সক্রেটিস এর তত্ত্ব ও বিচার পর্ব

ভাস্কর চৌধুরী 

ইয়োরোপ তথা এথেন্সে সক্রেটিসের আগে আরো বিখ্যাত অনেক দার্শনিক তাদের বিখ্যাত তত্ব দিয়ে গেছেন । কাল বিচারে এরা সকলেই সক্রেটিসের আগে থেকে ৫০০ বছর আগের দার্শনিক । এদের ভেতর ছিলে থেলিস , পারমিনাইডিস , হেরাক্লিটাস , পিথাগোরাস , ইউরিপাইডিস । হেরাক্লিটাসের বিখ্যাত উক্তি , ` তুমি এক নদীতে দুবার পা লেখতে পারবে না কারণ তোমার উপর দিয়ে সর্বদাই নতুন জল প্রবাহিত হচ্ছে । ` সময়ের ও বহমান জীবন চিন্তায় এই কথাটি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে ।
এঁদের কথাসহ গোটা ইয়োরোপীয় দর্শনের ইতিহাস ইংরাজ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর HISTORY OF WESTERN PHILOSOPHY গ্রন্থে লিখে গেছেন । আমরা সেখান থেকে বৃহত্তর গ্রীসে এর দর্শনচর্চা সম্পর্ক অনেক তথ্যই জানতে পারি । সেকালে আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনহাজার বছর আগে গ্রীসের আশপাশের রাস্ট্রসমূহে অক্ষর , ভাষা এবং চিন্তার যে স্রোত বয়ে গেছে তা , অচিন্তনীয় । এদেরই একজন বলেছেন , তুমি গাধাকে সোনা দিলে সে খাবে না । গাধা চায় খড় । এভাবে অনেক তত্বই সেকালে জন্মলাভ করেছে । বিকাশিত হয়েছে । পিথাগোরাস ছিলেন গনিতশাস্ত্রের চিন্তক । একই সাথে তিনি কুসংস্কারেও বিশ্বাস করতেন । আজো আমরা জ্যামিতিতে পিথাগোরাস পড়ি । এই পিথাগোরোগীয় ধারা থেকেই সক্রেটিশ তার চিন্তার উন্মেষ ঘটান । আগেই বলেছি , তিনি ধর্মে বিশ্বাস করতেন । নরকের অবস্থান মাটির নিচে । এবং নরকে একটা সরু পথের দুপাশে জল আছে । একদিকে আছে ফুটন্ত জল , আরেক দিকে আছে ভয়ংকর পোকামাকড়ে ভরা । এসব চিন্তা থেকে বোঝা যায় , পিথাগোরীয়দের দ্বারা ধীরে ধীরে তাঁর চিন্তা বিকাল লাভ করে । আমরা অনেক বিষয়েই ধরে নিতে পারি যে চিন্তা ও লেখার জগতে প্রথম দিকে ব্যক্তি পরম্পরা থেকেই জ্ঞান আহরণ করেন এবং পূর্ণ বিকাশে নিজে জ্বলে ওঠেন । সক্রেটিসের তত্বগুলো প্রশ্নউত্তরে নিজেকে এবং এথেন্সবাসী জ্ঞানীদের জর্জরিত করেই চিন্তাকে দর্শনে রূপ দিয়েছেন । যেমন আমিত্ব , অস্তত্ব , অহং সম্পর্কে সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি , `নিজেকে জানো` কথাটা ভাবতে গেলেই প্রশ্ন আসে , আমি আসলে কে ? আমি কি ? আমি ক্যানো ? এসব প্রশ্ন তো সক্রেটিশ করতেনই । তার প্রশ্নের সব চে আকর্ষণীয় দিকটি ছিলো , তিনি একজন প্রচলিত জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে নমিত হয়ে বলতেন , আমায় কিছু জ্ঞানদান করুন । হয়তো তিনি একজন সোফিস্টি ন্যায় বা কলায় তিনি ভালো শিক্ষক ও মর্যাদাবান । সোফিস্ট দের কাছে দর্শন এর চে সরল কিছু ব্যাখা ছিলো যা দিয়ে তিনি একজন রাজপুত্রকে কলা ও ভালো মন্দ সম্পর্কে সুন্দর ধারণা শেখাতে পারতেন । সেই ছাত্রটি রাজা হয়ে ভালো সম্পর্কে জ্ঞাত কিছুই করতেন না । কারণ সোফিস্টগন ভালোকে কলায় নিয়ে যেতেন । এবং এটি যিনি শিখতেন তিনি এর ব্যবহারিক বিদ্যাটি শিখতেন না বা চর্চা করতেন না ।



 `Virtue is knowledge` `সদগুন ও জ্ঞান অভিন্ন ` একথাটিও অমরা জানি । এটি সক্রেটিসেরই কথা । ` সমস্ত সত্যজ্ঞান সাধারণ ধারণা ভেতর দিয়েই আসে । ` ( All knowledge is knowledge through concepts ) এই কথা বলে সক্রটিস জ্ঞানকে যুক্তির শক্ত মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন এবং ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিরপেক্ষভাবে জ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তৈরি করলেন । নীতিশাত্র বুঝতে গেলে এই জ্ঞান তত্বটি জানা অতি দরকার । কারণ তায় নীতিতত্ব তাঁর জ্ঞানতত্বের উপরেই প্রতিষ্ঠিত । VIRTUE এর বাংলা প্রতিশব্দ নির্মান খুব কঠিন । এজন্যে আমরা কয়েকেটি বাংলা শব্দ নিয়ে আলোচনা করতে পারি । যেমন ` সদগুন ` ভালোত্ব ` `উত্তম ` ও ` শ্রেয় ` এইশব্দগুলো ব্যবহার করেই এর ব্যাখ্যা দিতে হবে । সক্রেটিস ভালত্বের জ্ঞান ছাড়া ভালোত্ব অর্জন সম্ভব নয় , একথা বলেছেন । মন্দ যারা করে তাদের ভেতর ভালোত্বের জ্ঞান নেই বলেই তারা মন্দ করে । একথাটিও বলেছেন সক্রেটিস । ভালোত্বকে একটি জ্ঞান বলেছেন সক্রেটিস । যেহেতু সেটি জ্ঞান সেহেতু সেটি নিত্যু । মন্দ থাকলেও ভালোত্বের পরিবর্তন ঘটবে না । অন্য দিকে মন্দত্ব যদি একটি জ্ঞান হতে পারে না , কারণ এর ভেতর নৈতিকতা নেই । সক্রেটিস চিরকাল নৈতিকতা ও যুক্তির উপর তাঁর তত্বসমূহ দাঁড় করিয়েছেন । তার শিয্য প্লেটোর তত্বগুলো এ কারণেই সুন্দরের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং Plato এর PLETONIC LOVE এর নৈতিক সৌন্দর্যবোধ এই ভালোত্ব গুনতত্ব এর উপরেই প্রতিষ্ঠিত । সক্রেটিসের কালে সকল দার্শনিক দেবদেবী ধর্মাচার এসব সহ দৈববানীতে বিশ্বাস রাখতেন । এবং সক্রেটিস যখন বলেছিলেন তিনি দৈববানী শুনতে পান , তখন শাসক শ্রেণী বুঝতে পারেন , সক্রেটিস তাদের জন্য ঝুঁকির কারণ । তারা জানতে পারেন যে কিছু অভিজাত যুবক সক্রেটিসের অনুগামী এবং তিনি তাদের দীক্ষাগুরু তথন তাদের গনতন্ত্র সক্রেটিসের ইশারায় বিপদে পড়তে পারে । ফলে সক্রেটিসকে বিচারের অধীনে আনার জন্যে তারা ফন্দি আঁটেন । অভিযোগ এনেছিলেন তিনজন । এঁরা কেউ খ্যাতির অধিকারী ছিলেন না । এ্যনিটস , মেলিটস এবং লাইকন ছিলেন মামলার বাদী । মূল অভিযোগ ছিলো যে , সক্রেটিস একটি নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করতে চান । জেরার মুখে মেলিটস টিকতে না পেরে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ আনেন । ফলে মূল অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ার পর বিচারকগন এথেনীয় আইন অনুসারে বাদীদের জিজ্ঞেস করলেন , তাঁরা সক্রেটিসের কি শাস্তি চান । তাঁরা সক্রেটিসের মৃত্যদন্ড চাইলেন । সক্রেটিস জানতেন অভিযোগ প্রমানিত হয় নি । তাই তিনি যে কোন দন্ডের বিরোধিতা করবেন । তিনি জানতেন যে , তাঁর দন্ড শাসকদের ইচ্ছেতে হবে । তাই তিনি যে কোন দন্ডের বিরুদ্ধে আপস করতে চাইলেন না । তিনি বিচারালয়ে যে জবানবন্দী দিয়েছিলেন তা অমর হয়ে আছে । এথেনীয় আইনে বাদীর পর বিবাদী সক্রেটিসের দন্ড চাওয়ার বিধান ছিলো । তাতে তিনি মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে মাত্র এক মিনা জরিমানা দিতে রাজী হলেন । এটাকে প্লেটো তিরিশ মিনায় তুলে মুক্তির কথা বললে বিচারকগন ভাববেন , এটি শ্লেষাক্মক । তাই যেখানে সামান্য সংখ্যা গরিষ্ঠতায় দোষী হয়েছিলেন , যেখানে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতায় মৃত্যুদন্দে দন্ডিত হলেন । হেমলক বিষপানে তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হয়েছিলো ।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন