাগলী তার সন্তানের কথা বেমালুম ভুলে যায়। এই ইতিহাস একবার নয় কয়েকবার ঘটে। শুধু
পুলিশ নয়, স্টেশনে আসা নানা বখাটে আর অজানা মানুষের শিকার হয় পাগলী।
কয়েকদিন
পরের ঘটনাÑ কেউ একজন পাগলীকে নদীর ঘাটে জঙ্গলের কাছে দেখে। তার কথা শুনে সবাই অনুমান
করে জঙ্গলের শেয়াল কিংবা গাড়োয়া জাতীয় কোনো প্রাণি বাচ্চাটাকে সাবাড় করেছে।
কিছুক্ষণ
পর একটি কুকুরের মুখে হাড্ডি নিয়ে দৌড়াতে দেখে নিরাপত্তা পুলিশসহ স্টেশনের গার্ড। পুলিশের
চোখে পড়তেই সে কুকুরটির দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে। আরেক দিন জঙ্গলের ভেতর থেকে বের হচ্ছে
কুকুরটি। পুলিশ তা চেয়ে দেখে সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে আসার পথে। তখনি সাইকেল ফেলে কুকুরের
পেছনে সেও কুকুরের মতো দৌড়াতে থাকে। কুকুর হাড্ডি ফেলে দিয়ে ঘেউ ঘেউ করে তার দিকে তেড়ে
আসতে গিয়ে আবার পালাতে শুরু করে। সেও কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।
তার
সমস্ত আত্মার শক্তি নিঃশেষিত হতে থাকে তবু সে হাল ছাড়ে না। বাইরের লোক দেখতে থাকে নিরাপত্তা
পুলিশ একটি কুকুরে পরিণত হয়েছে। ঘেউ ঘেউ করে স্টেশনের দিকে সে আসতে থাকে। সেও অনুভব
করতে থাকে ভেতরের কুকুরটা তার বাইরে এসেছে। সে এসে পাগলীর পায়ের কাছে অচেতন পড়ে থাকে।
অন্যদিকে পুলিশের দৃষ্টিপথ অনুসরণকারী ঐ কুকুরটিও দৌড়ে আসে। তারপর প্রভুভক্তের মতো
পাগলীর নিত্যসঙ্গী হয়। পুলিশ-রূপী কুকুরটাকে সে অস্বাভাবিক ঘেউ ঘেউ শব্দে বিতাড়িত করে।
সে-বিতাড়নে আরো কয়েকটি জন্তুর গায়ে আঁচড় পড়ে; তাদের কারোরই চার পা নেই। হাতিয়ার হাতে
থাকলেও মানুষরূপী দু পা বিশিষ্ট জানোয়ারগুলো কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়। এ-ঘটনায় উপস্থিত
সকলেই যার পর নাই অবাক হয়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধ টুনু মিয়া।
হোসেনপুর
স্টেশনে এ-রকম আশ্চর্য ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি।
--†Lv i ‡k ` Av j g
(ভোরের কাগজ-এ প্রকাশের পর পুনর্মুদ্রণ)
------------------------------------------------------------------
------------------------------------------------------------------
পাগলী ও নষ্টভ্রূণ (গল্প), ভোরের কাগজ পত্রিকার লিঙ্ক :
http://www.bhorerkagoj.net/content/2013/04/19/10.jpg
লেখক পরিচিতি :
খোরশেদ আলম : গল্পকার, প্রাবন্ধিক
পেশা : শিক্ষকতা
বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল : khorshed.ju.bngl@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন